ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ও তাঁর অনুবাদের তত্ত্ব-বিশ্ব

রুদ্র কিংশুক




   জার্মান তাত্ত্বিক ও অনুবাদক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন অনুবাদ করেছেন বোদল্যার-এর কবিতা ফরাসি থেকে জার্মান ভাষায়। সেই সঙ্গে তিনি অনুবাদের নানান দিক নিয়ে ভেবেছেন। সেই ভাবনাগুলো অনুবাদ- কর্মের উদ্দেশ্য, উপায় এবং তার সাংস্কৃতিক অভিঘাতের বহুস্তরীয় দিক উন্মোচিত করে। অনুবাদ যে কেবলমাত্র এক ভাষার তথ্যসম্ভার অন্য ভাষায় চালান করা নয়, তার বহুদিগন্তীয় হয়ে-ওঠা সৃজনশীলতা —এই উপলব্ধির দিকে বেঞ্জামিন আমাদের চালনা করেন।

বেঞ্জামিন মনে করেন শিল্প-সাহিত্য উপভোক্তা নিরপেক্ষ। কবিতা, উপন্যাস, সংগীত, ছবি যখন লেখক - শিল্পী- সংগীতকার সৃষ্টি করেন তখন কোন পাঠক- দর্শক - শ্রোতার কথা মাথায় থাকে না। সৃষ্টির পর উপভোক্তার আবির্ভাব। শ্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝখানে উপভোক্তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সৃষ্টির এরূপ এক উপভোক্তা-নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তার কথা ভেবেছেন বেঞ্জামিন। অনুবাদও কোন পাঠকের কথা ভেবে সংগঠিত হয় না। এমনকি যে মৌলিক রচনা থেকে একটি অনুবাদ-কর্মের জন্ম, অনুবাদ সম্পন্ন হওয়ার পর সেই মূলের সঙ্গেও তার কোনো অবশ্যম্ভাবী নির্ভরতা নেই। মূলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত পা মিলিয়ে ফেলা ও তার মুখ-ভঙ্গিমা নকলের বিরক্তিকর দায় বা বাধ্যবাধকতা নেই একটি সার্থক অনুবাদের।

যেকোনো ধরনের শিল্পকর্ম আমাদের কেবল কিছু তথ্য জোগান দেয় না। একটা কবিতা কী বলছে বা তার বিষয়বস্তু কবিতার সব নয়। তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য-সৌরভই সংবেদনশীল উপভোক্তার মনোজ্ঞ উপভোগের বিষয়। তাই কোনো মৌলিক রচনার বিষয়কে ভাষান্তরিত করার মধ্যেই অনুবাদের দায় ও দাবি শেষ হয় না। বিষয়-সীমাবদ্ধতা খারাপ অনুবাদের লক্ষণ। তাছাড়া সব রচনা অনুবাদের যোগ্য নয়। বেঞ্জামিন 'ট্রানস্লেবিলিটি' শব্দটি ব্যবহার করে বলতে চান যে, বহুস্তরীয় সম্ভাবনাময় টেক্সটের থাকে অনুদিত হয়ে ওঠার গুণ। টেক্সটের সেই সম্ভাবনাগুলিকে তার উৎস-ভাষার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে একটি নতুন ভাষায় নবজন্ম দান। অনুবাদক এই কাজটি করেন। তাই তাঁর কাজটি কেবল অনুকরণ নয়, এক ধরনের অনুসৃজন বা ট্রান্সক্রিয়েশন। বেঞ্জামিন ইঙ্গিত করেছেন যে, অনুবাদের মধ্য দিয়ে টার্গেট ল্যাংগুয়েজের গ্রোথ বা সম্প্রসারণের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। একটি অন্য ভাষার সম্ভাবনাময় টেক্সটের বহু কিছু টার্গেট ল্যাংগুয়েজের অ্যাপারেটাস দিয়ে ধরা সম্ভব নয়, সে চেষ্টার প্রয়োজন নেই। বরং এই সময় টার্গেট ল্যাংগুয়েজের কিছুটা সম্প্রসারণ ঘটানো দরকার। শব্দভাণ্ডার ও ভাষার আঙ্গিকে নবীনায়ন ঘটিয়ে নতুন টেক্সটকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে টার্গেট ল্যাংগুয়েজের গ্রোথ হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে অনুবাদকর্মের অভিঘাত বহুকৌণিক হয়ে ওঠে।

একটি টেক্সটের ভিতর লেখক বা সৃষ্টিকর্তার  সত্ত্বার বহুবিধ সম্ভাবনা থাকে। একেকজন পাঠক  লেখকের একেকটি সত্ত্বাকে আবিষ্কার করেন অথবা একসঙ্গে তাঁর সত্ত্বার কয়েকটি দিক আবিষ্কার করেন। তবু তাঁর সত্ত্বার অনেক দিক অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। সত্ত্বার যে দিকটি মূল রচনার পাঠকদের কারো কাছে আবিষ্কৃত হলো না সেটাই হয়তো উদ্ঘাটিত হবে টেক্সটের অনুবাদের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ অনুবাদ কর্মটি লেখকের আরেকটি নতুন সত্ত্বা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা।  বেঞ্জামিন লেখকের এই সম্ভাবনাময় নতুন জীবনকেই বলেছেন আফটার লাইফ। অর্থা‌ৎ অনুবাদের মধ্য দিয়ে লেখক নতুন জীবনে বেঁচে উঠছেন। এই নতুন জীবন মৌলিক রচনা নিরপেক্ষ, স্বাধীন।

বেঞ্জামিনের অনুবাদ-তত্ত্ব ট্রান্সলেশন স্টাডিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট। বেঞ্জামিনের এই টেক্সট অনুবাদ-কর্মের পাঠকদের কাছে উপভোগের নতুন দরজা-জানলা খুলে দেয়, সেই সঙ্গে অনুবাদকদের কাছেও বহুবিধ দিশা নির্দেশ করে।




ওয়াল্টার বেঞ্জামিন  


  ( জার্মান: Walter Benjamin, ˈvaltɐ ˈbɛnjamin); ১৫ জুলাই ১৮৯২ – ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ ) ছিলেন একজন জার্মান ইহুদি দার্শনিক, সাংস্কৃতিক সমালোচক ও প্রাবন্ধিক। জার্মান ভাবাদর্শ, রোমান্টিকতাবাদ, পশ্চিমা মার্ক্সবাদ ও ইহুদি অতীন্দ্রিয়বাদের উপাদানসমূহের সমন্বয়ক এক সারগ্রাহী চিন্তক বেঞ্জামিন নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য সমালোচনা এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদে স্থায়ী ও প্রভাবশালী অবদান রেখে গিয়েছেন। তিনি ফ্র্যাঙ্কফুর্ট স্কুলের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেশ্‌ট ও কাব্বালা পণ্ডিত গেরশম স্কোলেমের মতো চিন্তকদের সঙ্গে গঠনমূলক বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন। তিনি জার্মান রাজনীতিতাত্ত্বিক ও দার্শনিক হান্না আরেন্টের আত্মীয় ছিলেন যিনি বেঞ্জামিনের কাকাতো ভাই গুন্টার অ্যান্ডার্সের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন