আমাদের পাখিজার্নি। লাটপাঞ্চার

প্রায় ত্রিশ মন। অর্থাৎ ১১১৯.৬ কেজি ঢিপির পাথর। খুব আঁটো করে শেকলজড়ানো। যার অপরমুখ জঙের ক্যাঁচকেঁচেসহ এই বাঁ-পায়ের গোড়ালি কামড়ে। কত বছর। কত কত বছর। একমাত্র চাবিটাও কোন তলাওয়ের নিরুদ্দেশে শেওলাশিথিল পড়ে। এমনই এক আত্মমৈথুনের। পরবাসের নিজস্ব। এমন ছিল না যদিও। সেই ৮০-৯০য়ের কাল। রৌরব। এ-গ্রাম সে-গ্রাম। এ-পাহাড় সে-সমুদ্র। বহু বিপজ্জনক আর অফুরন্তের টই। আজ নৈঃশব্দ্যের অভিশাপ শুধু। শামুকবন্দি। আত্মমেহনের পাথরে ফুরায়।

তো, সব্য এন্ড কোং। কী ইন্দ্রজাল! হাঁটুজলে তিমির প্লাবন। আমার আত্মঘাতী শূন্যে বসাল আলাপের সরোদ। ঝালার ঝলস। সঙ্গে একমাত্র বউয়ের নিরাময়ের করাত। পায়ের মুক্তিতে দিল ঘোটকডানার বন্দিশ। চলো মুরারি। শালের দোনায় বসে নিউ ফারাক্কা। কিন্তু সব্যদের আশঙ্কা যায় না। এত কথাখেলাপিকে কারই-বা বিশ্বাস। অনবরত মুঠোফোনের গোয়েন্দা বেজে যায়। যখন নিশ্চিত, বলল কিছু খাবার নিয়ে ওঠ। তালুর চামড়ায় বসে যাওয়া সদ্য তোলা ডিমের ডেভিল। ওই শতাব্দী। ওদের বাড়ানো হাত সিঁড়ির চলন্ত। উঠে পড়লাম।

ডানা থেকে সমস্ত পালক খুলে আপাতত ধীমান প্রদীপ সব্য প্রভাতদার করতলে। পুনর্জন্ম হোক গঠনের রোঁয়ায়। সাঁই স্নায়ুতে বস। চিরাগের আচ্ছন্নতা দাও। নিজেকে পড়াচ্ছি। নিজেকেই লোহাছেঁকা। ওদের যোগ্য হই। সম্পর্কের ফোঁড়ে ছুঁচের অনন্ত। সফরে শ্রমণের রেশ তিনহাজার মাইল হোক ফেলে আসা ছায়ার লম্বা। সাঁইয়ের সঙ্গে এমন গোপনগভীর ইকিড়মিকিড় আঁখমিচৌলির মধ্যেই এনজিপি। আমার মতো হদ্দকুতকুতের কাছে জলপাইগুড়ি মানেই হিমালয়ের অনিঃশেষ পায়ের পাতায় হাওয়ার চিরুনি। কিন্তু এ কোন স্টেশন! এতো মহাউন্মাদের পাতাল সরণি। প্রথম ধাক্কাটা বেশ জোরেই বাজল। বাজুক। মোগলের হাতেই যখন। কসরতের শুঁড়ি ফুঁড়ে আমাদের তিন রিক্সা পেল রাতের সরাই। এক ঘরে প্রদীপ সব্য আর আমি। অন্য ঘরে ধীমান প্রভাতদা। খানিক জিরান। অতঃপর সন্ন্যাসীর বৃদ্ধলাল অধঃক্ষেপ ডুবল তিন গেলাসে। রাত তিনটে গড়িয়ে তিন তরলপ্রাণের রবীন্দ্রনাথে। ঘুম। মহাবিশ্বের ছাউনির তলায় তিন লিলিপুটের দিনের উথ্থান। মিশন লাটপাঞ্চার।
গাড়ি দৌড়ুচ্ছে। মাঝে ক্ষুধাবিরতি। জানালায় উইন্ডস্ক্রিনে বিরামহীন হুহু পরতের বায়স্কোপ। সাঁই কী চালাচ্ছেন রিল ঠেলে! পাহাড়জঙ্গল আর গলা-মেঘের ভিয়েন। অনন্তের কুরুশবোনা। স্তব্ধ। গহীন। নিখিল আচমন করছেন মোহব্বতের ঝিলে। বোবা-ধরা আমি। ধীমান প্রভাতদার ফুট কখনো ক্বচিৎ। সব্য আর প্রদীপ বিজনের চিলমন তুলছে অস্ফুট গানের সেকে। ভাঙা ভাষ্যে। কবিতার স্প্যাচুলা বুলিয়ে। থমথমে পাহাড়ভেজা মৌতাতের চালক আমাদের। চোয়ালবদ্ধ সুপুরির ঝোরায় অবিশ্রাম। পাকদণ্ডীর মাতাল তাঁর পাঞ্জা রুখতেই লাটপাঞ্চার। আমাদের হোমস্টে। সব্যর আঙুলে খোঁড়া জালিক টিকলির। শূন্যের কপালে নামা  আরশিমহল। খড়খড়িহীন। তিনপ্রান্তের পড়শিপাহাড়। খাঁজেখন্দের গাঁও। আবছা জুম। ক্ষীণ তিস্তা। দুপুর নামতেই চূড়ায় চূড়ায় পিচড্রাম। কে গড়ায়! সাঁই! আদিগন্ত স্মৃতির কুহক। আলিঙ্গনের। আমাদের পাখিযাত্রার কাল খুলে গেল। বৃষ্টির তুলোয় মোছা অনন্তের মুখ। গাঁওদেবতার দেশ। বিকেলের কাঁসায় বাজা পাহাড়। আমাদের চালকও যথারীতি। আস্ত সুপুরিভরতি চোয়াল। আইয়ে। হুড়মুড়ে আমাদের। গাইড বলল আহিস্তা। লিউকোপ্লাস্ট। গাইডের শিসের সোহাগ যাচ্ছে শূন্যের যোনিতে। আর যোনির আকুল পাখি ঠেলে। পাখি ফেরে। রঙের পরব। কোন মগডালে। চূড়ায়। আভাসের অন্তরালে। এই আছে এই ফুড়ুৎ। রঙের পশম ঝরে। ঠিনঠিনে হাওয়ার কাঁকন। প্রকৃতিবাজ দু-পাঁচ মেগা কোম্পানির চোংপ্রবল মেগাক্যামেরার মস্ত হাওড়। তবু কাচের অধরা। সন্ধে মজছে। সব্যর ততনিষ্ঠ লেন্স ততই মজে। আর তারই পকড় আমাদের ফেরার অর্জনে গৌড়মল্লার গেঁথে দিল। আমাদের ফেরার সরাই। সন্ধেখোঁচানো। দূরে দূরে পাহাড়ের ঘুমে রঙের জোনাকি। কোন খ্রিস্টপূর্বের ডাক চূড়া থেকে চূড়ায় যাচ্ছে। তারই ধ্বনির আবছা। হুরিপরিদের রান্নার তরাই। ভাপ ওঠে। আমাদের রাত্রি ডোবে ঘ্রাণের সুড়ঙ্গে। ভাপের অবিশ্রাম।

ভোর। হর্নবিল নেস্ট। গাইডের আগেই পড়িয়ে রাখা ফেরার সন্ধেয়। যত আগে তত নিশ্চিত। তো আমরাও। হঠাৎ অসুস্থ প্রদীপ। বিশ্রাম। কিছুটা এগিয়েও ধীমান ওর বহুকালের চেনা চোখে বলল না। সব্য তো জিনে পাওয়া। জয়যাত্রায় ভেঁপুর তরতরে। আমি আর প্রভাতদাও নাছোড়। ইশ্‌ক বাজছে বুড়ো পায়ে। ফুট দেড়দুয়েকের দুরূহ উৎরাই। নিরুদ্দেশের ট্রেক। খাবি খাচ্ছি প্রায় পঁচাত্তরভাগ নেমে। মরিয়া প্রভাতদা। জোর করেই থামালাম। চড়াইও কী ভয়ানক বুঝলাম প্রভাতদাকে দেখেই। হামাগুড়িপ্রায়। একজন গাইডের কাঁধেই শেষমেশ পরিত্রাণ। এই আনাড়িও ধুঁকেহেঁপে ঠিকানাঅব্দি। আর আমরা সব্যর অপেক্ষায়।

ফিরল সব্য। ছবির ধনেশ সমেত। পুরো বিধ্বস্ত। কিন্তু জয়ের বিপুল ওর চোখের সুর্মায়। বনের আয়ুর্বেদে কাঁচা মুখের সবুজ। দেখ দেখ বলতেই আমরা ঝাঁপিয়ে ওর ক্যামেরায়। কী সে ছবি! হতবাক আমরা। বাবা-ধনেশ। তেলরঙের ঐশ্বর্যে একাকার। ঠোঁটে রঙিন খাবারকুচি। বাসায় ঢোকার মুখে দ্রুত মেপে নেওয়া চারপাশ। এই ছবির রোশনাই কি সাঁইয়েরই নির্মাণ! যার জন্য হন্যে এত ক্যামেরা। এত শ্বাসরোধী অপেক্ষার ঢল। সব্যর লেন্সের জাদুকর পরতের পর পরত খুলে দিল। 

দুপুরের ফিকে। আমাদের পরিকল্পনা মতোই প্রদীপের "তানাশাহী" নিয়ে বসে পড়লাম। সদ্য বেরুনো। যার উন্মোচন। সুস্থ প্রদীপ। খুব সেজেগুজে। নিজের কোল থেকে আমাদের কোলে দেবার বিভোল ওর চোখেমুখে। বেরুলো। পাহাড়ের তিনপ্রান্ত হোমস্টের কংক্রিট এমনকী হাতপনেরো দূরের পাইন পর্যন্ত লাফিয়ে ওর মলাটে। একটা বইয়ের এমন আশ্চর্য প্রকাশ। তা নিয়ে বিস্তর কথা। পাঠ। আলোচনা। কখনও কোথাও! আমার মতো গেঁয়ো মজুরের অন্তত জানা নেই। তারই নিরবচ্ছিন্ন রেশ চুলকাঁটার বাঁকের মায়াবি। আমাদের পৌঁছে দিল মংপু। আবারও এক আচ্ছন্নতায় আমাদের গলে যাবার কাল। সমাপ্তিহীন। অবিরাম। বিপুলের পায়ের নীচে আমাদের ডিঙির ক্ষুদ্র আশ্রয়ের হাওয়ায় কাঁপছে। ফেরার ইচ্ছেও যেন কাছিমের স্তব্ধতায় ডুবে যায়। গোলঘরে ধীমানের কবিতাপাঠ। যেন আমাদের  শ্রেষ্ঠতম অবলম্বনকে বঞ্চিতের কদমবুশি। থাকব হে কখনও তোমার বাটে বটের ছায়ায় দুটো রাত। সাঁইকে বললাম। যদি তাঁর মঞ্জুরি কখনো পৌঁছায়। পৌঁছুলাম অহলদাঁড়। ডানার বিকেল মুছে কুহকের মহড়ার ধূসর। কত কত রেখার পূরবি। মহকাল। ভিখিরির অর্ঘ্যে তার কী আসে! সে শ্রমণের কাজ। ভ্রমণের শৌখিন ফেরে হোমস্টে। রাতের আড্ডা গান কবিতা। আর জলের আগুনে পোড়া কানাড়া পৌঁছায় মহালোকে। সকালেই আমাদের লাটপাঞ্চার ছেড়ে যাওয়ার ছড়ে বিলাসখানি টোড়ি। জন্মায়। আর বাজাবে বলেই হয়তো আকাশের ফর্সা কিছু প্রস্তুতিতে বসে।

বি:দ্র:
শিলিগুড়ি থেকে লাটপাঞ্চার : ৪০ কিমি, রিজার্ভ করা গাড়িতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘন্টা

নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লাটপাঞ্চার : ৪৫ কিমি, সময় লাগে প্রায় পৌনে দুঘন্টা

থাকা : Gurung home stay / Horn-bill Nest home stay

যোগাযোগ : 9475959974





সমীরণ ঘোষ

৭০-দশকের কবি গদ্যকার

প্রকাশিত গ্রন্থ :
হে বদ্ধ কাপালিক, কাঞ্চনবেড় থেকে কলকাতা, তলোয়ার পোহাচ্ছে রোদ একা একা, মিয়া কী মল্লার, নূহের জাহাজ, পর্যটকের ডানা, সাঁই আমাকে ওড়াও, অন্তর্বর্তীরেখা, চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান, কালোপাথরের হারমোনিয়াম, মরচে গোধূলির পাঠ, হাড়ের দূরবিন, মরিচগন্ধের সেতু, হাতআয়নার ঘুম, পেনসিলের শ্রুতিধর, সান্ধবৈঠক, কবিতাসংগ্রহ ১ ও ২, ভাঙা ডাকের হাশিশ 

প্রকাশিতব্য গ্রন্থ : লাল ছায়ার গথিক


অনূদিত নাটক : 

সুইফট নির্মিত প্রাসাদ।

প্রকাশিতব্য গ্রন্থ : লাল ছায়ার গথিক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন