এবং সময়ের বুকে নিমজ্জমান তুমি আমি আমরা



               হাসপাতালের বেডে শুয়ে যে সন্তান মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে আর হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে যে পিতা ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তার কি মনে পড়ে কি ধর্ম তার অথবা তার জাতের নামটাই বা কি ? না, মনে পড়ে না। তখন সে শুধু একজন মানুষ। একজন মানুষ আর একজন মানুষের মঙ্গল কামনায় ব্যস্ত। তাহলে কখন মানুষের ধর্ম মনে পড়ে, কখন মনে পড়ে তার জাতের কথা ? যখন সে মন্দির বা মসজিদের সামনে দিয়ে যায় অথবা যখন সে ধর্মভিত্তিক কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে যোগদান করে। আমার এক এক সময় ভাবতে খুব অবাক লাগে জন্মানোর পরমুহূর্তেই আমাদের প্রত্যেকের এক একটা মন্দির মসজিদ গির্জা হয়ে যায়। স্বাধীনভাবে তাকে ভাবতে সুযোগ দেওয়া হয় না। উল্টোটা যদি হতো অর্থাৎ আমার প্রিয়জনেরা আমার গায়ে কোনো ধর্মের লেবেল যদি লাগিয়ে না দিত। বড় হয়ে আমার পছন্দ মতো কোনো একটা কিছু বেছে নিতে পারতাম। কোনো সন্দেহ নেই যে পৃথিবীটা তাহলে অন্যভাবে তৈরি হতো।

                 ***************************


               মাঝে মাঝেই আমার হাতের মধ্যে আস্ত একটা বটগাছ উঠে আসে। অনেক বড় বটগাছ। যার মাথাটা অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। আকাশ ফুঁড়েও যেন অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। যত দূরেই যাক, সেখানেও এই মাটির পৃথিবীর মতো জল হাওয়া। সুতির জামা আর হাওয়াই চপ্পল পরে দাঁড়িয়ে অনায়াসেই তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তার নাক মোটেই তার শরীর ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির মতো ঊর্দ্ধগামী নয়। বরং সে তার নিজস্ব উঠোনে বিচরণ করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

               আঙুলগুলো হয়ে যায় এক একটা নদী। তারা যেন অনেক দূর থেকে বেশ গতি নিয়েই ছুটে আসে। তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক বিনীত ভাব। এমন নয় যে তারা কখনও কোনোদিন রাগে নি। তাদের কাছ থেকেই প্রথম শিখেছি রাগ মানেই ধ্বংসাত্মক কোনো পরিকল্পনা হাতে নেওয়া নয়। বরং আগামী প্রজন্মকে এমন এক শিক্ষা দেওয়া যেখানে ধ্বংসাত্মক হওয়া মানে যেন নিজেকেই ভয়ঙ্করভাবে নগ্ন করে ফেলা। নিজেকে আদ্যন্ত এমনভাবে চিনিয়ে দেওয়া যে, যে কেউ আমাকে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে পারবে।

               আমি বটগাছ, নদীদের জিজ্ঞাসা করি ---- তাদের কোনো মন্দির আছে কিনা। তারা আমার কথায় হাসে। আমি তাদের এই হাসিতে মোটেই অপমানিত হই না। আসলে আমরা তো এইভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। আমাদের থেকে যারা ভিন্ন ------ এই স্বতন্ত্রতা তার যে বিভাগেই থাকুক না কেন তাকে আমরা একটা আলাদা জায়গায় সরিয়ে দিতেই বেশি পছন্দ করি।

               গাছ, নদী থেকে আমরা এখনও কত কত দূরে। আমরা তো তাদের সঙ্গে ভালো করে পরিচয়পর্বটাই সেরে উঠতে পারলাম না। হ্যাঁ, এখনও পারি নি। গাছ তো আমার পরিবারের কেউ না। গাছের দুঃখে আমরা কবে দুঃখিত হয়েছি। সারা শরীর জুড়ে গাছের যে আলো ধরে থাকা তা কবে আমাদের নজরে এসেছে ? আমৃত্যু দুহাত বাড়িয়ে গাছের এই যে দাঁড়িয়ে থাকা তা আমরা কবে স্বীকার করেছি। কাছে পাই বলাইকে ------ " রাত্রে বৃষ্টির পরে প্রথম সকালে সামনের পাহাড়ের শিখর দিয়ে কাঁচা সোনা রঙের রোদ্দুর দেবদারুবনের ওপরে এসে পড়ে ------ ও কাউকে না বলে আস্তে আস্তে গিয়ে সেই দেবদারুবনের নিস্তব্ধ ছায়াতলে একলা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, গা ছমছম করে ------ এই-সব প্রকাণ্ড গাছের ভিতরকার মানুষকে ও যেন দেখতে পায়। তারা কথা কয় না, কিন্তু সমস্তই যেন জানে। " বলাইয়ের চোখে এসব তো গাছ নয়। এক একটা প্রমাণ সাইজের মানুষ।

               নদী সেই কোন সকালে পথে বেরিয়েছে। আমারই পাশ দিয়ে চলে গেছে সে। আমি কোনোদিনও মুখ ঘুরিয়ে দেখেছি ? হয়ত দেখেছি কিন্তু কখনও একদিনের জন্যেও কি মনে হয়েছে সে আমার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে? গভীর দুঃখের দিনে সত্যিই কি তাকে কোনোদিন স্বজনের মতো পাশে পেতে চেয়েছি? আনন্দের দিনে কবেই বা তাকে ভাগ দিয়েছি। এদের পাশে এসে দাঁড়ালে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। আমাদের এত শিক্ষাগত যোগ্যতা ---- এসবের কি মানে! এত ডিগ্রি ডিপ্লোমা লাভ করে কি হলো ? আপন করতেই শিখলাম না। মনের যে গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে ভালোবাসার আলো থাকে, যার ওপর নির্ভর করে মানুষের মধ্যে আনন্দ জাগ্রত হয় সেই আলো আমাদের কোথায় !

               আলো আসবে কোথা থেকে ? আলো জ্বাললে তবেই না আলো। আমরা কি আলো জ্বালিয়েছি ? কি করে জ্বালাব ? ঘরের দরজা দুয়ার পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। আমাদের কে বাইরে আনে ? গাছপালা, নদী, মাটি ------ এ সমস্ত কিছুই আমাদের ভেতরকে আলো করে দেয়। শেষ কবে আমরা আকাশ দেখেছি ? শেষ কবে আমরা নদীর পাশে বসে তাকে আমাদের দুঃখের কথা শুনিয়েছি?

               আমরা তো ঘরের বাইরে বের হতেই পারলাম না। জানলা দিয়েই সবকিছু দেখে গেলাম। নিজেকেই তো ভুলতে পারলাম না। চলতে - ফিরতে, উঠতে - বসতে শুধু নিজের কথাই বলে গেলাম। চারদেওয়ালের মধ্যেই নিজেকে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। অথচ বাইরে যদি একবার বেরিয়ে আসতাম তাহলে বুঝতে পারতাম জল হাওয়া মাটি কিভাবে আপন সংসারে এসে মিশে গেছে। তখন হারিয়ে যেতো আমাদের আপন ঘর সংসার।

               ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবার পরিজন কোনোদিনও গাছ নদী মাটিকে আপন করে নিতে শেখায় নি। আমরাও তাদের সঙ্গে তাই কোনোরূপ আত্মীয়তা গড়ে তুলতে পারি নি। আসলে গাছ নদী জল হাওয়া মাটি -------- এদেরকে দেখতে গেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়। এই বেরিয়ে আসা "আমার" থেকে বেরিয়ে আসা। "আমার" তখন ছোট হতে হতে এত ছোট হয়ে যায় যে, তা আর চোখে ধরা পড়ে না। তার জায়গায় স্থান করে নেয়, জল হাওয়া মাটির পৃথিবী। ওটা তখন আমাদের ঘর। ঘরের বাইরে ঘর। এখানে দাঁড়িয়ে ঘর বাইরে দুটোকেই আমরা ভালো রাখতে পারি।।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন