পথের নোলা

এখনো পথে বেরিয়ে  গাছতলা মিলে গেলে
 জিরিয়ে নেবার লোভ হয়।
কতজন কতভাবে আসে, যায়,আমি হা করে সেই সব মানুষ-- জন-- দেখি!

কেউ ডাকবে না জানি;
তবু
আমি অভূতপূর্ব হয়ে কেমন যেন নিজেকে আড়াল করে বসি।তাতেই বুঝি আমার এখনো প্রকৃত মানুষের মত বেঁচে থাকার লোভ আছে!

তার মানে আমিও ভাল আছি;- ময়ূরীবেগম!

এতে নিজেও আমি কেমন আত্মসুখি হয়ে পড়ি।
দোয়েল ফিঙে বলে কতরকমের পাখি আছে আবার  আমি দেখতে বসি।
টের পাই
ঝরাপাতার ওপর  কাঠবেড়াল দৌড়ে গেল।

মাঠে যাবার রাস্তার ধারে--  বসে -- ঘাসের ওপর ঘুঁটে দেয়  শালোয়ার আর কামিজ
মোবাইল ফোনে বাজে কালোবরণের আঁচল খসা গীত!

মানুষ ভরে ওঠার বয়সে এইভাবেই গান গায়
জেনে,
আমি  ঐ অদূরে রাই নগর স্টেশন আর এই সামনের
নিঝুম বাঁশবন পার হই।

পথের ধারে অমৃতের মায়ের নিকান টিনের ঘর!

 অমৃতের মা আমাকে দেখেও না দেখার ভাণ করল।
এতে মনে তড়কা এল খুব।

 অকালমন্দের বাজারে আমাকে কত কত সাধের সুখ ও  দুঃখের গল্প সে যেচে গিয়ে শুনিয়ে এসেছে, কোচড় ভরে না হোক
হাত ভরে যা পেরেছি দিয়েছি, নিয়েও এসেছে,
আর
 আজ কিনা আমি তার ঘরের দুয়োরে এলাম
 সে না দেখার ভাণ ক'রে আমাকে পাশ কাটাতে চাইছে!

মনে কেমন খটকা লাগল।একটু যে রাগ হয়নি, মিথ্যা বলব না,হলো!
মানুষ এমন চোখ উলটিয়ে নেয় কিভাবে,কৈ,
আমি ত আজো নিজেকে কারো কাছেই দুর্মূল্য করে দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুলতে পারিনি!

তাহলে
 অমৃতের মায়ের মত মানুষেরও দেখা যায়
আমার চেয়ে বড়
 মনে সুখতলা দুঃখতলা আছে এখনো! 

অমৃতের মায়ের শরীরে ত অমৃতের মা-ই আছে এখনো
সেই শরীরে শরীরই আছে,তাহলে,আড়াল করতে চাইলেও,যা থাকে,তা ত,অমৃতের মা-ই,নাকি,অন্যকিছু!

হাসলাম মনে মনে!

আজ তোমার খেল আমার দেখাই আছে,অমৃতের মা,ভেবে আমি পা টিপে টিপে পিছনের পথ ধরলাম!

সবার চোখে ত আঙুল নেই,আমার ত নেই-ই।
তাই 
কখনো কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর সুযোগ আমার হয়নি!
অল্প একটু জায়গা তার হেঁসেলে! 

"সেগেন হ্যান ত্রেপল"
দিয়ে রাস্তা আড়াল করা,সেখানে,মাথা দুহাঁটুর ফাঁকে ডুবিয়ে, আসলে আড়াল করে অমৃতের মা নিজের পক্ষপাতে কিছু করছিল!

দেখে মনে হল মানুষটা   সর্বান্তরকরণে ভরা

যেভাবে জল থাকে ভরা কলসীর ভেতর!

.... অমৃত কৈ,অমৃতোর মা?
শোধালাম।
মানুষটা মুরগীর মত ঝটপটিয়ে না উঠে কেমন যেন
ঝামরে গেল!
আমাকে দেখে একদম চোখ সোজা সে তাকাল মাত্র  একবারই!
তারপর স্বরে, আঁতে, মহিলা হয়ে উঠে, সে আমাকে শোধাল
কাকে চাইছেন এখানে?
এটা গেরস্তবাড়ী,হুট করে ঢুকে এলেন যে বড়,কে আপনি?

মানুষ ত নিজেকে বিশ্বাস করে,আমিও করি।

দিনকালে কি বিশ্বাস
 তবু নিজের স্মৃতিকে অবিশ্বাস করব কিভাবে!

মাসখানেকও হয়নি,এই মানুষটা খুব সকালে গিয়ে হত্তে দিয়ে পড়ল আমার দোকানে!

তার স্বামী বলে একজনকে দেখিয়ে বলল
মানুষটার  পা দুটো 'সাড়ে' নেই দিন পনের হল।
লকডাউনের কবলে পড়ে লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছে বটে
কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই পুরো কোমর পর্যন্ত অচল হয়ে গিয়েছে!
এখন তাকে ধরে ওঠাতে হয়
 ধরে বসাতে হয়,একলা পায়খানা বাথরুম পর্যন্ত  যেতে পারেনা!
নিজের নাম বলেছিল অমৃতের মা,তার আরো একটা মেয়ে আছে,নামটাও বলেছিল,মনে নেই।

বলেছিলাম,গিয়ে দেখে আসব একদিন!

আজো যে সেই কারণে আসা তা কিন্তু নয়,নেহাত মনের খেয়ালে আসা এই রাইনগর
বাঘাডাঙায়!

কোথাও যে বসব, নিরিবিলি পাব,তার ত কোন জো নেই!
তাই এই পথ ধরা,আর পথ ধরেই মনে পড়ল অমৃতের মায়ের কথা
মনে পড়ল কোমার পর্যন্ত অসাড় অসুস্থ  অমৃতের বাবার কথা!

তাছাড়া অমৃতের মাও আরো কয়েকবার আমাকে তার বাড়ী আসার কথা কখনো সরাসরি কখনো ঠারেঠোরে বলেছে!
অমৃতের বাবা কিভাবে কিভাবে আরো বিছানাগত হয়েছে জানিয়েছে সেইকথা!

পায়ের তলায় আমার কোনকালেই বা সুখতলা ছিল,যে,অবাক হব!
তবু কেমন যেন হতভম্ভ হলাম।পিছন ঘুরে দেখলাম
 মাটির বারান্দায় দুজন বসে
...সামনে খালি গ্লাস,টমেটো শসার মাখামাখিতে ভরা একটা প্লেট!

তবু অমৃতের মায়ের মুখটা আরেকবার দেখলাম।

সে ত জলে জলে
লতিয়ে বেড়ান কলমী শাক! 
বক আছে তার ধর্মও আছে তার!
  জলের বন্দোবস্তও আছে কোমর থেকে বুক পর্যন্ত ভরা
তবু ভারী একটা মায়া সেই মুখে....!

হেঁশেলটা চোখে পোড়ল,মুরগীর মাংস কুটছিল সে আপনমনে তখন।
এখন বুঝলাম,আমার সঙ্গে তার যখন চোখাচোখি হয়েছিল
তখন সে আসলে  উনুনে নুড়ো জ্বেলে দিচ্ছিল!

 আর
 দাঁড়ালাম না,মুখও নেই দাঁড়াবার মত,পিছনের পথটাই ধরলাম! আবার। 

এমনিতেই আমার হাত পা নড়ে কম,এখন আরো কমে গেল।

বড় রাস্তায় উঠে আবার সেই গাছতলা
দেখি কি
অমৃতের মা
 ঘরের পিছনে একটা চারামত আমগাছ
তার তলায়
পিঠ মাথা পিছনের সবটুকু গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে 
আমাকে পাগলের মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে!

আমার ত  যাবার কথা ছিল না কোথাও কোনদিন!

পাখিবন- বটবন -সারস - এলাহি ভরসা --শ্রীগুরুবন ----কত দেখা হল

 সেই অকারণের ভরসায় চলে এলাম শ্রী শ্রী  গাঙনাপুর।

মিঠেপাতার একটা পান খেলাম দশটাকা দিয়ে
 মুখ ভরে গেল।মনটাও।

হঠাৎ দেখি অবিকল এক পানপাতার মুখ
চোখে মুখে কেঁদে আমার একদম সামনে দাঁড়িয়ে।

আরেকটু বেখেয়াল হলে হয়ত ঢুলই লেগে যেত তার সঙ্গে।
স্বামীর অসুখ,সাহা্য্য চাইছে!
দিলাম দশটি টাকা। 
কেননা পকেটে ঐ টাকাটাই শুধু তখন আর ছিল !
তবে
মনে মনে হেসে ফেললাম। 

হায়রে হোসেন
এক গোয়ালের ঘাস এক গরু দিয়েই খাওয়ালে!?
এতই তোমার বাঁচার নোলা
এখনো!?




লুৎফর রহমান 


জন্ম ১৯৭৩। গ্রামের নাম বিষ্ণুপুর, চাকদা নদীয়া। 
মরণ (এই সহস্রধারা),
রাতকানা নিশিপাখি ও কলিমের গল্প (পরিচয়),
ফুলোফেউটি (বারোমাস) দিয়ে হাতেখড়ি! 


গল্পগ্রন্থ :
১.নিশিপালনের প্রহরে (ক্যাম্প ১৯৯৭, ভাষালিপি,২০১৯, ধানসিড়ি ২০২৩)
২.আন- মানুষ( তবুও প্রয়াস,২০২২)


উপন্যাস :
১.হাতেম ছৈয়াল ( ২০২২ ভাষালিপি) 
২.রাঙা শুক্রবার অথবা কহরকন্ঠ কথা 
(ধানসিড়ি ২০২৪)


চালচিত্র :
১. বিশ্বনাথ মাঝি ও বিভূতিভূষণের গ্রাম 
(ভাষালিপি ২০১৯)

প্রকাশিতব্য :
গল্পগ্রন্থ : বৃত্তান্তের আগে ও পরে (তবুও প্রয়াস)
চালচিত্র: কানাহোসেনের বিষয় আশয় (ধানসিড়ি)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন