কাব্যগ্রন্থ: ধরিত্রীনগর
কবি: কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক: রূপশালি
প্রকাশ সময়: ২০১৯ তারকেশ্বর লিটিল ম্যাগাজিন মেলা
আলোচক: মুরারি সিংহ
একাকী নিঃসঙ্গ এক কবির কবিতাকেই আঁকড়ে ধরে হাঁটা
ধরিত্রীনগর। ছাব্বিশটা কবিতা নিয়ে কল্যাণ চট্টোপাধায়ের দু-ফর্মার কবিতার বই। প্রকাশিত হয়েছে রূপশালি, বিবেকানন্দ পল্লী, হুগলি থেকে। প্রকাশকাল ২০১৯ সাল, তারকেশ্বর লিটিল ম্যাগাজিন মেলা।
কল্যাণ চট্টোপাধায় নয়ের দশকের কবি। কবিতা পাক্ষিক-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা উত্তাল নয়ের দশক। কবিতা পাক্ষিক-এরই ৪০ সংখ্যায় কল্যাণের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তারপর ৪৬, ৪৮, ৫১, ৫৩... , কল্যাণের কবিতা প্রকাশিত হতেই থাকে। নয়ের দশকের কবিতা কবিতা পাক্ষিকে লেখালিখি শুরু অথচ কবিতার নতুন জোয়ারে এবং নব্বইয়ের কোলাহলে কল্যাণ গা ভাসিয়ে দেয়নি। কবিতা-ভাবনা ও প্রকশে সে বরাবরই স্বতন্ত্র থাকতে চেয়েছে। কবিতাকে আঁকড়ে ধরে একাকী ও নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছে। তার বিশ্বাস কবিতার নতুন ডায়মেনশনে। ভালোবাসা ভাঙছে না। প্রেম ভাঙছে না। থেকে যাচ্ছে ভালোবাসার একটি নতুন নির্মাণ। তার কবিয়ায় প্রথাবদ্ধ প্রেম-ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে কল্যাণ ট্রাডিশনাল ভাবনার পথেই হাঁটতে চেয়েছে। তার লেখায় যেমন আবেগের কোনো বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই, তেমনি তুখোর বুদ্ধির মারপ্যাঁচও অনুপস্থিত। এবং নেই নরম শব্দের আদিখ্যেতা। প্রতিটা কবিতাতেই আছে শুধুই কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতির সহজ-সরল প্রকাশ।
কবিতা পাক্ষিকে প্রকাশিত প্রথম কবিতা ‘সকাল’-এ কল্যান লিখেছিল ‘আজকের মতো সকাল যতটা পারো লুটেপুটে নাও/ .... / এসো সবাই আজ সবুজ হয়ে উঠি - / কচিরোদে উৎসুল্ল হওয়া সবুজ।’ শুরু থেকেই তাই কল্যানের কবিতার মূল-ভাবনাই যেন হয়ে উঠেছিল এই সবুজ হয়ে ওঠা। নতুন বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে সে জানাচ্ছে- ও ধরিত্রীনগর, ও ধরিত্রীনগর / চূর্ণ শূন্যতার ভেতর কিছু সবুজের কণা দাও’। কল্যাণের ভাব প্রকাশের ভঙ্গি সহজ ও ভাষা সাধাসিধা। কোথো কোনো বাহুল্য নেই। বাড়তি আবেগ বা উচ্ছ্বাস নেই। সীমানা ভাঙার আগ্রহ নেই। কল্যাণ বরাবরই ভাবের প্রকাশকে নিজস্ব ঢঙের মধ্যে আটকে রাখতে চেয়েছে। তার কবিতায় যতিচিহ্নের ব্যবহারও খুব কম।
কিন্তু প্রত্যেকের যাপনে সময় বলে একটা ব্যাপার আছে। যে সময় একটু একটু চারপাশকে বদলে দেয়। ব্যক্তি-মানু্ষও সেই বদলের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না। সে যে মন-মানসিকতা নিয়ে কল্যাণ সেদিন বলেছিল করেছিল- ‘এসো সবাই আজ সবুজ হয়ে উঠি’, সেই মন কি সে ধরে রাখতে পেরেছে? তিরিশ বছর সময়টা নেহাৎ কম নয়। স্বাভাবিক কারণেই এই দীর্ঘ সময় কল্যাণের জীবন এক জায়গায় থেমে থাকেনি, তাকে নানা বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করতে হয়েছে , নানা কঠিন-কঠোর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, বহুমুখী ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে যৌবনের স্বপ্নগুলোও আর অটুট থাকেনি, ভেঙে গেছে, ছেতরে গেছে। তার সেই উপলব্ধির কথা প্রকাশ পেয়েছে তার নতুন বইয়ের কবিতার নানা জায়গায়। বাস্তব ও রূঢ় জীবনকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে থাকা কবির অনুভবের এই সব ঝলক, পাঠককেও বড়ো আনমনা করে দেয়। বইকী—
ক) এই পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিদিন বেমানান লাগে – দূরত্ব।
খ) ক্রমশই চোখ মুখ দাঁত মাড়ি / কথা বলার ভাষা ও চলন/ একজন বখাটে ছেলের মতো হয়ে উঠছে – ভয়।
গ) মাতাল মনের ভেতর শুধু আগাছা-জঞ্জাল – গ্রন্থি। একটা সময়ের শেষে জীবনে শুধু বিলাপ পড়ে থাকে – গন্তব্য।
ঘ) মানুষ মানুষের কাছে এখনো জন্তু – বিচ্যূত। সম্পর্ক এখন বিলাসিতা – সম্পর্ক। পাশে তো কেউই থাকে না – জীবন।
ঙ) একটা স্তব্ধ শহরের ভেতর / আমি হাত-পা নাড়াই / হাত-পা নাড়াই/ চিলচিৎকারে হাত-পা নাড়াই – কলকাতা
চ) সুখ কি পেরেছে কখনো স্বচ্ছ থাকতে – সুখ।
ছ) আমার তো নড়বড়ে জীবন / মাঠ হাওয়া আর গাছেদের ভেতর কেটে গেল/ মিশ্রদিন – সময়।
জ) রঙ মাখতে মাখতে আমরা সবাই মিশে যাচ্ছি/ বহুরূপী কিংবা জোকারে জগতে – অপর।
কল্যাণ যা বলে তা খুব সরাসরি। আড়াল নেই, হেঁয়ালি নেই। কল্যাণ অতিকথনও পছন্দ করে না। তার কবিতার শিরোনামগুলোও তাই এক-শব্দের এবং যাপনের চারপাশ থেকে নেওয়া। যেমন- সময়, অনন্ত, আবহমকান, সংসার, বাড়ি, সুখ, স্বপ্ন, সৃষ্টি, বিচ্ছেদ, অশক্তি, ভয়, গন্তব্য, গ্রন্থি, বিচ্যূত, দূরত্ব, কলকাতা, স্তব্দ, প্রয়াণ- এইসব।
কবিতার মাঝে মধ্যে কল্যাণের রোম্যান্টিক অনুভবের ঝলক দেখা যায়, সেখানে আবার রোম্যান্টিকতার সঙ্গে মিশে থাকে বিমূর্ত ভাব—
ক) হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি মনে হয়/ পায়ের নীচে চাঁদের বায়ুস্তর/ চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ – আরোগ্য।
খ) আমার আঁতুর মাঠের ওপর কতদিন জ্যোৎস্না দেখিনি/ রক্তে রক্তে শুধু চাঁদ খেলে যায় – আপশোস।
গ) আড়ায় টাঙানো রঙিন ফুলের ভেতর / আমি দেখি সাদা সাদা পুলিশকাকু/ বুকে স্টিকার লাগিয়ে/ আমার দিকে অঙ্গভঙ্গি করছে। আমাকে ব্যর্থ আদরের ভালোবাসা নিয়ে – কলকাতা ।
ঘ) আমার সৃষ্টির পথে মায়ামেঘ জমে আছে – সৃষ্টি।
ঙ) আয়নার কাচের মতো সুখ / আমি তোমাকে প্রতিদিন সাদা কাপড়ে মুছে রাখি – সুখ।
চ) আকন্দফলের মতো পৃথিবী/ আকন্দাঠার মতো পৃথিবী/ মাড়িয়ে মাড়িয়ে ধ্রুবনক্ষত্রের কাছে যাচ্ছি – ধ্রুবনক্ষত্র।
ছ) তোমার শাড়ির রঙিন পাড়/ মায়াবি সরুসুতোর মেঝে / রচনা করছে বিষণ্ণ ছায়াপথ – ধ্রুবনক্ষত্র।
এই রকমই সব রোম্যান্টিক ভাবনা থেকেই কল্যাণ মাঝে মাঝে তার ভাব-ভাবনা নিয়ে এক অলৌকিক খেলায় মেতে ওঠে। নিজের ইচ্ছেকে ডানা মেলে উড়তে দেয়। তিরিশ বছর কবিতা-যাপনের পর কল্যাণ তার এই বইয়ের প্রথম কবিতা ‘অনন্ত’-তে এসে লিখল—‘যেদিন বুঝতে শিখলাম/ সময়ের বুকের ভিতর ডানা গজিয়েছে/ আমি ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে সটান / রাস্তায় নেমে পড়লাম /... /
আমি কিছু তোয়াক্কা না করে / হাঁটতে শুরু করলাম অনন্তের দিকে ’।
কিন্তু কল্যাণের এই অনন্তের রূপ কেমন, সে কি এক আদিম পৃথিবী, হয়ত তাই—
ক) প্রত্যেকেই আদিম ও আদিবাসীদের কথা বলে (দূরত্ব)।
খ) নক্ষত্রের জন্মকথা শুনতে শুনতে আমার/ গুহা ও গুহামুখের কথা মনে হয়”। আবহমান।
ঘ) ‘তবু আমি পুরনো প্রস্তর যুগ, নতুন প্রস্তর যুগ/ লোহা ও চাকা আবিষ্কারের কথা ভাবি’।
কিন্তু রোম্যান্টিক ভাবনার মধ্যে কল্যাণ খুব বেশি সময় নিজেকে বেঁধে রাখতে পারে না। জীবনের চলার পথে অহরহ যে ঝড়-ঝাপটা গায়ে এসে লাগে এবং দেহ-মনকে কাঁপিয়ে দেয় সেই ঠকঠকানি কে কল্যাণ লুকোবে কী করে? জীবনের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন কবিরর স্বপ্নগুলো ভেঙে যায়। সে বুঝতে পারে অস্থির সময় মানুষে মানুষে সম্পর্ককে কত জটিল করে তুলেছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নানা রকম দূষণের কারণে চারপাশ ক্রমশ বিষিয়ে উঠছে।–
ক) আমরা সুসভ্য জাতির প্রতিভূ/ যতই স্যুট-প্যান্ট পরি / প্রতিদিন পৃথিবীর থেকে দূরত্ব রচনা হয়- দূরত্ব।
খ) এই ২০১৯-এ গ্লোবাল ওয়ার্মিং ঘিরে ফেলেছে/ বাংলার ছোটো ছোটো গ্রাম পাড়া / এতকালের জমাট স্বপ্নেরা গলে গলে পড়ছে/
সমতলে/ কষ্ট হচ্ছে, বড্ডো কষ্ট হচ্ছে- – ভয়।
গ) বায়ুস্তরে অক্সিজেন বিষিয়ে আসছে/ পৃথিবীতে পানীয় জলের যোগান কমছে/ সামাজিক অবস্থা নড়বড়ে – সম্পর্ক।
ঘ) সিঁড়িতে ওঠানামায় / সামনে পিছনে এত ঠেলাঠেলি/ টাল আর সামলাতেই পারি না – স্তব্দ।
ঙ) এইসব সংসারীরা সমাজের ভাষা বোঝে না / যেটুকু তাপ ও উত্তাপ আলো পায় প্রকৃতি থেকে / তার সবটাই / সামাজিক বিষ
হয়ে ফিরে আসে – জন্তু।
চ) অস্থির সময় – অস্থির সময়/ হাত নেড়ে থামায়ে চাইলেও / অক্সিজেনেরা উল্লাস করে চলে যায় – সৃষ্টি।
ছ) আসলে আমার স্বপ্ন বলতে / প্রতিদিন সকালের নতুন খবরের কাগজ – স্বপ্ন।
দৈনন্দিনের এইসব ধাক্কা থেকেই কবির মন নস্ট্যালজিয়ায় ভোগে। কবি যে এক দিন প্রান্তিকের বাসিন্দা ছিল, এখন নেই; নিজের গ্রামে থাকার শপথ ভেঙে সেখানকার পরিচিত পরিবেশ ও পরিজনদের ছেড়ে এখন সে উঠে এসেছে শহরে ফ্ল্যাটে। তার কিছু কবিতায় সে কথাও প্রকাশিত হয়। -
ক) কখন যে সময় এসে শপথ ভেঙে দেয়/ এইসব ব্যাপার আমার জানাই ছিল না/ আজ ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে / দেশের একটা
বাড়ি, কয়েকটি কৃ্ষ্ণচুড়া গাছ / আর পাখিদের কথা মনে পড়ে / মনে মনে একদিন যাদের বলেছিলাম, / তোদের ছেড়ে কোথাও
যেতে পারব না - বিচ্ছেদ।
খ) যে মাটি পেরিয়েছি ৪০ বর্ষা, শীত ও বসন্ত / সেই মাটিও কি কখনো অপর হতে পারে – অপর ।
গ) খুবই স্পষ্ট মনে আছে / লালসিমেন্টে বাঁধানো একটা দুয়ার/ অদূর উঠোন হয়ত আজও / কথা বলে অঠে কাঠচাঁপা আর জামের
গাছে - বাড়ি।
ঘ) যেন আমার ছেলেবেলার ক্লোরোফিল/ হই হই করি, হাততালি দিই / মজা করতে করতে যে পথে হেঁটে যাই/ তার সবটাই
আলপথ, কৃষিজমি / জলজ জলবায়ু, দোয়াঁশলা মাটি আর/ ফসলের সংসার – সংসার।
গ) এবছর বর্ষা ভালো না হওয়ায় বাংলায় ফসল তেমন হয়নি/ খরা বললে তেমন ভুল হবে না/ চাষিদের এমন দুর্দিনেও আমরা/
বাজারে দরদাম করি একই রকম – বিচ্যূত ।
নাগরিক জীবন কি গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা কবিকে বিরক্ত করে, ক্লান্ত করে ? কবি কি আবার ফিরে আসতে চায় মোয়াইল-টাওয়ারহীন জন্মভিটেতে, প্রকৃতির কাছে, সহজের কাছে?
ক) দশবার কেটে যাওয়া মোবাইল টাওয়ার / আমি ঠিক কসরৎ করতে করতে/ শূন্যে টাঙানো দড়ির ওপর থেকে / নদীর মতো
সম্পর্ক বজায় রেখে যাব - বাড়ি
ঘ) যে মাটির ভেতর লেগে আছে জন্মদাগ / আঁতুররক্ত/ আমি তো চাই প্রতি শুক্লপক্ষ রাতে তাকে ছুঁয়ে থাকতে – সুখ।
রোজকার বিসদৃশ ঘটনাবলির সঙ্গে কবির সংবেদনশীল মনের যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলে, সেই অভিঘাত, সেই আঘাতে কবির চেতনায় যে ক্ষত তৈরি হয়, কবি তার উপশম খোঁজে , শুশ্রূষা চায়। হয়ত কবিতার কাছেই। -
একবার আপেল হাতে এসে দাঁড়াও / আমার আরোগ্য বিছানার পাশে – আরোগ্য।
এই আরোগ্যেরই এক অন্য রূপ কবির সহজাত প্রকৃতি। এই সহজাত প্রকৃতি মানে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা কবির ভেতর রয়ে গেছে একটা উদাসীনতা। একটা বাউল-মন। সংসারের নানা বায়োনারিতে হোঁচট খেতে খেতে কল্যাণ অবলম্বন করতে চাই সেই মন-বাউলকে।
ক) প্রতিদিন উন্মাদ স্রোতের কাছে আমি বাউলসংগীত শুনি / একতারায় লেগে থাকা পৃথিবীর রূপ ও রসের গন্ধ – সংসার ।
খ) নিজেকে কঠোরভাবে শাসন করে দেখি / বাউল আজও তার নিজস্ব পথে – গ্রন্থি।
কবিতা ছাড়াও কবির এই শুশ্রূষার আরেক রূপ হতে পারত ঈশ্বর-বিশ্বাস। কল্যাণের ‘অশক্তি’ কবিতায় তারও দেখা পাওয়া যায়।
ভাঙাচোরা মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে / আমার উপাসনার কথা মনে হয়/ জল আলো হাওয়া ছাড়াও / মানুষের বেঁচে
থাকার জন্যে / পাথরপ্রতিমার কথা মনে হয়
কিন্তু আধুনিক পরবর্তী সময়ের বিশ্বে মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাসও তো ভেঙে গেছে। কল্যাণ নিজেও সেটা জানে -
ঈশ্বর মানে এখন শুধুই এক পাথরপ্রতিমা, কালের করাল গ্রাস থেকে যে নিজের মন্দিরকেও রক্ষা করতে পারে না। প্রতিমা নিজেই যখন রক্ষা করতে পারে না / নিজের আবাসনগৃহ ...। হাসি পায়, হাসি পায় / হেঁয়ালি করতে করতে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই/ কল্পিত ঈশ্বরের মুখ
কিন্তু কল্পিত ঈশ্বরের মুখ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলে তো একটা বিশ্বাসের জায়গা নষ্ট হয়ে যায়। ঈশ্বর মানে কোনো দেওবতা নয়, ঈশ্বর হল এক আলো, সেই আলো সপ্রে গেলে একজন কবির কাছে কী অবশিষ্ট থাকে? একটা নিস্ফল অনুর্বর ভূমি । -
আলো সরে গেলে আলো সরিয়ে নিলে / জগতে পড়ে থাকে জীবন্ত মৃতদেহ (স্তব্দ)
কঠিন বাস্তবের টাঁড়ভূমি কবিকে নিঃসঙ্গ করে, ক্লান্ত করে, অসুখী করে; কবি এক বিচ্ছিন্নতায় ভোগে। সেই একা-মানুষের কথাও কল্যাণের কবিতায় উঁকি মেরে যায়। কবির মনে হয় চারপাশ কেমন যেন শূন্য, ফাঁকা।
ক) চারপাশের সবইকে এক একটি গ্রহ মনে হয়/ আমার খুব শীত করে – আরোগ্য ।
খ) একদিন যাদের সাথে হৃদ্যতা ছিল/ আমার মোবাইল সেটে তাদের কোনো কনট্যাক্ট নম্বর নেই / কখনো দেখা হলে একে অপরকে
এড়িয়ে চলি – সম্পর্ক।
গ) আমার কেন যে বার বার মনে হচ্ছে/ আমরা সবাই যতটা কাছাকাছি থাকতাম / এখন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের থেকে/ অনেকটাই
উত্তর গোলার্ধে হেলে পড়েছি – বিচ্যূত।
ঘ) অমন বিবাগি বসনও পরি না আর শূন্যে / যদি ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাই – গ্রন্থি।
ঙ) এত এত আলোখেলা, শব্দের পৃথিবী / একটি ০ সবকিছু ঘিরে রেখেছে / বেলুনের বাতাস ক্রমশ হালকা হচ্ছে – অপর।
চ) পাখিরা উড়ে গেলে সামনের সবটুকু শূন্য। স্বপ্ন।
ছ) বুকের ভেতর মলিন পাতা, হলুদ / লেটার প্রেসে সাজিয়ে রাখা স্মৃতি / গোধূলি আকাশই পারে চিত্র রঙের বিচ্ছূরণ / পাখিদের ক্লান্ত আনন্দ রব – গন্তব্য।
জ) একটা মানুষ, একটা ঝুল বারান্দা, একটা আকাশ/ অপেক্ষা করে একটা অন্ধকারের – গন্তব্য।
ঝ) সবকিছু একসময় জগতের ভেতর / শূন্যে ঝুলে থাকে – জীবন।
ঞ) আলো সরে গেলে আলো সরিয়ে নিলে / জগতে পড়ে থাকে এক জীবন্ত মৃতদেহ – স্তব্ধ ।
ট) মরুভূমির ঘাসের মতো হয়ে ওঠে / আমাদের জগৎপৃথিবী – জন্তু।
ঠ) ভুবনডাঙা জুড়ে আজ শুধু মেলা মেলা / কেউ কারোর কথা শুনতে পাচ্ছি না/ কিছু শুনতে পেলেও বুঝতে পারছি না – আপশোস
ড) ঠিক বুঝতে পারি না / রাস্তায় আমার জন্যে কারা যেন অপেক্ষা করে আছে -সুখ
ব্যবহারিক জীবনের এই যে এত ঘাত-প্রতিঘাত কবিকে ক্ষত-বিক্ষত করে, অশান্ত করে, তার বিরুদ্ধে কি কবি কখনো বিদ্রোহ করার কথা ভাবে? কল্যাণের কবিতায় সেই অচলায়তন ভাঙার কোনো ঈঙ্গিত নেই। বরং সে খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় সে তার মতো করে নিজের সৃষ্টি নিয়ে মেতে থাকতে চায়, তার ভেতর কোনো বারুদ নেই, তার আগুনের কোনো স্থিতি নেই-
মাটির জলবায়ু খুব প্রতিকূল / সূর্য প্রতিদিন চকমকি পাথরের মতো আগুন দিলেও / বাতাসে বারুদেরা অনুপস্থিত ...
আমার আগুন কেবল স্থিতিহীন - সৃষ্টি
সম্প্রতি নিজের কবিতা-ভাবনার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে কল্যাণ জানিয়েছে –“ 'ভালোবাসা কতটা স্বার্থপর সে শুধু আকাশ জানে। ' আমারই কোনো কবিতার এই পঙ্ক্তিটি নিয়ত নিজের মনের কাছে ঘুরপাক খায়। তখন একাকী নিঃসঙ্গ আমি অবিরাম কবিতাকেই আঁকড়ে ধরি। ” একজন কবি কবিতাকে আঁকড়ে ধরে হাঁটবে, সেটার মধ্যে কোনো অতিশয়োক্তি নেই। কল্যান নব্বই দশকে কবিতা চর্চা শুরু করলেও সমসাময়িক অনেকের মতো তারকা হতে চাওয়া কবিযশোপ্রার্থীদের দলে ভিড় জমায়নি, পোস্টমডার্ন ভাবধারায় ভেসে যায়নি, নিজের কথা নিজের মতো করেই লিখতে চেয়েছে। নিজেকে সব সময় লো-প্রোফাইল রাখতে চেয়েছে। রুটি-রুজির অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও ‘এখন কৃতি’ বলে নিজের মতো একটা কাগজও বের করে। যদিও তা অনিয়মিত। সব মিলিয়ে কল্যাণ কবিতার প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে চায়। তবু ইদানীং তার মনে কোথাও যেন একটা হাহাকার বেজে ওঠে। যাপিত জীবনের প্রতি একটা বিদ্রুপ উঁকি মারছে। একটা চাপা অভিমান। তাই হয়ত সে বিদায় নিতে চাইছে। কবিতার কাছ থেকে, ভ্লোবাসার কাছ থেকে। বইয়ের শেষ কবিতা ‘প্রয়াণ’-এ যেন সেই সুরই বেজে উঠেছে-
বিরতি নয়, যতিচিহ্ন কিংবা বিরামও নয় / এবার চলে যেতে হবে ভাই / তোমাদের সব ভালোবাসা এ জগতের কাছে/ ফেরত দিয়ে / এবার চলে যেতে হবে / বুঝেছ মহাশয় / টিকে থাকা খুব সহজ প্র্যাকটিশ নয় / কক্ষপথে মাধ্যাকর্ষণ কখনো কখনো কিছুটা কম থাকে / এসব নিয়ে আফসোস বা ফলনের কথা ভেবে লাভ নেই / এভাবেই ড্যাংড্যাং করতে করতে / যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাব / তোমরা দেখবে / যারা আমাকে ভালোবাসার কথা বলত / তারা সব মুখ চাপা দিয়ে হাসছে
কল্যাণের কলম যতই প্রয়াণের কথা লিখুক, কবিতা কল্যাণকে ছেড়ে যায়নি; কল্যাণো কবিতাকে ছেড়ে যেতে পারেনি, পারবে না। এখনো দীর্ঘদিন সচল থাকবে তার কলম। তবে, তার সাম্প্রতিক কবিতা পড়ে মনে হচ্ছে, বোধহয় তার কবিতায় একটা বাঁক বদল হতে চলেছে। অগত্যা তার পাঠক সেই বাঁক-বদলের অপেক্ষায় থাকবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন