আশিস কুমার সরকার 






মুক্তি 

(ছোটগল্প)
রাত তখন একটা বেজে কুড়ি মিনিট। সেন্ট মার্কস্ স্কোয়্যারে সেই পরিচিত ভীড় এখন নেই। কিছু পর্যটক এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে।  অগাস্ট মাস। ভেনিসে তখন ভালই গরম। ভেনিসের মধ্যেই একশ সত্তরটা ক্যানেল আছে। অজস্র সরু সরু গলিতে জলের মধ্যেই বাড়ি। বাড়ির দরজা থেকে বেরোলেই জল। গাড়ি ঘোড়া, সাইকেলের কোন ব্যাপার নেই, শুধুমাত্র গন্ডোলা নামক নৌকোই যাতায়াতের একমাত্র উপায়। আর আছে স্টিমারের মতো জল ট্যাক্সি, তার নাম ভেপোরীতা।

গভীর রাত। রিয়ালতো ব্রিজের কাছে একটি ভেপোরিতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে একটি গন্ডোলা। সাদাকালো ডোরাকাটা ইউনিফর্ম পরে ইটালিয়ান মাঝি দাঁড় টানছে আর গুনগুন করে একটি পুরনো ভেনেশিয়ান ফোক্ সং গাইছে... 'ও সোলে মিও।'

গলি, গলির ভেতরে গলি। রাতের অন্ধকারে গণ্ডোলা চলেছে এমন এক জায়গায় যেখানে পর্যটকদের কোন আনাগোনা নেই। একটি লাল বাড়ির সামনে থেমে গেল গন্ডোলা। নীল রঙের দরজা। দরজার ওপরে একটি কমলা রঙের আলো। আলো এসে পড়েছে গন্ডোলার যাত্রির ওপরে। একজন মাত্র যাত্রী। হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখলে মনে হয় এ কোন মানুষ নয়, স্বয়ং যীশু। লম্বা চুল, অদ্ভুত রহস্যময় চোখ, শান্ত স্নিগ্ধ মুখ, লালচে দাড়ি, ছিপ ছিপে চেহারা। বয়স চল্লিশের আশেপাশে। হাতে একটি গিটার।

দরজার সামনে পাথরের ধাপে দাঁড়িয়ে দরজা নক্ করল সে। একবার, আরেকবার, আবার একবার। তাকে ছেড়ে গণ্ডোলা চলে গেছে। সেই কমলা আলোয় মনে হচ্ছে সকলের চোখের আড়ালে যীশু এসেছেন কাউকে মুক্তি দিতে। একা একা অপেক্ষা করছেন দরজার বাইরে।

দরজা খুললো এক ইটালিয়ান সুন্দরী। সোনালী চুল। কালো রংয়ের স্পোর্টস ব্রা আর ব্লু জিন্স। প্রায় সারা গায়ে উল্কি করা। ডান হাতে স্টিলের ব্যাঙ্গেল। গোলাপি ঠোঁটে একটা লম্বা কালো সিগারেট।

"কে তুমি?  এখানে কি চাই?"

"এস্তাস। কোকেন। হাসিস হলেও চলবে।"

"এখানে ড্রাগস্ বিক্রি হয় তোমাকে কে বললো?  এসব ডিল করি না আমি। অন্য দরজা দেখো।"

"তোমার নাম তো বিয়াঙ্কা, তাই তো? ভেতরে আসতে পারি?" শান্ত গলায় বললো এস্তাস।

ছোট্ট ঘরটার ভেতরে সবকিছু নীল। নীল আলো, নীল দেওয়াল, নীল সোফা, নীল কার্পেট। মনে হচ্ছে পুরো ঘরটাকে কেউ নীল বিষে স্নান করিয়েছে। মুখোমুখি বসে রয়েছে এস্তাস আর বিয়াঙ্কা। এস্তাস সোফায়। আর বিয়াঙ্কা মেঝেতে। বিয়াঙ্কা বসে রয়েছে বললে ভুল হবে, একটা কুশন নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে।

"মালকড়ি আছে কিছু? ফ্রিতে কিছু দিই না আমি।"

"আছে।" ছেঁড়া জিন্সের পকেটে হাত গলিয়ে একশো ইউরোর বেশ কিছু নোট বের করে এস্তাস।

"তুমি গিটার বাজাও? তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি। গত বছরে শীতের সময়টায়।"

"হমম.. বাজাই। গতবছরে সুইজারল্যান্ডে ছিলাম, গ্রিন্ডেলওয়াল্ডে। আমি এক বছরের বেশি কোথাও থাকি না।"

"হমম ঠিক ঠিক.. ওখানেই। তোমার মুখটা একবার দেখলে সহজে ভোলা যায় না। এইটা বললাম বলে আবার বেশি ইমোশনাল হয়ে যাওয়ার দরকার নেই।"

"তোমার সাথে বিছানায় শোবার আমারও কোন ইচ্ছে নেই। আমার ইমোশন শুধু এই আমার গিটার, আর কিছু নয়, আর কেউ নয়। আর কেউ নেই আমার। রাস্তায় জন্মেছি, রাস্তায় বড়ো হয়েছি। রাতের অন্ধকারে ডুবে থাকা রাস্তার সাথেই আমার প্রেম ভালোবাসা।"

"আরেব্বাস! তুমি তো দেখছি ফিলোসফার! তো কোকেন কবে থেকে চলছে বস্?"

"বছর খানেক। তার আগে মারিজুয়ানা নিতাম। নেশা চাই, নেশা। ঘোরের মধ্যে সুর আসে। সুর আসলে দুঃখ চলে যায়। রাস্তায় কতবার মারামারি করেছি। আমার দুহাতে রক্ত। এই হাতেই যখন সুর আসে তখন ওই মানুষগুলোর জন্য বড় কষ্ট হয়। ভুলেই যাই আমার জীবনটা কতটা অভিশপ্ত। তুমি বুঝবে না এসব বিয়াঙ্কা।"

"বুঝবো না যখন বোঝাও আমাকে। নেশা তো আমারও চাই। মনের নেশা, শরীরের নেশা, জীবনের নেশা। শোনাও, তোমার গিটার শোনাও আমাকে। যদি ইমপ্রেস করতে পারো, ফ্রিতে দেবো যা চাইছো। যা চাইবে সব। আমাকেও।"

"শুনবে? তোমার বাড়িতে ধূপ আছে?"

"ধূপ?  আছে, কিন্তু ওটা দিয়ে কি হবে?"

"নিয়ে এসে জ্বালাও এখানে।"

ঘরের এক কোণে টেবিলের উপরে ধূপ জ্বলছে। নীল ঘরটা তখন যেন এক মায়াপুরী। এস্তাসের আঙ্গুল ছুঁয়েছে গিটারের তার। চোখ বন্ধ। এক একটা স্ট্রোক বিয়াঙ্কার শিরা উপশিরায় রক্তে প্লাবন নিয়ে আসছে। কি অদ্ভুত সে সুর! কি উন্মত্ত সে ছন্দ! সে সুরের উত্তাপে যেন ফরাসি বিপ্লব, ভিয়েতনামের যুদ্ধ সবকিছু মোমের মত গলে যায়। আর মানুষের মন? একবার সেই সুরে ডুবলে মন নিজেই বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে, পৃথিবীতে না স্বর্গে! মনের গভীরতম দুঃখ, ধূপের সুগন্ধ আর মোহময়ী সেই সুর - এই ত্রিধারা যদি মিলে যায় তবে জীবদেহ নশ্বর জেনেও সকলে অমর হতে চাইবে, শুধু এই সুরপ্লাবন যেন থেমে না যায় এই কারণে।  এস্তাস আর মানুষ নেই এখন, চোখের সামনে জিসাস ক্রাইস্ট, জীবন্ত।

বাহান্ন মিনিট। বিয়াঙ্কা নিস্তব্ধ। পাথর। নিস্পন্দিত।

"আমি তোমাকে ড্রাগস্ দিতে পারবো না। তুমি নেশা চাইলে আমাকে নাও। আমার শরীরের প্রতিটা বিন্দু নাও,  কিন্তু ড্রাগস্ নয়, কিছুতেই নয়।"

"কেন দিতে পারবে না? ওটা যে আমার অন্য এক পৃথিবী।"

"ওটা মৃত্যু। তুমি তো জীবন। মৃতকে প্রাণ দিতে পারো তুমি। মুক্তি দিতে পারো তুমি।" চিৎকার করে ওঠে বিয়াঙ্কা।

"মুক্তি?  আমি মুক্তি দিতে পারি?"

"হ্যাঁ পারো পারো পারো! তুমি নিজেই জানো না তুমি কে! প্রথম বার.. এই প্রথমবার এস্তাস আমার এই অন্ধকার নরকটাকেও ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। কেন জানো? শুধু তুমি ছুঁয়ে দিয়েছো এই সবকিছু, তাই। তুমি বলেছিলে না আমি কিছু বুঝি না? হয়তো তোমার মত বুঝি না। কিন্তু এটুকু বুঝি প্রত্যেকটা মানুষ কোন একজনের জন্য অপেক্ষা করে। হয়তো সে তার অজানা, অচেনা। তবু সে বিশ্বাস করে কোন না কোনদিন এমন কেউ একজন আসবে তার জীবনে যার স্পর্শে মৃত মোমবাতিতে আগুন জ্বলবে, নিজের অস্তিত্বে আফসোস থাকবে না আর।"

এস্তাস চুপ করে শোনে বিয়াঙ্কার কথাগুলো। এরকম কথা কেউ তাকে আগে কোনদিন বলেনি। কে আগুন?  আর মৃত মোমবাতিটাই বা কে?  এস্তাস?  না বিয়াঙ্কা? প্রশ্নগুলো যেন ভেতর থেকে বড় অস্থির করে দিচ্ছে এস্তাসকে।

"তুমি যাবে আমার সাথে? আমার কোন চালচুলো নেই। তবুও.. যাবে? মুক্তি যদি দিতেই পারি সেটা প্রথম তোমাকে দিতে চাই।"

হাত বাড়ায় বিয়াঙ্কা। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। বাইরে গন্ডোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বহুদূর থেকে যেন কোন ডাক আসছে। বহুদূর... এখান থেকে বহুদূর। কোন নতুন জায়গা... কোন নতুন জীবন। 



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন