প্রদীপ চক্রবর্তীর গদ্য 

"আবহমান বাংলা কবিতার দুই ব্যতিক্রমী স্বর , স্বদেশ সেন ও সুশীল ভৌমিক এবং তাদের কবিতা "




এক

স্বদেশ সেনের কবিতার আলোচনা :

স্বদেশ সেনের  "  স্বদেশ সেনের স্বদেশ " কবিতা সমগ্রটি ( এক )  প্রকাশিত হয়েছিল কৌরব প্রকাশনী থেকে বারীন ঘোষালের সম্পাদনায় | এই সমগ্রের প্রথম খণ্ডে আমরা পেয়ে যাচ্ছি ,  ক) কৌরব (সমবেত সংকলন) খ) রাখা হয়েছে কমলালেবু (সম্পূর্ণ) গ) মাটিতে দুধের কাপ (অংশত) ঘ) ছায়ায় আসিয়ো (অংশত) এবং  অগ্রন্থিত কবিতার কিছু।

 স্বল্প বয়সের প্রভাব, কবির মনের গভীরে রেশ রেখে যায়। মনের জমি তৈরি করে। অপ্রাসঙ্গিক হবে না ভেবেই তার কিছুটা মিলিয়ে দেখেনি-

বরিশালের বাখরগঞ্জে জন্ম মুহূর্তের কিছুকাল পরে স্বদেশ চলে আসেন পিতার কর্মস্থল জামশেদপুরে। টাটা বাবার ডেরায় তার বেড়ে ওঠা, কর্ম, জীবনের অনেকটাই। মাঝখানে বুড়ি ছুঁয়ে গেছে সেদিনের অবিভক্ত বাংলাদেশ। বরিশালের নদী, স্টিমার ঘাটা, সাদা বাতাস, নদী পারের একটানা বনরাজি, সারেঙ, গোয়ালন্দ, বারইকরণ গ্রাম, শারদীয় নীল আকাশ, পোনাবালিয়ার খালপাড়। নারকেল সুপুরি বাঁশঝাড় জামরুলতলা। ভূঁইচাঁপা কুর্চির ঝোপ ভাঁটফুল বেতবন লতানো আলোবাসি হলুদ রাস্তা গাবগাছ বাঁশের পোল বুড়ির বাড়ির জঙ্গল বিশাল পদ্মা। এরপর দাদার বাড়িতে লেখাপড়ার সুবাদে আড়িয়াদহ। মেছোপাখি যেভাবে পুকুরে আসে সেভাবে আড়িয়াদহ পাবলিক লাইব্রেরিতে দেশী বিদেশী বইয়ের অন্বেষণ, তৃষ্ণা মেটানো। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ থেকে বিষ্ণু দে সুভাষ মুখ্যোপাধ্যায় মঙ্গলাচরণ অরুণ মিত্র রাম বসুর কবিতার সঙ্গে আদ্যন্ত পরিচয়। পরে একনিষ্ঠ মার্কসবাদী। প্রগতিবাদী মহল থেকে ধীরে ধীরে পার্টির ঠুলি খুলে একদিন বেরিয়ে যাওয়ার টান। নিঃসঙ্গ কালপুরুষের খোঁজে সেই প্রবেশ প্রস্থান ছাপিয়ে ওঠে আবাল্য কৈশোরের গভীর প্রস্রবণে। তৈরি হন স্বদেশ। কবিতায় আজীবন রক্তের নিহিত ছায়ায় সেই সুদুরের চিরকালীনতা।

এক একজন কবি থাকেন যাঁদের কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া নতুন জ্বালানি। ঢেউ উঠে আসে দীর্ঘকালীন আকাশবাণীর আলো অবধি। শব্দের ধ্বনি ও উচ্চারণজাত শ্রুতির রশ্মিগুলি সাড়া দিতে থাকে মেঘের ভিতর থেকে বেরিয়ে চিরহরিতের পাতায়। তাই গহন ছবি আর শব্দের ভেতর অঙ্ক ধুয়ে ফেলা। ইন্দ্রিয়ঘেঁষা সাদা কালো রঙিন সান্ত্বনাগুলো আনন্দের সীমা পেরিয়ে সেতুটিকে বয়ে নিয়ে যায়, সুস্থ মনের অন্তর্গত শয়নভঙ্গীর মতো সহজে...

তাই স্বদেশ সেনের 'কবিতা সমগ্র-১' এর প্রথম কবিতার রেশটুকু আমাকে নাড়া দেয়। পাঠক দেখুন 'উপত্যকা থেকে নেমে' (১৪ পৃষ্ঠা) কবিতাটির প্রথম দুটি বাক্য...

'আর কোন ভার নেই, পত্রমোচীবন, এখন সহজ খুব ভেসে যাওয়া
কেমন সুন্দর ওই অবলীলা ময়ূর দেখেছো?'

মানুষের দিনযাপনের মতো কিংবা রাতমোচনের মতো, এই 'অবলীলা ময়ূর', আমাদের কত সহজে আনন্দে খুন করে দিয়ে যায়। এর পরেই, এই বইয়ের একদম শেষ কবিতাটি (১৫৯ পৃঃ) 'ঘুম কাক'। পাঠক অনুভব করুন:

'যা পারি না সেই তো পিপাসা
একদিনের পাতায় ব'সে আমাদের অদ্য-ভক্ষ খুব
বেশ খাওয়া খাওয়া হ'ল
জলের ঠ্যাঙের থেকে মাঝে মধ্যে জল-কাক পায়ে পায়ে উড়ে যায়
তারই মধ্যে ওইতো বাসনা-বাসা
তারই মধ্যে কুয়াশার গর্জে ওঠা ঘাস'

এই প্রথম থেকে শেষে, জটিলতাহীন লিরিক। এক সঙ্গীত আভা তুলে ধারাবাহিক সুতোয় নীল ছোপানো ফোঁটা ওড়ায়। আর সমস্ত বইটির মাঝে তার শাশ্বত প্রেম, বিষাদ, স্পৃহাহীন লেন্স ৩০০ লং ফোকাসে বিশেষ অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলছে। চলাটাই এফেক্ট। চলমানের ইম্প্রেশন। তলটান। ভেতরের এ্যাবস্ট্রাক্ট ডকুমেন্টেশন অপলক ভেজা ভেজা। পরিবেশনে শব্দের অশেষ ব্যবহার। পাখিরাও তো সমস্ত বর্ণমালা থেকে এভাবেই আলো তুলে নিতে চায় ঠোঁটে...



অনীলের জং এবং ওই অনীলার জং
অনীলের মত গলায় ওরা বুঁদ। ওদের ফোঁটা এখনো আসে ঠায় দাঁড়িয়ে রোজ। ডাক মাফিক অন্ধকার ফুঁড়েই ভেসে ওঠে আলতো জানলায়। বৃষ্টির বেড়ানো ছায়ারা  একটু নীচু হলে সোঁদা আঁচলের মৃদু শব্দে সংরক্ষিত প্রশ্বাসে ছড়িয়ে ভাবে। দু'একট অদ্ভুত রাস্তা। রাস্তার ওপারে জলের ঝরা তলপেট। ধুলোর ঝিম্ ধরা সাঁকো। আলো ঝেড়ে  কেউ কেউ রাস্তা তাড়াবার কৌশলে হাতের কলিতে ইশারা করে। রাস্তা, পানশালা টুপি ও অ্যাসাইলাম নিয়ে ঢুকে পড়ে সটান আরো মাথা ঘন আইলাইনার থেকে চৌরাস্তার ম্যাপটাকে টুকরো টুকরো করতে করতে। পাখিদের ব্লটিং হলো, শুধু থেকে যাওয়া মরশুমে আমাদের ঠুনকো তফাৎ বুঝিয়ে দিতে--

'মরা ঘুঘুর একটা, দরজা আছে...' (রাস্তায় যদুনাথ)

'রাখা হয়েছে কমলালেবুর' পাতায় পাতায় গয়না ঝরিয়ে প্রতিনিয়ত অশূন্য ও অনালোর মধ্যে দুঃখ থেকে দুঃখহীনতার আলোশেখা ক্রশিং। কোন ভুল রংএর ছোপ নয়। বাড়তির পালক নয়। ওজনে হাল্কা, কার্যকারিতায় জনশূন্য আকাশের নিচে বনের আড়াল থেকে ছিঁড়ে আসা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যাওয়া পৃথিবীর সুদূর সূর্যাস্তের মতো চিরকালীন--

'গায়ের মাজন পেয়ে রূপ বাড়াচ্ছে গাছ ও'
(মনোবাসিনী দিন)

'বহুদূর উঠে গেছে সুন্দরের আরো দূরে তুলে ধরা ছায়া'
(এবার জিনিসগুলি)

'এত পিয়ানোর টুল
ডাকগুলি বাজানো হল না
কালিতে সমস্ত কথা  নড়ে '
(একছিল চঞ্চলতা)
বা ,
'বনের মশলার থেকে যেভাবে রান্নার ফুল ফোটে
এই যে সময় তার শেষ থেকে বেশ কিছু দিও'
( এই যে সময় )

 স্বদেশের কবিতায় অংশবিশেষের মোহ নেই। আছে ভ্রমণের ঋদ্ধ সম্প্রসারণ।
ঘরে-বাইরে ভাবনার পার্শ্বচারিতা। নিজস্বতার রঙসাজানো ছুটির গান। সাজানো ঘরের সাজানো আসবাব থেকে ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে, মেঘের আলাভোলায়। আলোর ঢেউগুলো বোধের নীড় ছুট পাখি। শ্রবণের উৎসে, চেনা শব্দের নতুন ব্যবহার। নস্টালজিক অথচ যন্ত্রণার বিকলতা নয়। আনন্দের সাঙ্গীতিক বেঁচে থাকা। শব্দরঙের আস্থায়। ঝিরঝরে হাওয়ায় স্বর্ণলতার পলকা জাল ছিঁড়ে মনের খোপে খোপে নানা রঙের বৃষ্টি আর সাবেক গন্ধ নিয়ে সূক্ষ্মের আনীল শিখাস্পর্শী। শান্ত শালীন বড় আলোর লিরিকগুলো পারাপার ছুট নতুন ভূমিকায়। প্রবাহের অনবরত চোট সারিয়ে নিয়ে সহজ বন্ধুতার জীবন পর্যন্ত স্নান-। কারণ আমরা জেনে গেছি অনেক অব্যক্তকে অক্ষর নেয় না অনুভব নেয়। ভাষার ক্রমভাঙন থেকে শুরু হয় সামগ্রিক চলাচল। কথায় কথা বাড়ে। না বলা কথা না বলে থেকে যাওয়াতেই বিকল্প পায় আসলের রঙ-- 

'ইচ্ছে করে
 অনবরত ডাক ডাকি 
সব নিয়ে ডাকতে উঠি আবারকার ডাক 
নিয়ে রাখি সমস্তের ভেতর থেকে সব 
বিন্দু, রেখা, কোণ।'
(বড় আসা যাওয়া)

'এসেছি জলের কাছে কথা নিয়ে। 
জীবন পর্যন্ত স্নান যেখানে সেখানে আমি গা রেখে দিয়েছি
 এসেছি জলের কাছে।'
(এসেছি জলের কাছে)

'ঘুরিয়ে পরো তোমার পায়ের পাতা 
আমগাছ জামগাছ টপকে ফিরে আসছে পাথর ফিরে আসছে নৌকোডুবির নৌকো।'
(পিছু ডাক)

'আমার কথার ওপরে এলো তোমার কথা
 ফুটে উঠলে তুমি গ্রামের রেলগাড়ির মতো ধীরে একটা ঘাসের কায়দায় দাঁড়িয়ে শুনলে দুই কানে এ জীবন থেকে ওই অন্য জীবন কথা।'
(সাদা ফিল্মগুলি)

'স্তরে স্তরে নির্জনতা তোমার চিবুকবিন্দু
 হাতে ধরে থাকে
নাকি কোন প্রকৃত উন্মাদ
 ঋতুভাঙা কোয়া কুরে খায় 
প্রিয় তারপলিন ছেঁড়ে 
কামড়ে ধরে বীজের পাহাড় 
তার দুঃখ অবেলায়, তার দুঃখ সমস্ত পল্লীতে।
নতুন কোথায় থাকে, নতুনের কোন দুঃখ নেই?'
 (নতুনের কোন দুঃখ নেই)

 ওপরের এই সমস্ত পঙ্ক্তিতে যে আপক্ক রক্তিম মিথষ্ক্রিয়া, তার উৎসবিন্দুতো ছড়ানোই আছে আমাদের অনুভবে। এই অফুরন্ত দেখার স্ফুরিত চলসম্ভাবনা, যা একটি জীবনের সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকাকে অনন্য যাপনের ওপচানো উৎস থেকে, সৃষ্টির অচরিতার্থ শব্দের আদি অব্দি নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয়। চোখ রুচিসম্মত গুণে চলে। যাবতীয় ফুটপাতের জন্ম থেকে যাবতীয় একা, বিষণ্ণ উদাসীনতার বাইরে এই প্রেম, সম্পর্ক, চিরকালীন ঘাসবোধ, পাখির লুকনো মোহনায় খুলে আসে। আমরা বেপাড়ার লোক হয়েও পেয়ে যাই শব্দের সাজিতে ছড়ানো জলের অপলক অল্পলাল ভাষা...



লম্বা, ক্ষীণ, ইতস্তত আমাদের পাখি...
স্বাধীনোত্তর পঞ্চাশ। বাংলা কবিতার উচ্চকিত ও তীর্যক চিৎকারের কাল। সময়ের অভিঘাতে পৃথিবী ক্রমশ বদলে যাচ্ছে চরিত্রে। মননে পরোক্ষ যুদ্ধের সন্ত্রাস, একান্নবর্তী বাঙালির পারিবারিক মূল্যবোধের বিনষ্টস্ফোরিত তলানিতে ঠেকা, ব্ল‍্যাকআউটের থিতিয়ে যেয়েও না যাওয়া ফেউ, টাউট-ফঁড়ে-দালাল মধ্যসত্ত্বভোগীর লুটেপুটে নেবার প্রবণতা, ফুসফুসে ছিন্নমূলবেদনার পুরোনো কাসুন্দি গন্ধ, বেকার স্ফীতি, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে সারি সারি ঝুলে পড়া মাথা, এ'সবের মধ্যেই জমি দখলের মতো 'মিডিয়া' দখলের লড়াই।  'মিডিয়ার সম্প্রসারণ ও বহুমুখী বিস্তার' এই সময় থেকেই প্রায় শুরু। কবি স্বদেশ সেনের প্রাথমিক শুরুয়াত এই সময় থেকেই।

শুরুতেই তার সামনে দু'টি দিক। একদিকে চল্লিশের রক্তে বোনা ধানের স্বপ্ন নিয়ে প্রগতিবাদীর বা বাদের সংস্কার। যৌবনে যে ম্যানিফেস্টোর নিচে প্রতিটি স্বপ্ন দেখা যুবক দাঁড়িয়েছে, সংবেদনের গভীর থেকে। অন্যদিকে বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের প্রত্যক্ষ প্রভাব। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবিতার ছন্দের দোলানি। পয়ার-মহাপয়ার-মাত্রাবৃত্ত-অক্ষরবৃত্ত-স্বরবৃত্তের খেলা। এই সময়ের প্রায় প্রতিটি কবিই জীবনানন্দে সম্পৃক্ত। আর জীবনানন্দ হলেন সেই ব্যক্তি, যিনিই একমাত্র কোন রকম কবিতা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় না থেকে 'সুররিয়ালিজমের- ইজমকে আত্মসাৎ করে প্রয়োগ করেছিলেন সফলভাবে। এর ফলে পঞ্চাশের বহু কবিই জীবনানন্দকে ক্যাননাইজ করেছেন। বলা ভাল বাইরে থেকে একটা জীবনানন্দীয় উন্মাদনায় আচ্ছন্ন থেকে স্পষ্ট ভাষার মোহে আর কুহকের জালে আটকে পড়ে অনেকেরই শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে। পঞ্চাশের কবিতায় আবেগপ্রবণ রোমান্টিক ভাবালুতা, লিরিকধর্মী বাচন, অন্ত্যমিলের পদ্য, জ্যোৎস্নাস্নাত, ছন্দের প্রসাধন বিস্তার, কোমল নাগরিকপ্রেমে আচ্ছন্ন কৃত্রিম স্বপ্নাচ্ছন্নতা বা কিছুটা শারীরিক ইঙ্গিতময় সাহসী শব্দের প্রয়োগ ছাড়া গভীর ভাবে জীবনানন্দের জগতকে আত্মস্থ করার সহিষ্ণুতাও সেভাবে ছিল না এ' দশকের অনেকের। স্বদেশের সামনে এই দুয়ের হাতছানি ছিল বিস্তর। যখন তিনিও পার্টি সদস্য ছিলেন একনিষ্ঠভাবে। অন্যদিকে জীবনানন্দের রামভক্ত...। প্রথার সংস্কার ও স্বাধীনতার দ্বন্দ্বে স্বদেশ শেষপর্যন্ত বেরিয়ে এলেন নিজের মত করে এটাই অত্যাশ্চর্য! তিনি হয়তো বুঝেছিলেন, জীবনানন্দের ভাষার অনুকরণ অনুসরণ  চলতে পারে, এই ভাষা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করা আসলে কবির মৌলিক স্বর প্রকাশে  বাঁধা সৃষ্টি করে । জীবনানন্দকে আত্তীকরণ করা যেতে পারে বর্জনের পথে গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। জীবনানন্দের যে ভাষা উপলব্ধিসঞ্জাত সেখানে প্রবেশ করা, চক্রব্যুহে প্রবেশ করার মতই। অন্ধ-বিভ্রান্তির দিকে টেনে নিয়ে যায় কেবল! অন্যদিকে কোলাহলমুখর কল্লোলিনীর বাইরে জীবন ও জীবিকার জন্য বিচ্ছিন্ন থাকাটাও  তাঁর শাপে বর হয়েছে। একা, নিঃসঙ্গ, শান্ত, বেদনার্ত, বিষাদী   মন নিয়ে চুপচাপ কাজ করে গেছেন। ধ্রুপদী ঐতিহ্যের প্রতি স্বভাবসিদ্ধ শ্রদ্ধা এবং পরম্পরাকে মেনে নিয়েই। লিরিক্যাল থেকেই, পৃথিবীর গাঢ়-অবলীন ছায়ায়, মায়ায়, কালক্রমে নিজের অস্তিত্বকে তুলে নিয়ে গিয়ে। তাঁর কবিতা আকৃতিতে ছোট। কয়েকটি মাত্র গাঙ ছোপানো অবেলার টানে আঁকা খুচরো ঘরোয়া শব্দে। নতুন কোন শব্দ তৈরি করার সময় নয় সেটা। নতুন কোন আন্দোলন বা গোষ্ঠী চক্রে না থেকেই, অতি পরিচিত শব্দের পুনরাবিষ্কার ও পুনর্বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে চারপাশ থেকে ভেতর পাশের নির্মল গেরস্থালি। অথচ বিস্তারে, প্রয়োগে, দেখায়, ব্যবহারে, ভাষাকে অনীলে-নভোনীলে মিশিয়ে দূরের কাছের ছায়ায় সামান্য কাঁপিয়ে। বাড়ানো চোখের থেকে চিরদিনের স্বচ্ছ ভাসানো অলীক কিংবা আসল সিক্ততা থেকে শূন্যের ছড়ানো সুবায়। স্তরে স্তরে অসীমের নির্জনতা কেবল। কেবল সমস্তের ভেতর থেকে পার হয়ে যাওয়া অসম্ভবের মাপ নিয়ে।

'রাখা হয়েছে কমলালেবু'র পরবর্তী বিস্তার আমরা পেয়েছি 'মাটিতে দুধের কাপ', 'ছায়ায় আসিয়ো', অগ্রন্থিত কবিতাগুলোতেও। স্বদেশের নিজস্ব স্বরে আমরা প্রতিটি নতুন সম্ভাবনায় পেয়ে যাই, ষড়জ ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদের চিহ্ন। চৈতন্যের সৃজনকুশল সময়যানের লক্ষ্যভেদী হরিৎপাতার সুগন্ধ। সবুজ স্রোতায় উপল আকীর্ণ যাত্রা। প্রথায় প্রথাবিরুদ্ধ। অসুস্থ প্রতিবেশী কবির ক্লান্তি ও বিকারের শুশ্রূষার জন্য আরোগ্য কামনাও তার বিষয়হীন আনন্দসন্ন্যাস...

স্বদেশের কবিতার কেন্দ্রে পৌঁছে তার চারপাশটাকে যদি দেখি তাহলে পৃথিবীর মহাশূন্যের চারপাশে চেতনার প্রকারভেদ মানুষও অন্যান্য বস্তুর গাঢ় সজীবত্ব নিয়ে বস্তুপ্রাণ থেকে কেবল গুণাচরণে আলাদা আলাদা হয়ে যায় কত নতুন হয়ে। ক্ষয়ের পরিবর্তে বিশ্ব ও জীব কিংবা প্রকৃতির বিকাশ-বৃদ্ধি এবং সম্পর্কের অবিমিশ্রতাই অভিজ্ঞতার বাইরে স্বপ্ন ও কল্পনার যৌথ উদ্যোগে চিরকালীনতার ছাপ রেখে গেছে। কবি পেয়েছেন প্রতিটি উৎসের গন্ধ। বহুমুখী দূরের উৎস থেকে ভেসে আসা বস্তুর কার্যকারণ ঐ ঘটনা ভেদ করে চলে গেছে কল্পনার অসীম আলোর প্রতিসরণে। কাল্পনিক অভিজ্ঞতার স্মৃতি, ক্লিশে অলংকার ও মিথ ভেঙে দৃশ্য- শ্রাব্যের ধ্বনিত ও সংকেতময় শব্দে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের নিঃস্বন থেকে মানুষের বিকল্প গতিসত্তার ধ্বনিকে তুলে ধরেছে। নিথর ও সচলশব্দকে বুঝে নিয়ে কবিতায় দৃশ্যমান করে তুলেছেন তিনি। অনেক শব্দে এক একটা ভাব নয়, অনেক ভাবকে এক একটা শব্দে জড়ো করা। এ' ভাবেই বাতাসে টুসকি কেটে আঙুলে বাজিয়ে শব্দগুণ পরখ করতে করতে...
'একদিন নিমগাছের ওপর টি পড়লো টিয়ার আলসের ওপর কা ডাকলো নিয়মের কাক একদিন আস্তে আস্তে এমন রোদ হ'ল 
যে নিজেই টুকরো টুকরো তার ছায়ায়।' (মাটিতে দুধের কাপ/ভাইরে ভাই)

'পায়রা পিছলে যাবে 
এমনি হ'য়েছে আকাশ 
রোদ এমন 
যে কাগজে ছাপানো যায়। 
যত ছোট বড় ক'রেই তাকাও
 আর ধরে রাখো নিজেকে
 মনে হবে
 এই ছড়িয়ে গেলো 
এই কেঁপে উঠলো বুক।'
(মাটিতে দুধের কাপ/অস্থায়ী)

'বহুদূরের চেয়ারগুলি ক্রল করে সামনে আসে আর কথা বলে একমানুষ দু'মানুষ ধ'রে।'
(ছায়ায় আসিয়ো/বেল)

'দুধের বাছুর এই সকালে ঠাণ্ডা মুখে দুধ খাচ্ছে ভোরের এই দৃশ্য কিছু কম কথা নয় 
পরের কথায় লেবু হাতে কেউ আসছে
 কেউ গান গাইছে নিজের মনের মত
ভোরের ঠাণ্ডা কুয়াশা দিচ্ছে যেমন দেয়।' 
(ছায়ায় আসিয়ো/তবুও লিরিক)

'এক হাতে বোনা 
ভাতে ডাল-কলাই লেগে আছে
 কড়াই ধরে হাত উঠছে
 নোড়া লাগছে শিলে।'
( অগ্রন্থিত / ইলোপ )

'তিন তলা শাঁখ দিয়ে কে যেন বাজালো অল্প শাঁখ
মাছ ও অনন্ত মাখানো ঝোল
কার্বন একটু নীল হয়েই কার্বন ষ্টিল...'
(অগ্রন্থিত/সুপুরী তোমার সারি)

এই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া, উর্ধ্বাভিসার। লীন মনের জানা অজানা থেকে চির
পরাম্মুখ, দূরগামী মন। তুচ্ছতা কিংবা অর্থহীনতার মধ্যেও আশাতীত মুহূর্তের কত দেখাশোনায়। 'Mixed or Smeared out', শব্দের। প্রাণময় ও প্রাণহীন, জীবিত ও অতি জীবিত অবস্থানে সমগ্র শব্দজগৎ ঢুকে যায়। অনুভূতিসাপেক্ষ কিংবা পরিচিত দৃশ্যের মধ্যেও নির্জনতম কোরক। সীমানার ধারণাটি খারিজ হয়ে যাচ্ছে। তেজস্ক্রিয় ছাই, দূষণ, গ্রিনহাউস এফেক্ট, যুদ্ধ, দুরারোগ্য, ঘরের ভেতর বাইরে অসাম্য সম্পর্কের বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানুষের সাথে চারপাশের সাধারণ অথচ গভীরতম প্রকৃতির নাড়ির যোগাযোগই অস্তিত্বের প্রধান চাবিকাঠি। বর্ডারের পিওরিটি ভেঙে জীবন ও অতিজীবনের 'ফিউশন মিউজিক'। এর ফলে প্রতিটি মুহূর্তেই খণ্ডের মধ্যে 'ধক' করে ওঠে। তিনতলা শাঁখ, অনন্ত মাখনো ঝোল, পায়রা পিছলে যাওয়া আকাশ আর কেঁপে ওঠা বুক, জলের ব্যাঙ, ঘাসের ফড়িং, ঝোপের ঝিঁঝি, গেরস্তের খেলাঘর, অনিকেত ধুলোর যে জগৎ সেই সংসার পৃথিবীর, শব্দ থেকে ক্রমশ শব্দহীনতার দিকে ,আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখি টাটকা  চিরদিনের মুহূর্ত ফিরছে। মলিন চাদরে আমাদের এই সতীর্থ শরীরের ক্ষতগুলো ধুয়ে দিচ্ছে ডুব অবধি। এই ডাক পায়ে পায়ে ফুটে ওঠার...




আকাশটির পরে আলোটি থাকলে তবেই আকাশ 

আমি আমার বিষাদকে বুঝি। লিখে ফেলি কবিতা। নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে তাই
থাকতে পারি না। এই লিরিক আর প্রেমকে খুঁজতে চিরদিনের কাছে তাই শব্দকে চেয়ে বেড়াই। শব্দের ছলনা আর রহস্যতে দিশেহারা হয়ে যাই। খুব কষ্ট হয়, বোঝাতে পারি না। আমার সঙ্গে 'প্রদীপ' থাকতে থাকতে সেও আমি হয়ে ওঠে। আমার প্রদীপ কখনো কখনো শব্দের ওপর হামলে পড়ে। দলাই মলাই করে। দিনে দিনে ঝরতে ঝরতে নিষ্কাম হয়ে ওঠে, তবু বাসনা যায় না। মায়া থেকে মায়াহীন, অমেয় থেকে 'মেয়' টুকু নেয় কেবল। 'অ' তে গিয়ে শুরুয়াত করে। প্রতিটি ব্যর্থতাই ঝরে যায় আনন্দে। বিষাদেও আনন্দ পাই। চোখের জলেও বুক ভরা টলটল আনন্দ। এই আনন্দ দেব কাকে? আনন্দ থেকে আলোর এফ.এম। বিবিধ ভারতীর দুপুর ছাপিয়ে আনন্দ আসে ঝকঝকে কাঁসার থালায়। ভাতের গন্ধে সোনামুগ, ঝিঙে আলুপোস্ত, মৌরলা মাছের টক, পাটশাক, ঘরে পাতা দৈ নেমে আসে। কাঠফাটা রোদে কুয়োয় মেলা নীলমশারির তলায় আমার শৈশব ফালি জামা গায়ে ঘন জলের ঠাণ্ডা ছায়ায় জলের  মুক্ত পুরুষকে ছেড়ে দি শরীরে। জল ঢেলে ঢেলে ঘুমের অতলে জ্বালা ধরা প্রাগৈতিহাসিককে মিলিয়ে দি অব্যক্তে। অদৃশ্য হাতের শরীর থেকে ময়লা তুলি তার উদ্বেল মাছ ডিগবাজি খেয়ে নীলের গহন অভ্যন্তরে নিরাশ্রয়ে ছেড়ে দেয় আমায়। পাতা ঝরে, শিশির টোপায়। গোটা পাতার কিছুটা দেখেনি, ধারাবর্ষণের একা থেকে আরো একা হতে হতে। আকৃতিবিহীন প্রদীপ বিষাদিত অথচ ঝরাপাতার তলায় ক্রমে মাতোয়ারা, বুঁদ। অতলের ধ্বনি শুনতে পায়। যখন দেখি তারই মনের শেষ খরগোশের পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে কেউ সান্ত্বনা দেয়, চোখের জলের চুনো পুঁটিদের সঙ্গে নৌকো ভেসে যায় জনমানবহীন আনন্দে....

'জন্ম-পঙ্ক্তি থেকে একটা লাইন পড়
সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম একবার কাজ
পড় এমন করে, এমন অসাধারণভাবে পড়
যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড় ও সমানে ছড়িয়ে যায়।'
(রাখা হয়েছে কমলালেবু/কোথায় এক পরিবর্তন)

'শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন সবুজ পোলের কাছে; একমনে ঝরে যাওয়া ভালো।'
(ঐ/ব্রিজ পার হয়ে)

'বহুদূরে বুক খোলো, আমরা কোথায় রাখি
 এ জন্মের এতগুলি হাত 
 সমস্ত কবিতা দিয়ে এবারের নীলধরা পিপাসার জল' 
(ঐ/এবার জিনিসগুলি)

'কোন কোন চোট আমি অনেক সারিয়ে নিতে পারি 
সমস্ত মৌরির মতো আমিও অনেক সইতে পারি শুধু উপলক্ষ্য চাই একটু দূরে যদি আমি একা।'
(ঐ/যে তুমি মেরেছো)

'এ হাওয়ায় চরাচরের ধুলো আর পট্টবাস উড়ে যায়
সেই হাওয়ায় কি কোথাও কিছু কম?'
(মাটিতে দুধের কাপ/তবু কোথাও ছেলেমানুষি)

'যে শব্দ মট্ করে না শুধু হুস করে ওঠে 
কোন দ্রুম শব্দেও একটা ফুল ফোটায়'
(ঐ/রাজধানী এক্সপ্রেস)

আমাদের পৃথিবীর গাঢ় রঙ ক্রমশ ফিকে এবং সুরের তরঙ্গ-সঙ্গতি প্রক্ষেপে। ভেতরের দূষণ এখন বর্ণাশ্রমের রোগে। প্রকৃতি মানুষের তৈরি বাগানে, উপনিবেশিক। বোহেমিয়ান পাখিদের ছলাৎছল পলকে নতজানু। তবুও টুকনি পেতে নিঃশব্দ উদ্ভাস। আকাশকে খিলানের আকাশ করে পোলট্রি টানিয়ে বলছি 'সাঁকো নেই!' নীলিমার গণক শুনতে শুনতে কেঁপে উঠছে মস্তিষ্কের বিষণ্ণ পল্ললে। এই সেই উড়ো পাতা তিল তিল অনুভবে ফুরোয় না কেবল। যতই ভরুক মুখে পল্লবে অর্থহীন আত্মপ্রক্ষেপণ। দিশেহারা নয়। হতাশা নয়। পাকেচক্রে পড়া নয়। স্বদেশের মন চেয়েছে শুধু পৃথিবীর প্রতিটি অণু, প্রতিটি প্রাণের পল অনুপল সবুজ শুশ্রূষায় বেঁচে উঠুক। মানুষ হোক নির্ভার। শব্দে জীবনে প্রথায় প্রকাশে। প্রতিটি স্পন্দনবৃত্ত ভাঙা হোক। আয়ুতে চেতনায় বিস্তারে সামান্য অসামান্যের ভেদরেখায় ঝংকার  লাগুক। সবাই বেঁচে বর্তে উঠুক এমন উচ্চতায় এমন এক অসম্ভব উচ্চতায়, যেখানে মানুষ কেবল অবয়বে নয় ভেতর ফেরার অনবরত ডাক থেকে আকাশের ওপারের আলোয় যেন ধুয়ে যায়। সীমানার ওপারে নড়াচড়া করুক আরোগ্যবাসনা নদী। কোনো কিছুরই সীমা হয় না। শেষেরও শেষ হয় না। নীলচে আমনগন্ধে মথিত ঘাসও সাজানো  হয়। রেলবাঁধের ওই ওপারে শরিকে শরিকে জমির বিবাদই কেবল শেষ কথা নয়, বাহিরবন্দি মানুষেরও একটা সমস্ত রঙের পাখি থাকে ভোরের ঋতুমতী পাখিদের বিকল্পে। অবিরত দেহের রসে মিশে যায় ফিনকি দিয়ে কতকাল, নতুন হাওয়ার অনুবাদ...

'বাড়ো সবুজ দিশা, 
লাল ধুলোর সামনে
 বাগানের চড়াই পাখি বাড়ো।'
(মাটিতে দুধের কাপ/ প্রবাসে)

'না হওয়া মানুষ তার খোলা আয়নাতেও উঠে আসে না 
বৃষ্টিতে আগমন ক'রে এসে ফিরতে হয় 
কাদানো মাটিতে কথা এই যদি দুঃখের চাল 
তবে সুখের ভাত হয় না।'
(ঐ/অভিমান)

'ধরেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবে না কিছু তোমাকে আমার ব'লা হ'য়েও তা হবে না 
আমি যে থমকে গেছি তার চিহ্ন এই দেখো সামগ্রিক রঙ থেকে খোয়ানো আসল রঙ।'
(ঐ/অক্ষর নেবে না কিছু)

'প্রাণে কি সম্মতি ছিল, বিনোদবিহারী তবু বন্ধুত্ব ভেঙেছে সারাবেলা
 যে ভাবে সমস্ত ভাঙে; ফলে মন ভালো নেই কারো।
 পৃথিবীর এই মাঝ-মধ্যিখানে কবে যেন 
ভালো ছিল মন
আর মন ভালো নেই, আর মন ভালো নেই কারো।' (ঐ/ভালো নেই মন)

আরে তাতে কী? আমাদের তো খোঁজ চিরকালের। অনাগত বীজে, নিত্য জায়মান সম্পর্কে। মনখারাপের খোলাডাঙায় রক্তের মধ্যেই কেয়াপাতারা খেলা করছে অস্ফুট আনন্দে। আম্রমুখর, অপলক সেই বর্ণবেলার পুরো রাস্তাটাই। একপাতায় আমাদের বৃষ্টি নামে, ঠুনকো তফাৎ উপড়ে ফেলে... মমতায় বাজে বরাবরের সবকটি আঙুল...

'থাকতে গিয়ে শিখতে হলো ঝড়ের কাঠ জাপটে ধরতে 
ছন্ন পাতায় দূরের মুখে একটা ঘর বানাতে' (অগ্রন্থিত/যাওয়া)

'স্তনের অগ্র স্রোত হ'য়ে যায় 
 মা মরে না 
কারো মা 
পুরনো বেনারসী স্রোত হয় 
দুধের জলটাও দুধ।'
(ঐ/রকম)

'কুয়াশা চিরে রস রক্ত চুরি দেখালো জনৈক সময়ের আলো সেই সুবাদে টানা ব্যান্ডেজ হ'য়ে গেলো।' (ঐ/ব্যান্ডেজ)

'চোখে যে জল তা স্বভাবের চোখে নতুন ফোঁটা হয়ে উঠুক।'

(ছায়ায় আসিয়ো/বিশ্বলোকে একজন)





স্বদেশ সেনের কবিতা