বিচিত্র এই কবিতাযাপনে কখনও কখনও কোনো কবিতা কুসুমকোরক বিছানো পথের থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রথাগত পাঠক-উল্লাস এমনিতে তাকে ছোঁয় না। শুধু আচমকা কোনো পাঠকের একলা দুপুরবেলা আলগোছে ছোটপত্রিকায় প্রকাশিত সেইসব কবিতায় হাত রাখলে... সেই বুঝি পাঠকের নবজন্ম, কবিতারও। গোপনে, এক গূঢ় সাধনায় কোনো কবি কাটিয়ে দেন তাঁর লিখনের যাপনবেলা। আবার এ পৃথিবীর আলো কারো কারো মুখে অকৃপণ ভাবে পড়ে। তিনি পাঠকের ভালোবাসা পান। আর কে না জানে, কবিমাত্রেই ভালোবাসার কাঙাল। তবু, তার মধ্যে কেউ কেউ সেই মোহিনী আলোর মায়ায় মত্ত হন। আলোর বৃত্তে থাকতে থাকতে ক্রমশ সেই কবি বুঝতেই পারেন না, কখন যে কবিতা থেকে তিনি অনেক অনেক দূরে সরে গেছেন।
প্রথাগত কবিতার আর পাঠকের ভিড়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ‘কুড়ি কুড়ি বছরের পার’ স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন জর্জ অপেন। অপেন ও তাঁর কবিতার আজ নবজন্ম হয়েছে। এভাবেও ফিরে আসা যায় ! এই অপেনই এক কবিতায় লিখেছেন – The question is : how does one hold an apple/ who like apples/ And how does one handle/ Filth? The question is/ How does one hold something/ In the mind which he intends/ To grasp and how does the salesman/ Hold a bauble he intends/ To sell? The question is/ When will there not be a hundred/ Poets who mistake that gesture/ For a style ।
তর্কটা চিরকালীন। জনমোহিনী কবিতা আর প্রচলের বিরোধী কবিতা। শিল্পের জন্য শিল্প আর মানুষের জন্য শিল্প। খাজুরাহোর মন্দিরগাত্রে প্রকীর্ণ কারুকাজ নাকি নদীর ওপর বেঁধ দেওয়া সেতু, যা দিয়ে বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষকে জুড়ে দেওয়া যায়। প্রশ্নের উত্তর কি সহজ এতই? কোনটা যে gesture আর কাকে বলে style – কোন ছাঁচে কবিতাকে আটকাব, সেই ভেবে দৌড়চ্ছি। এদিকে আমরা তো people hearing without listening... তাই, অজস্র শব্দমালার ভিড়ে যখন নীরব কোনো এক কবিতা অন্ধকারে আলো দেয় – তখন তাকে আর চিনতে পারি না। তার কারণ, সে কবিতা তো শুধু রূপের নয়, তার শেকড়ের মধ্যে অরূপও খেলা করে। বাংলাকবিতার দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিয়ে এরকম কোনো কোনো কবিতার খোঁজ মেলে, যেখানে সেই অরূপের আলো। তবু সেই সন্ধানের পরও কবি বা পাঠক কি তৃপ্ত হন? কোনো কবিতাকে কি সত্যিই চেনা যায় পুরোপুরি? ‘এসেছিলে তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে... সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে... এসেছিলে...’
এই যে এক নির্মোহ নিয়ে কবি লেখেন, এই সন্ন্যাস আসলে সন্ন্যাস অনুভূতির সন্ন্যাস। সমস্ত কিছু ত্যাগ করে যে শূণ্যতার নির্মাণ, সেখানেই সবচাইতে বেশি পূর্ণতা পুনর্নির্মিত হয়। কবি সেইভাবেই তাঁর কবিতায় জীবন, সত্ত্বা ও অনুভূতির এক সম্পূর্ণ ভোগরাগ উপলব্ধি করেন। এই অনুভূতির প্রগাঢ়তাই তাঁর কবিতার জিরেন রস। এই অনুভুতির নির্জনতাই তাঁর কবিতার তানকারি। এই অনুভূতির স্থৈর্যই তাঁর কবিতার গভীরতা। এই সন্ন্যাসে অনুভূতির ওপর আর কোনো মালিকানা থাকে না। এ কিন্তু দুঃখবিলাস নয়। এখানে হাসি ও দুঃখের মধ্যবর্তী সীমারেখা ভেঙে যায়। সেখানে ভালোবাসার ঘায়ে কান্নারা জেগে ওঠে, সেখানে নিবিড় বেদনাতেও পুলক লাগে গায়ে, চোখে ঘনায় ঘোর। বয়সের প্রজ্ঞায়, অনুভূতির প্রজ্ঞায় অভিজ্ঞতায় এ কবির নিজস্ব অর্জন।
এই যে কবি প্রকারান্তরে লেখেন নিজ-মর্ত্যসীমা চূর্ণ করার কথা, পিশাচবৎ, উন্মাদবৎ, জড়বৎ দিনাতিপাত করবার কথা – এইখানেই লেখা হয়ে যায় কবিতার সাধনমার্গের কথা। সেই সাধনায় কবির চোখ বন্ধ, কান অচল, সমস্ত জাগতিক সুতোর গ্রন্থি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন – এখন অনুভূতিই একমাত্র সত্য। আর সত্য সেই অনুভবের শব্দপ্রকাশ। এই বালুকণার জীবন, আপাত তুচ্ছসাধন – এটাই তো সত্যিকারের শিল্পীর, সত্যিকারের কবির ‘অভিপ্রায়’। অর্থ নয় যশ নয় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় খেলা করে কবির মনের মধ্যে। তাই সতিকারের কবিই পারেন ‘প্রভাতে দাও অর্থ চিন্তা, মধ্যাহ্নে দাও যশ চিন্তা, দিনান্তে দাও অলস চিন্তা’ বলে কাঁদতে পারেন। তাঁকে মানায় সেই কান্না। সভাসমিতির আলো, পুরস্কার-মঞ্চের আলো তাঁকে মানায় না। তাঁর মুখে প্রহর শেষের চৈত্র মাসের আলোটুকুই সবচাইতে ভালো সাজে। তাই সত্যিকারের একটা ভালো কবিতা পাঠকের দিনরাতের সর্বনাশ করে ছাড়ে। সেই কবিতায় তীব্র বেদনাতেও থাকে এক অন্তরীণ সুন্দর। প্রগাঢ় বেদনার মধ্যেও যিনি বিপ্রতীপ প্রেক্ষিতে সৌন্দর্যের জন্ম দেন, তিনিই সত্যিকারের শিল্পী। স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিণ্ডলার্স লিস্ট’ ছবিটিতে সাদাকালো ছায়াদৃশ্যে যখন নরমেধের চলমান চিত্রমালা আমাদের বারবার ধাক্কা দেয়, অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে যখন নাকে লাগে মাংসপোড়ার কটুগন্ধ, আর সেই মৃতের পাহাড়ের পাশ দিয়ে আচমকা হেঁটে যায় লালফ্রক পরা এক শিশুকন্যা – তখন সেই ভয়ংকর সাদাকালোর বিপ্রতীপে শিশুটির রঙিন কি শিল্পের প্রতি এক আস্থার জন্ম দেয় না? আমরা কি আক্রান্ত হই না এক ভালোবাসার অসুখে? ঋত্বিক বা ভ্যান গঘের সৃষ্টিতে যখন আসন্ন মৃত্যুগুলি রচিত হয় – তখন তারাও কি এক পরমাশ্চর্য মমতায় মাখা নয়? কবির মৃত্যুস্বপ্ন সেরকমই এক প্রমিত সৌন্দর্য।
ঠিক যেভাবে হাওয়া-বাতাস-জলের খেলায় পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রকৃতির কোলে আশ্চর্য সব শরীর নেয়, তেমন করে তৈরি হয় কবিতা। এ সত্যিই এক রহস্য। তার তল পাওয়া ভার। কখন যে সে আসে, কী ভাবে আসে, তাকে কখন যে দেখা যায়, কে জানে?
যে কবিতা মিতবাক্ - সে কবিতা রহস্যময়। সেটুকুই তার স্বতন্ত্র সুন্দর। তা বলে যে কবিতা পাঠকপ্রিয়, সে সুন্দর নয়, তা-ই বা বলি কী করে? প্রতিমুহূর্তে যেন বা সে কবিতার দরজায় দাঁড়িয়ে শব্দভিক্ষা করে। আর এই এক এক মুঠি ভিক্ষান্নে তৈরি হয় সুজাতার পরমান্ন। আর কে না জানে, সেই পরমান্ন তার অপার রূপ পায় ভিক্ষু বুদ্ধদেবের করতলস্পর্শে। অর্থাৎ, কোথাও না কোথাও গোপন বা প্রকাশ্য, যে ভঙ্গিমাতেই কবিতা লেখা হোক না কেন, সে চায় সংযোগ স্থাপিত হোক। পাঠকের সঙ্গে সংযোগ। না-ই বা হলো সে মঞ্চের আলোকময় প্রত্যুত্তর, কোনো এক একলা রাত্রে পাঠক যখন একা একাই একলা হয়ে যান, তখনও তো সেই সংযোগ জন্ম নেয়। যে কবিতা এই ছুঁয়ে দেওয়াটুকু পারে না, সে হয়ত লিখন, সে হয়ত শব্দসম্ভার। কিন্তু সে কি সত্যিই কবিতা হয়ে ওঠে? যে কবিতা ভাবায় না, যে কবিতা ভেতরে ভেতরে ঢেউ তোলে না, তাকে দূর থেকে দেখার, তাকে যত্নে সাজিয়ে রাখা যায়। তার সৌন্দর্যে নিজে সেজে ওঠা যায় কি?
জীবনক্লান্তির শেষ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজাধিরাজও মাটির সামনে নতজানু। একমুঠো জিরিয়ে নেওয়াটুকু ভিক্ষা করেন বৃক্ষের ছায়ায়। কবিতাও নীরবে সেই ভিক্ষাপাত্র রাখে কোনো এক অজানা পাঠকের জন্য। সেই কোনো এক পাঠক কোনো এক দিন এই শব্দমালা চিনে নেবেন কি না, সে এক রহস্য। এই সফলতা... নিষ্ফলতায় কেন যে মনে পড়ে অরসন ওয়েল্সের ‘সিটিজেন কেইন’-এ মৃত্যুপথযাত্রী এক ‘সফল’ মানুষের শেষ উচ্চারণ – মাতৃগর্ভের কাছে ফিরে যাওয়া যেন – ‘রোজ্বাড’ ...
এই-ই তো কবিতার মাপা সৌন্দর্য। যা খোলা চোখে রূপ বলে মনে হলেও, আসলে নয়... সে-ই কবিতাকে নিয়ে যায় রূপ থেকে অরূপের দিকে। প্রতিটি সার্থক কবিতাতেই সীমানা টপকানোর বীজ লুকিয়ে আছে সেই কবে থেকে। শব্দে শব্দে কী যেন বলবার কথা আছে। আছে ডুবোজাহাজ উদ্ভাবনের কথা। অন্ধ আমরা। পাঠক হয়েছি। তবু ধরতে পারিনি...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন