আমিনুলের সঙ্গে আমার পরিচয় খুবই অল্পদিনের। পরিচয় সেই অর্থে তখনো ঘনিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু একদিন ম‍্যাসেঞ্জারে ও আমার কাছে বেশকিছু কবিতা পাঠিয়েছিলো। মাঝখানে একদিন অল্প কিছুক্ষণের জন্য দেখাও হয়েছে। এরপর ১লা জুন ও আমার কাছ থেকে 'ভুবনডাঙা' বানানটা যাচ‌াই করে নেয়। ২০ জুন ও আমাকে আরেকটি লেখা পাঠায়। যাতে জানতে পারি 'ভুবনডাঙা' নামে পহেলা জুলাই থেকে একটি অনলাইন পত্রিকা বেরোচ্ছে।
এ পর্যন্ত সব‌ই ঠিক ছিলো। কিন্তু তারপর একদিন হঠাৎ ও আমাকে জানায় যে, ওরা ওদের পত্রিকার প্রথম সংখ‍্যার আমন্ত্রিত মুখ‍্য-সম্পাদক আমাকেই নির্বাচন করেছে। ব‍্যাপারটি আমার কাছে অভূতপূর্ব। সম্ভবত 'বুড়োর খাতা'য় আমার নাম উঠে গেছে। এটা গেল একটা দিক। আরেকটি দিক হলো, এই কাজে আমার উপযুক্ততা কতোটুকু? সম্পাদনা কাজটি রীতিমতো একটি আর্ট। সবাই সম্পাদক হ‌ওয়ার যোগ্য নন। এই কাজে যে পারিপাঠ‍্য এবং গৃহিণীপনা প্রয়োজন হয়, তা আমার একান্তভাবেই নেই। কথাটা বিনয় দেখানোর জন্য বলছি না। যাঁরা আমাকে চেনেন বা আমাকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা খুব ভালোভাবেই এটি জানেন। যে অগোছালোপ্রবৃত্তি আমার রয়েছে, তার জন‍্য আমার উপর পরিচিতরা খুবই বিরক্ত হন। 'উত্তর ইতিহাস' নামে আমাদের যে পত্রিকাটি আছে এই অগোছালো প্রবণতার জন্য সেটাও ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারি না। এরপর অন‍্যান‍্য দায়দায়িত্বের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তাই আমিনুল যখন আমাকে এরকম অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিলো, সত‍্যি সত্যি আমি আঁতকে উঠেছিলাম। কিন্তু 'স্নেহ' বিষম বস্তু। তাই উপরোধের বা ভালবাসার ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হলাম। 
আমরা জানি শিল্প সাহিত্যের জগতে কোনো তত্ত্বই চিরন্তন নয়। শুধুমাত্র শিল্প সাহিত্যের জগতে বলি কেন পৃথিবীতে কোনো দর্শন, কোনো পদ্ধতি, কোনো ধর্ম অনন্তকাল ধরে একইরকম থাকতে পারে না। আর পরিবর্তন‌ই যখন জগতের নিয়তি, তখন শিল্প-সাহিত‍্য‌ও তার বাইরে নয়। জগতের প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, শিল্প-সাহিত্যের ধারায় বা পদ্ধতিতে পরিবর্তন হচ্ছে। আর আমরা, কবি-সাহিত‍্যিক-শিল্পীরা এই পরিবর্তিত সময়ের 'মর্জি'কে বা প্রবণতাকে বা সম্ভাব‍্যতাকে শুধুমাত্র অনুসন্ধান‌ই করতে পারি। আর নোতুনকে অনুসন্ধানের ফলে, শিল্প-সাহিত‍্য‌ও অর্জন করে নোতুন নোতুন মনোভঙ্গি। এভাব বৈজ্ঞানিক ও মনোবৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমাদের প্রবহমান ভাবনারাশির মধ্যে, হঠাৎ হঠাৎ আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। বদলে দিতে পারে সময় ও সভ‍্যতার হৃদস্পন্দন, অভিমুখ। শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের মধ‍্যে এই নোতুন উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে নোতুন কোনো প্রকৌশল। নোতুন সময়ের স্পন্দনই তাদের দিয়ে লিখিয়ে নেয় বা আঁকিয়ে নেয় নোতুন কোনো শিল্পকে। আমি যেমন নোতুন সময়ের এই শিল্পধারাকে 'উত্তর ইতিহাস' বলে ডাকি।
একটা ছোট্টো উদাহরণ দেই। আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে দরিদ্র মানুষেরা মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না করত, মাটির থালায় খেত বা মাটির গ্লাসে জনপান করত। কিন্তু এটিকে আমরা জানতাম গরীবের লক্ষণ হিসেবে। অর্থাৎ এগুলো যারা ব‍্যবহার করে, তারা সমাজের নীচুতলার মানুষ। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে যে, মাটির পাত্র ব‍্যবহার করা মানবজীবনের পক্ষে খুবই উপকারী এবং জরুরি। অনেক রোগভোগ এই প্রাকৃতিকভাবে তৈরি দ্রব‍্যগুলি প্রতিরোধ বা নিরাময় করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে, প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে আমাদের প্রাচীন মৃৎশিল্প। ফলে এগুলো আর সহজলভ্য নয়। এগুলো আজ বড়লোকরাই কিনতে পারেন। অর্থাৎ এই সমস্ত পাত্র যারা ব‍্যবহার করেন, বর্তমানে তারা বড়লোক। এবার যদি আমরা ৫০-৬০ বছর পিছিয়ে যাই তাহলে বলতেই পারি ওই সময় মাটির পাত্র ব‍্যবহারকারীরা বড়লোক‌ই ছিল। এই যে সত‍্যিকারের বিষয়টিকে ভুলিয়ে দিয়ে মানুষের মনে তখন হীনম্মন্যতা জাগিয়ে তোলা হয়েছিল, এটিকে যদি আমরা ইতিহাস বলি তাহলে লুকানো বাস্তব সত‍্যটা উত্তর ইতিহাস বা প্রেক্ষাপট ইতিহাস। এক‌ইভাবে বলা যায় যে ছেঁড়া প‍্যান্ট একটা সময় দারিদ্রের চিহ্ন ছিল।কিন্তু বর্তমানে এটাই 'স্ট্যাটাস সিম্বল'।

আসলে নোতুন সময়, নোতুন পদ্ধতি বা নোতুন কারিগরি, আমাদের পুরানো পৃথিবীকে নোতুন দৃষ্টিতে দেখার অধিকার দেয়। এই জন্য যখন কেউ নোতুন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতে চায়, তাকে বা তাদের আমি সাধুবাদ জানাই। শুধু একটা কথাই তাদের বলি, পত্রিকা প্রকাশ যেন বাল‍খিল‍্য ব‍্যাপার না হয়ে ওঠে, তার মধ্যে যথেষ্ট প্রযত্ন এবং ভালোবাসা থাকে। দায়সারা ভাবে কোনো কাজ করে পৃথিবীতে তথ্যের জঞ্জাল বাড়ানোর পক্ষপাতী আমি ন‌ই। সাত‍্যিকার অর্থে এই তথ্যের জঞ্জালের ভিড়ে, প্রকৃত প্রয়োজনীয় তথ‍্যগুলি চাপা পড়ে যায়। এই ফাঁকে পত্র-পত্রিকা প্রকাশের ইতিহাসটাও আমাদের ভালোভাবে জেনে নেওয়া দরকার। এটা যেমন কাগজে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি অনলাইন পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রেও সত্যি।
এটা ঠিকই যে অনলাইন পত্র পত্রিকার ব্যাপারে বাঙালি এখনও বালক দশাতে‌ই আছে। নাবালক বলতে পারলেই ভালো হতো। তা হলেও একটু একটু করে যে সচেতন হচ্ছে না, তা নয়। যারা অনলাইন পত্র-পত্রিকা করছেন এ ব‍্যাপারে তাদের আর‌ও সচেতনতার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
লিটিল ম‍্যাগাজিন আন্দোলন বাংলা সাহিত্যকে কর্পোরেট প্রকাশনার জাঁকজমক থেকে রক্ষা করে চলেছে। সে ব‍্যবসায়িক পত্র-পত্রিকার চক্রান্ত থেকে রক্ষা করেছে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি লেখকদের। আমার মনে হয় অনলাইন পত্রিকা প্রকাশনা, লিটিল ম‍্যাগাজিন আন্দোলনের একটি সম্প্রসারিত রূপ। তাই এই জাতীয় পত্র-পত্রিকা যাঁরা করছেন বা করতে চাইছেন, লিটিল ম‍্যাগাজিন আন্দোলনের শক্তি ও দুর্বলতাগুলো তাদের জেনে নিতে হবে। গোষ্ঠীবাজি, একদেশদর্শিতা, দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনভাব—এই তকমাগুলি পত্রিকা প্রকাশে ক্ষেত্রে তুলে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। যা প্রবণতা দেখছি, তাতে মনে হয় অনলাইন পত্র-পত্রিকার সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ রয়েছে। কিন্তু তাকে ব্যবহার করতে হবে অনেক সচেতনতার সাথে। লেখা প্রকাশের একটি সহজলভ্য মাধ্যম হওয়ার জন্য এর মধ্যে বেনোজল ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ফলে সম্পাদক বা পরিচালকদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। আশা করছি 'ভূবনডাঙা' ওয়েব ম‍্যাগাজিনটি এইসব দিক খেয়াল রেখেই এগুবে। আমি সম্পাদক মণ্ডলীর সদস‍্যদের তথা আমিনুল ইসলাম,
শান্তনু রায়চৌধুরি,অনুপ চ্যাটার্জিকে অনুরোধ করব ব্যাপারটির দিকে মনোযোগ দিতে। আমি এই পত্রিকার ধারাবাহিক সাফল্য কামনা করছি। এর প্রতিটি সংখ্যাই উৎকর্ষে, সাহিত্যিক মননে, সমৃদ্ধ হোক এবং প্রতি মুহূর্তে নিজেদের উৎরে যাক এই আশা রাখছি। পাঠকপ্রিয়তা যেন এই পত্রিকার মুকুট হয়ে ওঠে।
বিভাবসু
২২.০৯.১৯

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন