সুজিত কুসুম পাল



আদিবাসীর ক্রিয়েশন মিথ

প্রত্যেক জাতির একটি ক্রিয়েশন স্টোরি থাকে। নিজেদের কিছু অলিখিত কানুন থাকে। পৃথিবীতে এমন কোনো সংস্কৃতি নেই, যেখানে মিথ কিংবা কিংবদন্তি’র গল্প নেই। ক্যানাডার আদিবাসীদের মিথ, কিংবদন্তি কিংবা লোকসংস্কৃতির ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে টিকে আছে বিভিন্ন গল্পের ঝুড়িতে। আধুনিককালে এসে গল্পগুলি এখন লিখিত ভাণ্ডারে ঢুকে পড়েছে। এসব ঝুড়িতে আছে বিভিন্ন উপজাতির বিভিন্ন গল্প। গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য তথা অভিন্নতা ও ভিন্নতা। অতীতের গল্প বর্তমান শ্রোতার মননে এসে সম্পন্ন করেছে কালের ধারাবাহিকতা। নির্মাণ করেছে সাংস্কৃতিক মৈত্রী অতীতের সাথে বর্তমানের। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে আদিবাসীদের লুণ্ঠিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভূমি-অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রেরণা ও বোধ জাগাতে এই জাতীয় গল্পের কোনো বিকল্প নেই। তবে, এই প্রবন্ধের উপজীবিকা জাতীয় কিংবা সাংস্কৃতিক মিথ নয়, ক্রিয়েশন মিথকে ঘিরেই আজকের আলোচনা। 
আদিবাসীদের বিশ্বাস, তাঁদের পূর্বপুরুষরাই সমগ্র পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আদিবাসীরা বরফ যুগের শেষের দিকে অর্থাৎ প্রায় বারো হাজার বছর আগে একটি স্থল সেতু অতিক্রম করে এসেছিলেন এই অঞ্চলে। কিছু উপজাতির মতে, উত্তর আমেরিকা মহাদেশটি একটি কচ্ছপের পিঠে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয়, উত্তর অ্যামেরিকার ভূ-মানচিত্রটি দেখতে কিন্তু প্রায় একটি কচ্ছপ সদৃশ। সেই বরফ যুগের অ-সভ্য পূর্বপুরুষরা আজকের সভ্য যুগের এই অঞ্চলের মানচিত্রটি তাঁদের মানসপটে এঁকে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই গল্প থেকে প্রমাণিত হয়, মিথ মানবজাতির জ্ঞানের আদি ভাণ্ডার।
কিছু উপজাতি, যেমন ওজিবওয়ে, মনে করে সমগ্র বিশ্বটাই কচ্ছপের পিঠে। তাই, তাঁদের পৃথিবীর নাম কচ্ছপদ্বীপ। উল্লেখ্য, উত্তর অ্যামেরিকার আদিবাসী ছাড়াও, পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কচ্ছপ একটি সেলিব্রেটি প্রাণী। আফ্রিকান মিথে, কচ্ছপ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। চীনা পুরাণে কচ্ছপ একটি খুব শক্তিশালী প্রতীক। ফ্রান্সের তাহিতি দ্বীপে কচ্ছপ মহাসাগরের অধিপতি এবং ভারতীয় পুরাণে, বিষ্ণু’র অবতার।
গল্পের চিরকালিনতা
যে কোনো গল্প তার পাঠক কিংবা শ্রোতাকে নিজের পরিবেশ ও ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন ও ধারণে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। গল্পগুলো শোনার পর শ্রোতারা নিজেদের মতো করে একটি সমস্যার চরিত্র পাঠ করে তার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারে। বলা যায়, গল্পবলার মতো বিষয়টি যে কোনো জাতীয় সত্ত্বা ও ঐতিহ্যের অন্তর্গত অংশ। ক্যানাডা তথা উত্তর অ্যামেরিকার আদিবাসীদের গল্পবলার বিষয়টিকে, প্রকারের দিক থেকে, দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম প্রকার হলো ব্যক্তিগত গল্প যার মধ্যে রয়েছে পর্যবেক্ষণ, স্থানের বিবরণ এবং অভিজ্ঞতার বিষয়। এই ধরনের গল্প কালের পরিক্রমায় পরিবর্তিত ও বিকশিত হয় এবং জনসংখ্যার চাহিদা ও প্রাসঙ্গিকতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। দ্বিতীয় প্রকার গল্পগুলো শিক্ষণীয় যার মধ্যে রয়েছে মহাজগতের সৃষ্টিতত্ত্ব (ক্রিয়েশন স্টোরি)। শেষোক্ত গল্পগুলোকে বলা হয় কখনো মিথ, কখনো কিংবদন্তি। চরিত্রগত দিক থেকে এইসব কাহিনি আধ্যাত্মিক প্রকৃতির, এবং কালের পরিক্রমায় কাহিনিগুলো অপরিবর্তিত থাকে। 
ক্রিয়েশন স্টোরি
স্কাইওমেন ক্রিয়েশন স্টোরি এমন একটি গল্প যেটি পূর্ব ক্যানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ইরোকোয়ান উপজাতি শেয়ার করে। এসব উপজাতিদের মধ্যে রয়েছে কেনিন’কেহ্কা বা মওহাক, আনিশনাবে বা ওজিবওয়া, হাউডেনোসাউনি, টাইয়েন্ডিনাগা, ওনেয়ডা এবং অন্যান্য। এসব  ক্রিয়েশন স্টোরিগুলো বলে শোনাতে গেলে কয়েক সপ্তাহ বা এমনকি বছরও লাগতে পারে। আজকের লেখায় দুয়েকটি ক্রিয়েশন স্টোরি’র সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরা হলো।
আনিশনাবে ক্রিয়েশন স্টোরি
অনেক অনেক দিন আগের কথা। আকাশে তখন একটি ভাসমান দ্বীপ ছিলো। আমাদের পৃথিবীর মাটি, কিংবা সমুদ্র সম্পর্কে দ্বীপবাসীদের কোনো ধারণাই ছিলো না। এই দ্বীপের বাসিন্দারা আসমানি জাতি হিসেবে পরিচিত ছিলো। একদিন এক আসমানি নারী খাদ্যের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ক্ষুধা নিবারণের জন্যে তিনি হয়তো কিছু বেরি জাতীয় ফল আর শাক-পাতা পেয়ে যাবেন। বেরি ফল না পেলেও কিছু দূর যেতেই তিনি ভালো জাতের বড়ো একটি বৃক্ষের সন্ধান পেলেন। গাছের নাম জীবনবৃক্ষ (ট্রি অফ লাইফ)। কিছু শেকড়ের আশায় ক্ষুধার্ত এই নারী গাছটির চারিপাশে খুঁড়তে শুরু করলেন। খননকাজের এক পর্যায়ে তিনি দেখলেন গাছটির নীচে বিরাট একটি ফাঁকা উন্মুক্ত গর্ত। স্থানীয় পশুরা শুরু থেকেই আসমানি নারীকে এইভাবে গাছের গোড়া খনন করতে বারণ করেছিলো। তারা বলেছিলো, এই গাছের গোড়ায় কোনো খাবার পাওয়া যাবে না। বরং এইভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করলে গর্তের মধ্যে মেয়েটির পড়ে যাওয়ার আশংকা আছে। 
আসমানি মেয়েটি তখন খুব ক্ষুধার্ত ছিলেন। তিনি জানতেন না যে, তিনি তখন সন্তান সম্ভবা এবং তাঁর গর্ভে তখন যমজ সন্তান। ক্ষুধার তাড়নায় তিনি তখন পশুদের সতর্কবার্তা কিংবা জ্ঞানকথা কানে নিতে পারেন নি। ততক্ষণে বড়ো একটি গর্ত খনন করা হয়ে গেছে। ঘূর্ণায়মান অন্ধকার ভেদ করে গর্ত দিয়ে দৃশ্যমান হলো ঝকমকে আলো। কিছুটা ঝুঁকে পড়ে দেখতে গিয়ে মেয়েটি নিজের তৈরি অন্ধকার সুরঙ্গের মধ্যে পড়েই গেলো। 
সুরঙ্গ বেয়ে পড়ছে তো পড়ছে। নিচে আরো নিচে। ক্রমশ পতন। আকাশ থেকে ক্রমশ পৃথিবীর দিকে। পৃথিবী তখন জলমগ্ন। কোথাও কোনো স্থলভূমি নেই। উপরে আকাশ, নিচে জল। জলপ্রাণীরা তাকিয়ে দেখলো, আকাশদ্বীপের সুড়ঙ্গ বেয়ে একটি মেয়ে তাঁদের দিকেই নেমে আসছে। তারা খুব আতংকিত ও চিন্তিত হয়ে পড়লো। তাদের আশংকা, মেয়েটির পতনের ফলে তাদের পৃথিবীর জলভাগের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। জলপ্রাণীরা তাদের করণীয় নির্ধারণে এক জরুরি সভায় মিলিত হলো। আলোচনা করে ঠিক হলো, আকাশ থেকে পতনরত মেয়েটিকে জলে পড়ার আগেই ধরে ফেলতে হবে। উত্তপ্ত আলোচনা – কে ধরবে, কীভাবে ধরবে? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, রাজহংসীরা এই গুরু দায়িত্ব পালন করবে। তারা তাদের ডানা মেলে ধরলো। নির্মিত হলো এক বিশাল পালকের জাল, যার ওপর চিত হয়ে অবতরণ করলেন আকাশ থেকে পতিত এই নারী। সম্পন্ন হলো অভিবাদন পর্ব। জলপ্রাণীরা এখন তাঁর অভিবাসন পর্ব নিয়ে আলোচনায় বসলো। তারা অনুধাবন করলো, আসমানি নারী সাঁতরাতেও পারবেন না, উড়তেও পারবেন না; তাঁকে এখন দাঁড়াতে হবে। আর, তাঁর দাঁড়াবার জন্যে প্রয়োজন মাটি। সর্বসম্মতভাবে, একটি ক্ষুদ্র প্রাণি ডুব দিয়ে বিশাল জলরাশির তলদেশ থেকে কিছু মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে এলো। একটি কচ্ছপ স্বপ্রণোদিত হয়ে সংগৃহীত মাটিগুলো তার পিঠের ওপর রাখার প্রস্তাব দিলো। তা-ই করা হলো; কচ্ছপের পিটের ওপর মাটি রাখা হলো। তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়ে গেলো একটি বিস্ময়কর প্রক্রিয়া। কচ্ছপের পৃষ্ঠদেশটি ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে হতে বর্তমান পৃথিবীর আকার ধারণ করলো। তারপর এই পৃথিবীর বুকে ভূমিষ্ঠ হলো আসমানি মেয়ের দুটি যমজ ছেলে। বর্তমান পৃথিবীকে এতো সুন্দরভাবে সাজানোর পেছনে এই দুই সন্তানেরই অবদান।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটিশ কবি জন মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (১৬৬৭) মহাকাব্যে এই রকম একটি বৃক্ষের উল্লেখ আছে। স্বর্গের ইডেন গার্ডেনের বৃক্ষটির নাম ‘ট্রি অফ নলেজ’ বা জ্ঞানবৃক্ষ। নিষেধ থাকা সত্বেও এই বৃক্ষের ফল খাওয়ার কারণে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রথম মানব ও মানবীকে স্বর্গ থেকে নেমে আসতে হয়েছিলো পৃথিবীতে। আদিবাসীর এই কচ্ছপদ্বীপের গল্পে আমরা জানলাম ‘ট্রি অফ লাইফ’ বা জীবনবৃক্ষের শিকড় খেতে চাওয়ার প্রচেষ্টার কারণে আসমানি মানবীকে পৃথিবীতে অবতরণ করতে হয়েছিলো। অসাধারণ অভিন্নতা।
নেহিয়াওয়াক ক্রিয়েশন স্টোরি
নেহিয়াওয়াক, যারা ক্রি নামেও পরিচিত, জাতিগোষ্ঠির সৃষ্টিতত্ত্বের গল্পটি একটু ভিন্নরকম। কায়স (একটি আদিবাসী শব্দ, যার অর্থ বহুকাল আগের কথা), কচ্ছপদ্বীপ নামে একটি পৃথিবী ছিলো। প্রাণীরা সেখানে হেঁটে, উড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা সরীসৃপ হয়ে শান্তিতে বসবাস করছিলো। সাগরের নীল জলে সাতারু প্রাণীদের জীবন যাপিত হচ্ছিলো সাতার কেটে আনন্দ করে। সৃষ্ট প্রাণীদের এমন শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান দেখে সৃষ্টিকর্তা বেশ হাসলেন। দুনিয়া সৃষ্টির এই গল্পে উইসাসেজ্যাক নামে একটি চরিত্র আছে। ক্রী তথা নেহিয়াওয়াক গোত্রের আদিবাসীদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে অনেক মিথ কাহিনি আছে। তাঁর আবার কোনো লিঙ্গ নেই। একটি পৌরাণিক ধূর্ত চরিত্র হিসেবে তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি আছে এসব কাহিনিতে। সৃষ্টিকর্তা একটি বিশেষ কারণে উইসাসেজ্যাককে সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি তাঁকে সব প্রাণীর দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন যাতে তাঁর সৃষ্ট সকল প্রাণী সুখে থাকে। কিন্তু কচ্ছপ দ্বীপের প্রাণীরা একে অপরকে অসম্মান করতে শুরু করে। উইসাসেজ্যাক সেই মহান দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। ক্রমশ তিনি অলস হয়ে ওঠেন। কচ্ছপ দ্বীপের প্রাণীরা একে অপরকে অসম্মান করতে শুরু করে। তারা পরস্পরের মধ্যে নানান বিবাদ এবং খুনাখুনির মতো অপরাধবৃত্তি শুরু করলে সৃষ্টিকর্তা উইসাসেজ্যাককে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয় বলে দেন, “হে উইসাসেজ্যাক, তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তোমার সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। কচ্ছপ দ্বীপের পরিচ্ছন্নতা ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে দ্বীপের জমি, বন, পাহাড় ইত্যাদি কেড়ে নেয়া হবে।“ উইসাসেজ্যাক সৃষ্টিকর্তার হুঁশিয়ারিকে কথার কথা মনে করে পাত্তাই দিলেন না। তিনি অলস হয়ে প্রাণীদের সকল অপকর্মের নীরব সাক্ষী হয়েই থাকলেন। মারামারি, খুনাখুনি এতই বেড়ে গেলো, কচ্ছপ দ্বীপ রক্তে রক্তিম হয়ে উঠলো। দ্বীপ পরিষ্কার করার জন্যে মহান সৃষ্টিকর্তা বৃষ্টির আয়োজন করলেন। বৃষ্টির অবিরামতা ও প্রবলতার কারণে স্থলভূমির সমস্ত প্রাণী ডুবে গেলো। কচ্ছপদ্বীপ পরিণত হলো একটি কিনারাহীন সমুদ্রে। কেবলমাত্র বেঁচে রইল জলপ্রাণীরা। গাছগুলো মাটি থেকে আলগা হয়ে ভাসতে লাগলো। সম্পূর্ণরূপে জলে ভরা পৃথিবীতে স্থলভূমির মাত্র চারজন বেঁচে গেলো। বেঁচে যাওয়া বিভার (বড় জাতের আধা জলজ ইঁদুর), অটার (ছোটো জাতের আধা জলজ মাংশাসী স্তন্যপায়ী প্রানী) এবং মাসক্র্যাটকে (মাঝারি জাতের আধা জলজ ইঁদুর) সঙ্গে নিয়ে উইসাসেজ্যাক আশ্রয় নিলেন সাগরের মাঝখানে ভাসমান একটি বড় গাছে। উইসাসেজ্যাক এখন খুবই অনুতপ্ত। নিজের বোকামি, অপরাধ ও ভুলের জন্যে নিজের ওপর রাগ করে তিনি কেঁদে ফেললেন। স্থলভূমির রাজত্ব হারিয়ে তিনি এখন কাঁদতে কাঁদতে বাকরুদ্ধ। দিশাহারা হয়ে উইসাসেজ্যাকের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দুঃখ-ভারাক্রান্ত বিভার, অটার এবং মাসক্র্যাট। তারা উইসাসেজ্যাকের কাছ থেকে জানতে চাইলো এই অবস্থায় তাদের কিছু করণীয় আছে কিনা। তিন প্রাণীর কথা শুনে উইসাসেজ্যাক সাহস পেলেন। তিনি তখন একটি পরিকল্পনার কথা ভাবতে শুরু করলেন। চতুর (এই মুহূর্তে জ্ঞানী) উইসাসেজ্যাক জানতেন, যদি তিনি জলের নীচ থেকে পুরনো পৃথিবীর সামান্য মাটি পেতে পারেন, তবে তিনি তাঁর ঈশ্বর-প্রদত্ত শক্তির অবশিষ্ট কিছু ব্যবহার করে বসবাসের জন্য একটি ছোট দ্বীপ তৈরি করতে পারেন। তিনি জানতেন, তাঁর সাথে এই ভাসমান বৃক্ষে অবস্থানরত তিনটি প্রাণী-ই সাঁতারু। 
তিনি প্রথম অটারকে জিজ্ঞেস করলেন, সে জলের নীচ থেকে মাটির কিছুটা তুলে আনতে পারবে কিনা। অটার একজন শক্তিশালী সাঁতারু। খুশিতে গভীরে ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ পর সে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আসে। কিন্তু তার থাবায় কোনো মাটি দেখা গেলো না। উইসাসেজ্যাক এবার বিভারকে জিজ্ঞেস করলেন, সে ডুব দিয়ে এক টুকরো মাটি নিয়ে আসতে পারবে কিনা। বীভার একজন দুর্দান্ত সাঁতারু। একটি সমতল শক্তিশালী লেজের কারণে সাঁতারে তার দক্ষতা অনেক বেশি। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিভার ডুব দিলো। বেশ কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হলো। সবাই অধীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে। এক সময় বিভার জলের ওপরে উঠে আসে। কিন্তু প্রায় আধমরা অবস্থা বিভারের। তার থাবাতেও কোনো মাটির গন্ধ নেই। 
উইসাসেজ্যাক এখন বেশ হতাশ অবস্থায়। ডুব দিয়ে পুরনো পৃথিবীর মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে দুই সেরা সাঁতারুর প্রাণ যায় যায়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, “আমি আপনার জন্যে কিছু মাটি নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি, উইসাসেজ্যাক।“ সবার দৃষ্টি তখন মাসক্র্যাটের দিকে। মাসক্র্যাটের কথায় বিভার ও অটার ব্যঙ্গ হাসিতে ফেটে পড়লো, “যে কাজ আমরা করতে পারি নি, তুমি এতো ছোটো প্রাণী হয়ে সেই কাজ করার সাহস পাও কী করে?” বিভার ও অটারের ঠোঁটে ব্যঙ্গ হাসি দেখে উইসাসেজ্যাক একজন আদর্শ লিডারের ভূমিকা নিলেন। জিততে হলে শেষ বলে দুই রান দরকার, এমন অবস্থায় ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন যেভাবে বোলারের সাথে একাত্ম হয়ে তাৎক্ষণিক করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন, অনেকটা সেইভাবে এগিয়ে আসলেন জ্ঞানী উইসাসেজ্যাক। তিনি নিচু হয়ে মাসক্র্যাটকে তাঁর দুই হাতের তালুতে তুলে নিলেন। ছোট্ট প্রাণীটির বাদামী চোখের দিকে তাকিয়ে নেতা বললেন, “মাসক্র্যাট, তুমি কি সত্যি মনে করো যে কাজটি তুমি করতে পারবে?” জবাবে কৌশলী সাঁতারু বললো, “দেখতে থাকো, আমি কী করি।“ মাসক্র্যাট এবার ডুব দিলো। কিন্তু কোনো খবর নেই। সবার জন্যে নতুন পৃথিবীর প্রত্যাশা নিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে ফিরে এলো মাসক্র্যাট। কিন্তু না, তৃতীয় থাবায়ও মাটির কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না। হঠাৎ উইসাসেজ্যাক উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ মাসক্র্যাট, থাবায় নেই তাতে কী, আমি তোমার পায়ে মাটির গন্ধ পাচ্ছি। তুমি তোমার কর্মের সাফল্যের খুব কাছাকাছি এসে গেছো।“ দলনেতার চোখে মুখে প্রত্যয়ের ছাপ দেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে মাসক্র্যাট আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো জলদেশের অভ্যন্তরে। বন্ধুর প্রত্যাবর্তনে বিলম্ব হওয়ায় বিভার ও অটার অনেক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। নিজেদের ব্যঙ্গার্থক আচরণ ও হাসির জন্যে তারা অনুতাপ ও শোক প্রকাশ করলো দলনেতার কাছে। উইসাসেজ্যাক জলের উপরিভাগের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। দেখলেন, কিছু বুদবুদের আনাগোনা। উইসাসেজ্যাক অনুধাবন করতে পারলেন, এই বুদবুদ বন্ধুর প্রত্যাবর্তনের আভাষ। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ পার হয়ে যাওয়াতে নেতা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এবার তিনি নিজেই ডুব দিয়ে মাসক্র্যাটের প্রায় নিষ্প্রাণ দেহটিকে জলের ভেতর থেকে টেনে নিয়ে এসে রাখলেন ভাসমান বৃক্ষের ওপর। জ্ঞান ফিরলে বন্ধু তার থাবা খুললো; প্রত্যাশিত এক টুকরো মাটি দেখে সবার প্রাণে জ্বলে উঠলো আগামির আলো। 
উইসাসেজ্যাক বিলম্ব না করে সংগৃহীত মাটিতে একটি ফুঁ দিয়ে তাঁর শক্তিকে সঞ্চারিত করলেন। মাটি ক্রমশ প্রসারিত হতে হতে একটি দ্বীপের আকার ধারণ করলো। সৃষ্টি হলো নতুন পৃথিবী। কোনো কোনো গাল্পিক বলেন, পরম সৃষ্টিকর্তা উইসাসেজ্যাক ও তাঁর বন্ধুদের প্রতি করুণা করে পৃথিবীটা আবার নতুন করে গড়ে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন, নতুন দ্বীপ সৃষ্টি করার জন্যে উইসাসেজ্যাক কিছু কাঠ ও মৃত প্রাণীর হাড় কাজে লাগিয়েছিলেন। 
জ্ঞানের সঞ্চালন 
গল্প এবং গল্প বলার মধ্য দিয়ে, আদিবাসী সমাজগুলো তাদের উদ্বর্তনের (সারভাইভাল) জন্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রয়োজনীয় জ্ঞান সঞ্চালন করে আসছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তারা সুখি ও সুস্থ কমিউনিটি গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজেদের সাংস্কৃতিক কাঠামো নির্মাণ করে। প্রকৃতপক্ষে গল্প অনেক শক্তিশালী। গল্প মানুষের ভেতর থেকে শক্তিশালী আবেগ বের করে নিয়ে আসতে পারে। গল্প আমাদেরকে কাঁদাতে পারে, হাসাতেও পারে। রাগ, স্বস্তি, সহানুভূতি এবং ভালোবাসাও জাগাতে পারে। মানুষ গল্প বলতেও আনন্দ পায়, শুনতেও আনন্দ পায়। যেখানেই এবং যখনই লোকজন মিলিত হয় সেখানেই গল্প হয়। বাইরের লোকেরা এই গল্পগুলিকে কিংবদন্তি, কল্পকাহিনী, লোককাহিনী, পৌরাণিক কাহিনী বা রূপকথার গল্প হিসেবে দেখতে থাকে। আদিবাসীদের এই গল্পগুলি তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সৃজনশীলতার জন্যে একান্তই অপরিহার্য। এই গল্প তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে সঠিক আচরণ শেখার জন্যে নির্দেশনা প্রদান করে। বৈশ্বিক সংযোগ রক্ষা করে বেঁচে থাকার পথ প্রদর্শন করে। 


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন