ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্পগ‌ুচ্ছ



পর্দা

ভুলু সোফার ওপর শুয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে কী না তাকিয়ে ডেকে উঠল হঠাৎ । তার কান নড়ছে, লেজও নড়ছিল। সে কিছু বলছে, যার উদ্দেশ্যে বলা তাকে তেমন অপছন্দ মনে হচ্ছে না।


মাঝদুপুর পার হয়েছে। আমি বিছনায় বুকের নিচে পাশবালিশ রেখে, উপুড় হয়ে, সামনে লেখার প্যাড, হাতে কলম। একটা শব্দও ধারেকাছে নেই, যেন তাদের হরতাল কিংবা এখন ঠিক কাজের সময় নয়। তখুনি, টের পেলাম, পর্দা। আছে, দেখতে পাচ্ছি না। পর্দার অপর প্রান্তে কেউ, মনে হচ্ছে আছে, দেখতে পাচ্ছি না। 


কী করি? ভুলু এইসময় শান্ত, লক্ষ্মী ছেলে যেমন, আর সোফা থেকে নেমে, বিছনার গা ঘেঁষে, কাছাকাছি আমার।


আগেও হয়েছে। একা থাকলে একেকদিন এমনধারা হয়।


আজ আমি বললাম--- কে? পর্দার অন্য প্রান্তে কে? 


উত্তর নেই।  জানলার গায়ে লালে লাল শিমূলগাছ। তার নিচে কী কোথাও কাঠবেড়ালি থেমে থেমে কিছু বলছিল।


আমি আবার বললাম--- আমার কথা শুনতে পাও? আমার ভাষা ধরতে পারো? কথা বলতে পারো?


উত্তর নেই। 


অস্থির লাগছিল।  পুবের দেয়ালে পুরনো ঘড়ি। তার সেকেন্ডের কাঁটা সজাগ যেন। 


এখন আমি কাতর কণ্ঠে বলছি--- কে তুমি? উত্তর দাও। 


মাথার ওপর ফুল স্পিডে পাখা। অন্য প্রান্তে কেউ। চেনা?  অচেনা? আমি চাইছিলাম পর্দাখানি দুই হাতে সরিয়ে দিই। পর্দার আড়ালে যে তার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়ে যাক। 


--- কে তুমি? তুমি কোথায়?


ভুলু আবার যথাপূর্ব সোফায়, জিভ বের করে। পর্দাটিও, এইসময় ক্রমশই আরও বেশি সূক্ষ্ম, আছে বলে মনেই হচ্ছে না।




রমেনরা 

রমেনের কাজ গেছে। ইয়াসিনের কাজ গেছে। বীরেন সুরজ খোকা গণেশ মনোজ--- কাজ গেছে সবার। রমেন ওনলি  বিমলের শোরুমে মাসে সাতশোর কাজ জুটিয়েছে। বীরেন কোথাও সুবিধে করতে পারেনি। ইয়াসিন কারখানায় ঢোকার আগে রেলট্রেনে ডাব বেচত। বলছিল ডাবই বেচবে। তার একটা পায়ে  সমস্যা।  সাত মাস হয়ে গেল শুরুই করতে পারেনি। সুরজ খোকা গণেশ এখানে দুদিন সেখানে দুদিন ফুরনের কাজ পাচ্ছে, পাচ্ছেও না। হপ্তাশেষে রোজগার কারোই নেই। 


কারখানার গেটে মস্ত বড় তালা। তার বাইরে লালঝান্ডা তেরঙ্গা ঘাসফুল পদ্মফুল ছড়ানো। বাইরের লিডারদের  অনেকদিন দেখা নেই।     

  

সবাই বলছে মনোজ অন্য কোথাও কাজ পেয়েছে। তার বউ লাল ডুরে শাড়ি পরে মঙ্গলবার মঙ্গলবার কালীমন্দিরে ডালি সাজিয়ে পুজো দিতে যায়, ছেলেটা এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে।     

 

মনোজের বয়েস চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। বাচ্চাই বলা যায়। খাটতে পারবে। সেজন্যেই কাজ পেয়েছে, সবার তাই ধারণা। বীরেনের বউও তেমনটাই ধরে  নিয়েছে। 


গণেশ একদিন খোকাকে জিজ্ঞেস করল--- মনোজের কেসটা তুই জানিস? 

খোকা বলল--- পার্টি করতেছে লিশ্চয়। পার্টি করলেই লুটমার। ঠিক কিনা? 


একদিন ডাব নিয়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে ইয়াসিনের পা ভাঙল। মনোজই নিয়ে গেল হাড়ের ডাক্তারের কাছে। এক্সরে, প্লাস্টার, পুরো খরচ দিল। ইয়াসিনের বউ মনোজ ভাইয়ার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।   


একদিন বীরেন মনোজের হাত ধরে বলল--- দেক দিকিনি, ভাই, আমারেও কাজে লাগিয়ে দিতে পারিস যদি।  

মনোজ বলল--- সে কাজ তুমি পারবে না।  

বীরেনের চোখে জল চলে এল--- পারব, পারব। তুই এগবার নে চল।      

কথা দিতে পারল না মনোজ। 


একদিন সকাল করে গণেশ মনোজের ঘরে হাজির। মনোজ তখন লাল বাইকটা মোছামুছি করছে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বত্রিশ ইঞ্চি টিভি। মনোজের বউ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, সে তাই চা দিতে পারল না। 


গণেশ বলল--- আমাকে বাঁচা, ভাই। বাবার জন্যে এস্থালিনও কিনতে পারছি না।  

মনোজ হাঁ করে চেয়ে রইল গণেশের মুখের দিকে। 


গণেশ বলল--- সবাই বলছে পার্টি করছিস। আমিও পার্টি করব।


মনোজের মুখ মাটির দিকে এবার। দেখল গণেশের পায়ের জুতোর তাপ্পি ছিঁড়ে গেছে।  


গণেশ বলল--- কোন পার্টি বল। মা মাটি মানুষ? 

মনোজ চুপ করে রইল।


গণেশ আবার বলল--- জয় শ্রীরাম? যে পার্টি বলবি বল, করব... 


মনোজের চোখেমুখে কিন্তু কিন্তু ভর করেছে। সে বলল--- পার্টি না, পার্টি না। গণেশদা, আমি না খুব নীচে নেমে গেছি। তুমি তেমন নীচে নামতে পারবে না।




ম 

ম, অম, মা--- সবচেয়ে পুরাতন ধ্বনিদের মধ্যে এইগুলি পড়ে বলে শোনা। 


মএর আগে কী পরে স্বরধ্বনি যুক্ত হয়ে যা দাঁড়ায় এখন অব্দি এইটুকুই তার উচ্চারণবশ। এইটুকুই সে উচ্চারণ করে। একেকসময় শোনায় কান্নার মতো।  


এখন অব্দি একজনই সবচেয়ে বেশি চেনা। সবচেয়ে বেশি, মানে, সহজেই সে তাকে চিনে ফেলতে পারে। সেই একজনের বুকেই সারাক্ষণ সে প্রায় লেপটে থাকে। কখনো কখনো কী একটা হয়। সে তখন সেই একজনেরই বুকের কাছে যায়, তার বুকের দুধ ঠোঁট  দিয়ে টানতে থাকে। এইরকম কেন করে, কেন এইরকম না করে পারে না, সবই তার বোধের বাইরে। 


ওই আগে কী পরে স্বরধ্বনি দিয়ে সে ফের উচ্চারণ করে ম। শোনায় কান্নার মতোই। অথবা কাঁদতে কাঁদতেই এই ধ্বনি তার গলা দিয়ে বের হয়ে আসে। 


রাতে যেসব ঘটে গেছে সে আর কেমন করে বুঝবে? অন্ধকার। কাছ থেকে দূর থেকে যে শব্দেরা শীতবাতাস পেরিয়ে ভেসে আসছিল তাও সে বোঝে না।  যে তাকে বুকে নিয়ে শুয়েছিল তার শরীরটা পাশেই পড়ে আছে। মাথাটি মাঝখান থেকে দুফালা। সে হামাগুড়ি দিতে দিতে তার দিকে এগোয়। 


আর একবার উচ্চারণ করে ম।  


সে এখনও জানে না রক্ত, প্যালেস্তাইন, ইসরায়েল, আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, তরলসোনা আর আমার মতো ছাতার লিখিয়েকে…




নগ্ন

হাতের চুড়ি, নাকছাবি, কানপাশা, গলার চেন একেক করে খুলে ফেললে, বলতে না বলতেই। রজনীজড়ানো খোঁপাটিও খুলে ফেললে। দ্বিধার চিহ্ন নেই।


  শাড়ি, ব্লাউস, ব্রা। তারপর সায়া, প্যান্টি, স-অ-ব।


আমি তোমার গন্ধে গলে দেখলাম।  তোমাকে চুমু খেয়ে, ছুঁয়েছেনে দেখলাম। অনেকক্ষণ ধরে আমি দেখলাম সামান্য একজন মানুষ কেমন করে এইরকম অপরূপ, এইরকম আনন্দের নিকেতন।


শুরু থেকেই আমরা দুজন কথা বলছিলাম। অনেক বিষয় নিয়ে আর অ-নে-কক্ষণ ধরে আমরা কথা বলছিলাম।


হায়, নগ্ন হয়ে আমি পড়ে আছি। হায়, আমি তোমাকে নগ্ন দেখতে পেলাম না।




এক্সট্রা

অরুণদা আর তরুণদা। মামাতো-পিসতুতো ভাই। অরুণদার হাইট ভাল, স্লিম, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। তরুণদা গোলগাল, হাইট হয়নি, ক্লাস টেনেই সেভ করতে হয়।


চৌমাথার গায়েই অরুণদাদের কোয়াটার। কোয়াটারে গোটা তিনেক স্থলপদ্ম, কদম্বও একটা।


কোয়াটারের গা দিয়ে যে রাস্তা কাছেই বাঁদিকে ঘুরে সেন্ট মেলিনা স্কুলের গেটে শেষ হয়েছে সেখানেই বেলিদি ক্লাস টেনে পড়ে। বেলিদির সঙ্গে জুনিদিও পড়ে। মানি, মীরা, বীণা, জয়া, দিদির পর দিদি।


অরুণদা ভোরে উঠে শরীরচর্চা করে। তরুণদার ঘুম ভাঙে দেরিতে। ততক্ষণে বেলিদিরা স্কুলে চলে যায়।   স্কুল ছুটির সময় অরুণদার প্রব্লেম এই যে জিওমেট্রির একটা এক্সট্রা সল্ভ করতে টাইম পেরিয়ে যায়। তরুণদা তখন ফ্রি। আর সে বেলিদিকে আষাঢ় নামলে কদম্বের লোভ দেখায়, ভাদ্র নামলে পদ্মফুল হাতেই তুলে দেয়।


অরুণদার বাবার ওপর রাগ জমতে থাকে। অফিসে বেরিয়ে যাবার আগে বাবার স্ট্রিক্ট ইন্সট্রাকশন, রোজ   একটা করে এক্সট্রা সল্ভ করতেই হবে। সলিড জিওমেট্রি, তার এক্সট্রা কী সহজ সব্বাই জানে।


এদিকে বেলিদি আর জুনিদির মধ্যে অরুণদাদের নিয়ে কিছু একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে।


প্রথমে জুনিদিই ফেন্সিংএর গায়ে চিরকুট ছুঁড়ে দেয়। বেলিদি ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায় না। চিরকুটটা   হাতে পায় তরুণদা। পরের দিন বেলিদিও চিরকুট ছুঁড়ে দেয়। জুনিদি ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায় না। তরুণদা সেখানিও হাতে পায়।


চিরকুটে কারো নাম লেখা নেই। হাতের লেখাও আলাদা।


তরুণদা এখন প্রত্যেকদিন সেভ করে। মেসোমশায়ের আফটার সেভ লোশন প্রায় শেষ। তাছাড়া, সকালেই স্নান করে পাউডার গলায়।


বেলিদি আর জুনিদি এমন ভাব দেখায় যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। না পদ্ম, না কদম্ব, কিছুতেই তাদের মোটে আগ্রহ নেই।


অরুণদা কম্পিউটারে একশন মুভি দেখে। তরুণদা পাগলু দেখে পাগল হয়ে যায়। অবশেষে তরুণদা প্রব্লেম সল্ভ করার জন্যে অরুণদারই শরণাপন্ন হয়।


অরুণদা বেচারা। চিরকুট হাতে নিয়ে দেখে আর দেখে। দেখতেই থাকে। একটি নীল কালিতে লেখা। অন্যটি লাল কালিতে। একটির হাতের লেখা ছাপা অক্ষরের মতো, অন্যটির গোল গোল কেমন যেন।  একটিতে লেখা আছে আঁখি ফিরাইলে বলে না না না, আর একটিতে লেখা আছে বাবাকে বলে দেব।




দিক

মাঠের দিক থেকেই হাওয়া আসছিল কিংবা মাঠের দিকেই হাওয়া আসছিল এমন চিন্তায় আমি যখন বিচলিত, হাওয়া  বলল, আমার কথা ছেড়ে তুমি একবার বলো নিজে কোন দিক থেকে আসছ কিংবা কোন দিকেই আসছ তুমি নিজেই। 


ব্যস, সব আমার গুলিয়ে গেল। ঘরের কোণে মাটির প্রদীপ। ম্লানমুখ যেমন। দেয়ালে কিসের ছায়া। ছায়া না  অন্ধকারের পা পড়েছে, কিছু একটা। 


আকাশে একটা চাঁদ ছিল, ঠান্ডা তাওয়ার মতো আকার, রেজোলিউশন হাই।  

চাঁদ বলল, আমি অন্যের আলো ফিরিয়ে দিই, বলতে পারো ছড়িয়ে দিই। তোমার নিজের আলো দেখাও দেখি কোন অব্দি ছড়িয়ে দিতে পারো। 

লজ্জায় পড়ে গেলাম। আমার নিজের আলো? আমার যে আলোও নেই, অন্ধকারও নেই। 


ছেঁড়া বোষ্টুমির নাতনি আমার গল্প শুনছিল। পাশে শুয়েছিল। অপ্রশস্ত জানলা, সেদিকেই চোখ।  

বলল, তোমার না মাথা খারাপ। মাথা খারাপ নাহলে এমন আবোলতাবোল বলে বলে কেউ কখনো ভাবে আমায় গল্প বলছে? 

মাথা খারাপ না মাথার ঠিক নেই?

সে বলল, ওই একই তো হল। কোন দিক থেকে শুরু করেছ কোন দিক ধরে যাচ্ছ জানোই না। 


বোষ্টুমি বলল, বৃষ্টি নামবে। চাঁদ দেখো মেঘবন্দী ক্রমশই। উড়নি! তোর মায়ের কাছে যা।

উড়নি তখন গেল। উড়েই গেল যাবার আগে লম্বা করে জিভ ভেঙিয়ে। 

তারপরই বৃষ্টি।  


বোষ্টুমি বলল, আমায় ছুঁয়ে থাকো। 

মনে মনে বললাম, আঙুল, তোরা সবাই আবার একবার জাদুর কাঠি হতে পারিস যদি! 

বোষ্টুমি বলল, না থাক। আমিই তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিই।

বললাম, চন্দন! চন্দন!

এবার শান্তি। এবার শান্ত হও, তুমি একটা দিকদিশাহীন মানুষ।  

বলে সে চেয়ে রইল বৃষ্টিছিটের দিকে, অন্ধকারের দিকে, আর যেদিকে আর দিকই নেই সেদিকেই।




একেকদিন

মাঝদুপুর বলেই, অলিভেরা বা পাথর পাইন, কারো ছায়াই যথেষ্ট না একেকদিন, তবে সেখানেই টিলার ঢালে স্যান্তিনো এসে বসে, একা একাই বসে। 


স্কুলের ছুটি সবে। সামনে বাস্কেটবলের মাঠ, মাঠে এইসময় অনেকগুলি ছেলে। স্যান্তিনো খেলে না, ঘরেও ফেরে না। একেকদিন। 


তোমার পাপা কী করে?

পাপা নেই। মাম্মার সঙ্গে থাকি।

আমারও পাপা নেই। ডিভোর্স হয়ে গেছে। 


মাম্মা?

ইভনিং শিফটে বারে কাজ করে।

আমার মাম্মা ওয়াইন শপে।


একেকদিন মরিয়ামের সঙ্গে এইরকম একটা-দুটো কথা। মরিয়াম বেশি কথা বলে না। ফিয়াটে আসে, ফিয়াটেই বাড়ি ফেরে। লক্ষ করে স্যান্তিনো কেমন যেন, মনখারাপ সবসময়ই।


ভিয়া লরেঞ্জোয় স্যান্তিনোদের বাসা, বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। পার্কে লিলিয়ানও আসে। দুধের বাচ্চা কোলে। লিলিয়ান হাত পাতে। স্যান্তিনো এক সেন্ট দেয়, দু সেন্ট দেয়, একেকদিন। একেকদিন ছায়া ঘনালে লিলিয়ান কাছাকাছি বসে, পুরো বুক উদোম করে দেখায়। স্যান্তিনো অবাক হয়ে দেখে। তার চোখের তারা থেকে মরিয়ামের মুখখানি সরে যায় না।


একেকদিন সন্ধের পর বাড়ি ফিরে বইএর ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে সোফায় নিজের ছোট্ট শরীর এলিয়ে দেয়। আলফো এসে বুক ছুঁয়ে দাঁড়ায়।  তাকে খানিকক্ষণ আদর করে নেয়। 


একেকদিন রেকর্ডেড ভয়েস ভেসে আসে--- আমরা পাশের রুমে আছি। ডাইনিং টেবিলে হামবুর্গার আছে। ফ্রুট জুস আছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। 

মায়ের ভয়েস। মা পার্টনার নিয়ে নিজের বেডরুমে।


মরিয়ামের হলদেশাদা স্কিন, ঈষৎ লম্বা মুখ, খুশিখুশি ছটফটে চোখ, আয় চুমু খাই ঠোঁট, জাদুকাঠির আঙুল আর হাঁটুর বেশ অনেকটাই ওপরে আকাশি আকাশি স্কার্ট, সমস্তই মনে আসে একেকদিন।




মিছিল

মিছিল তেমন বড় ছিল না। হারানদার পানদোকান থেকে নারানদার চাদোকান।


মিছিলের সামনে দুদিকে ব্যানার ধরে শুভদারা। নির্মল জেঠুরা তার পেছনে। বন্ধুদের সঙ্গে আমি মাঝামাঝি। পাশের লাইন মেয়েদের। সেখানে শ্রাবণীরা ছিল।

আমাদের হাতে হাতে পোস্টার, পোস্টার আর পতাকা, ঠোঁট ঢাকা কালো কাপড় দিয়ে। মানে মৌন মিছিল। 


মৌন মিছিল। অল্প কজন। মিছিলখানি শান্তও। শান্ত মানে তাড়াহুড়ো নেই।

হঠাৎ কোথা থেকে জনাকয় পুলিশ। তাদের হাতে লাঠি। একজন বোধহয় অফিসার। তার কোমরে পিস্তল।


পেছনে আর কে কে এসেছে দেখতে চেয়ে মুখ ঘুরিয়েছি। পুলিশের একটা গাড়ি। পুলিশের গাড়ি আমাদের পেছন পেছন।


হারানদা আর নারানদার দোকানের মাঝখানে রামুচাচার জুতো সেলাইএর দোকান। রোদ খুব চড়া বলে মাথায় ছোট্ট ছাতা। ছাতাও বেশ পুরনো আর ছেঁড়া।


বেণীমাধবকাকা ছিট কাপড়ের দোকান থেকে আমাকে দেখছিল। স্টেশনারি দোকানের অখিলেশ এগিয়ে এল একবার। সুইটশপের গজুমামা ক্যাশ কাউন্টারে বসে পান চিবোচ্ছিল। একবারও চোখ তুলে তাকাল না।


শ্রাবণী এর মধ্যেই ক্লান্ত। ক্ষুদে রুমাল দিয়ে বারবার মুখ মুছছে। আমাদের একটু আগে একজন খুব বুড়ো মানুষ। আস্তে হাঁটছে বলে পেছনে যারা তাদের খুবই অসুবিধে হচ্ছে দেখলাম। মানুষটা বিচিত্রও। পুলিশের উর্দি পরনে। বগলের কাছে ছেঁড়া। হঠাৎই কলেজের ছেলেমেয়েরা মিছিলের বুক চিরে এফুট থেকে ওফুটে ছুটে গেল। তাদের দু-একজনের কানে মোবাইল ফোন। মোবাইলে গান বাজছে (আজ কি সাম দুলহন জ্যায়সি হ্যায়)।


মিছিল মোটেই বড় ছিল না। যে যার নিজের গরজেই এসেছে। সেভাবে প্রচারও কেউ করিনি। ভাল লাগছিল না। ভাবছিলাম অকুস্থলে আমি যদি থাকতাম। হয়ত আমাকেও দেখতে হত স্কুল কলেজ দোকান বাজার অফিস আদালত বন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় রাইফেল হাতে সদাপ্রস্তুত সেনা। জলপাইজামার লোকজন ঘরের ভেতর ঢুকে দাদাকে খামোকা খুন করে  গেল। হয়ত আমাকেও দেখতে হত জলপাইজামার লোকজন ঘরের ভেতর ঢুকে মাকে আচমকা তুলে নিয়ে গেল।


মিছিল এগিয়ে চলল। নারানদা পান সাজছে, সামনেই খদ্দের। চায়ের ভাঁড় হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে হারানদা। রামুচাচা কার একটা চটি সেলাই করছে। বেণীমাধবকাকার দোকানে কী ভিড়! অখিলেশ দোকানে ফিরে গেছে। গজুমামার ঠোঁটের কোণে পানের কষ।


টিভি চ্যানেলের কেউ বুম হাতে সামনে এসে দাঁড়ায়নি।




যুদ্ধমজুর

ইস্পাতের পাখি আকাশ থেকে আগুনের ডিম ছাড়ে। নিয়েলসম্যান জানে। সে একটা কমান্ড দেয় শুধু, নিচে কিছু তেমন ভাবে দেখতে  পায় না। ডিমগুলো প্রোগ্রামমতো কারখানায় পড়ে, সেনাশিবিরে পড়ে, বিমানবন্দরে পড়ে, অথবা ছুটির দিনে সবাই যেখানে ভগবানের কাছে শান্তি আর নিরাপত্তা প্রার্থনা করতে জড়ো হয়  সেইসব বড়সড় ভিড়ের মাথায় ঠিকঠিক।     

 

রোদ বেশ মধুর এখন ভোর পার হয়ে। নৌজাহাজ থেকে ঢেউএর ওপর সেই রোদ দুলছে স্পষ্ট দেখা যায়, দুলতে দুলতে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাতসতেরো রঙ। ডান্সফ্লোরে বুবকিনের  মার শরীর এইরকম দোলে, নিয়েলসম্যানের চোখে ভাসে হঠাৎ।    


সেইসময় অপারেটিং স্টেশন থেকে ইমারজেন্সি কল। তেমন কিছু না। বুবকিন, নিয়েলসম্যানের সাত বছরের ছেলে, আজ দুদিন হয়ে গেল স্কুল থেকে ঘরে ফিরে আসেনি। খোঁজাখুঁজি চলছে। উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। সিস্টেম বীর সেনাদের সঙ্গে আছে সবসময়। 


তক্ষুনি ইস্পাতের পাখি আবার সেজে নিয়েছে। প্রস্তুত। তক্ষুনি নিয়েলসম্যানের পরের ট্রিপ। 


সিস্টেম দায়িত্ববান। হৃদয়বানও। নিয়েলসম্যান কী করবে জানতে চাইছে। সিস্টেম জানে যে খবর ভুলবশত পৌঁছে  গেছে তার ধকল আছে। নিয়েলসম্যান কি রিলাক্স করবে?   


(দিস ল্যান্ড ইস আ’র ল্যান্ড)এর জন্যে সঙ্গে সঙ্গেই পরের ট্রিপ, ইস্পাতপাখি ডাকছে।


পরের টার্গেট হাসপাতাল। একমাত্র শিশুদের হাসপাতাল। 




ভাঙা ব্রিজ

বকুলপার্ক রক্ষিত একলাই জমিয়ে রাখে। ভাঙা ব্রিজ পার হয়ে সে আসে। 


বিয়ের পর থেকে মেয়ে আমেরিকায়। ছেলে তবে ইন্ডিয়াতেই। মজুমদার সেই কথাই তুলল--- একটা ঠ্যাং তোমার তবু আছে। আমার থেকেও নেই। দুবছরে একবার আসছে। পরে আর আসতে পারবে না। 


সিংহরায় সুতো ধরে--- লেখাপড়ার হদ্দমুদ্দ করেছে সব। রক্ষিতটার পুণ্যফল। পারিজাতের সমান কাউকে দেখিনি। ক্লাসে ফার্স্ট হত, এত এত প্রাইজ, রেজাল্ট বের হলেই প্রণাম করতে আসত। আমারটি স্কুলেই যেতে চাইত না। 


সেনগুপ্ত থামিয়ে দিল--- তোরও তবু ভাল। স্কুলে পড়ায় এখন। মা-বাপকে ছেড়ে কোথাও যায়নি।

চাটুজ্যে বলল--- অনুরাগও ভাল ছেলে। চাকরি পেয়েছে ব্যাঙ্গালোরে, ভাল চাকরি। কলকাতায় পেলে তোর সঙ্গেই থাকত। 

সেনগুপ্ত সিগারেট ধরিয়ে বলল--- বলা যায় না। কেউ রক্ষিতেরটার মতো কিন্তু হয়নি। পারিজাত আমেরিকায় সেটল করতেই পারত। বাপমায়ের সঙ্গে থাকবে বলে দেশে ফিরে এসেছে।


বকুলগাছে পাখিরা সব এতক্ষণে। তীক্ষ্ণস্বর কিচিরমিচির তাদের। তাদের বাপ মা ভাই বোন চেনা যায় না।


আজকের সন্ধেটা জমল না।


মজুমদার বলল--- নাতনিটাকে নিউ জার্সিতে স্কুলে দিয়েছে। তার নাকি সর্দিজ্বর সারছে না।


চাটুজ্যেদের ছেলেপুলে নেই। দুঃখ আছে, বলে না, চুপচাপ সবার কথা শোনে।


অপরূপ, রক্ষিত জানে বরাবরই অসুস্থ, গতকালও গলা জড়িয়ে হনুমানের লঙ্ককাণ্ড শুনেছে, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে।


অন্ধকার নামতেই তিন-চারজন বকুলপার্কে এল। রোজই আসে। এলেই রক্ষিতরা বাড়ির পথ ধরে। পারিজাতের চেয়ে বয়েস এদের কম। রক্ষিতরা জানে না কাদের বাড়ির ছেলে। চাকরিবাকরি জোটেনি,  জুটবেও না। গাঁজা-মদ অন্ধকারে বসে।  


গতকাল অপরূপ ঘুমিয়ে পড়ার পর পারিজাত বাবার ঘরে এসেছিল। কদিন থেকে রক্ষিত আন্দাজ করছিল ছেলে কিছু বলতে চায়।

--- তোমার শরীর এখন কেমন?

--- ভাল।

--- প্রেসার?

--- নর্মাল। 

--- হজমে কোনো প্রব্লেম হচ্ছে?

--- না।


আগে কোনোদিন ছেলে এসব জিজ্ঞেস করেনি। টিভির খবর বন্ধ করে রক্ষিত বলল--- কিছু বলবি? 

পারিজাত অকুণ্ঠিত--- হায়দ্রাবাদে বড় অফার পেয়েছি। অনসূয়াও পেয়েছে। নেক্সট মানডে চলে যেতে হবে। 

 

রক্ষিত বলল--- ভাল। গুড। আমি কিন্তু যাব না। 


এইটুকুই।


রক্ষিত ভাবল ওয়াকিং স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল। তবু ভাঙা ব্রিজটার কাছে এসে মনে হল দেরি হচ্ছে, ফিরেই যাই। অপরূপ একলা থাকতে ভয় পায় গতকালও বলেছে।




শুকনো ফুল

পড়ে আছে শুকনো ফুল যেমন।


পড়ে আছে লাল মোরামের পথ দিয়ে যে লরীটি নদীবালি খুঁড়ে আনতে ছুটে গেল তার ছড়ানো ধুলো সারা দেহে জড়িয়ে।


পড়ে আছে তেমাথায় মিলিয়ে গেছে যে পথটি তার কোলছোঁয়া বিপুলাকার পাকুড় গাছের তলায়। একটা হাত মাথার নিচে, একটা হাতে চটের থলি ধরা। 


হাটে যাচ্ছে যারা, যারা হাট থেকে ফিরছেও, চিনতে পারছে না। 


--- কে বটে?

--- চিনা না।


একটা শাদা লোমের পেছনেঘা নেড়িকুকুর নিকটে এসে অল্পক্ষণ দেখল। ফ্যাকাশেনীল আকাশ থেকে অবিরাম আগুন ঝরছে। কুকুরটির জিভ আধখানা বেরিয়ে। সে আর দাঁড়াল না, লেজ নাড়িয়ে যে দিক দিয়ে এসেছিল ফিরে গেল।


--- হাটুরিয়া?

--- লাগে নাই। 


--- ভাটি ফিরত? দমা লিছে বুঝি?

--- হবেক সে।


একটিও পাখি নেই আকাশে। 


--- রোগবিমার?

--- হবেক সে। 


--- পেট নাই বটে।

--- ভুখা তবে।


পড়ে আছে শুকনো ফুল যেমন। কেউ ভাবতে পারছে না মারা গেছে। কেউ ভাবতে পারছে না খেতে না পেয়ে মারা গেছে বলে যায়নি।





রেন্ডি

আগে দুবার বাচ্চা বিইয়েছে। একটা সাত দিনে মরেছে, একটা দশ দিনে। শেষ বাচ্চাটা বিইয়েই রেন্ডি তাকে বেচতে চেয়েছে। 


ধবধবে ফর্সা। চোখ-নাক সুন্দর। ভিকিরির বাচ্চা। বেচতে পারেনি। তার নাম হয়ে গেছে না বিকা। 


হুনুমান মন্দিরের ডান হাতে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় ভিকিরিদের মধ্যে বড় হতে হতে সে অনেকের আগে জেনে ফেলেছে বাচ্চা কী করে পয়দা হয়। 


মাকে সে একদিন জিজ্ঞেস করে, বল দেখি মা, আমার বাপ কে।


রেন্ডি নড়ে ওঠে। যেকেউ তাকে রেন্ডি বলে ডেকেছে, সে সাড়াও দিয়েছে।  তারও মা বলে কেউ ছিল, তার মুখ এখনও আবছা আবছা মনে পড়ে। নিজের নামও কিছু একটা ছিল, সে নাম সে নিজেই ভুলে গেছে।


রেন্ডি বলল, দেখ বেটা। ঠিকঠাক বলা মুশকিল। মটুরাম ছিল একজন। মন্দিরের এই পণ্ডিত, তার কেউ হয়। সে হতে পারে। 


রাস্তার আলো রেন্ডির মুখে এসে পড়েছে। না বিকা সেদিকে চেয়ে। রেন্ডি বলল, রেল প্লাটফর্মের দু-তিনটে পুলিশ, তাদেরও একজন হতে পারে। 


না বিকা চেয়ে আছে। মায়ের মুখের দিকে। রেন্ডি বলল, বাজারে ভিক মাগতে গেছি, বৃষ্টি পড়ছিল। আলু বেচে তাগড়া মুচ্ছা। সে ভি হতে পারে। 


রেন্ডি বলছিল, গোরস্তানের দিকে সন্ধেবেলা একটা মাতাল একবার নিয়ে গেছে। ও ভি হতে পারে। 


রেন্ডি বলছিল, তারপর--- 


রেন্ডির একজনের পর একজনকে মনে পড়তে থাকে। কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা। কেউ ফর্সা, কেউ কালো। কেউ বুড়ো, কেউ বাচ্চা। কেউ চোর কেউ পুলিশ। কেউ জুয়ারি, কেউ মাতাল। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম। এইরকম।


না বিকা বলল, থাম এবার। আমার বাপের তবে ঠিক নেই। মা তো আছে। আছে কী নেই বল। 


রেন্ডির চোখের পাতা অনেকদিন পর ভিজতে চাইছে। কেউ নেই, তবে একটা ছেলে তার আছে। 


অনেকদিন পর তার চোখের পাতা ভিজতে চাইছে। ভিজতে চাইছে তবে শুধু ছেলের জন্যেই না।






সাধন দাসের অণুগল্পগুচ্ছ


গল্পের খোঁজে

ফাঁকা বিকেল। মাথায় কোনো গল্প নেই। বাইরের গেটে এসে দাঁড়িয়েছি। বেরুবো। সামনে আড়াআড়ি রাস্তা। কোন দিকে গল্প পাওয়া যাবে ভাবছি। লোকটা ডানদিক থেকে আসছে, বাঁদিকে যাবে। রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। এবার লোকটি সামনে থেকে আসছে পিছন দিকে যাবে। মুখ নিচু। এক মনে হাঁটছে। ব্যস্ততা নেই, কুঁড়েমিও নেই। পাঁচজন মানুষের মতই অচেনা। অঙ্গভঙ্গিতে কোথাও কোনো গল্পের আভাস নেই। হাতে একটা হাটুরে ঢাউস ব্যাগ। তেল ময়লায় রক্তাভ রঙ কালচে হয়ে গেছে। মানুষটিকে ঘরগেরস্ত ছাড়া কিছু আন্দাজ করা চলে না। আজ হাটবার। লোকটা হাটের দিকে যাচ্ছে। পথে অমন শ’য়ে শ’য়ে ব্যাগ চোখে পড়বে। গল্পের সম্ভাবনা খুবই কম। 
ভাবছেন, ব্যাগ নিয়ে পড়েছি যখন ওতেই গল্প আছে। আমিও তাই আন্দাজ করেছি। ব্যাগটির পিছু নিয়ে লোকটাকে অনুসরন করলাম। পিছন থেকে সামনে যাচ্ছি। মানুষটার মতই সাদামাটা পথ। দিনের পর দিন শ’য়ে শ’য়ে লোক এই পথে আসছে যাচ্ছে। তাঁদের গায়ে পায়ে গল্পের ছিঁটে ফোঁটা থাকে না। লোকটা থামবে ভাবিনি। মোড়ের মাথায় একটা স্টেশনারি দোকানে উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ থেকে একটা বড়ো প্লাস্টিকের পুতুল, মিষ্টি শিশুর মতো, বের করে চুমু খেলো তারপর ফেরত দিলো। ঠিক নতুন নয়। গায়ের জামাটা নতুন। দোকানি নিতে চাইছে না। বচসা হলো। তবু নিলো। লোকটা কিছু পয়সা ফেরত পেলো। 
পুরনো পুতুল ফেরত কেনো? প্রশ্ন। প্রশ্ন যখন, গল্পের জন্ম হতেও পারে, লোকটিকে অনুসরণ করলাম। লোকটি শহরের দিকে যাচ্ছে। খনিক হেঁটে একটা ছোটখাটো বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়লো। বর্ণ পরিচয় দ্বিতীয়ভাগ, নামতা বই, একটা কালো শ্লেট সামান্য পয়সার বিনিময়ে বেচে দিলো। নিশ্চয় পুরনো বই শ্লেটগুলো বাড়িতে জঞ্জাল বাড়াচ্ছিলো। এরপর ঢুকে পড়লো একটা পুরনো পোশাক বিক্রির দোকানে। গোটা চারেক পুরনো ফ্রক বিক্রি করলো। ক্রেতা যখন বিক্রেতা, একটা গল্প হয়তো কাছাকাছি! যখন গেরস্ত বারবার নানান জিনিস প্রকাশ্যে বিক্রি করে, পুরনো হলেও বিক্রেতাকে চোর টোর ভাবা চলে না এবং গল্পের সম্ভাবনা কমে যায় কিন্তু টান থেকে যায়। সেই টানে হাঁটছি। 
ব্যাগওয়ালা লোকটি একটা কুচোকাঁচা কাচ্চাবাচ্চা ভর্তি ঘিনঘিনে বস্তির গলিতে ঢুকে পড়লো। রোগা কালো বেঁটে একটা লোককে পলিথিন তাঁবুর ভিতর থেকে ডেকে বের করলো। পকেট কুড়িয়ে ব্যাগওয়ালা এতক্ষণ বিক্রির সমস্ত পয়সা বেঁটে লোকটার হাতে তুলে দিলো। বেঁটে লোকটা একটা কোদাল কাঁধে আর ক্লান্ত ব্যাগওয়ালা ব্যাগ কাঁধে তার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলো। শহর পেরিয়ে নদীর প্রান্তে এসে দু’জন থামলো। কোদালওয়ালা নদীর পাড়ে মাটি খুঁড়ে বেশ বড়ো গর্ত তৈরি করলো। ব্যাগওয়ালা ব্যাগ থেকে একটি শিশুকন্যার মৃতদেহ বের করলো, নতুন ফ্রক গায়ে। প্লাস্টিক পুতুলটার মতো। লোকটি মুখনিচু করে একবার চুমু খেলো। কোদালওয়ালা মৃতদেহটা দ্রুত গর্তে চালান করে মাটি চাপা দিয়ে দিলো। তারপর ব্যাগ আর কোদালওয়ালা আধো অন্ধকারে দু’জন দুদিকে মিলিয়ে গেলো। 
সাধারনস্য সাধারন, শ’য়ে শ’য়ে লোক ঢাউস ব্যাগ হাতে হাঁটছে। আপনারাই বলুন, এটা কি গল্প হতে পারে?



আপাতত ইনজাংশন জারি আছে  

আমাদের ফ্ল্যাটে ছারপোকা ঢুকেছে। খাটের, তোষকের, সোফার ফাঁকে ফোঁকে অদৃশ্য হয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই রক্ত চুষে খায়। অথচ খুঁজে পাওয়া যায় না। বড়দার ছেলে খোকা, ছোটো। ছারপোকা চেনে না, বোঝেও না। ছারপোকা নির্বাধায় ওর রক্ত চুষে খায়। কামড়, চোষন, শোষন খোকার অভ্যেস হয়ে গেছে। কাঁদে না। ছটফটও করে না। কেবল গায়ে দড়া দড়া লাল দাগ পড়ে যায়। ফুলে থাকে। আবার মিলিয়েও যায়। হাত বুলোলে আরাম হয় বটে, ছারপোকার ব্যত্যয় কিছু ঘটে না। ঠাকুমার বয়স হয়েছে। চশমা খুলে শোয়, কিছু দেখতে পায় না। সেই সুযোগে ঠাকুমা জেগে থাকলেও ছারপোকা রক্ত খেয়ে যায়। বড়োদের রক্ত সাবধানে লুকিয়ে চুরিয়ে খেতে হয়।  

ছারপোকা নাকি, গো-মুর্খ, গরিব, ছোটোলোকদের ঘরে ঢোকে। জানাজানি হলে, মানসম্মান চলে যাবে এই ভয়ে ঘটনা চেপে রেখে, লক্ষণরেখা, টিক টোয়েন্টি, গরম জল অভিযান চালায়। কিছু হয় না। হবে কেনো? পাশের ফ্ল্যাটেও ছারপোকা। সম্মান যাওয়ার ভয়ে তাঁরাও চেপেচুপে থাকে। আমরা ছারপোকা তাড়ানো শুরু করলে পাশের ফ্ল্যাট থেকে আমাদের ফ্লাটে ঢুকে পড়ে। বাবা বিল্ডিং কমিটিকে উদ্যোগ নিতে বলেছিলো। সেক্রেটারি আড় চোখে তাকিয়ে, মুচকি হেসে চেপে গিয়েছে। আড় চোখে তাকানো মানে ছোটোলোক ভাবা। ছিঃ ছিঃ! বড়দা চুপিচুপি খোঁজ নিয়েছে, সবার ঘরেই ছারপোকা। এমন কি সেক্রেটারির ফ্ল্যাটেও। স্ট্যাটাস যাওয়ার ভয়ে কেউ উঁইচুঁই করে না। সবার সাথে ছারপোকাও মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। ঘরে ঘরে রক্ত চুষে খায়। বাবা উদ্যোগ নিয়েছে, এবার ঢি ঢি পড়ে যাবে!     

ছোটোপিসে উকুন ছারপোকা মশা জোঁক মারা সরকারি দপ্তরে মস্ত অফিসার। পিসি ছারপোকা তাড়ানোর এক্সপার্ট। তাঁকে ডেকে আনা হয়েছে। মা চুল আঁচড়ে দিতে গিয়ে দ্যাখে পিসির মাথায় উকুন। হায় হায়, উকুন যে ছোটোলোকেদের মাথায় হয়! পিসে বাড়ির জামাই, তার’পর মস্ত অফিসার, তাঁর বউয়ের মাথায় উকুন! চুপ! চুপ! সারা বাড়ি থমথমে। ছারপোকা শরীর থেকে রক্ত খায়। উকুন মাথার ঘিলু চোষে। শক্তি বুদ্ধি দুইই নাশ করে। ছারপোকা, উকুন দুইয়েরই রমরমা এখন আমাদের ফ্ল্যাটবাড়িতে।   
ঠাকুমা ফিসফিসিয়ে বললো- ছারপোকা একদিন হয়তো যাবে। উকুন কিছু করার নেই। মাদি উকুন এক রাতে সাতবার বিইয়ে ভোরে গনৎকারের কাছে গিয়ে হাত পেতে জিজ্ঞেস করে– গুণেটুনে দ্যাখো দিকি ঠাকুরমশাই বাঁজা হলাম নাকি?  
মা আরো চুপিচুপি বলে- জন্ম জন্মান্তরেও উকুন নিব্বংশ হয় না। নেড়া করে দিলেও না। যদি পিসির মুণ্ডুটাই উড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে একটা হিল্লে হয়। 
বৌদি মার কানেকানে বললো- পিসেমশাই ইচ্ছে করলেই রক্তচোষা বন্ধ করতে পারে, করে না। 
বাতাসেরও কান আছে। কী করে পিসি যেনো সব শুনে ফেলেছে। সরকারি দুঁদে অফিসারের বৌকে খুন করার ইচ্ছা! এ্যাটেম্প টু মার্ডার! অফিসারের কাজে সমালোচনা, সম্মানহানি! পিসির কথা মতো পিসেমশাই দিলেন আমাদের বাড়ির নামে কেস ঠুকে। মহামান্য আদালত আপাতত রক্ত চোষাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, অভিযানের উপর ইনজাংশন জারি করে রেখেছেন।


 

ছাতা 

আমি ফর্সা। যে কালো কদাকার লোকটির ঘরে থাকতাম, তিনি আমার বাবা কিনা জানি না। একজন গরিব ছাতা সারাইওয়ালা। কিন্তু বাবা ডাকতে হতো। ছাতার কাপড় দিয়ে আমাকে কালোরঙের একটা ফ্রক বানিয়ে দিয়েছিলেন। ফুটপাতে শতছিদ্র এক বিশাল ছাতা পুঁতে তার নিচে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে বসতেন। শতসেলাই, শতকালোর সমাহার ছাতাখানার নিচে ছায়াও নামতো শতছিদ্র কালো হয়ে।   

মা ভোরে বাবুর বাড়ি কাজে যেতো। কালো জামা গায়ে সুন্দর আমি থাকতাম বাবার কাছে। ছেঁড়া, ফুটো, বিকল, ছাতারা সারাই হতে আসতোই না। বাবার দিব্য অবসর। আমায় একটা কালোছাতা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা এতো ছোটো রোদ, বৃষ্টি থেকে আমি কেনো, বেড়ালছানা, কুকুরবাচ্চা কিছুই বাঁচতো না। অবসর সময় বাবা ছাতার কাপড়ের পুঁটুলি দিয়ে পুতুল বানিয়ে দিতেন। আমিও শিখে শিখে পুতুলের জামা বানাতাম। পুতুলের মাপে পুচকি ছাতাও বানিয়েছিলাম।   
দুর্যোগের সন্ধ্যেয় বাবা ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরতেন। তার নিচে আমি আমার ছাতি মাথায়, কোলে পুতুলের ছাতি মাথায় পুতুলগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।

রাতের দাওয়াই আমাকে কোলে বসিয়ে বাবা বাইরের প্রকৃতি দেখতেন, আর ভিতরে আমাকে। নিরেট অন্ধকারে ফর্সা আমি ধবধব করতাম। আমি ছিলাম বাবার স্বপ্ন। আমাদের টিনের ছাদ ছিলো ঝাঁঝরা। রোদ, বৃষ্টি, হিম, কিছুই আটকাতো না। ছাদের নিচে ছেঁড়া ফুটো ছাতাখানা বাবা মেলে ধরতেন। তার নিচে আমি আমার মাথায় ছোট্ট ছাতাখানা মেলে, আমার কোলে পুতুলগুলোর মাথায় পুচকি ছাতাও খুলে দিতাম। তবুও দুর্যোগ আটকাতো না। ছাদ, ছাতা, ছাতি, পুতুলের জামা পর্যন্ত ভেদ করে দুর্যোগ আমাদের অসহায় করে তুলতো। ছাতার দুর্ভেদ্য কালোয় আমরা কেউ কাউকে দেখতে পেতাম না।  অদৃশ্য মা তখন রান্না চাপাতো।  কড়াইয়ে গরম তেলে দুর্যোগের ফোঁটা ফোঁটা পড়ে ছ্যাঁত্‌ ছ্যঅ্যাাঁত্‌ আওয়াজ হতো। আমরা চমকে চমকে উঠে ভয় পেতাম। তবু খিদে আমাদের অপেক্ষায় থাকতো।  
দুর্যোগে খুন্তির আরো হৈ চৈ তুলে মা বলতো- আদিখ্যেতা দেখে গা জ্বলে যায়। কতোকাল মেয়ে কোলঘিরে রাখবা? মেয়ে, মানুষ হয়ে গেছে। এবার কাজে পাঠাও। নইলে খেতি পাবা না।  
স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ভয়ে বাবা কিছুতেই আমার বড়ো হওয়া স্বীকার করতেন না। বলতেন- খুকির জামাটা ছোটো হয়ে গেছে। নতুন মাপে জামা বানাতে হবে। 
মায়ের মাপে আমার জামা তৈরি বাবার হিম্মতে কুলোতো না। 
আমার বড়ো হওয়া ঠেকাতে রোজ বলতেন- কাল বানিয়ে ফেলবো। 
মা ঝগড়া বাঁধিয়ে বলতেন- কালে পেয়েছে তোমাকে। 
খ্যাংড়া তুলে তেড়ে আসার ভয়ে বাবা চুপ করে থাকতেন। একদিন মায়ের ষড়যন্ত্রে ছোটো জামার ভিতরে বড়ো আমি বাবুর বাড়ির কাজে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে ফিরে দেখলাম, ঢাউস ছাতার নিচে বাবা পুতুল কোলে বসে আছেন। 
বাবা বলতেন- পুতুলের জামা তৈরি শিখে গেছিস। একদিন ঠিক নিজের জামা তৈরিও শিখে যাবি।  



ধোপাঘাটের মাঠ

একখানা সাদাকালো ছবি। রঙীনের চল তখনও হয়নি। সোনালী রোদের আকাশে সকালের নীল। শ্যাওলা ধরা আয়না বসা নদী। আঘাটায় ধোপারা সারবেঁধে কাপড় আছড়ায়। হুঁশরাম হুঁশরাম … ধ্বনির কোরাসও সে ছবিতে ফুটে ওঠে। জোয়ারের নতুন জল এলে ভেসে যাওয়া ঘাসের জাজিমে আকাশ মিশে একখানা পরিপূর্ণ ছবি হয়ে থাকে!  

ছবির মাঝখানে, নাদায় ব্লিচিং, খাবারসোডা গোলা দুধসাদা তরল। ধবধবে সাদা কাপড় ডুবানো। কলঙ্কহীন সাদা হলে মাঠ ভরে মেলে ছেলেটা। কুচবক যেনো ডানা মেলে উড়িয়ে দেবে মাঠখানা।    
হেডমাস্টারের বৌ তখন মেয়েকে স্নান করাতে আনে। মেয়েটা নিসঙ্কোচে যায় নাদা ভর্তি উচ্ছ্বল ঝলমল দুধসাদা তরলের পাশে। মুগ্ধ চোখে দেখে, মাঠময় উজ্জ্বল ফর্সা কাপড়েরা; আর রোদ্দুরে পুড়ে বাদামি ছেলেটা স্বচ্ছ ঘামের নিচে যেনো গোটানো ডানা বেঁধে ছোটে।   মেয়েটি বলে- কুচবকের মতো বাদামি শরীর খুলে সাদা ডানা মেলে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াও। আমার ভালোলাগে। 
মেয়েটাকে খুশি করতে, ছেলেটা একটু ছায়ার জন্যে ভেসে যাওয়া মেঘের নিচে ছুটে ছুটে হয়রান হয়। ভাবে, সত্যিই কুচবক হয়ে সে উড়ে যাবে। হঠাৎ পা মচকে পড়ে গেলো সবুজ গালিচায়। মেয়েটি ছুটে গিয়ে বসে পড়লো ছেলেটির পাশে।    
ভিডিও না হোক, মেয়েটির ছুটন্ত কিংবা ছেলেটির খোঁড়া পায়ের পাশে বসে থাকা দু’ জনের একখানা স্টিল ছবিও নেই। 

হেডমাস্টারের বৌ মেয়েটিকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেলো- চল, তোর স্কুলের দেরি হয়ে যাবে। 
জল থেকে ছেলেটির কাছে উঠে আসতে চেয়ে এক বুক জলে মেয়েটা ব্যর্থ ঝাঁপায়। হাঁসফাঁস করে। কিন্তু বাঁধা মায়ের হাতে। মাঠ ভরা কাপড় পাহারায় বাঁধা ছুটন্ত ছেলেটির মতো। 
স্নান সেরে হেডমাস্টারের বৌ মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে ফিরে যাচ্ছে। ছেলেটা অবাক চোখে স্নানভেজা মেয়েটির স্কুলে যাওয়া দেখছে। গোপন ইচ্ছায় কখন ঘামে ভেজা খোঁড়াপায়ে স্কুলের দিকে সে-ও এগিয়ে গেছে, জানতে পারেনি। ভাবতো, মেয়েটাকে নয় স্কুলবাড়িটাকে। স্কুলবাড়ির সাথে বারান্দার মতো মেয়েটিকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে তাঁর মা। 
ভিডিও না হোক, চলন্ত স্কুলবাড়িটার সাথে ছেলেটির একখানা স্টিল ছবিও, না; নেই।   

মেয়েটা কি স্বামীর বারান্দায় বসে উল বোনে? নদীর ধারে সবুজ মাঠের ডিজাইন তোলে? ছেলেটা বড়ো হয়ে আজও নদীতে হুঁশরাম করে। ফর্সা কাপড় মেলে সবুজ মাঠটাকে সাদা করে। ছবিটা গল্পের না পড়া অক্ষরের মতো ক্ষয়ে, পোকায় কেটে ফেড হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হয়নি। কী করে হবে? ছবিটা তো দু’জনের কেউ তোলেইনি। ধোপাঘাটের মাঠে পড়ে আছে। 



আলুর দাম

প্যাসেঞ্জার চলে যায় টোটো-স্ট্যান্ডের দিকে। প্যাডলার করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে। পোড়ামবিলের দাম ২৫ টাকা বেড়ে ৬০ হয়েছে। শুকনো চেন কটকটায়, প্যাডেলে চাপ দিলে ঘাট ফসকে পা হড়কে যায়। কেরোসিন ৪৩ থেকে ১০০। টেমি, জ্বলে না। অন্ধকারে রিকসা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে বাজারের মোড়ে। সওয়ার নেই।  
 
আড়তে আলু বেড়েছে কেজিতে দু’ টাকা। খাইরুল মহাজনের ঘরে যেহেতু বাকিতে- দু’ টাকা বাড়তির আলু তিন টাকা বাড়তিতে কেনে। বাজার দরে সমান রাখতে কেজিতে এক টাকা লোকসান খায়।
নিলুবুড়ির পায়ে বাত। হাঁটতে পারে না। বাজারে দর কষাকষি করে ভাড়াটা বাঁচিয়ে রিক্সায় যায়। ভাড়া জোটাতে সবজি আনাজপাতি, আলুও কম কেনে। তাতেও রিক্সা ভাড়া কুলোচ্ছে না। ধার নেয়। অভাবি খরিদ্দারদের চাপে খাইরুল মহাজনের ঘরে মোটা টাকা দেনা করে ফেলেছে। 

কেলো চুপিচুপি ভাড়া কমিয়ে নিলুবুড়ির ভাড়াটা দখল নিয়েছে। সেদিন বুড়ি সবে কেলোর রিক্সায় উঠেছে। মহাজনের তাগাদাদার এসে খাইরুলের উপর চড়াও হয়েছে। আজও বিক্রিবাটা হয়নি। রোজ রোজ আদায় নেই। তাগাদাদারের চাকরিও থাকবে না। রাগের চোটে মেরেছে থাপ্পড়। ক্যাশ, আলু যা পেয়েছে, কেড়ে কুড়ে নিয়ে গেছে। রাগ থেকে রাগ। বাকির খরিদ্দার নিলুবুড়িকে রিক্সায় দেখে, খাইরুল মারলো ধাক্কা। মালকোচা মেরে কালু রেডি হচ্ছিলো। আলুর দাম বাড়া গরমে বুড়ি শুদ্দু রিক্সা গড়িয়ে ধাক্কা মারলো পিছনের রিক্সায়। পিছনের রিক্সা মারলো তার পিছনের রিক্সায়। রিক্সা থেকে রিক্সায় আলুর গরম গড়িয়ে চললো। শেষ রিক্সা সেলিমের। ব্রেক খারাপ। প্রাণপণ চেপেও দাঁড় করাতে পারলো না। হুমড়ি খেয়ে পড়লো ড্রেনে। আলুর দামের রাগ বাড়ছে। মালিককে গাল দিয়ে ঝাল মেটাতে গেলো সেলিম।  

মালিক রেগে আগুন। রিক্সা কেড়ে,  দুমদাম কিল ঘুষি চাপিয়ে দিলো সেলিমকে। আলুর গরমে সেলিম তখন টগবগিয়ে ফুটছে। ঘরে ঢুকে দেখে অন্ধকার। কেরোসিন ফুরিয়েছে সে জানে। তবুও বৌকে দিলো বেদম পিটিয়ে। বৌ জানলো না, বাজারে আলুর দাম বেড়েছে। এক ঘুষিতেই বৌ চিত হয়ে, অজ্ঞান। উপোসি মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে।  
হাঁচড়ে পাঁচড়ে খোকা মায়ের বুকে ঠেলে উঠেছে। আমসি বুক টেনে হয়রান। আলুর দাম বাড়লে বুকের দুধ কেনো শুকিয়ে যায়, খোকাও জানে না? চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছে। সেলিম মা ছেলে দু’জনকেই পেটাচ্ছে।  




জ্যাঠার মৃত্যু  

চোরের মন ভাঙা বেড়ায়। উজান জানতো, চোর হচ্ছে শেয়াল। এখন জানে, চোর ভাটির জ্যাঠা। উজান পাড়ার সব্বাইকে বলে দিয়েছে জ্যাঠা চোর। জ্যাঠা গুরুজন, উজানের বাবা চুরির খবর জেনেও না জানার ভান করে। দাদাকে সম্মান দেখায়। আসলে চিরাচরিত রীতিকে ভয় করে। জ্যাঠা সুবিধে মতো জ্যাঠা, সুযোগ বুঝে চোর, ওই হয়েছে মুশকিল। জমির আল বরাবর, শেষরাতের অন্ধকারে বসে খুসুর খুসুর। নতুন বেড়া বাঁধার অজুহাতে সীমানা চুরি করে। একটু একটু করে বেড়া এগিয়ে ভাটিদের  দিকে দখল বাড়িয়ে নেয়।  

বেড়ার এপার ওপার জুড়ে আকাশ ছোঁয়া কাঁঠাল বাগান। চারপাশ অন্ধকার করে আছে। জৈষ্ঠের শেষ। গাছে গাছে গাছপাঁঠা পেকে গাছপাকা দুধেল বকরি হয়ে আছে। বাগানের মাঝ বরাবর শরিকি ভাগ। সইসবুদ কিছু হয়নি। ওই হয়েছে সমস্যা। জ্যাঠা মাটিতে সিঁদ কেটে বেড়া এগুতে এগুতে উজানদের এপারের আকাশছোঁয়া গাছখানা ভাটিদের ওপারের বাগানে প্রায় ঢুকিয়ে নিয়েছে। এ গাছ গাঁয়ে বিরল। দু’খানা নেই। কাঁঠাল পাকলে চাঁপাফুলের গন্ধ ছাড়ে। গন্ধের এপার ওপার জ্ঞান নেই। দু’পার ম ম করে। কাঁঠাল পেকেছে। কচি শেয়াল গিয়ে আখড়ায় খবর দিলে শেয়ালদের বড়োমোড়ল এসে সরেজমিনে তদন্ত করে যায়। গাছখানা এখন দুই বাগানের  মাঝামাঝি। সীমানার এপারে অর্ধেক, অর্ধেক ওপারে। কাঁঠাল চুরির হক দু’পারের শেয়ালদেরই। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। দু’পারের শেয়ালরা মিলে যুক্তি ফেঁদে, পা টিপে টিপে ভোর রাতে বাগানে হাজির। 

শেষ রাতের অন্ধকারে জ্যাঠা, ফলের কথা না ভেবে, জলজ্যান্ত গাছ চুরির লক্ষ্যে জমি দখল নিচ্ছিলো। চুরি করা সাধনার কাজ। কোনো সাড়াশব্দ থাকে না। গাছের গোড়ায় জ্যাঠাকে অন্ধকার ঢিপির মতো দেখাচ্ছিলো। মাটির ঢিপি ভেবে মোড়োল শেয়াল চেপে বসলো কুঁজো মেরুদণ্ড ঝুঁকে পড়া জ্যাঠার পিঠে। জ্যাঠা শেয়ালদের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে চুপচাপ উপুড় হয়ে পড়ে রইলো। ভাবলো, একটু পরেই নেমে যাবে। বড়ো শেয়ালের পিঠে মেজো শেয়াল, মেজোর পিঠে সেজো, শেয়ালের পিঠে শেয়াল চড়ে… গাছে উঠে কাঁঠাল মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আয়েশ করে খেলো। তারপর দল বেঁধে নিঃশব্দে চলে গেলো। আমরা জানালা খুলে শুয়ে ছিলাম। টেরও পেয়েছি। শেয়ালদের চাপে চিঁড়ে চ্যাপ্টা জ্যাঠা বাঁচার জন্যে কুঁইকুঁই করেছিলো। বাবা সম্মান না বাঁচিয়ে যদি জ্যাঠাকে চোর বলে স্বীকার করতো, আমরা চুরির কাছে পৌঁছুতে পারতাম। চোর হলেও জ্যাঠা বেঁচে যেতো। কাঁঠালও বাঁচতো। দুই জমির সীমানার মাঝে জ্যাঠা মরে পড়েছিলো।  



ফ্যাঁসার মৃত্যু   

ওর নামের আগে না মাথায় চন্দ্রবিন্দু বসবে বুঝতে পারছিনে। ফেঁসা খুন হয়ে গেছে। কবে গঙ্গার বানে ভেসে এসেছিলো, কেউ জানে না। পাড়ে লাশ হয়ে পড়ে আছে। উলঙ্গ। সোনার বরণ রঙ, পাথর কোঁদা শরীর, ছ’ফুটের উপর লম্বা। কোঁকড়া আলুথালু চুল, টানা বাঁশির মতো নাক। রমনীরা লাজুক অবনত দৃষ্টিতে দেখে নেয়। যাকে কল্পনা মিশিয়ে রাতে গোপন কামনা করে। 

ফেঁসা গঙ্গার ঘাটে থাকে। মা একদিন চান করে উঠে, ঘাটের সিঁড়িতে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে শাড়ি তুলে যখন নিংড়াচ্ছিলো, ফেঁসা আড় চোখে মায়ের পায়ে তাকিয়েছিলো। মায়ের পা খুব সুন্দর। মা-ও লোভ সামলাতে পারেনি, ফেঁসাকে দেখেছে। বিধবা পিসি মার পিছনেই ছিলো, ফেঁসাকে দেখতে পায়নি। যাদের পা সুন্দর তাঁরাই কেবল ফেঁসাকে দেখতে পায়। 
ঠাকুমা যৌবনে গঙ্গার ঘাটে ওকে ছাই মেখে বসে থাকতে দেখেছে। আগের কালে সে জমকালো ঋষি ছিলো। লক্ষী, সরস্বতী, দুর্গা কোনো দেবীর পা দেখা যায় না, সে পা দেখার সাধনা করতো। ঠাকুমা বলেছিলো, তখন ওকে শিব ঠাকুরের মতো লাগতো। মা বলে এখনও লাগে। অতো সুন্দর শিবঠাকুরও নন। পিসি বলে চোখ বুঁজলে দেখতে পাই, স্বয়ং শিবঠাকুর। পৃথিবীর সব রমনীর সুন্দর পা দেখা না হওয়া পর্যন্ত ফেঁসা কতোবার মরবে ইয়াত্তা নেই।  

বউ বলে, আগেরদিনে জমিদার বাড়ির মেয়েরা পালকি চেপে গঙ্গায় যেতো। ঘাটে পালকি রেখে স্নানে নামতো। গোড়ালি দেখানোও ছিলো অশালীন। স্নান সেরে জল সপসপে কাপড়ে উঠে আসতো পাল্কিতে। ফেঁসা তখন আদুল সন্নাসী। দেখা যেতো নদীর পাড়ে। ধুনির ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে রমনীয় পায়ের দিকে এমন চেয়ে থাকতো, সুন্দরীর স্নান করা ভিজে শরীরও কেঁপে উঠতো। রাতে স্বামীর পাশে শুয়ে…… ছিঃ! ভাবতে নেই!   
পিসির মেয়ে বইতে পড়েছে। আরো আগে সুন্দরীদের পালকিশুদ্দু গঙ্গায় চুবিয়ে স্নান করানো হতো। পর্দা সরিয়ে পালকির ঘুলঘুলি পথে রমনীরা সন্ন্যাসীকে খুঁজতো। দেখতে না পেলে কল্পনায় ভাবতো, সোনার বরণ রঙ, পাথর কোঁদা শরীর, ছ’ফুটের উপর লম্বা। কোঁকড়া আলুথালু চুল, টানা বাঁশির মতো নাক। 

গায়ে কাদা মাখামাখি। ফেঁসা চিত হয়ে পড়ে আছে গঙ্গার পাড়ে। চোখ খোলা। শুয়ে আছে যেনো আকাশ দেখছে। মেয়ে বৌ বুড়ি পাগলের মতো ছুটছে। শেষবারের মতো দেখবে। পুরুষেরা আড় চোখে দেখে হাঁফ ছাড়ছে। রমনীরা আলু থালু বেশ, স্নান শুদ্ধ হয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠছে, উঠছে, উঠছে ……   
খুনি ধরা পড়েনি। সন্দেহ করা হচ্ছে, এক পোটুনিকে। সে গঙ্গার ঘাটে বসে আছে। হাতে গঙ্গার কাদা মাটি মাখা। ফেঁসার গায়ে মাথায় মাটি মাখিয়ে শিবের মূর্তি বানাচ্ছে। অন্যদিকে মাথায় গঙ্গাজল ঢেলে মাটির শরীর ধুয়ে দিচ্ছে রমনীরা। মাটির তৈরি ফেঁসা ধুয়ে মিশে যাচ্ছে গঙ্গার জলে। 



বুড়ি

উঠতে বসতে বুড়ি বুঝিয়ে দেয় রিটায়ার করলেই মদ্দামানুষ আকামের ধাড়ি হয়ে ওঠে। বৌকে কড়া হতে হয়।  
- আঃ ছ্যা, ছ্যা, পচা মাছ! কেউ পয়সা দিয়ে কেনে? সকাল সকাল বাজার যেতে পারো না? রিটায়ার করে মাথা কিনে নিয়েছো? ঘুমই ভাঙে না। কেনার সময় কি মেছুনির মুখে তাকিয়েছিলে? 
অফিসে রাশ ছিলো সরকারের হাতে। এখন বৌয়ের হাতে। অফিস করা-কালীন বাড়ির জমে থাকা হুমকিগুলো বেরিয়ে আসছে। 
- গাণ্ডে পিণ্ডে গিলছো? থালা উপচে ভাত পড়ছে। ধান চালের দর জানো? 
উত্তর দিয়ে লাভ নেই। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করলেই কাঁদুনে গ্যাস, ফোঁস্ফোঁস, জল কামান, প্যাঁএ্যাঁএ্যাঁ… ত্রাশন বাড়ে। তার মধ্যেই চলতে থাকে অক্লান্ত বক্তৃতা। মুখে মারিতং জগতে প্রধান মন্ত্রী কি পুরো ক্যাবিনেট ফেল।   
- ভীমরতি ধরেছে। মরণদশা! লুঙি খুলে খুলে যাচ্ছে। দেকতে পাচ্চো না? নাতি নাতনি বড়ো হচ্ছে, হুশ নেই? 
ভাত বন্ধ, ঘরে বন্ধ, শাসনে বুড়ির এসমা নাসা জলভাত হয়ে গেছে।

ছেলে, ছেলের বৌরা- যুবক যুবতী, ওদেরই তো অসহায় উদ্ধার করার কথা। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওরা মায়ের ব ক’লমে  নিজেদের দলে। আমাকেই ঠাসে। - দিনরাত মুখে টিভি গুঁজে বসে আছো, থাকো। ট্যাঁ ফোঁ করার দরকার কী?  
সামনে থাকি, না থাকি, বুড়ি বকবক করেই চলেছে। যতক্ষণ না ঘুমুচ্ছে, দুনিয়ার যতো নপুংশকতা, অক্ষমতার দায় আমার উপর। যে ক’টা টাকা পেনশান পাই, ট্যাক্স, ভ্যাট, সেস, গুষ্টিরমুন্ডু সরকারের মতো ভুজুংভাজুং দিয়ে কাঁড়িয়ে বের করে নিচ্ছে। তবু সব দোষ আমারই। আমার জন্যেই সংসারে বিশৃঙ্খলা, দেশ জুড়ে অরাজকতা, চিনের বাড়বাড়ন্ত, আমেরিকার শত্রুতা। 

ঘুমিয়েও বুড়ির চড়, চাপাটি, লাথি, বাক্য বুলেট চলতে থাকে। ভয়ে, টেনশানে ঘুম আসে না। 
- পাশে সারারাত জেগে থাকলে ঘুম আসে? উশখুশ উশখুশ... নিমুখো মিনসে ঘুমুতেও দেবে না! 
ভোর চারটে না বাজতে আবার শুরু হয়ে যায়। চারটে বেজে দশ হয়ে গেলো, বুড়ি কিছু বলছে না। কী ব্যাপার? উঁকি মেরে দেখি, বুড়ি চুপ। উঁহু, বিশ্বাস নেই। নাকে হাত দিই। সে কী? নিঃশ্বাস নেই! বুড়ি আর কিছু বলবে না? কোনোদিন কিছু বলবে না?   



খিদে

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই খুব খিদে পাই। স্থির থাকতে পারিনে। তপাদার মুদিখানার সামনে ঘোরাঘুরি করি। সাইকেল চালিয়ে শিবুদা আসে, তপাদার দোকানে বিড়ি সাপ্লাই দেয়। বেঞ্চে বসে ঘাম মুছে অর্ডার করে, চার আনার মুড়ি চানাচুর। 
আমি ফ্রকের নিচ থেকে একটা লঙ্কা, দুটো রসুনকোয়া বের করি। তপাদাকে বলি- মুড়িতে একটু ফ্রি সর্ষেরতেল দিও তো। 
তপাদা তেলের সঙ্গে এক টিপ লবনও দেয়। দু’জন মিলে হুড়মুড় করে খাই। 

শিবুদা আমার কেউ না। ফুটপাতে আমাদের ছোট্ট পানবিড়ির দোকানে বিড়ি সাপ্লাই দিতো। নগর সৌন্দর্যায়নে এসে বুলডোজার দোকানটা ভেঙে দিয়েছে। এখন আমরা খিদের ভাই বোন। সেদিন শিবুদা আসতে দেরি হচ্ছে। ইজেরের গাঁটিতে লঙ্কা ছুঁয়ে বসে আছি। আসছেই না। তপাদা গল্প বলে- ক’দ্দিন ধরে বিরিয়ানি খেতে খুব ইচ্ছে করছিলো। সবাই মিলে খাওয়ার পয়সা নেই, একদিন একা হোটেলে চলে গেলাম। চারজনের বিরিয়ানি নিলাম। একাই খাচ্ছি। খেতে খেতে গলা পর্যন্ত উঠে এলো। তারপরেও খাচ্ছি। খেতে আর ইচ্ছে করছে না। তবু খাচ্ছি। গা পাকাচ্ছে, তবু খাচ্ছি। অরুচি হচ্ছে। তবু খাচ্ছি।  নিজেকে বলছি, খাবিনে মানে? অতো গিলতে ইচ্ছে করে কোত্থেকে? খা। চটকে চটকে মুখের ভিতর গ্রাস ঠেসে দিচ্ছি। ঘেন্না করছে। তবু নিজেকে গেলাচ্ছি। আর কোঁৎ নিতে পারছি নে। বিরিয়ানি মুখে ঠেলে উঠে এলো। গা ঘুলিয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেল্লাম খাওয়ার টেবিলে। রেগে মেগে হোটেলওলা মাথার পেছনে এমন থাপ্পড় মারলো মুখ খুসে গেলো বমির মধ্যে। সারা গায়ে মুখে বমি। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো হোটেল থেকে। কোথাও নিজেকে না ধুয়ে সেই বিরিয়ানি মাখামাখি অবস্থায় শহরের ভিতর দিয়ে হেঁটে ফিরে আসছিলাম। বিরিয়ানির দুর্গন্ধে একটা, দুটো, করতে করতে এক ঝাঁক নেড়িকুত্তা আমাকে তাড়া করলো। ছুটে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে এলাম। সেই থেকে বিরিয়ানি খেতে ভয় করে।  

বুলডোজার ফুটপাতে পানবিড়ির দোকানগুলো ভাঙতে ভাঙতে চলে যাচ্ছে। আর বিড়ি সাপ্লাই দিতে শিবুদাকে আরো দূর যেতে হচ্ছে। ফিরতে রোজ একটু করে বেশি দেরি হয়। ক’দিন সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো। বুলডোজারের সাথে পাল্লা দিয়ে শিবুদা আজ নিশ্চয় আরো দূরে গেছে। ফিরতে রাত হচ্ছে। খিদেয় গা-র মধ্যে পাক দিচ্ছে। কাল আরো রাত হবে... পরদিন আরো……  
- তপাদা দেখো, একদিন মুড়ি চানাচুর না খেয়েই… বলতে বলতে হড়হড়িয়ে বমি করে ফেললাম। জল, সবুজ রঙের পিত্তি। এ্যাসিড। দুর্গন্ধ। নাক মুখ জ্বলে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় বললাম- আর খেতে ইচ্ছে করবে না। 



যোগিনদা 

- দেখছো না, হাঁপাচ্ছি। আজ রিক্সা টানতে পারবো না। 
রিক্সাস্ট্যান্ডে গাছটার সব পাতা ঝরে গেছে। একটুও ছায়া নেই। অভ্যেসে যোগিনদা তার নিচে বসেই এক মনে হাঁপাচ্ছে। গায়ে ঠা ঠা রোদ্দুর। হুঁশ নেই। বিশাল হাঁ করে দুনিয়ার সব বাতাস টানছে। ছাড়ছে। যেনো বাঁচতেই হবে, কোথাও দাসখৎ লেখা আছে। হাপড়ের মতো বুক উঠছে নামছে। 
রিক্সা না হলে আজ যেতেও পারবো না। দরাদরি করা আর টাকা কম দেওয়ার ওস্তাদিতে যা হোক মালকড়ি বেঁচেছে। খানিক সবজি বেশি কিনে ফেলেছি। ব্যাগ ভারী হয়েছে। সকালে পেট পুরে টিফিন করেই এসেছিলাম। কথায় বলে না, লোভ! বাজারের মধ্যেই ফের খান ছ’য়েক ডালপুরি, ফ্রি তরকারি, খান চারেক জিলিপির সাথে গলা পর্যন্ত জল খেয়ে ফেলেছি। আঁইঢাঁই অবস্থা। হেঁটে ফেরার ক্ষমতা নেই। স্ট্যাণ্ডে আর রিক্সাও নেই।
- তুমি না নিয়ে গেলে যাবো কী করে? আমিও তো হাঁপাচ্ছি।    
- তোমরা হাঁপাও খাওয়া বেশি হলে। আমি হাঁপাচ্ছি রাত থেকে খেতে পাইনি বলে। 
একদম ঠিক বলেছে। বেঁচে যাওয়া মালকড়ি এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। পকেট বাজিয়ে বলে দিলাম- বাড়ি পৌঁছে দাও। ভাড়ার সাথে ডালপুরি খাওয়ার টাকা দিয়ে দেবো। 

ছেঁড়া গেঞ্জিখানা উল্টে বাঁ কাঁধের হাড় বের করে আঙুল দিয়ে টিপে কলারবোন দেখালো- রিক্সা থেকে পড়ে, হাড়খানা বহুকাল ভাঙা। কাত হয়ে রিক্সা চালাই। হাঁপানির টানে বুকে ব্যথা। আজ কাত হতে পারবো না। কাত হয়ে চালিয়ে চালিয়ে হোল ফুলে ঢোল, ব্যথায় টাটাচ্ছে। দু’হাতের অঞ্জলি মেলে ফোলা অণ্ডকোষের মাপ দেখায়। 
যোগিনদা হাঁপাচ্ছে। ইশারায় জানালো, দাঁড়াও। অন্য রিক্সা আসুক। রোদ চড়ছে। বললাম - ব্যাগে কাঁচা মাছ। 
পেঁড়াপিঁড়ি করতে সাহস হলো না। যোগিনদার মুখ কাটা। কী বলতে কী বলে দেবে! মাছ পচে যাওয়ার দুশ্চিন্তা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। যোগিনদা আপন মনে বকে চলেছে- ছেলে থাকলে কে এই (‘ব’ কার দিয়ে শুরু জোড়া খিস্তি দিয়ে) রিক্সা টানতো। 
– তোমার ছেলেপুলে নেই? 
– (আবার খিস্তি দিয়ে) পোড়া কপাল, তিনখানা মেয়ে। 
- আজকাল মেয়েরাই তো ছেলে ধরে আনে।  
– একটা মেয়ে যক্ষ্মারুগি, বিধবা। তার দুই মেয়ে। আমার ঘাড়ে। একটা জামাই পকেটমার। আমারই পকেট মারে। আর একটা মেয়ে আয়বুড়ো মুখে রঙ ঘষে ঘুরে বেড়ায়। অন্ধকারে, একদিন আমাকেই ডেকেছিলো।  
কিছু বলার নেই। এমন অবস্থা হলে হাঁপানি হওয়ার আগেই হার্টফেল করতাম। যোগিনদা দেখলাম সামলে নিয়েছে। 
- ভাড়াটা আগাম দাও। ডালপুরি খেয়ে আসি। 
টাকা নিয়ে বললো - রিক্সায় উঠে বোসো। আসছি। 

খেয়ে, চাঙ্গা হয়ে যোগিনদা প্রায় দৌড়ে রিক্সা চালাবার সিটে এসে বসলো। -কাঁচা মাছ আছে আগে বলবে তো?  
বসার সিটে চিৎ হয়ে আমি এলিয়ে পড়লাম। গলা জ্বলছে। এ্যাসিড হয়ে গেছে। রিক্সা চলছে। 



চাবি

লোহার আলমারিটাকে যদি দুর্গ ভাবি, তালা বন্ধ চাবির ফুটো দিয়ে অনর্গল যে প্রতিরোধ বেরিয়ে আসে তাকে বুলেট ভাবলে, চাবিটাকে গেরস্থের পিস্তল ভাবতে কোনো অসুবিধে নেই। যদিও ভাড়া নেওয়া, পাঁচ বছরের এগ্রিমেন্ট, বাড়িটা আমার রাজত্ব।
রাত কতো হিসেব নেই। খুব গরম। ঘামে বিছানা ভিজে গেছে। দরকার মতো ঘুমের মধ্যে জেগে, জেগে থাকার মধ্যে ঘুমিয়ে আছি। এপাশ ওপাশ করছি। নিরাপত্তা রক্ষী যখন কালো পোশাক পরে বর্মের মতো লাগে। একজন লোক বর্মে ঢেকে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে। সোনাদানা, টাকাপয়সা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ, শান্তি, স্বপ্ন যা কিছু রোজগার করেছি ওই আলমারির মধ্যে গচ্ছিত। চুপি চুপি কেউ দখল নিতে চাইলে তাকে চোর বলতেই পারি। কী আশ্চর্য, চোরটাকে আমার মতোই দেখতে। 

চোরটার হাতে গেরস্থের সবখোল চাবির মতো পিস্তল। তালার ফুটোতে ঠেকানো। স্পষ্ট দেখলাম, প্রথম চোরটার পিঠে রিভলবার ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর একজন কালো বর্মে ঢাকা চোর। তার পিছনে আর একজন। তার পিছনে আর একজন। তার পিছনে... । চোরেদের মিছিল ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে পর্যন্ত চলে গেছে। কারো হাতে বন্দুক, কারো হাতে ঢাল, কারো লাঠির ডগায় রাষ্ট্রীয় পতাকা, পতপত করে উড়ছে। কারো তালুতে আইনের বই, কারো হাতে হাতুড়ি, এমন কি,অন্যহাতে সংবিধানও দেখলাম। আধোঘুমের একটা সুবিধে, শুয়ে শুয়ে সব কিছু দেখা যায়। 
লাইনের একদম শেষ চোর আমাকে ধমকে উঠলো- চোপ, চোখ বন্ধ।
ঘুমের ঘোরে চোখ বন্ধই। আধো স্বপ্নের ভিতরে বন্ধচোখ আবারও বন্ধ করেছি। ভয়ে গোল পাকিয়ে গেছি নিজের অজান্তেই । ঘোরের মধ্যে চোরের-ধমক মুখ দিয়ে একটানা বেরিয়ে চলেছে- চোপ, আমি চোপ। আমার সব চোপ। বন্ধ চোখের ভিতরে চোখ বন্ধ। ঠোঁটের ভিতরে জিভ বন্ধ, ঠোঁট বন্ধ। আমি চোপ ...

ঠেলা মেরে বউ ডেকে তুললো- ওঠো। বেলা হয়ে গেছে।
কাল থেকে আলমারির চাবি পাচ্ছিনে। উঠেই খুঁজতে লেগে গেলাম। মনেমনে খুঁজছি চোর। কে চোর? কোথায় চোর? অন্দর ছেড়ে বাইরে এলাম। কুত্তারা বাতাসে রেখে যাওয়া চোরের গন্ধ পায়। নেড়িগুলো বেদম ডাকছে। চোরটোর কিছু চোখে পড়লো না। প্রতিবেশী, রাস্তায় লোকজন, সব ঠিকঠাক চলছে। কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে ঘরে ঢুকছি। মনের ভিতরে শুনতে পাচ্ছি কুকুর ডাকছে। 




গোদা কাহিনি

পালের গোদাদের রমরমা চলছে। লুটেপুটে খাচ্ছে দেশ। বউয়েরা দিনরাত মিনসেদের কপালে ঝ্যাঁটা মারছে।
-যাও, গোদা হও। 
- গোদা না পারো পালের ঘেউ হও। 
- ঘেউ না পারো ফেউ হও।

কাঁহাতক! 
জগা, মাধা রেগেমেগে বেরিয়ে পড়েছে। ঘেউ ফেউ কেনো, গোদা হয়েই ফিরবে। পথের মাঝে মুখোমুখি দেখা। 
-মুই গোদা।
-তুই গোদা না, মুই গোদা।
ধুন্ধুমার। হাতাহাতি, রক্তারক্তি। শেষে গণাদা হাজির। দু জনেরই হাতজোড়। 
গম্ভীর গলায় গণাদা বললেন- দমের পরীক্ষা এভাবে নয়।
এঁদোপুকুর দেখিয়ে বললেন -যাও, সায়রে ডুব দাও। যে বেশিক্ষণ বেশি নিচে ডুবে থাকবে সেই গোদা।
গণাদার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বিচারের দায় নেওয়ার ফুরসুৎ নেই। ওদের ডুবিয়ে দিয়ে হাওয়া। জগার দম শেষ। মাথা তুলে দেখে মাধা ওঠেনি; কী সর্বনাশ! গোদা হতে পারবো না? অমনি দম নিয়ে ফের ডুব। মাধা উঠে দেখে জগা ওঠেনি। ফের ডুব। ডুবডুবডুব ডুব এঁদোতে দু’জন কাদা নোংরা মাখামাখি। ঠকডুবের খেলায় জগা মরে ম্যাঁড়াভূত। মাধা মরে এ্যাঁড়াভূত। ভূত হয়েছে তাতে কি? গোদা ভূত হয়েই ফিরবে। 

দুই ভূত ফের বেরিয়ে পড়ে অভিযানে। 
পথের মাঝে পড়েছিলো ট্যাঁরাব্যাঁকা এক বঁড়শি। ম্যাঁড়াভূত বললে- পড়ে পেয়েছি, খুঁটে খেয়েছি। বঁড়শি আমার।
এ্যাঁড়াভূত বললে -মরিমরি, পড়ে পেলাম চোদ্দআনা! আগে দেখেছি আমি, টঁড়শি আমার। 
- এটা বঁডশি 
– না। এটা টঁড়শি। 
- ঠিক আছে। বঁড়শি হলে আমার। টঁড়শি হলে তোর।    
ওসব লোক জানানো কথা। আসলে গোদা কে হবে? দুই ভূতে রাস্তা জুড়ে ধুন্ধুমার। চলাচল বন্ধ।   

ভয়ে ঢাকঢোলের গাঁ অস্থির। ধূপ ধুনো পুড়িয়ে দুই ভূতকে পুজো দিয়েই চলেছে। টাকডুমাডুম, কাঁইনানা বেজে কুল পাচ্ছে না। ভূতেদের ফয়সালা চাই। দু’জনেই হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করে- বল এটা কী? কে পাবে? নইলে টুঁটি টিপে ভূত বানিয়ে দেবো।    
ঢাক চোখ চুলকে গম্ভীর মুখে বলে- এটা বঁড়শি নয়!  
ঢোল চোখ পাল্টে গম্ভীর স্বরে বলে- টঁড়শিও না।
দু’জনেই মাথা ঝাঁকিয়ে একসাথে বলে ওঠে– বঁড়শিও না টঁড়শিও না ব্যাঁকা পানা ন’ (লোহা)
সঙ্গেসঙ্গে ঢাকঢোল বেজে ওঠে। ঢুমাঢুম টাক ডুমাডুম… তালে তালে ঢাকঢোলের গাঁ চিল্লিয়ে গাইতে শুরু করে- জয় ব্যাঁকানোয়া নন্দনো, ঢাকঢোলও বন্দনো। 
ভূত দুটো হাঁ। এ তাকায় ওর পানে, ও তাকায় এর পানে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন