নীলম সামন্ত





শূন্যে ফেরিওয়ালা বৃত্তে বেলুন

পর্ব- ২

 


ঘুমোতে রাত হলেও অচেনা জায়গায় ভালো ঘুম হয়না বলে ভোর ভোর উঠে পড়েছি। সকালের সূর্যটা দেখতে ঠিক হাঁস ডিমের কুসুম লাল, কিন্তু আকাশ পরিষ্কার নয়৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লম্বা লম্বা তারের মতো মেঘের লাইন ঘিরে ফেলল আর অর্ধেক সূর্য মিলিয়ে গেল।  একটা মলিন শুরু৷ হোটেলের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাতে ভালো বুঝতে পারিনি চারপাশটা, এখন দেখছি কাজুবাদামের জঙ্গল আর মাঝে মাঝে কাঁঠাল ভর্তি বড় বড় গাছ। কিভাবে যে উঁচু ডাল থেকে বড় বড় কাঁঠাল ঝুলে আছে না দেখলে আশ্চর্য গল্পই ভাবতাম। আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফলের গাছ জায়গা বুঝে লাগানো হয়। আমি এটাই জানতাম এটাই দেখেছি। কিন্তু এই দৃশ্য আমার ভ্রান্ত ধারণার পর্দা সরিয়ে দিল। সত্যিই তো সমস্ত গাছ যেখানে সেখানে যেমন তেমন ভাবেই তো বেড়ে উঠেছিল। যার ফল খেয়ে একদিন আমাদের প্রাচীন মাথা তুলে বেঁচে থাকত। সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে কত কিই বদলে যায়। 

যাইহোক আমাদের গন্তব্যে পৌঁছোতে হবে। তাই প্রাতঃরাশ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে জল ভরে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে আমাদের সাথে আমাদের পোষা প্রাণীগুলোও রয়েছে৷ আমরা বড় দুইজন ও আমাদের ছানা সহ মাছ পাখিগুলোর খুব একটা অসুবিধে হয়নি। কিন্তু গাড়ির দুলুনিতে মাছের বক্স থেকে জল পড়ে গেছে অনেকটাই৷ এদিকার রাস্তা একেবারেই ভালো না, ৩০/৪০ এর বেশি স্পীড তোলা যাচ্ছে না৷ তাতেই অসম্ভব দুলুনি৷ মাছের কৌটোটা হাতে তুলে দেখলাম খুব ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ভয় হচ্ছে মরে না যায়৷ তবে কিছুক্ষণ ধরে দেখে বুঝলাম মাছটি ভয়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে।

সত্যিই ভয়ে সাদা হয়ে যায় প্রাণীরাও। কারণ রাতে যখন গন্তব্যে পৌঁছে হোটেলে উঠলাম তখন মাছের জল বদলালাম,  এক ঘন্টার মধ্যেই দেখলাম আগের রূপে।  উফ কি যে শান্তি। যতই মুখে বলি মায়া কাটিয়ে ফেলি কিন্তু প্রাণের প্রতি মায়া ভেতরে ভেতরে থাকেই। এরা আমার ভরসাতেই আমার কাছে থাকে। এদের যত্নও আমার কর্তব্য। 

গন্তব্য বলতে গোয়া। মুম্বাইয়ের পাঠ তুলে গোয়া এলাম। বন্ধুরা যেই শুনেছে সেই ভেবেছে বেড়াতে এসেছি। আমিও হেসেছি তাই নিয়ে। সত্যিই তো ভারতবর্ষের সব থেকে বেশি চাহিদাপূর্ণ বেড়ানোর জায়গা বললে গোয়ার নামই মনে পড়ে৷ তবে আমাদের তো বেড়ানোর জন্য আসা নয় তাই ভেতর ভেতর অনেক দায়িত্ব বা চিন্তা কাজ করে। এখন হোটেলে থাকছি ঠিকই কিন্তু সাত দিনের মধ্যে নিজেদের থাকার আস্তানা খুঁজতে হবে। সন্তানের জন্য পড়ার স্কুল। কাছাকাছি হসপিটাল, সবজি মাছের বাজার। আরো কত কি। 

সন্ধে তে একটু বেরিয়েছিলাম আসপাশটা দেখতে। এখানে দোকানপাট রাত আটটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়৷ মানুষের ব্যস্ততা কম। মুম্বাইতে সকলেই ছোটে। জীবন দ্রুত কাটে। এখানে মানুষকে দেখে তা মনে হয়নি। বরং তারা ছোটার ব্যপারে বড্ড উদাসীন৷ ছোট ছোট বাড়ি, কনভেন্ট স্কুল, চার্চ, মন্দির, মসজিদ সব মিলে একটু অন্য রকম তো লাগছেই। তবে ধীরে ধীরে আরও বুঝতে পারব। 

রাতে আমার প্রিয় বন্ধুটি জিজ্ঞেস করছিল মুম্বাইয়ের গোছানো সেট আপ ছেড়ে এখানে এসে পুরনো দিন কতটা মিস করছি। ওকে হাসতে হাসতে বললুম এখন কেবল নতুন জানার উত্তেজনা। মুম্বাই তো জেনে ফেলেছি৷ এবার এখানে নতুন মানুষ নতুন যাপন, নতুন অভিজ্ঞতা।  জানার কি আর শেষ আছে? তবে বাজার থেকে ফেরার পথে বিজ্ঞানীবাবু একটা ঠেলা দেখিয়ে বললেন "বড়া পাও"!  হা হা হা।  মুম্বাই ছেড়ে দিলেও বড়া পাও পেছন ছাড়েনি। হয়তো মহারাষ্ট্রের পাশে বলেই খাবারের সামঞ্জস্য রয়েছে৷ যেখানে অনেকটা মানিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে কিছুটা পরিচিত যাপন ক্লান্তি, অস্বস্তি ইত্যাদির ছাপ সরিয়ে জানান দেবে আমরা একেবারে ছিটকে যাইনি।

(হোটেল মেনিনো এক্সিকিউটিভ, ফোন্ডা, গোয়া)
৩০.০৪.২০২৩

চলবে ~

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন