কবিতাপাঠের বদলে একটি ব্যক্তিগত স্টেরয়েড




                           উপরোল্লিখিত শিরোনামটির বদলে লেখাটির নাম দেওয়া যেত 'অ্যান্ড্রোজেনিক কান্না ও তার কাব্যিক শতনাম'। কারণ, অ্যান্ড্রোজেন বা অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন হলো সেই সকল প্রাকৃতিক স্টেরয়েড হরমোন, যেগুলো মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে কেবল পুরুষদের অ্যান্ড্রোজেন রিসেপ্টরকে বাঁধার কাজ করে। এটি পুরুষের যৌনাঙ্গ গঠন এবং গৌণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য গঠনেও কাজ করে থাকে। অন্যদিকে আবার এই অ্যান্ড্রোজেনের বিপাক সংঘটিত হয় যকৃতে; আর যেহেতু যকৃতের সঙ্গে হজম প্রক্রিয়া ও রেচন পদার্থ উৎপাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি জড়িয়ে আছে এবং তা চলতি কথায় পায়খানা করা নামেই পরিচিত, সেহেতু এই দুর্গন্ধময় লেখাটির শুরুতে একটু অ্যাকাডেমিক জ্ঞান আওড়ে নেওয়া গেলো। আসলে ফারসি থেকে এলেও 'পায়খানা' বর্তমানে একটি আদি ও অকৃত্রিম বাঙালী শব্দ এবং তার সঠিক নির্গমন না হওয়ার মতোই সকালবেলা দাঁত মাজা না হলে সারাটা দিন অস্বস্তিতে কাটে। আজকের দিনটা আমার তেমনই। তাড়াহুড়ো থাকায় সকালে আর দাঁতগুলোর ঘষামাজা করা হয়নি; শীতের আলসেমিতে কাল রাতেও করিনি। এখন কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে এসেছি। একটু পরেই আমার ডাক। কাল রাতে খাওয়া মাংসের ছিবড়ে, ভাতের আঠা, থালার কিড়মিড় সব লেগে আছে দাঁতে, দাঁত খুব স্মৃতিপ্রবণ কিনা! ----- সারাদিন গেছে, শুধুমাত্র টুথপেস্টের ছোঁয়া পায়নি বলে মুখের মধ্যে প্রজাপতি বনে রয়ে গেছে গন্ধ। উদাত্ত কবিতা পড়বার তাড়নায় সমস্ত এনার্জি জড়ো করেছি আমি, কথা বলিনি কারো সাথে, শুধু নিজেকে নিজে বুঝিয়ে গেছি, সান্ত্বনা দিয়ে গেছি কাব্যের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ আমার। আমাকে দাও ফিরে সেই অরণ্যের রোদন, হে নব সভ্যতা। 

                 অবশেষে অপেক্ষার অবসান, এইমাত্র ডাক এলো। দুটি কবিতা, সর্বোচ্চ চার মিনিট সময়। এখনও আমার মুখ বন্ধ। মুখের গহ্বরে লক্ষ লক্ষ গন্ধের জীবাণু মুক্তির জন্য অপেক্ষমান। ধীর পায়ে পোডিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মাইক্রোফোনের ঠোঁটে আমার চোখ গেলে যায়; তারপর পাতা পাল্টে দেখি দর্শক, শ্রোতাদের। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলে উঠি 'নমস্কার, শুভ সন্ধ্যা! আমি গন্ধমাদন পর্বতের শ্রেষ্ঠ কবি, বর্তমান বাংলায় আমার সমতুল্য কবি আর কেহ নাই, আমি আপন চক্ষুদ্বয় চড়কগাছে চরাইয়া ঘূর্ণমান সময়কে দেখিতেছি ঠারে ঠারে। অথবা দেখছি, সময়ের ভেতরে থাকা নিজেকে, নিজের ভেতরে থাকা একেকটি দিন; দিন কীভাবে আপনার ভেতরের মুহূর্তগুলোকে অতিবাহিত করে, সেই সব। কিন্তু এখন হিসাববহির্ভূত এক মাইক্রোবায়োম বলে মনে হচ্ছে নিজেকে, যদিও আমরা সংখ্যায় কয়েক লক্ষ, দান্তব মানুষের মুখবিবরে অনবরত ঘুরে চলেছি, দিকে দিকে ছড়াচ্ছি দুর্গন্ধ। আমাদের বলবার কথা অনেক, অনেক দুর্বলতা, কিন্তু শব্দের যন্ত্রণা আজকাল এতো তীব্র হয়েছে যে ---- গান আসছে, নাচ আসছে, অনর্গল আসছে হাসি। এতো গভীর গান আমি আগে কখনও গাইনি, এতো উন্মত্ত নাচ আমি আগে কখনও নাচিনি, এইভাবে হা হা করে হাসতে আমায় কে কবে দেখেছে আর! শুধু কবিতার ভেতর নথ নেড়ে নেড়ে আমি ক্রমশ নেকড়ে হয়ে উঠেছি, অথচ কামড়াবার সাহস নেই, গরজ নেই দ্রুত ছুটে চলার। তাহলে এই চলন্ত জন্মের শোধবোধ হবে কী করে! কবে! তারও কোনো যথাযথ উত্তর আমার অজানা। আমি উলোট-চণ্ডাল ফুলের মতো বিষাক্ত, অথচ অর্শ্বরোগের রক্তস্রাব আমার আকর্ষি বেয়ে উবে যায় সূর্যালোকের ছায়ায়, আবার ফিরে আসে শেকড়ে, একটুকরো অক্সিজেন সম্বল পেলে ঝুঁকে পড়ে আরো তলদেশে। কত অসংখ্য গাছের কবরে আমার দন্তহীন ছেলেবেলা পোঁতা আছে, শাশ্বত স্তবকের মতো সেখানেই সমুদ্র ফেরত অসহ্য নীল গুমরে থাকে ফুলের ভেতর, কোয়ান্টাম তথ্যের তারে সে আদ্যন্ত তামসিক। চেতনার মাসে ভাঙতে ভাঙতে ভাঙনের দিকেই ভেঙে পড়েছে, অথবা ভেঙে পড়বার অভিপ্রায় হয়ে বিগত জিবলি গাছের ডিজিটাল পথে দাঁড়িয়ে পড়েছে মৃত ----- স্তূপাকার ভক্তির ধূপে যেন গদগদমুণ্ড, আমার নৃমুণ্ড সৎকারে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো পৃথিবীর কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রেই এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু আজকাল এতো এতো কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে আমার যে একদম সময়ই পাই না লেখার। পড়াশোনা করতেও তীব্র অনীহা। প্রয়োজনে, মাঝে মাঝে করতে হয় যদিও। নইলে সারাক্ষণই মনে হয় শুয়ে থাকি। শুয়ে শুয়ে এটা সেটা ভাবি। ঘুমাই, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, জেগে জেগে উঠি, ভাবি। অনুশীলন করি রচনার। কিন্তু স্বভাবতই আমি কর্মবিমুখ। ফলে থমকে থাকি। আমার চারিদিকে পৃথিবীলোভী মানুষেরা ঘোরে; সমস্ত কৃত্রিম পার্থিব সুখ তাহাদের চাই। এতে তাহাদিগকে দোষ দেওয়া চলে না, এটাই তো স্বাভাবিক।  জগত এভাবেই চলে, আমার মতন কবিতা-লেখক দিয়ে নয়। অথচ এর সাথে অন্ত্যমিল দিয়ে আমি দিব্যি বলতে পারি --- 'I slept and dreamt that life was joy.' ----- কী দুঃসাহসিক অলসতা ভাবুন! কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয় না। মম হেজিমন, আকাশে বাতাসে শোনা যায় ইকো তারই -----

                          জানি কবিতার বদলে এইসব ছাইপাঁশ শুকতে আপনাদের বিরক্ত লাগছে, কিন্তু কী করবো বলুন, ইদানীং কবিতা লিখতে যেন ভুলে গেছি আমি। যেন কী! সম্ভবত ভুলেই গেছি। আমার মুখ এখন দুর্গন্ধে ভরপুর। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার যা যা বলবার ছিল তা কি বলা হয়ে গেলো কবিতায়! কিন্তু বলবারই বা কী ছিল? সত্যিই কি কিছু থাকে বলবার, অন্তত কবিতায়! বলবার কিছু থাকলে খবরের কাগজে কলাম লিখলেই হয়, খামোখা কবিতা কেন! ------ এইসব ভেবে ভেবে মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেছে। আগে তো আমি প্রায় প্রতিদিনই কবিতা লিখতাম, প্রতিটা মুহূর্তে কবিতার পঙক্তি মাথায় আসতো, চটপট সেগুলোর নোট নিতাম। কিন্তু এখন দীর্ঘদিন হয়ে গেলো, আর সেরকম হয় না। সেই পাগল পাগল ভাব আর আসে না, তুরীয় আনন্দ জাগে না, তার বদলে আসে অসহায় একটা ভাব, একটা হেজিমনিক অবস্থা। খুব কম কম মুহূর্ত আসে কবিতার জন্য। অথচ সারাক্ষণই আমি কবিতা নিয়ে ভাবছি, কী করা যায়, কী লেখা যায় ইত্যাদি। আমি ফুলটাইমার কবি হিসেবে নিজেকে দেখি, সবসময়। কিন্তু তবুও, কবিতা লেখা হয় না। কখনও কখনও হয় দুয়েকটা, কিন্তু মনমতো হয় না। আগে যেমন অনেক কবিতা লেখা থাকতো, কেউ চাইতো না আমার থেকে, আমি যেচে এখানে ওখানে পাঠাতাম; আর এখন কবিতা থাকে না, কিন্তু অনেকেই লেখা চায়। বাড়িতে হয়তো স্থির হয়ে বসে আছি, বসে আছি খাতা পেন নিয়ে, লেখা আসছে না, কিন্তু যেই গাড়ি চালাতে শুরু করি অমনি নানান লেখার বিষয় মাথায় আসতে থাকে। শান্তিপুর থেকে কৃষ্ণনগর যাতায়াত করতে করতে কত কিছু দেখি, কত দৃশ্য, কত ঘটনা, কত লাইন মাথায় আসে, কিন্তু ব্যস্ততায় গাড়ি থামানো যায় না, তাই লেখাও হয় না। চলন্ত গাড়িতে লিখতে পারলে প্রতিদিন অন্তত চার পৃষ্ঠা করে লিখতে পারতাম মনে হয়। কিন্তু দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরি তখন সেসব কিছুই আর মনে থাকে না, মাথা খুঁড়ে ফেললেও না। তখন হতাশ লাগে। মনে হয়, আমি কি তাহলে মানব প্রবৃত্তির প্রিয় আকাঙ্ক্ষা আর পূরণ না হ‌ওয়ার সেই দ্বন্দ্ব! নাকি জ্বর হলে মানুষকে যেমন দেখতে লাগে তেমনই অবহেলায় ঘুরে ঘুরে কাঁদে যে হৃদয় তার চোখ আচ্ছন্ন করা মৃত মেঘ, নাকি চিহড় গাছের পাতার তৈরি ঘঙে নিজেকে মুড়ে ফেলা টাটকা শিশির! ----- এইসব জটিল জিনিস, যৌগিক কারবার নিয়ে ফেঁসে গেছি। বন্দরে আমার আসা-যাওয়া আছে, অথচ আমি নেই, আমার হাওয়া ভেসে বেড়ায় অনন্তে। হাজার হাজার স্নায়ু মুখ থুবড়ে এসে ডানা ঝাঁপটায়, উত্তাল উন্মাদনা আছড়ে পড়ে, বিস্ময়ের অহংক্ষারে জ্বলে যায় শরীর,  গভীর আপন হবার চেষ্টায় বর্ণমালার জিহ্বাফলক, হঠাৎ হঠাৎ গান ধরে, নেচে ওঠে, হা-হা হি-হি হো-হো... চলতে থাকে। আমি একলাটি বসে 'অঘ্রাণের অনুভূতিমালা' পড়ি, পড়ে জানতে পারি 'দুপুরে এসব নেই, কোনো অস্পষ্টতা নেই আছে শুধু নিজের সুখেই / নিজে-নিজে খুশি থাকা, পরিষ্কার পরিস্ফুট হয়ে থাকা আত্মগরিমায়।' ---- ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কবিতাপাঠ শেষ হয়ে যায় কেবলমাত্র ধন্যবাদান্তে।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন