প্রদীপ চক্রবর্তীর গদ্য 

"আবহমান বাংলা কবিতার দুই ব্যতিক্রমী স্বর , স্বদেশ সেন ও সুশীল ভৌমিক এবং তাদের কবিতা "




এক

স্বদেশ সেনের কবিতার আলোচনা :

স্বদেশ সেনের  "  স্বদেশ সেনের স্বদেশ " কবিতা সমগ্রটি ( এক )  প্রকাশিত হয়েছিল কৌরব প্রকাশনী থেকে বারীন ঘোষালের সম্পাদনায় | এই সমগ্রের প্রথম খণ্ডে আমরা পেয়ে যাচ্ছি ,  ক) কৌরব (সমবেত সংকলন) খ) রাখা হয়েছে কমলালেবু (সম্পূর্ণ) গ) মাটিতে দুধের কাপ (অংশত) ঘ) ছায়ায় আসিয়ো (অংশত) এবং  অগ্রন্থিত কবিতার কিছু।

 স্বল্প বয়সের প্রভাব, কবির মনের গভীরে রেশ রেখে যায়। মনের জমি তৈরি করে। অপ্রাসঙ্গিক হবে না ভেবেই তার কিছুটা মিলিয়ে দেখেনি-

বরিশালের বাখরগঞ্জে জন্ম মুহূর্তের কিছুকাল পরে স্বদেশ চলে আসেন পিতার কর্মস্থল জামশেদপুরে। টাটা বাবার ডেরায় তার বেড়ে ওঠা, কর্ম, জীবনের অনেকটাই। মাঝখানে বুড়ি ছুঁয়ে গেছে সেদিনের অবিভক্ত বাংলাদেশ। বরিশালের নদী, স্টিমার ঘাটা, সাদা বাতাস, নদী পারের একটানা বনরাজি, সারেঙ, গোয়ালন্দ, বারইকরণ গ্রাম, শারদীয় নীল আকাশ, পোনাবালিয়ার খালপাড়। নারকেল সুপুরি বাঁশঝাড় জামরুলতলা। ভূঁইচাঁপা কুর্চির ঝোপ ভাঁটফুল বেতবন লতানো আলোবাসি হলুদ রাস্তা গাবগাছ বাঁশের পোল বুড়ির বাড়ির জঙ্গল বিশাল পদ্মা। এরপর দাদার বাড়িতে লেখাপড়ার সুবাদে আড়িয়াদহ। মেছোপাখি যেভাবে পুকুরে আসে সেভাবে আড়িয়াদহ পাবলিক লাইব্রেরিতে দেশী বিদেশী বইয়ের অন্বেষণ, তৃষ্ণা মেটানো। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ থেকে বিষ্ণু দে সুভাষ মুখ্যোপাধ্যায় মঙ্গলাচরণ অরুণ মিত্র রাম বসুর কবিতার সঙ্গে আদ্যন্ত পরিচয়। পরে একনিষ্ঠ মার্কসবাদী। প্রগতিবাদী মহল থেকে ধীরে ধীরে পার্টির ঠুলি খুলে একদিন বেরিয়ে যাওয়ার টান। নিঃসঙ্গ কালপুরুষের খোঁজে সেই প্রবেশ প্রস্থান ছাপিয়ে ওঠে আবাল্য কৈশোরের গভীর প্রস্রবণে। তৈরি হন স্বদেশ। কবিতায় আজীবন রক্তের নিহিত ছায়ায় সেই সুদুরের চিরকালীনতা।

এক একজন কবি থাকেন যাঁদের কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া নতুন জ্বালানি। ঢেউ উঠে আসে দীর্ঘকালীন আকাশবাণীর আলো অবধি। শব্দের ধ্বনি ও উচ্চারণজাত শ্রুতির রশ্মিগুলি সাড়া দিতে থাকে মেঘের ভিতর থেকে বেরিয়ে চিরহরিতের পাতায়। তাই গহন ছবি আর শব্দের ভেতর অঙ্ক ধুয়ে ফেলা। ইন্দ্রিয়ঘেঁষা সাদা কালো রঙিন সান্ত্বনাগুলো আনন্দের সীমা পেরিয়ে সেতুটিকে বয়ে নিয়ে যায়, সুস্থ মনের অন্তর্গত শয়নভঙ্গীর মতো সহজে...

তাই স্বদেশ সেনের 'কবিতা সমগ্র-১' এর প্রথম কবিতার রেশটুকু আমাকে নাড়া দেয়। পাঠক দেখুন 'উপত্যকা থেকে নেমে' (১৪ পৃষ্ঠা) কবিতাটির প্রথম দুটি বাক্য...

'আর কোন ভার নেই, পত্রমোচীবন, এখন সহজ খুব ভেসে যাওয়া
কেমন সুন্দর ওই অবলীলা ময়ূর দেখেছো?'

মানুষের দিনযাপনের মতো কিংবা রাতমোচনের মতো, এই 'অবলীলা ময়ূর', আমাদের কত সহজে আনন্দে খুন করে দিয়ে যায়। এর পরেই, এই বইয়ের একদম শেষ কবিতাটি (১৫৯ পৃঃ) 'ঘুম কাক'। পাঠক অনুভব করুন:

'যা পারি না সেই তো পিপাসা
একদিনের পাতায় ব'সে আমাদের অদ্য-ভক্ষ খুব
বেশ খাওয়া খাওয়া হ'ল
জলের ঠ্যাঙের থেকে মাঝে মধ্যে জল-কাক পায়ে পায়ে উড়ে যায়
তারই মধ্যে ওইতো বাসনা-বাসা
তারই মধ্যে কুয়াশার গর্জে ওঠা ঘাস'

এই প্রথম থেকে শেষে, জটিলতাহীন লিরিক। এক সঙ্গীত আভা তুলে ধারাবাহিক সুতোয় নীল ছোপানো ফোঁটা ওড়ায়। আর সমস্ত বইটির মাঝে তার শাশ্বত প্রেম, বিষাদ, স্পৃহাহীন লেন্স ৩০০ লং ফোকাসে বিশেষ অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলছে। চলাটাই এফেক্ট। চলমানের ইম্প্রেশন। তলটান। ভেতরের এ্যাবস্ট্রাক্ট ডকুমেন্টেশন অপলক ভেজা ভেজা। পরিবেশনে শব্দের অশেষ ব্যবহার। পাখিরাও তো সমস্ত বর্ণমালা থেকে এভাবেই আলো তুলে নিতে চায় ঠোঁটে...



অনীলের জং এবং ওই অনীলার জং
অনীলের মত গলায় ওরা বুঁদ। ওদের ফোঁটা এখনো আসে ঠায় দাঁড়িয়ে রোজ। ডাক মাফিক অন্ধকার ফুঁড়েই ভেসে ওঠে আলতো জানলায়। বৃষ্টির বেড়ানো ছায়ারা  একটু নীচু হলে সোঁদা আঁচলের মৃদু শব্দে সংরক্ষিত প্রশ্বাসে ছড়িয়ে ভাবে। দু'একট অদ্ভুত রাস্তা। রাস্তার ওপারে জলের ঝরা তলপেট। ধুলোর ঝিম্ ধরা সাঁকো। আলো ঝেড়ে  কেউ কেউ রাস্তা তাড়াবার কৌশলে হাতের কলিতে ইশারা করে। রাস্তা, পানশালা টুপি ও অ্যাসাইলাম নিয়ে ঢুকে পড়ে সটান আরো মাথা ঘন আইলাইনার থেকে চৌরাস্তার ম্যাপটাকে টুকরো টুকরো করতে করতে। পাখিদের ব্লটিং হলো, শুধু থেকে যাওয়া মরশুমে আমাদের ঠুনকো তফাৎ বুঝিয়ে দিতে--

'মরা ঘুঘুর একটা, দরজা আছে...' (রাস্তায় যদুনাথ)

'রাখা হয়েছে কমলালেবুর' পাতায় পাতায় গয়না ঝরিয়ে প্রতিনিয়ত অশূন্য ও অনালোর মধ্যে দুঃখ থেকে দুঃখহীনতার আলোশেখা ক্রশিং। কোন ভুল রংএর ছোপ নয়। বাড়তির পালক নয়। ওজনে হাল্কা, কার্যকারিতায় জনশূন্য আকাশের নিচে বনের আড়াল থেকে ছিঁড়ে আসা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যাওয়া পৃথিবীর সুদূর সূর্যাস্তের মতো চিরকালীন--

'গায়ের মাজন পেয়ে রূপ বাড়াচ্ছে গাছ ও'
(মনোবাসিনী দিন)

'বহুদূর উঠে গেছে সুন্দরের আরো দূরে তুলে ধরা ছায়া'
(এবার জিনিসগুলি)

'এত পিয়ানোর টুল
ডাকগুলি বাজানো হল না
কালিতে সমস্ত কথা  নড়ে '
(একছিল চঞ্চলতা)
বা ,
'বনের মশলার থেকে যেভাবে রান্নার ফুল ফোটে
এই যে সময় তার শেষ থেকে বেশ কিছু দিও'
( এই যে সময় )

 স্বদেশের কবিতায় অংশবিশেষের মোহ নেই। আছে ভ্রমণের ঋদ্ধ সম্প্রসারণ।
ঘরে-বাইরে ভাবনার পার্শ্বচারিতা। নিজস্বতার রঙসাজানো ছুটির গান। সাজানো ঘরের সাজানো আসবাব থেকে ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে, মেঘের আলাভোলায়। আলোর ঢেউগুলো বোধের নীড় ছুট পাখি। শ্রবণের উৎসে, চেনা শব্দের নতুন ব্যবহার। নস্টালজিক অথচ যন্ত্রণার বিকলতা নয়। আনন্দের সাঙ্গীতিক বেঁচে থাকা। শব্দরঙের আস্থায়। ঝিরঝরে হাওয়ায় স্বর্ণলতার পলকা জাল ছিঁড়ে মনের খোপে খোপে নানা রঙের বৃষ্টি আর সাবেক গন্ধ নিয়ে সূক্ষ্মের আনীল শিখাস্পর্শী। শান্ত শালীন বড় আলোর লিরিকগুলো পারাপার ছুট নতুন ভূমিকায়। প্রবাহের অনবরত চোট সারিয়ে নিয়ে সহজ বন্ধুতার জীবন পর্যন্ত স্নান-। কারণ আমরা জেনে গেছি অনেক অব্যক্তকে অক্ষর নেয় না অনুভব নেয়। ভাষার ক্রমভাঙন থেকে শুরু হয় সামগ্রিক চলাচল। কথায় কথা বাড়ে। না বলা কথা না বলে থেকে যাওয়াতেই বিকল্প পায় আসলের রঙ-- 

'ইচ্ছে করে
 অনবরত ডাক ডাকি 
সব নিয়ে ডাকতে উঠি আবারকার ডাক 
নিয়ে রাখি সমস্তের ভেতর থেকে সব 
বিন্দু, রেখা, কোণ।'
(বড় আসা যাওয়া)

'এসেছি জলের কাছে কথা নিয়ে। 
জীবন পর্যন্ত স্নান যেখানে সেখানে আমি গা রেখে দিয়েছি
 এসেছি জলের কাছে।'
(এসেছি জলের কাছে)

'ঘুরিয়ে পরো তোমার পায়ের পাতা 
আমগাছ জামগাছ টপকে ফিরে আসছে পাথর ফিরে আসছে নৌকোডুবির নৌকো।'
(পিছু ডাক)

'আমার কথার ওপরে এলো তোমার কথা
 ফুটে উঠলে তুমি গ্রামের রেলগাড়ির মতো ধীরে একটা ঘাসের কায়দায় দাঁড়িয়ে শুনলে দুই কানে এ জীবন থেকে ওই অন্য জীবন কথা।'
(সাদা ফিল্মগুলি)

'স্তরে স্তরে নির্জনতা তোমার চিবুকবিন্দু
 হাতে ধরে থাকে
নাকি কোন প্রকৃত উন্মাদ
 ঋতুভাঙা কোয়া কুরে খায় 
প্রিয় তারপলিন ছেঁড়ে 
কামড়ে ধরে বীজের পাহাড় 
তার দুঃখ অবেলায়, তার দুঃখ সমস্ত পল্লীতে।
নতুন কোথায় থাকে, নতুনের কোন দুঃখ নেই?'
 (নতুনের কোন দুঃখ নেই)

 ওপরের এই সমস্ত পঙ্ক্তিতে যে আপক্ক রক্তিম মিথষ্ক্রিয়া, তার উৎসবিন্দুতো ছড়ানোই আছে আমাদের অনুভবে। এই অফুরন্ত দেখার স্ফুরিত চলসম্ভাবনা, যা একটি জীবনের সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকাকে অনন্য যাপনের ওপচানো উৎস থেকে, সৃষ্টির অচরিতার্থ শব্দের আদি অব্দি নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয়। চোখ রুচিসম্মত গুণে চলে। যাবতীয় ফুটপাতের জন্ম থেকে যাবতীয় একা, বিষণ্ণ উদাসীনতার বাইরে এই প্রেম, সম্পর্ক, চিরকালীন ঘাসবোধ, পাখির লুকনো মোহনায় খুলে আসে। আমরা বেপাড়ার লোক হয়েও পেয়ে যাই শব্দের সাজিতে ছড়ানো জলের অপলক অল্পলাল ভাষা...



লম্বা, ক্ষীণ, ইতস্তত আমাদের পাখি...
স্বাধীনোত্তর পঞ্চাশ। বাংলা কবিতার উচ্চকিত ও তীর্যক চিৎকারের কাল। সময়ের অভিঘাতে পৃথিবী ক্রমশ বদলে যাচ্ছে চরিত্রে। মননে পরোক্ষ যুদ্ধের সন্ত্রাস, একান্নবর্তী বাঙালির পারিবারিক মূল্যবোধের বিনষ্টস্ফোরিত তলানিতে ঠেকা, ব্ল‍্যাকআউটের থিতিয়ে যেয়েও না যাওয়া ফেউ, টাউট-ফঁড়ে-দালাল মধ্যসত্ত্বভোগীর লুটেপুটে নেবার প্রবণতা, ফুসফুসে ছিন্নমূলবেদনার পুরোনো কাসুন্দি গন্ধ, বেকার স্ফীতি, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে সারি সারি ঝুলে পড়া মাথা, এ'সবের মধ্যেই জমি দখলের মতো 'মিডিয়া' দখলের লড়াই।  'মিডিয়ার সম্প্রসারণ ও বহুমুখী বিস্তার' এই সময় থেকেই প্রায় শুরু। কবি স্বদেশ সেনের প্রাথমিক শুরুয়াত এই সময় থেকেই।

শুরুতেই তার সামনে দু'টি দিক। একদিকে চল্লিশের রক্তে বোনা ধানের স্বপ্ন নিয়ে প্রগতিবাদীর বা বাদের সংস্কার। যৌবনে যে ম্যানিফেস্টোর নিচে প্রতিটি স্বপ্ন দেখা যুবক দাঁড়িয়েছে, সংবেদনের গভীর থেকে। অন্যদিকে বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের প্রত্যক্ষ প্রভাব। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবিতার ছন্দের দোলানি। পয়ার-মহাপয়ার-মাত্রাবৃত্ত-অক্ষরবৃত্ত-স্বরবৃত্তের খেলা। এই সময়ের প্রায় প্রতিটি কবিই জীবনানন্দে সম্পৃক্ত। আর জীবনানন্দ হলেন সেই ব্যক্তি, যিনিই একমাত্র কোন রকম কবিতা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় না থেকে 'সুররিয়ালিজমের- ইজমকে আত্মসাৎ করে প্রয়োগ করেছিলেন সফলভাবে। এর ফলে পঞ্চাশের বহু কবিই জীবনানন্দকে ক্যাননাইজ করেছেন। বলা ভাল বাইরে থেকে একটা জীবনানন্দীয় উন্মাদনায় আচ্ছন্ন থেকে স্পষ্ট ভাষার মোহে আর কুহকের জালে আটকে পড়ে অনেকেরই শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে। পঞ্চাশের কবিতায় আবেগপ্রবণ রোমান্টিক ভাবালুতা, লিরিকধর্মী বাচন, অন্ত্যমিলের পদ্য, জ্যোৎস্নাস্নাত, ছন্দের প্রসাধন বিস্তার, কোমল নাগরিকপ্রেমে আচ্ছন্ন কৃত্রিম স্বপ্নাচ্ছন্নতা বা কিছুটা শারীরিক ইঙ্গিতময় সাহসী শব্দের প্রয়োগ ছাড়া গভীর ভাবে জীবনানন্দের জগতকে আত্মস্থ করার সহিষ্ণুতাও সেভাবে ছিল না এ' দশকের অনেকের। স্বদেশের সামনে এই দুয়ের হাতছানি ছিল বিস্তর। যখন তিনিও পার্টি সদস্য ছিলেন একনিষ্ঠভাবে। অন্যদিকে জীবনানন্দের রামভক্ত...। প্রথার সংস্কার ও স্বাধীনতার দ্বন্দ্বে স্বদেশ শেষপর্যন্ত বেরিয়ে এলেন নিজের মত করে এটাই অত্যাশ্চর্য! তিনি হয়তো বুঝেছিলেন, জীবনানন্দের ভাষার অনুকরণ অনুসরণ  চলতে পারে, এই ভাষা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করা আসলে কবির মৌলিক স্বর প্রকাশে  বাঁধা সৃষ্টি করে । জীবনানন্দকে আত্তীকরণ করা যেতে পারে বর্জনের পথে গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। জীবনানন্দের যে ভাষা উপলব্ধিসঞ্জাত সেখানে প্রবেশ করা, চক্রব্যুহে প্রবেশ করার মতই। অন্ধ-বিভ্রান্তির দিকে টেনে নিয়ে যায় কেবল! অন্যদিকে কোলাহলমুখর কল্লোলিনীর বাইরে জীবন ও জীবিকার জন্য বিচ্ছিন্ন থাকাটাও  তাঁর শাপে বর হয়েছে। একা, নিঃসঙ্গ, শান্ত, বেদনার্ত, বিষাদী   মন নিয়ে চুপচাপ কাজ করে গেছেন। ধ্রুপদী ঐতিহ্যের প্রতি স্বভাবসিদ্ধ শ্রদ্ধা এবং পরম্পরাকে মেনে নিয়েই। লিরিক্যাল থেকেই, পৃথিবীর গাঢ়-অবলীন ছায়ায়, মায়ায়, কালক্রমে নিজের অস্তিত্বকে তুলে নিয়ে গিয়ে। তাঁর কবিতা আকৃতিতে ছোট। কয়েকটি মাত্র গাঙ ছোপানো অবেলার টানে আঁকা খুচরো ঘরোয়া শব্দে। নতুন কোন শব্দ তৈরি করার সময় নয় সেটা। নতুন কোন আন্দোলন বা গোষ্ঠী চক্রে না থেকেই, অতি পরিচিত শব্দের পুনরাবিষ্কার ও পুনর্বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে চারপাশ থেকে ভেতর পাশের নির্মল গেরস্থালি। অথচ বিস্তারে, প্রয়োগে, দেখায়, ব্যবহারে, ভাষাকে অনীলে-নভোনীলে মিশিয়ে দূরের কাছের ছায়ায় সামান্য কাঁপিয়ে। বাড়ানো চোখের থেকে চিরদিনের স্বচ্ছ ভাসানো অলীক কিংবা আসল সিক্ততা থেকে শূন্যের ছড়ানো সুবায়। স্তরে স্তরে অসীমের নির্জনতা কেবল। কেবল সমস্তের ভেতর থেকে পার হয়ে যাওয়া অসম্ভবের মাপ নিয়ে।

'রাখা হয়েছে কমলালেবু'র পরবর্তী বিস্তার আমরা পেয়েছি 'মাটিতে দুধের কাপ', 'ছায়ায় আসিয়ো', অগ্রন্থিত কবিতাগুলোতেও। স্বদেশের নিজস্ব স্বরে আমরা প্রতিটি নতুন সম্ভাবনায় পেয়ে যাই, ষড়জ ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদের চিহ্ন। চৈতন্যের সৃজনকুশল সময়যানের লক্ষ্যভেদী হরিৎপাতার সুগন্ধ। সবুজ স্রোতায় উপল আকীর্ণ যাত্রা। প্রথায় প্রথাবিরুদ্ধ। অসুস্থ প্রতিবেশী কবির ক্লান্তি ও বিকারের শুশ্রূষার জন্য আরোগ্য কামনাও তার বিষয়হীন আনন্দসন্ন্যাস...

স্বদেশের কবিতার কেন্দ্রে পৌঁছে তার চারপাশটাকে যদি দেখি তাহলে পৃথিবীর মহাশূন্যের চারপাশে চেতনার প্রকারভেদ মানুষও অন্যান্য বস্তুর গাঢ় সজীবত্ব নিয়ে বস্তুপ্রাণ থেকে কেবল গুণাচরণে আলাদা আলাদা হয়ে যায় কত নতুন হয়ে। ক্ষয়ের পরিবর্তে বিশ্ব ও জীব কিংবা প্রকৃতির বিকাশ-বৃদ্ধি এবং সম্পর্কের অবিমিশ্রতাই অভিজ্ঞতার বাইরে স্বপ্ন ও কল্পনার যৌথ উদ্যোগে চিরকালীনতার ছাপ রেখে গেছে। কবি পেয়েছেন প্রতিটি উৎসের গন্ধ। বহুমুখী দূরের উৎস থেকে ভেসে আসা বস্তুর কার্যকারণ ঐ ঘটনা ভেদ করে চলে গেছে কল্পনার অসীম আলোর প্রতিসরণে। কাল্পনিক অভিজ্ঞতার স্মৃতি, ক্লিশে অলংকার ও মিথ ভেঙে দৃশ্য- শ্রাব্যের ধ্বনিত ও সংকেতময় শব্দে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের নিঃস্বন থেকে মানুষের বিকল্প গতিসত্তার ধ্বনিকে তুলে ধরেছে। নিথর ও সচলশব্দকে বুঝে নিয়ে কবিতায় দৃশ্যমান করে তুলেছেন তিনি। অনেক শব্দে এক একটা ভাব নয়, অনেক ভাবকে এক একটা শব্দে জড়ো করা। এ' ভাবেই বাতাসে টুসকি কেটে আঙুলে বাজিয়ে শব্দগুণ পরখ করতে করতে...
'একদিন নিমগাছের ওপর টি পড়লো টিয়ার আলসের ওপর কা ডাকলো নিয়মের কাক একদিন আস্তে আস্তে এমন রোদ হ'ল 
যে নিজেই টুকরো টুকরো তার ছায়ায়।' (মাটিতে দুধের কাপ/ভাইরে ভাই)

'পায়রা পিছলে যাবে 
এমনি হ'য়েছে আকাশ 
রোদ এমন 
যে কাগজে ছাপানো যায়। 
যত ছোট বড় ক'রেই তাকাও
 আর ধরে রাখো নিজেকে
 মনে হবে
 এই ছড়িয়ে গেলো 
এই কেঁপে উঠলো বুক।'
(মাটিতে দুধের কাপ/অস্থায়ী)

'বহুদূরের চেয়ারগুলি ক্রল করে সামনে আসে আর কথা বলে একমানুষ দু'মানুষ ধ'রে।'
(ছায়ায় আসিয়ো/বেল)

'দুধের বাছুর এই সকালে ঠাণ্ডা মুখে দুধ খাচ্ছে ভোরের এই দৃশ্য কিছু কম কথা নয় 
পরের কথায় লেবু হাতে কেউ আসছে
 কেউ গান গাইছে নিজের মনের মত
ভোরের ঠাণ্ডা কুয়াশা দিচ্ছে যেমন দেয়।' 
(ছায়ায় আসিয়ো/তবুও লিরিক)

'এক হাতে বোনা 
ভাতে ডাল-কলাই লেগে আছে
 কড়াই ধরে হাত উঠছে
 নোড়া লাগছে শিলে।'
( অগ্রন্থিত / ইলোপ )

'তিন তলা শাঁখ দিয়ে কে যেন বাজালো অল্প শাঁখ
মাছ ও অনন্ত মাখানো ঝোল
কার্বন একটু নীল হয়েই কার্বন ষ্টিল...'
(অগ্রন্থিত/সুপুরী তোমার সারি)

এই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া, উর্ধ্বাভিসার। লীন মনের জানা অজানা থেকে চির
পরাম্মুখ, দূরগামী মন। তুচ্ছতা কিংবা অর্থহীনতার মধ্যেও আশাতীত মুহূর্তের কত দেখাশোনায়। 'Mixed or Smeared out', শব্দের। প্রাণময় ও প্রাণহীন, জীবিত ও অতি জীবিত অবস্থানে সমগ্র শব্দজগৎ ঢুকে যায়। অনুভূতিসাপেক্ষ কিংবা পরিচিত দৃশ্যের মধ্যেও নির্জনতম কোরক। সীমানার ধারণাটি খারিজ হয়ে যাচ্ছে। তেজস্ক্রিয় ছাই, দূষণ, গ্রিনহাউস এফেক্ট, যুদ্ধ, দুরারোগ্য, ঘরের ভেতর বাইরে অসাম্য সম্পর্কের বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানুষের সাথে চারপাশের সাধারণ অথচ গভীরতম প্রকৃতির নাড়ির যোগাযোগই অস্তিত্বের প্রধান চাবিকাঠি। বর্ডারের পিওরিটি ভেঙে জীবন ও অতিজীবনের 'ফিউশন মিউজিক'। এর ফলে প্রতিটি মুহূর্তেই খণ্ডের মধ্যে 'ধক' করে ওঠে। তিনতলা শাঁখ, অনন্ত মাখনো ঝোল, পায়রা পিছলে যাওয়া আকাশ আর কেঁপে ওঠা বুক, জলের ব্যাঙ, ঘাসের ফড়িং, ঝোপের ঝিঁঝি, গেরস্তের খেলাঘর, অনিকেত ধুলোর যে জগৎ সেই সংসার পৃথিবীর, শব্দ থেকে ক্রমশ শব্দহীনতার দিকে ,আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখি টাটকা  চিরদিনের মুহূর্ত ফিরছে। মলিন চাদরে আমাদের এই সতীর্থ শরীরের ক্ষতগুলো ধুয়ে দিচ্ছে ডুব অবধি। এই ডাক পায়ে পায়ে ফুটে ওঠার...




আকাশটির পরে আলোটি থাকলে তবেই আকাশ 

আমি আমার বিষাদকে বুঝি। লিখে ফেলি কবিতা। নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে তাই
থাকতে পারি না। এই লিরিক আর প্রেমকে খুঁজতে চিরদিনের কাছে তাই শব্দকে চেয়ে বেড়াই। শব্দের ছলনা আর রহস্যতে দিশেহারা হয়ে যাই। খুব কষ্ট হয়, বোঝাতে পারি না। আমার সঙ্গে 'প্রদীপ' থাকতে থাকতে সেও আমি হয়ে ওঠে। আমার প্রদীপ কখনো কখনো শব্দের ওপর হামলে পড়ে। দলাই মলাই করে। দিনে দিনে ঝরতে ঝরতে নিষ্কাম হয়ে ওঠে, তবু বাসনা যায় না। মায়া থেকে মায়াহীন, অমেয় থেকে 'মেয়' টুকু নেয় কেবল। 'অ' তে গিয়ে শুরুয়াত করে। প্রতিটি ব্যর্থতাই ঝরে যায় আনন্দে। বিষাদেও আনন্দ পাই। চোখের জলেও বুক ভরা টলটল আনন্দ। এই আনন্দ দেব কাকে? আনন্দ থেকে আলোর এফ.এম। বিবিধ ভারতীর দুপুর ছাপিয়ে আনন্দ আসে ঝকঝকে কাঁসার থালায়। ভাতের গন্ধে সোনামুগ, ঝিঙে আলুপোস্ত, মৌরলা মাছের টক, পাটশাক, ঘরে পাতা দৈ নেমে আসে। কাঠফাটা রোদে কুয়োয় মেলা নীলমশারির তলায় আমার শৈশব ফালি জামা গায়ে ঘন জলের ঠাণ্ডা ছায়ায় জলের  মুক্ত পুরুষকে ছেড়ে দি শরীরে। জল ঢেলে ঢেলে ঘুমের অতলে জ্বালা ধরা প্রাগৈতিহাসিককে মিলিয়ে দি অব্যক্তে। অদৃশ্য হাতের শরীর থেকে ময়লা তুলি তার উদ্বেল মাছ ডিগবাজি খেয়ে নীলের গহন অভ্যন্তরে নিরাশ্রয়ে ছেড়ে দেয় আমায়। পাতা ঝরে, শিশির টোপায়। গোটা পাতার কিছুটা দেখেনি, ধারাবর্ষণের একা থেকে আরো একা হতে হতে। আকৃতিবিহীন প্রদীপ বিষাদিত অথচ ঝরাপাতার তলায় ক্রমে মাতোয়ারা, বুঁদ। অতলের ধ্বনি শুনতে পায়। যখন দেখি তারই মনের শেষ খরগোশের পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে কেউ সান্ত্বনা দেয়, চোখের জলের চুনো পুঁটিদের সঙ্গে নৌকো ভেসে যায় জনমানবহীন আনন্দে....

'জন্ম-পঙ্ক্তি থেকে একটা লাইন পড়
সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম একবার কাজ
পড় এমন করে, এমন অসাধারণভাবে পড়
যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড় ও সমানে ছড়িয়ে যায়।'
(রাখা হয়েছে কমলালেবু/কোথায় এক পরিবর্তন)

'শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন সবুজ পোলের কাছে; একমনে ঝরে যাওয়া ভালো।'
(ঐ/ব্রিজ পার হয়ে)

'বহুদূরে বুক খোলো, আমরা কোথায় রাখি
 এ জন্মের এতগুলি হাত 
 সমস্ত কবিতা দিয়ে এবারের নীলধরা পিপাসার জল' 
(ঐ/এবার জিনিসগুলি)

'কোন কোন চোট আমি অনেক সারিয়ে নিতে পারি 
সমস্ত মৌরির মতো আমিও অনেক সইতে পারি শুধু উপলক্ষ্য চাই একটু দূরে যদি আমি একা।'
(ঐ/যে তুমি মেরেছো)

'এ হাওয়ায় চরাচরের ধুলো আর পট্টবাস উড়ে যায়
সেই হাওয়ায় কি কোথাও কিছু কম?'
(মাটিতে দুধের কাপ/তবু কোথাও ছেলেমানুষি)

'যে শব্দ মট্ করে না শুধু হুস করে ওঠে 
কোন দ্রুম শব্দেও একটা ফুল ফোটায়'
(ঐ/রাজধানী এক্সপ্রেস)

আমাদের পৃথিবীর গাঢ় রঙ ক্রমশ ফিকে এবং সুরের তরঙ্গ-সঙ্গতি প্রক্ষেপে। ভেতরের দূষণ এখন বর্ণাশ্রমের রোগে। প্রকৃতি মানুষের তৈরি বাগানে, উপনিবেশিক। বোহেমিয়ান পাখিদের ছলাৎছল পলকে নতজানু। তবুও টুকনি পেতে নিঃশব্দ উদ্ভাস। আকাশকে খিলানের আকাশ করে পোলট্রি টানিয়ে বলছি 'সাঁকো নেই!' নীলিমার গণক শুনতে শুনতে কেঁপে উঠছে মস্তিষ্কের বিষণ্ণ পল্ললে। এই সেই উড়ো পাতা তিল তিল অনুভবে ফুরোয় না কেবল। যতই ভরুক মুখে পল্লবে অর্থহীন আত্মপ্রক্ষেপণ। দিশেহারা নয়। হতাশা নয়। পাকেচক্রে পড়া নয়। স্বদেশের মন চেয়েছে শুধু পৃথিবীর প্রতিটি অণু, প্রতিটি প্রাণের পল অনুপল সবুজ শুশ্রূষায় বেঁচে উঠুক। মানুষ হোক নির্ভার। শব্দে জীবনে প্রথায় প্রকাশে। প্রতিটি স্পন্দনবৃত্ত ভাঙা হোক। আয়ুতে চেতনায় বিস্তারে সামান্য অসামান্যের ভেদরেখায় ঝংকার  লাগুক। সবাই বেঁচে বর্তে উঠুক এমন উচ্চতায় এমন এক অসম্ভব উচ্চতায়, যেখানে মানুষ কেবল অবয়বে নয় ভেতর ফেরার অনবরত ডাক থেকে আকাশের ওপারের আলোয় যেন ধুয়ে যায়। সীমানার ওপারে নড়াচড়া করুক আরোগ্যবাসনা নদী। কোনো কিছুরই সীমা হয় না। শেষেরও শেষ হয় না। নীলচে আমনগন্ধে মথিত ঘাসও সাজানো  হয়। রেলবাঁধের ওই ওপারে শরিকে শরিকে জমির বিবাদই কেবল শেষ কথা নয়, বাহিরবন্দি মানুষেরও একটা সমস্ত রঙের পাখি থাকে ভোরের ঋতুমতী পাখিদের বিকল্পে। অবিরত দেহের রসে মিশে যায় ফিনকি দিয়ে কতকাল, নতুন হাওয়ার অনুবাদ...

'বাড়ো সবুজ দিশা, 
লাল ধুলোর সামনে
 বাগানের চড়াই পাখি বাড়ো।'
(মাটিতে দুধের কাপ/ প্রবাসে)

'না হওয়া মানুষ তার খোলা আয়নাতেও উঠে আসে না 
বৃষ্টিতে আগমন ক'রে এসে ফিরতে হয় 
কাদানো মাটিতে কথা এই যদি দুঃখের চাল 
তবে সুখের ভাত হয় না।'
(ঐ/অভিমান)

'ধরেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবে না কিছু তোমাকে আমার ব'লা হ'য়েও তা হবে না 
আমি যে থমকে গেছি তার চিহ্ন এই দেখো সামগ্রিক রঙ থেকে খোয়ানো আসল রঙ।'
(ঐ/অক্ষর নেবে না কিছু)

'প্রাণে কি সম্মতি ছিল, বিনোদবিহারী তবু বন্ধুত্ব ভেঙেছে সারাবেলা
 যে ভাবে সমস্ত ভাঙে; ফলে মন ভালো নেই কারো।
 পৃথিবীর এই মাঝ-মধ্যিখানে কবে যেন 
ভালো ছিল মন
আর মন ভালো নেই, আর মন ভালো নেই কারো।' (ঐ/ভালো নেই মন)

আরে তাতে কী? আমাদের তো খোঁজ চিরকালের। অনাগত বীজে, নিত্য জায়মান সম্পর্কে। মনখারাপের খোলাডাঙায় রক্তের মধ্যেই কেয়াপাতারা খেলা করছে অস্ফুট আনন্দে। আম্রমুখর, অপলক সেই বর্ণবেলার পুরো রাস্তাটাই। একপাতায় আমাদের বৃষ্টি নামে, ঠুনকো তফাৎ উপড়ে ফেলে... মমতায় বাজে বরাবরের সবকটি আঙুল...

'থাকতে গিয়ে শিখতে হলো ঝড়ের কাঠ জাপটে ধরতে 
ছন্ন পাতায় দূরের মুখে একটা ঘর বানাতে' (অগ্রন্থিত/যাওয়া)

'স্তনের অগ্র স্রোত হ'য়ে যায় 
 মা মরে না 
কারো মা 
পুরনো বেনারসী স্রোত হয় 
দুধের জলটাও দুধ।'
(ঐ/রকম)

'কুয়াশা চিরে রস রক্ত চুরি দেখালো জনৈক সময়ের আলো সেই সুবাদে টানা ব্যান্ডেজ হ'য়ে গেলো।' (ঐ/ব্যান্ডেজ)

'চোখে যে জল তা স্বভাবের চোখে নতুন ফোঁটা হয়ে উঠুক।'

(ছায়ায় আসিয়ো/বিশ্বলোকে একজন)





স্বদেশ সেনের কবিতা 






দুই 

সুশীল ভৌমিকের কবিতা ও কবিতার আলোচনা :



অন্ধকারের কারুশিল্পী

২২শে অক্টোবর ২০০৭ ব্যক্তিজীবন ও কবিতায় শেষ পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছিলেন কবি সুশীল ভৌমিক। মুখের পাইপে অম্বুরি তামাকের  ধোঁয়া। মৃদুল সুবাসে ঘর দোর জুড়ে পুরনো বেলার গন্ধ। অন্তর্মুখী প্রচার বিমুখ এই মানুষটি মৃদু শুদ্ধ উচ্চারণে যেন নিজেকেই বলে যাচ্ছেন... আমি পুনঃমার্জনার পক্ষপাতী ছিলাম না-এজন্য যে প্রত্যেক মুহূর্তের মানুষ আলাদা, অসত্যের সম্ভাবনাও থেকে যেত না তাহলে।...

৬০-এর কবি সুশীল ভৌমিক। কৃষ্ণচন্দ্র এবং ননীপ্রভা ভৌমিকের অন্যতম সন্তান, ময়মনসিংহের পারুলিতলায় (এখন বাংলাদেশ) জন্ম পরে রায়তগঞ্জ বহরমপুরে বড় হওয়া। দেশভাগ যার শৈশবকে দু'টুকরো করে দিয়েছিল। যার ব্যক্তিক ক্ষত তিনি সযত্নে বহন করেছেন অনেক অনেক বছর ধরে। একসময় সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে প্রভূত  খ্যাতি। ১৯৫৭'য় প্রথম, কলকাতার  একটি পত্রিকায়  কবিতা ছাপা হয় । যদিও যাট দশকে তাঁর লেখালেখির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেন তৎকালীন পূর্বাশা পত্রিকার প্রখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। পরে তাঁর স্নেহধন্য হন। নিয়মিত ভাবেই পূর্বাশা পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। প্রচার ও প্রকাশ বিমুখ এই কবির প্রথম কবিতার বই 'আমি, তবু' প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। বাংলা কবিতাকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছানোর বাসনায় সম্পাদনা শুরু করেন 'Poetry International'... যার কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায় । ২০০৪-এ দ্বিতীয় কবিতার বই 'নির্বাচিত কবিতা' প্রকাশিত হয়। কমল চক্রবর্তী সম্পাদিত 'বাংলা কবিতার ষাটের দশক' এবং সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত ' ষাটের  কবিতা'য় সংকলিত হয় তাঁর কবিতা।

এও বাহ্য। আসলে যে কোনও মানুষেরই দুটো জগৎ থাকে। শুধু ব্যবহারিক অনভ্যাসে, দ্বিবিধ সত্তারা বিন্যাসে ও বোঝাপড়ার অভাবে চেতনাশ্রিত ও চেতনাবিবর্জিত মানুষের অভিনীত পার্থিব রক্তমাংসের চরিত্রটির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে একটা মৌলিক পার্থক্যে প্রকট হয়ে ওঠে। প্রত্যহ অভ্যাসে, যে চরিত্রটির মধ্যে আমরা বাস করি তার সামাজিক পরিচিতি নিয়ে ভিন্নজগতের সূক্ষ্ম-সংবেদী, খুব বেশি মাথা ঘামান না। অভিনয়টাই দৈনন্দিন চাহিদা অনুযায়ী বাহ্যিক চারিত্রিক অভ্যাসে পরিণত হয়। কিন্তু চেতনাশ্রিত ব্যক্তি তাঁর বাহ্য পরিচয়ে খুব বেশি স্বস্তিতে থাকেন না। তার প্রয়োজন হয় দ্বিতীয় পৃথিবীর। যদি তিনি সতর্ক ও সাবধানে দ্বিতীয় পৃথিবীতে নিজের চরিত্র বলা ইমেজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে আহ্লাদিত হন তাহলে তার বাহ্য- প্রচারিত প্রথম পৃথিবীতে তিনি হয়ে পড়েন চরিত্রহীন, মামুলী লোক, স্মরণ অযোগ্য ও সবার দুঃখের ও বিরক্তির কারণ। এমন কি কবি হলে তো কথাই নেই। তাঁর গুণগত মানদণ্ডের বদলে পরিমাপ করা হয় তিনি কত বেশি পুরস্কৃত, সংবর্ধিত এবং বাজার প্রচল পত্রিকার দ্বারা প্রচারিত ও এস্টাব্লিস্ট। সেটাই হয়ে ওঠে স্তুতিবাদের তাৎপর্যপূর্ণ চাহিদা। সেটা পূরণে ব্যর্থ হলেই নেমে আসে নিরন্তর নখ দাঁতের হিংস্র আক্রমণ। আর প্রথম পৃথিবীর সফল ব্যক্তি দ্বিতীয় পৃথিবীতে বিনষ্ট হন লোভের ডালপালা মেলে। প্রবৃত্তির তাড়নায় কিংবা আনুগত্য আদায়ের জন্য ক্রমাগত নিজেকে ক্ষয়িষ্ণু ব্যূহের ভেতর বিশ্বস্ত হয়ে ওঠার নিরাপদ তাগিদে। এর প্রমাণ অনেক। কিন্তু দুটো পৃথিবীতেই ঠিক ঠিক ভাবে অভিনয় করা এবং অতি সাবধানে আপন মগ্নতায় দ্বিতীয় পৃথিবীতে নির্লিপ্ত চরিত্রচিত্রণে পারঙ্গম হ'য়ে ওঠেন খুবই কম ব্যক্তি। সুশীল ভৌমিক এই বিরল গোত্রের একজন। যা তাঁর অনেক  শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখে শুনেছি।

সুশীল ভৌমিকের কবিতার বই প্রথম আমার হাতে আসে ২০০৭ এর ডিসেম্বরে। প্রথম পঠনে খুব বেশি মুগ্ধতা ছিল না। সেই সময় বাংলা সাহিত্যের সমান্তরাল ধারার লেখালেখি নিয়ে বা অপরাপর নতুন কবিতা নিয়ে যে যে আলোচনা হচ্ছিল কয়েকটি পত্রপত্রিকায় যেমন 'কৌরব', 'কবিতা ক্যাম্পাস', 'নতুন কবিতা', 'কবিতা পাক্ষিক', 'ভিন্নমুখ', 'চিত্রক', 'এখন বাংলা কবিতা পত্রিকা', 'কালিমাটি', প্রভৃতি, সেই সময়, পত্রিকার বিশেষ বিশেষ অনেক সংখ্যায় তিনজন কবিকে নিয়ে নতুনভাবে বা বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন শুরু হয়। তাঁর হলেন স্বদেশ সেন, শ্যামল সিংহ, এবং অবশ্যই সুশীল ভৌমিক। সেই সমস্ত আলোচনা আমাকে গভীরে নাড়া দেয়। নতুন ভাবে সুশীল ভৌমিকের 'নির্বাচিত কবিতা' পড়তে শুরু করি এবং এই দ্বিতীয় ও পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কয়েকবার পুনর্পঠনে নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হতে থাকেন, আমার কাছে এই কবি। এক বিদগ্ধ দিশা, যার স্পর্শে মানব মনের আলো অন্ধকার আর সম্পর্ক ভাবনা ঋদ্ধ হয় অন্তর্দীপ্ত হয় মৌনমুখর আমাদের অসংখ্য আত্মপ্রতিকৃতিগুলিতে। যে শূন্যতা বিষাদিত, যার আলো ছায়া মোহমুক্ত দৃষ্টিপাতে দুরূহতম বোধের অতলশীর্ষ স্পর্শ করে অপ্রতিরোধ্য প্রাতিস্বিকতাবোধে। যেখানে অস্তিত্ব সূক্ষ্ম জীবনচর্যার তীব্র সচেতনতা থেকে অন্তর্বাস্তবতায় প্রোথিত সেই স্ববিরোধী প্রাতিস্বিকতা ও চারিত্রিক বিরোধী সংশয়গুলোও যেন মিলেমিশে গেছে সুশীলের নিজস্ব লেখনীর আত্মক্ষয়ী মননজগতের দুর্বলতাগুলো নিয়েই। যদিও একটা আক্ষেপ থেকে গেছে আমার। জীবিত অবস্থায় কোনমতেই তার সঙ্গে আলাপ হয়ে ওঠেনি।

ত্রিশ দশকে বাংলা আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অগ্রগণ্য রবীন্দ্রনাথ তখন চিত্রী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত দেশে বিদেশে। অন্যদিকে বিশ শতকের পৃথিবীব্যাপী মন্দা, স্বদেশী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক নষ্টামি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দুঃসময় তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ যতদিন ছিলেন, পশ্চিমে জীবন প্রণালীর বিপরীতে ভারতীয় সংস্কৃতির উচ্চতা ও সৌন্দর্য আমাদের নিরুপকরণ দৈনন্দিন জীবনকে আনন্দময় করে রেখেছিল। আশ্চর্য, ঐ একটি মানুষের অভাবে, কিছুটা সহজ আত্মপ্রতিষ্ঠারও কারণে শেষপর্যন্ত তিরিশের কবিতা ভারতীয়তা ছেড়ে পশ্চিমের মুখাপেক্ষী হয়েছিলো। কেউ ইউরোপীয় কবিতা আঁকড়ে ধরেছিলেন, কেউবা ছবি ভাস্কর্যে সংগীতে পশ্চিমের শিল্প বিশ্বে, কেউ দর্শন ও জীবন প্রণালীতে। সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে-র আধুনিক-ধ্রুপদীয় বিষণ্ণ ঔজ্জ্বল্য থেকে ছড়িয়ে পড়েছিলো নব- আধুনিকতায়। কিন্তু এর প্রাক সূচনাপর্বে, ক্রান্তিকারি হিসেবে যেভাবে আধুনিক বৈশিষ্ট্যের সংজ্ঞায়, সংজ্ঞায়িত না হয়েও যাদের কবিতা আধুনিকতার প্রাক সূত্র হিসেবে আলোচকদের কাছে সবিশেষ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে তাঁরা হলেন যৌবনদীপ্ত- প্রতিবাদী ও সাম্যভাবনায় অটুট নজরুল, শরীরিপ্রেম-মদিরতা কিংবা যুক্তির মসৃণতায় মোহিতলাল মজুমদার এবং নৈরাশ্যের সংকটে চিহ্নিত কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। এদের লেখায় স্বকীয় বাস্তবতা তখন রবীন্দ্রনাথের চেয়েও কখনো কখনো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তরুণ জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব, প্রেমেন্দ্র মিত্র কিংবা অচিন্ত্য কুমারের কাছে।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আধুনিকতারও পরিবর্তন ঘটে। ত্রিশ দশকের কবিদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে যেমন মুক্ত হতে পারেন নি ৫০-এর অনেক কবি, ঠিক সেভাবেই ছয়ের দশক কালখণ্ডটি ঐতিহাসিক, সামাজিক ও বাংলা কবিতার দিক থেকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে ৮০-র কবিদের, নব্বই-এর কিছু কিছু কবিকে এমনকি শূন্য দশক ও তৎপরবর্তী অনেক তরুণ কবিকে এই দশক প্রভাবিত করে যাচ্ছে। কেন?

ঐ দশকের দিকে তাকালে আমরা দেখি, একদিকে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধ। কমিউনিস্ট দলের বিভাজন, খাদ্য সংকট, নজিরবিহীন ছাত্র আন্দোলন, প্রথম অকংগ্রেসী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ ও ভেঙে যাওয়া। এ-ছাড়া নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূচনা অন্যদিকে বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন, পরীক্ষা নিরীক্ষা মূলত ইওরোপীয় আন্দোলনের বঙ্গীকৃত আমদানী যার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্দোলন ছিল হাংরি এবং শাস্ত্রবিরোধী, শ্রুতি ও ধ্বংসকালীন 'আন্দোলন। যদিও এই সমস্ত আন্দোলন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত থাকা সত্ত্বেও সেভাবে বিশ্বাসী ছিলেন না সুশীল ভৌমিক। বিশিষ্ট কবি বারীন ঘোষাল একবার সুশীল ভৌমিককে প্রশ্ন করেছিলেন, ষাট দশকের আন্দোলনকে সেই সমসাময়িক কবি হয়েও তিনি কেন এড়িয়ে গেলেন? সুশীলবাবুর জবাব ছিল, "দূর, ও সব কবিতা নাকি? ও সব হল অ্যাডভেঞ্চার আর ব্যক্তিগত খ্যাতির শর্টকাট উইথ...।" অথচ এই মানুষটিই ভালোবাসতেন বোদলেয়র, হোস্তার্লিন, র‍্যাঁবো, ভেরলেন, হিদেগার, অ্যাপলিনীয়ার, বিনয় মজুমদারের কবিতা। যদিও এদের একটা কমন ফ্যাক্টর ছিল। তা হল- অস্থির চিত্ততা থেকে মনোবিকলন এবং তিনি ছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের স্নেহের পাত্র। যে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ১৯৫১ সালে আত্মহত্যার চেষ্টায় অসফল হন এবং তাঁর মনোবিকলন হয়। তা সারিয়ে ১৯৫৫-তে আবার শুরু করেন পূর্বাশা।

সুশীল ভৌমিকের কবিতা কেন আমাকে এত নাড়া দিল? কেন মনে হল তিনি
আধুনিক কালখন্ডে অভিনব চেতনার কারুশিল্পী। যিনি মথিত যন্ত্রণার বিষরেণু সযত্নে মেখেছেন অস্তিত্বের অনমনীয়  ব্যথিত ব্যবধানে। হাসপাতালের ভিজে ওঠা মন খারাপের গন্ধ, আমাদের দুরধিগম্য আয়নার মুখোমুখি একা শূন্য গভীর অনুভবহীন অনুভব, বন্ধ্যা সময়ের আপাদমস্তক অবস্থান, মৃত্যুর অপলাপী-অবেলায় দিগ্বিদিকে ক্ষয়ে যাওয়া কুয়াশার ষোড়শী মুখ। কখনো বা মৃত্যুর বিচিত্র প্রণয় পাশার দান। কখনো অনাদরে, কখনো বা বিভিন্ন পোশাকে গুলি-খাওয়া মৃত্যুর প্রস্ফুটিত লাল, যে, কবির চেতনায় হঠাৎ পাশ ফিরে শোয়। মৃত্যুভয় নয়, সীমাহীন মৃত্যচেতনার বৈপরীত্য, স্বকীয় ও সুতীব্র টানাপোড়েন, যে অনুভূতির কখনো ভাষায় অনুবাদ হয় না। তারই অনূদিত খাদ্যসম্ভারে আমাদের মন আসক্তি মাখানো কিছু কিছু বিস্ময়ে জীবনের নিধি হয়ে কেঁপে ওঠে। দূরের মাপের ও বড় দূরে হারিয়ে যায়। আমাদের প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার গভীরে সঞ্চারী যে অবক্ষয় যে গূঢ় আসক্তিহীন পরিত্রাণহীন, তত্ত্বহীন, গমগমে নিঃশব্দ আকাশ, উত্তরাধিকার সূত্রে যে অবচেতন-চেতনামিশ্রিত আঁধার সঞ্চারিত হয় আঁধারে আঁধারে সেতুবন্ধন হয় মানবমনও পৃথিবীর মহাশূন্যে, তার ক্রম অতলের ধ্বনি তিনি শুনেছেন বুঁদ হয়ে অথচ সেই রেশ অস্থিরতা থেকে বেরোতে চাননি। চাননি অপেক্ষা করতে। অতর্কিত ছোবলের নেশায় বারংবার নিজের জীবনকে তার লিখিত পঙ্ক্তির মতো কাটাছেঁড়া করেছেন শুনেছি। শুনেছি যৌবনে এই নিয়ত অস্থির মানুষটি প্রচুর ড্রাগ সেবন করেছেন এবং তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা দেখেছেন তার প্রচুর ওষুধ সেবনের প্রবণতা। যাই হোক, আমার কাছে ধীরে ধীরে যে ভাবনাটি অবিকল্প সত্য হিসেবে দৃঢ়তর হয় সেটি হল, প্রাক আধুনিক কালখণ্ডে, আধুনিক কবিদের যেভাবে পরোক্ষে প্রাণিত করেছিলেন 'নজরুল, মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, ঠিক সে ভাবেই ৮-এর দশক থেকে অদ্যাবধি বাংলাভাষায় যে নতুন ধারার বিকল্প বোধের অপরাপর কবিতাচর্চার শুরু হল, সেই নতুন দিশার ক্রান্তি লগ্নে যে তিনজন নতুন ধারার আধুনিক হয়েও আধুনিকোত্তর কবি, নতুন কবিতার প্রাক্ প্রধান সূত্রধর হিসেবে গণ্য করা যায়, তাঁরা হলেন পঞ্চাশের স্বদেশ সেন, যাটের সুশীল ভৌমিক এবং ৮০'র শ্যামল সিংহ। কেন? এ'আলোচনা এই লেখায় অবান্তর বলে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে সুশীল ভৌমিকের কবিতার জগৎ ও কবিতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি। প্রথমেই সুশীল ভৌমিকের 'আবহমান' কবিতাটি সংক্ষিপ্ত তুলে ধরছি-

'ঘাড় ফিরিয়েই দেখি গাছের জন্ম থেকেই জন্মাচ্ছে না
মাঠ থেকে সোজা বাড়িগুলো, পাঁচুগোপালকে
দূর থেকে দেখতে দেখতে বুঝতে পেরেছি 
ও পাঁচুগোপাল হতে পারে না -- ওপারে
চেন নাকি রতিকান্তকে?'

Doubt in everything সংশয় এবং বৈপরীত্য কিংবা স্ববিরোধী সত্তার দ্বন্দ্ব'ই ছিল সুশীল ভৌমিকের কাব্যভাবনার মূল চালিকাশক্তি এবং তাঁর আত্মপ্রকাশের উৎসমুখ। অথচ নিজের মধ্যেই দুটো অস্তিত্বকে অবিরাম লালন এবং পারস্পরিক সন্দেহ প্রশ্ন জাগিয়ে রেখে কেন যে নিজেকে পিষ্ট করে গেলেন জীবনভর, কেন পূর্ণ ফলবান-হয়ে উঠলেন না তাঁর মত মননের মানুষ, এ এক বিস্ময়।

আধুনিক কালের অবয়বহীন নিঃসঙ্গকীর্ণ নির্জনতায় অভিমান সন্ধানী কবি'র কাছে তীব্র হয়ে ওঠে অবক্ষয়জনিত বিষাদ যা নিরন্তর বাসনাপ্রয়াসী এবং ক্রমে ক্রমে মৃত্যুচেতনায় অবলীন। 'মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান।/ মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট,/তাপবিমোচন করুণ কোর তব....' দেখা নয়, নয় মৃত্যুকে রাধা কামনায় বিষাদিত সুন্দরের আনন্দে দেখা- 'দূর সঙে  তুঁহুঁ  বাঁশি বজাত্তসি,/অনুখন ডাকসি, অনুখন ডাকসি/রাধা রাধা'।' নয়...। মৃত্যু নিরুচ্চারিত এই কবি'র কবিতায়। কিন্তু চারপাশে অবিরত এক নিশ্ছেদ্য বিদেহী নিশীথিনীর জন্ম হয় বা অকস্মাৎ আসে দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে সন্তর্পণে, প্রতিকারের ছলে অন্য আঁধারকে অপরিজ্ঞাত অচেনাকে রচিত করার জন্য।...

আমার ঘুম নিঃসঙ্গ ওই টুল... (ঘুম হয় না).

হাসপাতালে অসংখ্য পাতাল আছে: তবু টানে (কবিবন্ধু প্রদীপেন্দু)

ক্রমশ ঘড়িতে জড়িয়ে জড়িয়ে 
ঘুমের কুঠিতে চেয়ে সুদৃশ্য অভিজ্ঞতা নেই (ঘড়ি)

রাস্তায় বেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছি কোথাও
এমন কোন ভাষা আমি বলে যাচ্ছি যার
উপমা আছে বালি সিমেন্ট
ও লক্ষ্যহীনতায় (হারিয়ে যাচ্ছি?) 

আবার অনেক সময় 'আবহমানের ছদ্ম আড়ালে' মনোরম বিভ্রম তৈরি করেছেন
এই কবি-

একদিন বাঘের গলায় ছিল তুমুল গর্জন- আসলে, তার গায়ে কি ঠিক কালো ডোরা ছিল, না কলেজ স্কোয়ার (বাঘ)

জন্মাবধি এক হাওয়ার পাহাড় উঁচু হয়ে আছে
(হাওয়ার সঙ্গে দেখা)

খন্ড খন্ড ছিট কাপড়ে ছড়ানো ছিল রুস্তমের ঘর। (বিভক্ত)

কোথাও আবার আধুনিক ছিন্নমস্তা অসংঙ্গতির প্রতি চকিত বিদ্রূপ- 
সাহেবের চামড়া গায়ে দিয়ে এবার শীত কেমন কাটালেম?
(অপরাপর অসমাপ্ত কবিতার পঙ্ক্তি।)

যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আধুনিক কবিতার যুক্তিবোধ, মন্তব্য, ঠিক তেমনি আবহমান আধুনিকোত্তর, নতুনের প্রাক্ চিহ্ন সকল- 

যেমন: যুক্তি:

এক। যে পাতাগুলো এতদিনে শুকিয়ে যাওয়ার কথা/তারা শুকোয়নি; আসলে পাতাগুলো নকল/কপটতার বৃষ্টিতে সবুজ হয়ে আছে বাড়ির মাঠ... (পাতা)

দুই। যাবতীয় পশুপাখি ও বেড়ালের পেটের ভেতর হিন্ডোলিয়ামের খাদ্য ও চামচ/যা আমাদের মধ্যে সব সময় বিক্রিয়া ঘটায়,/আমাদের কথাবার্তা সৌষ্ঠবহীন, অবিচ্ছিন্ন,/আমাদের প্রিয় চেন -- কলার পূর্ণ (ইমপেস্টা)

তিন। আমি পার হচ্ছি রাস্তা/গোলাপচারা পার হচ্ছে রুক্ষ মাটি/এসময় নার্ভের মধ্যে শুধু সাদা চাঁদ আমার গাইড/.../অপ্রতিহত, গোলাপফুল আমার ক্লান্ত রক্তে ঝরছে (আমার দীর্ঘ পথ)

মন্তব্য:

এক। একুশদিন হাসপাতালে থাকলে নাও ফিরতে পারে কেউ (আবিষ্কার)

দুই। আরো একটু উন্মাদ হবে ভানঘগের বিশাল সূর্যটা (আরো পুরনো হবে)

তিন। রোজ হাঁটতে হয় এর বিকল্প নেই; (হেঁটে যাই)

আবহমান আধুনিক অথচ নতুনের প্রাক্ চিহ্ন সকল:

এক। কয়েকজন ভদ্রলোক অন্ধকার ফুলগুলো/অন্ধকার টবে ফলাচ্ছে... (হারিয়ে যাচ্ছি?)

দুই। গ্লাসসুদ্ধ জল কিভাবে ব্রাউন ওয়াটারপ্রুফ/হয়ে যাচ্ছে, ছাতা মাথায় দিয়ে যাচ্ছে/আকাশের দিকে (ব্রাউন ওয়াটার প্রুফ)

তিন। হাওয়ার বাঁক থেকে ভেসে ওঠে জামা/আর কোনও কিছু নেই এই দিন ও রাতের/ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে থাকে/অরুণ নামে এক বিপন্নতা শুধু/ঘর মানে ঘরের জন্য প্রচণ্ড পিপাসা... (জামা)

কবি সুশীল ভৌমিকের কবিতার একটি প্রিয় উপাদান ঘুম। যার প্রথম পিঠে অপার শান্তিবোধ। অন্য পিঠে ইনসোমনিয়া-তাড়িত ক্লান্তি ও বিষাদ। এরপরেও ঘুম অনেক কিছুর নির্ধারক। ঘুম স্বপ্ন দেখায়, ভাষা জোগায়। মনঃসমীক্ষণ বা সাইকো অ্যানালিসিস তত্ত্বেও ফ্রয়েড ঘুমকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ভালো ঘুম হলে ভালো আলোকপ্রাপ্তি ঘটে। অন্ধকার প্রতিবাদের উৎস। ভালো ঘুম হলে ভাবনাশক্তি বাড়ে। ভালো না হলে বেদনার জন্ম। উভয়ের উৎস কবিতার। ঘুমের ডিজায়ার থেকে মনস্তাত্ত্বিক নির্জনতা ও একাকিত্ব অবলম্বনের প্রবণতাকে ইনটেনসিউফাইড করতে থাকেন শিল্পীরা। ইনটেনসিফিকেশন থেকে কখনো আত্মহত্যার মিথ জন্ম হতে পারে। না হলে কবি আর একটি নতুন আশ্রয় খুঁজতে থাকেন। ঘুম নিয়ে রূপকথা লেখা হতে পারে। না- ঘুমকে সামাল দেবার জন্য চলতে থাকে ডায়াজিপাম অথবা অ্যালজোলাম। অ্যান্টিথিসিস তৈরি করতে। কবি ঘুমকে করে তুলতে পারেন তার স্বপ্ন খেলা ও স্বপ্নলেখার উপকরণ। কখনো সিজোফ্রেনিয়া। ঘুমকে অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের এক রূপকার ক'রে তোলা হয়। ঘুমকে বিভিন্ন নামে ডেকে, অন্য কোনো-ইলাশট্রেশনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়। কবির এই খেলা অনেক সময় চাইল্ড সাইকোলজির সঙ্গে মিলে যায়। মিলে যায় আমাদের মনের আদিম অচেতন শক্তি তান্ডবের সঙ্গে। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে আমাদের মনের সমস্ত কামনা-বাসনা, জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য জিনগত ও অন্তর্নিহিত দৈহিক শক্তি। ফলতঃ পাঠকের পাঠঅভ্যাসে বিপন্নতা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ থাকে না। ঘুমসহ অন্য যে কোনো উপাদানের টেকস্ট পাঠ অভ্যাসকে বেশি করে বিস্মিত করে মাত্র। এরকম কয়েকটি নমুনা দেখানো যেতে পারে সুশীল ভৌমিকের কবিতা থেকে-

এক/ আকাশ ও নক্ষত্রকে... ঘুমের ট্যাবলেট খেতে দিই। দুই/খালি আপেলের প্লেটে আপেল ঘুম। তিন/কুকুরের চেনে ঘুম। ঘাড়ে ঘুম। অফিসে ঘুম। ওয়াসিং মেশিনে ঘুম। জামাকাপড়ে ঘুম। চার/প্রত্যেক মাকে দাও মর্মান্তিক ঘুম, ঘুমের গন্ধে থাক ছুরি ও মাংসের গল্প। পাঁচ/একবার শুধু ঘুম থাক তোমাদের আঁধারে। ছয়/ ঘুম, তুমি আমার ঘুম চেনো? সাত/ঘুমের মধ্যে দেখা পুকুরের ভেতর থেকে আমি কিছুতেই উঠতে পারছি না। আট/মহিলা বর্ণের ঘুমকে ডায়াজিপাম খাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছি রোজ। নয়/কার্বনডাইঅক্সাইড মুখে পুরে রোজ ঘুমিয়ে পড়ি। দশ/তোমাদের গ্রন্থিতে ঘুম, সে ঘুমও হাসবে আমার কবিতার কথা মনে করে।

বিভিন্ন কবিতা থেকে উদ্ধৃত এই পঙ্ক্তিগুলো সভ্যতা ও নিষ্ঠুরতা দুটোকেই রিফ্লেক্ট করে। ব্যাধি ও অব্যাধির প্রস্রবণ। আমরা পেয়ে যাচ্ছি কিছু..., সাইকাসথেনিয়া লালিত মানুষের মন যা সমাসক্ত থাকে একটি বিষয়ে আর সেই বিষয়টাকেই ভাসিয়ে দেয় অন্যসব রূপের মধ্য। অন্যসব রূপের নামকরণও হয় প্রাথমিক রূপটির আলোকে ঘিরে। কবির সমস্যাকুল অভিজ্ঞতা যখন বলছে, কার্বনডাইঅক্সাইড মুখে পুরে আমরা রোজ ঘুমিয়ে পড়ি- তখন উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না যে সারা পৃথিবী জুড়ে এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের উপর কেন এতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ঘুমকে কোথাও লালিত্য দিয়ে মাখানো হয়েছে কবিতায়। ঘুম নিয়ে কোনো আখ্যানমূলক কবিতা লিখতে চাননি সুশীল ভৌমিক। অভিজ্ঞতা, পারসেপশন আর ইমোশনাল ইমাজিনেশন, এই তিন মিলে কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে কবিতার ভেতরে আর এক কবিতার ভ্রমণ পিপাসা। যে ভ্রমণপথটি একাধিক পরিচয়ে চিহ্নিত ও চিহ্নকের কাছে নতুন চিহ্নের সূত্র অভিযোজিত করে। চিহ্নগুলি বাস্তবে যে অর্থে অর্থময়, কবিতায় তা থেকে দূরে সরে যায়। দেখি আমরা তার বিগঠিত রূপ। কবিতায় তার ইঙ্গিতটি প্রধান। ইঙ্গিত থেকে ডিজায়ারের মধ্যে রূপান্তরের অন্য একটি সীমানা ভেসে উঠতে দেখা যায় যার কোনো অভিধানিক অর্থে প্রাকৃতায়ন হয় না। এই উপলব্ধি থেকেই হয়তো সুশীল ভৌমিক লিখেছিলেন, 'আমি বলি কবিতার অর্থ হয় নাকি? সমুদ্র দেখার কোনো অর্থ হয় নাকি, দূরে দূরে ঝুলন্ত টি গার্ডেন সমেত স্পাইরাল বেয়ে দার্জিলিং ওঠার ল্যান্ডরোভারের কোনো কোনো অর্থ আছে? থাকলে তা নোট বইতে।

রবীন্দ্রনাথের বহু গান নির্মিত হয়েছে গানকেই বিষয় করে। বুদ্ধদেব বসুর কিছু কবিতা চিহ্নিত হয়েছে যার ভাবনাকেন্দ্রে শুধু কবিতাই, কবিতার বিষয় হিসাবে। এরকম কিছু নিরীক্ষা হয়তো সব কবির মধ্যেই বিভিন্ন মাত্রায় অস্থির হয়ে থাকে। যেমন আমরা লক্ষ্য করি সুশীল ভৌমিকের কবিতায় তিনি লিখলেন- এক/এই দুঃসহ কবিতাই আছে তোমার উপহার। দুই/জটিল গ্রন্থিল, সমস্ত বাধার কাছে আমার কবিতা। তিন/কবিতার কথা ভাবলেই পুরোনো ঠেকে এসে উঠি। চার/কোনো কবির জন্য মোটে ১টি কবিতা তাকে নতুন স্পর্শ দিতে পারে। পাঁচ/ভাষা ভুলে গেলে গলগণ্ড দিয়ে কবিতা লিখবো, তোমরা পড়বে আর হাসবে সব সময়, যখনই মনে পড়বে। ছয়/উঁচু বাড়িগুলি ভেঙে যাচ্ছে কবিতায়। সাত/দেখা হয়ে গেল ভাগ্যিস, ফোনে পাইনি আপনাকে। যাচ্ছি কবিতা পড়তে, আসুন না শুনবেন, বলবেন কেমন হয়েছে। আট/এমন কোনো ভাষা আমি বলে যাচ্ছি যার উপমা আছে বালি সিমেন্ট ও লক্ষ্যহীনতায়, যাত্রা শুরু হয়ে শেষ হয় না।

সুশীল ভৌমিকের কবিতায় 'ঘুমের ' পাশাপাশি 'মন' একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ক'রে রয়েছে। এই মন কখনো ব্যবহারিক সঙ্গতি কখনো ছাপোষা মধ্যবিত্তের বিশেষ সঙ্গতিপূরণের সদর্থক অক্লান্ত প্রয়াসের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে, দাপটে অসঙ্গতিগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে যায়। কখনো পাগলামির পর্যায়ে চলে যায় এই দ্বিতীয় জীবনের দ্বিতীয় পৃথিবীর অধিকারীর সমস্ত সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে। এই পাগলামি, পাগল, লুনেটিক ও অস্বাভাবিকত্বকে কবিরাই মহার্ঘ ভাবে, ভালবাসে তীব্রতার সঙ্গে। এই অস্তিত্বকে সে উপভোগ করে। সে উপভোগ ক'রে সদ্যোজায়মান এই অন্ধকারের আলোকে। অন্যের দ্বারা প্রাপ্ত তাচ্ছিল্য, অবহেলা সেও পৃথিবীকে ফিরিয়ে দেয় সমমূল্যে। কিন্তু যেখানে নেই দৈনন্দিন তুচ্ছতার গ্লানি, নেই সেভাবে ক্ষোভ, ক্রোধ বা অহমিকা। আছে কেবল দ্রষ্টার বিভিন্নতরূপে দেখার মন। কিংবা একই বিষয়কে বিভিন্ন সময়ে মানসিক ভাবনার তারতম্যে দেখার বৈচিত্র্যে। একান্তেই দেখার আকর্ষণীয় তারতম্য। 

এক.

এসময় নার্ভের মধ্যে শুধু সাদা চাঁদ আমার গাইড হাতে পৌঁছাতে থাকে সাদা পোস্টকার্ড
আর পোষ্টকার্ডের ভেতরে, সাদা পোকা একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণ শব্দ নামতে থাকে... ( আমার দীর্ঘ পথ )

দুই .

অসুস্থতা, আমি ও প্রেমিক
অসুস্থতার পাশে বসে অসুস্থতা, জানি,
(অসুস্থতার গল্প)

তিন.

আমার পোশাক খুলে যাচ্ছে- আমার সমস্ত শরীর আমার রক্ত থেকে পরিচিত নকশাগুলি
(পরাজিত ঘুড়ির মতো)

চার.

সম সময় ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ, ইউক্লিড আমাকে চুরমার করছে তীক্ষ্ণতা দিয়ে ওজন করছে আমাকে।
বিজনতা দিয়ে তৈরি করেছে আমার বাসস্থান
তারাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বাস করছে, একদল মোষ। (কালো মেঘ)

 আসলে সুশীল ভৌমিকের 'নির্বাচিত কবিতা' গ্রন্থটি বাংলা কবিতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতার বই বলেই আমার মনে হয়। সুশীল ভৌমিক এমন একজন কবি ও মানুষ, যিনি নিজের এবং নিজের চারপাশের যা-কিছুকে অস্তিত্বের ভেতরে টেনেছেন তাকেই শুধু ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, পরিহাস করেছেন তাই-ই নয় তাদেরকেও উপকথায় পরিণত করেছেন প্রায় এক স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে। আর এভাবেই তিনি ক্রমাগত সুস্থিরতা ভেঙেছেন, ভেঙেছেন নিয়মমাত্রা আর তৈরি করেছেন এমন এক দৃষ্টি যা নিছক সরল হলেও আসলে বক্রগামী ও উৎক্ষিপ্তভাবে কাটা। কাফকার রূপান্তরিত মানুষগুলোর মতো একা বা তা না হলেও তার চেয়েও বেশি উদ্ভট এক বৈপরীত্যের মধ্যে তার পর যে খেয়ালীরাজা তার নাম সুশীল ভৌমিক। যার কবিতায় অপরিমাপযোগ্য বেদনা। অথচ পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে অর্থহীন এক গভীর উপলব্ধি থেকে বলে --  'মার্বেল পাথরের গয়না পরে মেয়েটা প্রেম করছে' বা 'সোনা ও শুয়োর পরস্পরকে ঘাস খাওয়াচ্ছে'- এই বিপরীত দু'টি উপলব্ধির অর্থ খোঁজা নির্বোধের কাব্য পাঠেরই নামান্তর। অজস্র মৃত্যুগন্ধ, অসুখ, অবষাদ, ওষুধ, বিষণ্ণতা, ঘুম, প্রেম, প্রতিদিন নাথিংনেস ব্যক্তিক, সামাজিক রাষ্ট্রিক সব দিক জুড়ে গ্রন্থিলতা ভাঙা, গ্রয়েন ভাঙা অনিয়ন্ত্রিত মানসিক ডিপ্রেশন ও ক্রমাগত সামাজিক ভাবে অন্য হয়ে যাওয়া এই লোকটিই হল আসলে তাঁর কবিতা। যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন 'আমার প্রকাশিত বহু কবিতা সমেত সেগুলো ঝাঁকামুটের মাথায় তুলে দিয়েছি। না, কোন পাণ্ডুলিপির নকল রাখার অভ্যেস আমার কোনদিনই ছিল না। ৬০ দশক থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত এইসব কবিতা উচ্ছিষ্ট হবার সুযোগ পায়নি।...কথা একটাই I will not rest...'




সুশীল ভৌমিকের কবিতা




বেড়াল

অবরুদ্ধ একটা পাথর অবরোধ তৈরি করেছে এখানে, অনেক ডাকাডাকির পর শুধু দেখা গেল পাথরের মুখ কথাবার্তা নেই কিন্তু মুখ নাড়ছে কাচের আড়ালে মানুষ কী বলছে ছেলেটা আদৌ যে কথা বলছে না যেন খরগোশের শরীরটা ছোট্ট একটা আটসাঁট খাঁচা পিয়ে দিচ্ছে সর্বদা তারও স্বপ্ন ছিল, অসংলগ্ন, নিষ্ঠুর, এবং কিছুটা বন্য একটা বেড়াল পর্যন্ত নীরবতা শুধু মাইক্রোস্কোপ ও কার্স্ট শহরের বনেদী পাড়ায় বেড়ালটা বেঁচে আছে কি বেঁচে নেই-এরকম একটা সমস্যা প্রকট হচ্ছে ক্রমশঃ শুনতে গেলে কি কানের দরকার আছে.... এরকম একেকটা প্রশ্ন.... উঠছে চোখ না থাকলে কি...মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা....... কে বলতে পারে; মারবেল পাথরের উদ্ভাবন কবে হয়েছিল? ক্রোধ ও ক্লিষ্ট হাসিতে কতখানি প্রভেদ কথা না বলা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আবহাওয়া মুখে পুরে অলৌকিক ঘুমের অপেক্ষায়




হারীত

'ব্রিজ' মেখে চান করে ফ্রেস লাগছে হাওয়া বা সেতু বলে এখনও খটকা কাটেনি- বাবা-মা সোফাসেট হয়ে লিভিংরুমে শিগিরি এসে যাবে বুঝি কী আশ্চর্য এ-কেমন দিনকাল পড়ল যে সমাস-ও গুলিয়ে যাচ্ছে রোজ? আরে আমার নাম হারীত-এখনও চিনতে পারছ না, সেন্টু? আমির যা মনে পড়ল তা অফিসে-ছোটা শিয়ালদার ভীড় নামবোস্ট্র্যাটাস মেঘ ঘেঁটে একটিও ভালো কথা মনে এল না দেখি-দেখাটা রুলটানা একগাদা লুট মরুভূমি হয়ে গেল- কোনখানে একটুও উপলব্ধি ছিল না যে-কোনো প্রশ্নের যে-কোনো উত্তর লিখলেই যথেষ্ট যেন প্রসঙ্গহীন কথাবার্তা, কথোপকথন বিড়াল হয়ে যাচ্ছে অথচ বিড়ালটা কার এসব চিন্তা বা ভ্রুক্ষেপ ছিল না বিমল স্যুটিং-এ হারীতকে বেশ মানিয়েছিল সেদিন- শুধু টরেন্টোর ব্র্যান্ড কিনা জানা না থাকায় একপাশে ডাঁই হলো সে।



স্বপ্ন

কবিতার কথা ভাবলেই পুরনো ঠেকে এসে উঠি হারমোনিয়ামের রীডে বক্সিং ও কানচাপাটির ধুলো পড়েছে আরে বাংলা পড়াতে পড়াতে নির্ঘাৎ মাইকেল হয়েছে বিধান লস্করের ছেলেটা

ড ড বিশ্বাসকে আর চেনাতে হবে না, সেই যে... বাতি নিভিয়ে ধস্তাধস্তিটা শুনতে পাই, মাথার মধ্যে টেবিলে চেয়ার টেবিল চেয়ার টেবিল ভাঙছে রোজ কে বলেছিল আমার ঘুমটা ধ্বজামার্কা, পুরনো- একটা অভিধান খুলে আমি স্বপ্নের টীকা, টিপ্পনি

পড়ছিলাম-

মনে হচ্ছে শ্বেতপাথরের তৃণভূমিতে গরুগুলি মোটা মোটা লেজ দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে- "বড়বাবু, অ্যাকাউন্ট্যান্ট বাবু” বলে তারস্বরে গান বাজছে সাংস্কৃতিক উৎসবে

মূলতঃ প্রস্রাবাগারের মধ্যে শব্দগুলি রেখে যাচ্ছি, পড়ো




গান

গান নেই অথচ অনেকক্ষণ ধরে হাঁ দেখছি একটা গ্রামোফোন দাঁত দিয়ে চিড়ছে নিজেরই গলা কুকুর বেড়ালটাও লেজ নাড়ে না এরকম গুমোট সকালে খাবার টেবিলে বুঝতে পারিনা

স্যান্ডউইচ না স্পন্ডিলাইটিস্ কথারও ওরকম অসুখ, তাই কথা হয় না কোনো, কথা নেই কথার পার্টস খুলে গিয়েছে, কথার কথা ফুডুৎ উড়েছে এরও তো একটা গান হয়, গাও, মানে বন্দুক, মানে বু-উ-উ-উ-উ-ম



হাসপাতাল

হাসপাতালের ছাদে ঝরে পড়ো ফুল। উঠে দাঁড়াক, শায়িত স্ট্রেচার; ইসিজি মেশিন, হেসে ওঠো, যেন করকরে কোনও চলচ্চিত্র দেখতে গিয়েছ- আর এখানে ঝরে-পড়া ফুলের বাগান উদ্বোধন করো;

ওই শাদা গম্ভীর মাকড়শা- মায়া মুখার্জির মতো রবিবারে এই ঘর আলো করে দাও, হাত ধরো; ঘুরে-ঘুরে দ্যাখো, কী সুন্দর ভাল থাকা যায়; বিছানার চাদরগুলি শান্তিপুরী-কী শোভন রুচিতে সাজানো।

লিফ্টে ছ-তলায় উঠতে-উঠতে কার না বাড়ির কথা মনে হয়!




বিশাল বুদ্বুদ

কোনও কিছুর উপস্থিতি কিংবা অভাব অথবা এমন কিছু যার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন, আমি

যার জন্যে রাস্তা থেকে ক্রমাগত পিঠ জমতে থাকে পাথর গলে তরল কথাবার্তার মাস্তল ধোঁয়াটে বিকেলে আমি সঠিক কোনও মুখ আজ পর্যন্ত দেখিনি আমি জানি না কে প্রথম মুখ আবিষ্কার করেছিল কে প্রথম ঠিকানা লিখেছিল, আমি জানি না

যেভাবে একদিন মানুষ আবিষ্কার করেছিল ফুলের মিষ্টত্ব স্বপ্নে দেখেছিল হাজার-হাজার মানুষের প্রহৃত অনুভূতি কে প্রথম আবিষ্কার করেছিল যোগাযোগের সেতু, অথবা বিশাল, বিশাল বুদ্বুদ?




এই ঘর-৩

এই ঘর ঠিক যেন যন্ত্রের মতো চলে- কখনও ভীষণ শীত ঢেলে দেয় পাহাড়ি মেয়ের হাত: পাখির মতোই ভাসে এই ঘরের হাওয়ায় কখনও গভীর ফার্নগাছের ছায়ায় আচ্ছাদনহীন মানুষের মুখ, ঘরের দেয়াল শুধু স্থির কখনও গ্রীষ্মের নারী কম্বলের মতো বুকে





স্টেশন

একদিন আস্তাবলে ঘোড়াগুলি দাঁড়াত আঁধারে; এখন ভীষণ গতিতে শুধু স্টেশন লাফিয়ে চলে; নৌকাগুলো তুলে নিয়ে অন্তহীন সাঁতার আছে দূরগ্রামে ফেরবার পথে

আমাকে পঙ্গু করে কলকাতা চাঁদ এঁকেছিল, পাথরে ঝর্নার স্বাদ দিয়েছিল-এখন গর্ত এঁকে

দুর্গম করেছে পথ;

বাড়ি পৌঁছনো হল না, গলি ঘুরে-ঘুরে সারারাত হাঁটি; ঘড়ির চেয়েও বুঝি আমিই তার একান্ত সাধনা




একা শুধু ঘুম থাক

তোমাদের মধ্যে আমার দুরারোগ্য অসুখ তোমাদের মধ্যে আমার মৃত্যু পার্ক স্ট্রিটকে বলো, একবার আসুক এই ঘরে তারপর ভাঙো পথ, একবার শুধু ঘুম থাক তোমাদের আঁধারে, তোমাদের স্মৃতির পাথরে




প্রতিবন্ধক

আমি নিজের হাতে ছুঁতে পারি না কিছু, সবসময় স্টাফ-করা হরিণের মতো ঠেকে, আনন্দ বা ব্যথা ক্র্যাচ, তুমি অকপট মাটি যা ছুঁয়েছ, আমি তার ললিত স্পর্শ কখনও পাইনি: গোমো থেকে একটানা পাথরের সুড়ঙ্গ বেয়ে ছুটছি, ব্যাঙ্কে যাত্রিণীর চামড়ার সুটকেস কোনওটাই আমার স্পর্শের মধ্যে নেই, অনুভূতি ত্রিশঙ্কু ঝুলে আছে

তন্দ্রার মধ্যে বরফমানবী, টগবগ করে ফুটে যায় কারণ দূরগামী গরম ইঞ্জিন তার স্নিগ্ধতা স্পর্শ করে বরফের শীতলতা তাপ হয়ে পৌঁছচ্ছে এখানে চস্টিক, স্ট্র, গ্লান্স আমার ঘরে ভিড় করে থাকে যা-কিছু সেকেন্ডহ্যান্ড, ফোনের ক্রি......ক্রিং, স্টেরয়েড, কভার ইত্যাদি.....

অনেক ঠোঁটের ভাষা ধাক্কা খায় চারকোটি, দশইঞ্চি চওড়া দেয়ালে



আমার মধ্যে

আমার মধ্য দিয়ে, আমি দেখতে থাকি- আমাকে কারা মৃতদেহগুলি উপহার দিচ্ছে; আমি এই মৃতদেহদের চিনি;

তারা আমাকে যথেষ্ট ভালবাসা দেয় প্রতিদিন; আমার হাত ধরে, পরে গন্ধে জাপটে থাকে সারারাত; কপিকলে বালতি-বালতি জল তোলার শব্দ হয় আমার গ্রন্থিতে;

বাসের হর্ন, দূরের ধূলো আমাকে আবিষ্ট করে রাখে;

কিন্তু আমি তবু হাঁটতে থাকি, নিজের মধ্যে;

মমি-র আচ্ছাদনের মতো ফিনফিনে আমার জীবনযাত্রা আমার জিভ পর্যন্ত ঢেকে থাকে;

আমাকে আদর করে চুমু খায়, মৃত্যুর অদ্ভুত আলজিভ




মসৃণ

মসৃণতা, তোমার সঙ্গে ঘন-ঘন দেখা হয়

তোমার আঙুল সুদৃশ্য, তীক্ষ্ম অথচ ধ্যাবড়া রঙের

তোমার কাছে দাঁড়ালে-

আমার ভেতর অসংখ্য সমান্তরাল বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে আমি মুর্গির পালকের মতো ভেঙে পড়ি চতুর্দিকে আবছা কালো কোট ও অদৃশ্যতার শলা-পরামর্শ শুনতে পাই

অতঃপর আমার কণ্ঠনালীর ওপর স্থির হয়ে যায়, অপূর্ব

রূপবতী মসৃণতার দুই চোখ





তিন

শ্যামল সিংহের কবিতার আলোচনা : বিজয় দে

শ্যামল ছিল আমার ক্লাসতুতো বন্ধু। জলপাইগুড়ি শহরের বনেদি যৌথ-পরিবারের সন্তান, শ্যামলের সামাজিক পরিমন্ডল ছিল ঈর্ষাযোগ্য। সেই সময়ের শ্যামল... প্রাণবন্ত উচ্ছল এক যুবক-প্রতিম ছাত্র, যার সঙ্গ আমরা সকলেই উপভোগ করতাম। শিয়ালপাড়ার গুঞ্জন থেকে শাম্মী কাপুরের উল্লম্ফন, সবই ছিল আমাদের চর্চার বিষয়, কিন্তু কবিতার ধারে কাছে কেউ নেই। এদিকে স্কুলের বন্ধুত্ব যেরকম হয় প্রায় সেরকমই, স্কুলের শেষ ঘন্টা বাজলেই শেষ, তারপর যে যার পাড়ার কোটরে।

স্কুল থেকে বেরোবার অনেক পরে, আবার শ্যামলের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরী হোলো। কেননা বাড়ি বদলে বদলে, আমরা তখন শ্যামলের পাড়ার কাছাকাছি। ফলে জমে যেতে সময় নেয়নি। শ্যামল তখন আমার প্রায় নিত্যদিনের ভ্রমণসঙ্গী, মননসঙ্গীও বটে।

সত্তরের মাঝামাঝি, লেখালেখির ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে। দু-এক কলম লিখিনি যে এমন নয়। ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে দু'একবার ফিরে এসে, আমার প্রথম লিট্ল-ম্যাগাজিন-দর্শন, এবং ইচ্ছে হয়, জলপাইগুড়ি থেকে ওরকম একটি কাগজ করার। বন্ধু শ্যামলকে কথাটা বলি। সে এক বাক্যে লুফে নেয়। তখনও কিন্তু সে লেখালিখির মধ্যে নেই। ১৯৭৫ সনে জরুরী অবস্থার সময় 'পাগলা ঘোড়া' প্রকাশিত হোলো। নিতান্ত বন্ধুকৃত্য হিসেবে শ্যামলের একটি কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়, যা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। এরপর 'পাগলা ঘোড়া'র পরপর কয়েকটি সংখ্যায় শ্যামলের একটি দু'টি করে প্রকাশিত হতে থাকে। তখনও তেমন সাড়া জাগেনি। কিন্তু যখন এর পরবর্তী 'পাগলা ঘোড়া'য় 'সাম্প্রতিক ২৫টি অভিজ্ঞতা' শিরোনামে শ্যামলের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হোলো, তখন সবাই নড়ে চড়ে বসলো, হ্যাঁ, একজন নতুন কবির সন্ধান পাওয়া গেছে। কলকাতা থেকে কবিবন্ধু পিনাকী ঘোষ চিঠিতে লিখলেন, 'আমি মুগ্ধ, you are one of them whom I have to compete.

ইতিমধ্যে বন্ধু সময় রায়চৌধুরীর কবিতা কাগজ 'ক্রুসেড' চলে এসেছে, সেখানেও শ্যামলের প্রচুর কবিতা। কবিতার স্রোত আর বন্ধ হয়নি। এ সবই ৮০'র দশকের কথা। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আঁচ তখন আমাদের গায়ে, ফলে 'পাগলা ঘোড়া', 'ক্রুসেড' এবং অন্যান্য দু'একটি লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া অন্য কোথাও শ্যামল লেখা প্রকাশ করেনি।

ওরকম একটা সময়ে, কবি ও গবেষক কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত 'বক্সাবাজার' পত্রিকায় শ্যামলের কবিতা নিয়ে একটি ছোট্ট লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটির প্রয়োজনীয় কিছু অংশ উদ্ধৃত না করে পারছি না...

'প্রদীপের কূটচালে নিহত খড়মের শ্লোক'। শ্যামলের কবিতার কথার প্রথমেই এই লাইনটি আমার মনে পড়ে। কেন? এত জটিল এত সরল এত পোয়েটিক যে মনে হয় কবিতার প্রকৃত দুধ খাচ্ছি। এর কি কোনো অনুবাদ হয়? আর শেষ
পর্যন্ত প্রকৃত কবিতা তো তাই, যা অনুবাদ-অযোগ্য। আপাত অর্থহীন এই লাইনগুলির ভেতরে যেন চোরা ঘূর্ণি, জলের ভিন্ন মাত্রা, লুকিয়ে আছে বা ডুবে যাওয়ার আগে কোনোদিন বুঝতে পারবো। শ্যামলের কবিতা পড়লে যা যা হয়, মানে যেরকম বুঝতে পারি, সেটা হচ্ছে

ভেড়ার পালের মতো আজকাল সন্ধ্যা আসে / দেয়াল ও পেরেকের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলি / কথা বলি উটের ছায়া নিয়ে / ঝোপের আড়াল থেকে সুই-সুতোর কথা বলি/টুপির ভেতর থেকে বলি টুপির কথা / টুপির পাশে টেলিফোন বলে শুধু টেলিফোনের কথা...

আমি ওর দুটো কবিতা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা লাইন উল্লেখ করলাম; চেতন থেকে অবচেতন, বাস্তব থেকে অবাস্তবে কিংবা অবাস্তব থেকে বাস্তবে, এই যে ওর যাওয়া আসা, সেটা এক ধরনের ম্যাডনেস ছাড়া সম্ভব নয়। একজন প্রকৃত কবির পক্ষে এটা একটা জরুরী ঘটনা, ... ঘরের বেড়াল কিংবা বনের বাঘ যেমন পায়ে পায়ে, গুটি গুটি এগিয়ে নিঃশব্দে, জিরো আওয়ারে উপহারে দেয় সেই বিখ্যাত লাফ, ঠিক শ্যামলও তেমনি, দু'চার লাইন ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা এগিয়ে শেষ এক বা দুই লাইনে কবিতার টুটি টিপে ধরে এবং পাঠকেরও। এটা এক ধরনের মারাত্মক শিকার ও শিকারীমনস্কতা ছাড়া সম্ভব নয়। এর ফলে একজন কবি অন্যদের থেকে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রিয় পাঠক, আপনি যদি কষ্ট করে ওর পুরো কবিতাগুলি পড়তে পারেন, তবে আমি যা বোঝাতে চাইছি, সেটা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করি। আর আমি একটা ছবি দেখি, যেন ওই ছবিতেই শ্যামলকে চেনা যায়। সেটাও পুরোনো কবিতার একটা লাইন "কালিমাখা লণ্ঠনের মত আমি যাচ্ছি এক ঘর থেকে আর এক ঘরে"। এত স্পষ্ট এত স্বাভাবিক কবিতার লাইন শ্যামল বেশী লেখেনি।...

শ্যামলের দুই পকেটই ছেঁড়া, হাত দিয়ে স্পর্শ করে লিঙ্গ, কবিতা ঝরে যায়। ফলে ওর সমস্ত কবিতাই মুখে মুখে; একদিন হয়তো বা সত্যি-পাখী হয়ে উড়ে গেলে, কোনদিন যদি শহরের মাথায় উপরে উঠে শ্যামল আমাদের ডাকতে চায় তবে তখনো মনে হয়, ওঁর ঠোট থেকে কবিতাই ঝরে পড়বে।

বলা বাহুল্য, লেখাটি আমারই। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যা ভেবেছিলাম, আজও যেন সেই কথাগুলি একই আছে, কোনও পরিবর্তন হয়নি। লেখাটি ভালো হোক মন্দ হোক, লেখাটি পড়ার পর শ্যামল সম্পর্কে অনেকেই আগ্রহ বোধ করে এবং শ্যামলও প্রচুর উৎসাহিত হয়। এবং এরপর মনে মনে নিজস্ব কবিতার বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। সীমিত সাধ্যে, ১৯৯১ সনে প্রকাশিত হয় 'চাঁদ ও খোঁড়া বেলুনওয়ালা', যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, শিল্পী প্রকাশ কর্মকার। এর প্রায় ১০ বছর (২০০১) বাদে প্রকাশিত হয়, কবি বিকাশ সরকারের উদ্যোগে 'সূর্যাস্ত আঁকা নিষেধ'। এবং তৃতীয় বা শেষ কাব্যগ্রন্থ 'জেগে উঠছেন বাঘা যতীন' প্রকাশিত হোলো ২০০৩ সনে, মৃত্যুর ঠিক আগে। শ্যামল বোধ হয় একটিই 'কপি' দেখে যেতে পেরেছিলো। মাত্র তিনটি বই প্রকাশ করে শ্যামল একেবারেই চলে যাবে, এটা আমরা কেউ ভাবতে পারিনি। অথচ ততদিনে শ্যামলের প্রচুর গুণমুগ্ধ পাঠক তৈরী হয়েছে, যারা শ্যামলের কবিতা পাঠ ও প্রকাশের জন্য সদা উন্মুখ। ফলে দুর্ভাগ্য আমাদের সকলের।

শ্যামলের স্বভাব ছিল, কবিতা মাথায় লিখে রাখা। অর্থাৎ, কেউ কবিতা চাইলে, সে তৎক্ষণাৎ মুখস্থ বলে যেতো। আমাদের ধারণা ছিল শ্যামল বোধ হয় কাগজ কলমে লেখে না, কেননা ওর কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপির কারিগর তো আমিই ছিলাম। মৃত্যুর পর' যখন ওর ঘরে, দ্যাখা গেল অনেক ডায়েরিতে অনেক অনেক কবিতা থরে থরে সাজানো, তখন অবাকই হয়েছি। ফলে কিছু অপ্রকাশিত কবিতা এখানে ওখানে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ওর লেখার পরিমাণের তুলনায় কিছুই নয়। ইতিমধ্যে শ্যামলের তরুণ বন্ধুরা যখন সিদ্ধান্ত নেয় শ্যামল-সংগ্রহ প্রকাশে, তখন আমরা শ্যামলের পুরানো বন্ধুরা উৎসাহিত বোধ করি, যে কাজ আমাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, এই সংগ্রহ প্রকাশে, সহযোগিতার নিদর্শন স্বরূপ ডায়েরি থেকে কিছু কবিতা নির্বাচন করেছি, এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে অতনু (অলীক) বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে 'এখন বাংলা কবিতার কাগজ' এবং আজকের তরুণ সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা, সময় ব্যয় করেছেন তা তুলনারহিত। এক সময় অনেকেই অনুযোগ করতেন যে, শ্যামলের বই পাওয়াটা দুর্লভ, যা চর্চার অন্তরায়। ফলে, আশা করি এই সমস্যা এবার আর থাকবে না। শ্যামলকে নিয়ে কবিতা-চর্চার নতুন দিন শুরু হবে, এটা ভাবতে দোষ কী?


বিজয় দে
১৮৮, পানপাড়াগাঁ, জলপাইগুড়ি
ঋণ : এখন বাংলা কবিতার কাগজ



শ্যমল সিংহের কবিতা




ডায়েরি ২০০০

কোথাও ঘুম নেই সকলে পাহাড়ে গ্যাছে ঘুম আনতে মশারির জালে আটকে গ্যাছে দমকল তখন, সকলে হাঁসের শীতের ভিতরে ঘুম চুরি করছে



ডাক্তার বলে পাহাড়ে যেতে অধ্যাপক বলে সমুদ্রে এইভাবে শুরু হয় চিকিৎসা অতীত হলে ফলের ভেতরে নড়ে ওঠে মা



কুঠার ফেলে চলে যাব অরণ্যে যেখানে দেবতা গড়েন বালক-বালিকা

বিয়ের পরে

তোমার মেঘের টাপুর-টুপুর

আমার মেঘের টাপুর-টুপুর সড়ক ধরে চলে নদীতে জন্ম নিল তোমার রূপ আমার রূপ




'নদীতে জল বাড়ছে' এর অর্থ বুঝি

তুমি এসেছিলে 'নদীতে জল কমছে' এর অর্থ বুঝি

তুমি এসেছিলে রুটির বদলে তুমি চাওনি চাঁদ রুটির পিঠে তুমি লিখেছো তোমার নাম ও ঠিকানা

রুটি আকাশে ঘুরছে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে তুমি যাচ্ছো আরেক বাড়িতে তোমার কলম বেড়াতে গেছে নদীতে আকাশ দেখে আমরা বুঝেছি ছুটি পেলেই তুমি আবার আসবে




তোমার গ্রন্থ থেকে উঠে আসে মেঘ

আমার গ্রন্থে

আমার গ্রন্থ থেকে বৃষ্টি যায়

তোমার গ্রন্থে

এইভাবেই আমরা গ্রন্থপাঠ করি

আমাদের গ্রন্থপাঠে ভয় পায় নদী

আমাদের গ্রন্থপাঠে ভয় পায় সমুদ্র

গ্রন্থপাঠ শেষে আগুন গোনে

ক'টি নদী পার হলাম

ক'টি সমুদ্র পার হলাম




মহিষ

ছয় লাইনের কবিতায় যুবক নেই ... যুবতী নেই বাতাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে চলে গেছে সমুদ্রে সারাদিন একটা পাগল চিৎকার করে 'ভাঙা রেললাইন' 'ভাঙা রেললাইন'

'ভাঙা রেললাইন'

আঁচল পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেলে শ্লেট ভেঙে বেরিয়ে পড়ে মহিষ




ঝুমঝুমি

শিশুটি ঝুমঝুমি বাজাচ্ছে চক্কে উঠছে দুধ

আর চক্কে উঠছে মা

বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে ঝুমঝুমি গড়িয়ে যাচ্ছে

গড়িয়ে যাচ্ছে শিশু চক্কে উঠছে রাত

আর চক্কে উঠছে দুধ





নবান্ন

ধানক্ষেতে নেমে গেল উলঙ্গ মেয়েগুলি ধানক্ষেত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন মেয়েগুলির শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন দূর থেকে ছেলেটি দেখছে আগুন

ছেলেটির হাত-ঘড়ি বাঘের চোখের মতো জ্বলছে ঘড়ি থেকে এবার লাফিয়ে পড়বে বাঘ




বেড়াল

সকাল উল্টে আমি দেখি বেড়ালের আঁচড় বিকাল উল্টে আমি দেখি বেড়ালের আঁচড়

আঁচড় ধরে ধরে আমার যাওয়া আসা আমার শরীর জুড়ে জ্বর

এখানে কেউ আসে না এসেছে শুধু আপেল আপেলের কাছে আমি শুনি

আপেলের গড়িয়ে-যাওয়া

সমুদ্রের দিকে





লাল অক্ষর

মনে পড়ছে লাল সোয়েটার

সোয়েটারের শরীর জুড়ে ছিল একটি মেয়ের অজস্র লাল চুমু সোয়েটার উড়তে উড়তে পার হয়ে গেছে নদী নালা পাহাড় পর্বত

হু হু করে শীত বাড়ছে ভাঙা দাঁতের মতো পড়ে আছে লাল অক্ষর



চিড়িয়াখানা

আমি পেছনে ফেলে এসেছি স্টেশন আমার হাত ফেটে রক্ত পড়ছে আমি পেছনে ফেলে এসেছি স্টেশন আমার পা ফেটে রক্ত পড়ছে

শঙ্খ ভেঙে আমি অঙ্ক শিখেছি জলের আড়ালে রাখিনি জামাকাপড় জলের আড়ালে রাখিনি হারমোনিয়াম

আমি ঘুরিয়ে দিচ্ছি বাঘের মুখ আমি ঘুরিয়ে দিচ্ছি সিংহের মুখ আমি ঘুরিয়ে দিচ্ছি হাতির মুখ

শিশুদের পা থেকে উঠে আসছে রামধনু





অন্তর্জলি

পাখিকে আড়াল করে

লোকটি লিখছে

জুতার শেষ প্রান্তে পড়ে আছে মাঠ

এর কোনো মানে হয়?

এই বলে লোকটির ছেলে ছুটে গেল নদীর দিকে

গাছকে আড়াল করে

লোকটি লিখছে

জুতোর শেষ প্রান্তে পড়ে আছে মাঠ

এর কোনো মানে হয়?

এই বলে লোকটি নিজেই ছুটে গেল নদীর দিকে

ঘরের ভেতরে লোকটির বউ

নদী হয়ে যাচ্ছে



ঋণ: এখন বাংলা কবিতার কাগজ

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন