(অলংকরণ: বিপ্লব দত্ত)








শেষ অঙ্ক

  পলাশথুপি বাস স্ট্যান্ডে কংক্রিটের বিশাল ছাউনির নিচে রোজ বসে থাকে একটা যুবক - যে কোন একদিন আর পাঁচটা সাধারণ যুবকের মতোই ছিল। আজ নেই। কারণ সে এখন বদ্ধ উন্মাদ। নোংরা ছেঁড়া শার্ট, ছিন্ন প্যান্ট, গায়ে জমাট ধুলোময়লা, এক মাথা ভিমরুলের চাকের মতন চুল। সকালের ট্রেনে পলাশথুপি স্টেশনে নেমে, রেললাইন টপকে বাস স্ট্যান্ডে অফিস যাওয়ার বাসের জন্য এসে দাঁড়ালে সপ্তাহের প্রায় প্রতিটিদিনই চোখে পড়ে অমিতের। আর যেটা বিশেষ করে চোখে পড়ে সেটা হল, যুবকটি স্ট্যান্ডের বাঁধানো চত্ত্বর জুড়ে নিজের মনে বিড়বিড় করে আর ঘাড় গুঁজে আঁকবাঁকা ইংরাজি হরফে অঙ্ক কষে যায়। বেশিরভাগই বড় বড় সংখ্যার গুণ। মাঝেমধ্যে দু-একটা ভাগের অঙ্ক। স্ট্যান্ডে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাস এসে যায়, তাই ইচ্ছে থাকলেও পাগলের কষা গুণফল ঠিক না বেঠিক, সেটা আর কষে দেখার সময় পায় না অমিত। বিকেলে অফিসফেরত যখন স্ট্যান্ডে এসে নামে, তখন দেখে যুবকটি চলে গেছে। আর ডাস্টার দিয়ে স্কুলে যেমন ব্ল্যাকবোর্ডের গায়ে চকের দাগ বেমালুম মুছে ফেলা হত, ঠিক তেমনই স্ট্যান্ডের মেঝের ওপর থেকে সব অঙ্ক মুছে দিয়ে গেছে পাগলটা। যেন ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। ছুটি হয়ে গেছে ইশকুল। পাগলের জীবন থেকে সত্যিই কবে ইশকুল-জীবনের ছুটির ঘন্টা বেজে গেছে, কিন্তু অঙ্কের সংখ্যারা এবং অঙ্ক মেলানোর অভিলাষ পাগলের অবচেতনে আজও রয়ে গেছে। কোন অঙ্ক মেলাতে চায় ওই পাগল যুবক, রোজ ফিরতে ফিরতে ভাবে অমিত! 

      প্রতিদিনের মতই ফিরে, স্নান সেরে, একবাটি মুড়ি-চানাচুর মাখা নিয়ে টিভির খবর শুনতে বসে পড়ে অমিত। ইদানিং শোনাটা আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। করোনা নামক একটি ঘাতক জীবাণু সারা পৃথিবীকে পরাধীন করে ফেলছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মারণ ভাইরাসটি। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ক্রমে ঘোরালো হয়ে উঠছে। অতীব ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের প্রকোপে দৈনিক সংক্রমিতের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু মিছিল। হাসপাতাল, নার্সিং হোমে শয্যার আকাল। সব থেকে ভয়ের বিষয়, টিভিতে শুনে বা খবরের কাগজ পড়ে যা জানা যাচ্ছে তা হল এই যে, এই মারণ জীবাণু মোকাবিলা করার কোন নির্দিষ্ট ওষুধ এখনও সারা পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার একটাই পথ - মানুষে মানুষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সঙ্গে মুখে মাস্ক আর হাতে স্যানিটাইজারের প্রয়োগ। এ এক কঠিন পরিস্থিতি।
      অমিত শুনছিল, খবর পরিবেশক বলছে, “সংক্রমণের ক্রমঃবর্ধমান সংখ্যার দিকে তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রী সার্বিক লকডাউনের কথা চিন্তাভাবনা করছেন। ইতিমধ্যে অনেক দেশই অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছে। কিছু অতিআবশ্যক জরুরি পরিষেবা ছাড়া স্কুল, কলেজ, অফিস, কাছারি, দোকানপাট, কল-কারখানা, ট্রেন, বাস সব বন্ধ রাখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় স্তরে। বিদেশ থেকে বিমানের আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আপতকালীন পরিস্থিতি।” এ যেন অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে নিধিরাম সর্দারের যুদ্ধের প্রস্তুতি।

  চ্যানেল পাল্টালো অমিত। সর্বত্র একই খবর। রোজনামচার আকাশে অশনি সংকেতের স্পষ্ট লক্ষণ দেখতে পেল সে। এ এমন এক জীবাণু যা থামিয়ে দিয়েছে আপামর মানুষের স্বাভাবিক জীবন, জীবিকা, যাপন। এই রাজ্যে, এই জেলায়, এমনকি তার এই পাড়ায়ও জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে আসছে। 
      উঠে পড়ে অমিত। মনে মনে অঙ্ক কষে ফেলে সে। রান্নাঘরে যায়। অমিতের মা, সুপ্রিয়া রান্না চাপিয়েছে।
    “চাল ডাল চিনি সব মজুত আছে ঘরে?” জিজ্ঞেস করে অমিত।
    “ও আবার কী কথা! থাকবে না কেন? ঠাকুরের আশীর্বাদে বাড়িতে অভাবটা কীসের শুনি!” অবাক হয়ে উত্তর দেয় সুপ্রিয়া।
    “সামনে ঘোর দুর্দিন। টিভিতে দেখছ না! দোকানপাট কলকারখানা সব বন্ধ হতে চলেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। আকাল তৈরি হল বলে। তাই বলছিলাম, দোকান খোলা থাকতে থাকতে আজ থেকেই যা পারি ঘরে স্টক করে রাখি।”
      “এ কী বলছিস খোকা! দোকান বাজার বন্ধ হবে কেন! এত মানুষ কি তবে না খেয়ে মরবে! তোর যেমন কথা! কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে!” অবিশ্বাসী সুপ্রিয়া উত্তর দেয়। তার অঙ্ক সরলরেখায় চলে। হেঁসেলে আর টিভি সিরিয়ালে সারাদিন মগ্ন মানুষটা। দেশ-দুনিয়ার খবরের প্রতি তার প্রগাঢ় নির্লিপ্তি। তাই করোনার আসন্ন অভিঘাত তাকে বিচলিত করে না।
      “বাজার দোকান, কলকারখানা, বাস-ট্রাম বন্ধ না হলে মানুষ ওমনিই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মরবে, ভাইরাসটা এমন সংক্রামক। বাঁচতে হলে মানুষকে মানুষের থেকে দূরে থাকতে হবে এখন।” বোঝানোর চেষ্টা করে অমিত।
      “কীসব বলছিস! মানুষ মানুষের পাশ থেকে সরে যাবে! মানুষকে এভাবে বেঁচে থাকতে হবে?” হতভম্ব হয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সুপ্রিয়া। অমিত উত্তর দেয় না। কথাটা নেহাত ভুলও বলেনি মহিলা। এই আসন্ন ক্রাইসিসে মানুষকে তো মানুষের পাশেই থাকতে হবে, তবে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখেই। কিন্তু সুপ্রিয়াকে এই কথা বোঝানো দুষ্কর। দুটো বড় বাজারের থলি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে টেবিলের ওপর থেকে মানিব্যাগটা পকেটে চালান করে অমিত বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। উদ্দেশ্য ঘনশ্যামের গোলদারি দোকান।
 
        দোকানটা দেখা যাচ্ছে না। সামনে শুধুই অস্থির জনতার ভিড়। সকলেই অমিতের শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে আবশ্যক জিনিসপত্র কিনতে বেরিয়ে পড়েছে। সামনে অনিশ্চিত দিন। দোকানে বিশৃঙ্খলা, হাঁকডাক- “পাঁচ কিলো চিনি... দশ কিলো আটা... চার প্যাকেট নুন... সর্ষের তেল তিন... হাফ কেজি হলুদ... চার ক্রেট ডিম... পাঁচ কেজি আলু...,” যে যেমন পারছে হাঁকাচ্ছে। সকলের মুখ উদ্বিগ্ন। কিন্তু কতটা কিনলে সুরাহা হবে সেই আন্দাজ কারও নেই।
        অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পরে অমিতও যেমন যতটা পারল, গোলদারি জিনিসপত্রে থলি ভর্তি করে বাড়ি ফিরে এল। ঠিক করল পরদিন সকাল সকাল উঠে কাঁচা সবজিপাতি কিছু কিনে নেবে।

        বসার ঘরে টিভি চলছিল। বিকাশরঞ্জন, অমিতের বাবা, খবরের চ্যানেলে আটকে আছে। “প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবে একটু বাদেই। ড্রাস্টিক কিছু একটা ঘোষণা হবে মনে হচ্ছে।” গম্ভীর গলায় বলে ওঠে মানুষটি। এক কাপ চা হাতে উদগ্রীব অমিত বসে যায় টিভির সামনে। মিনিট কয়েক বাদেই জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে জানিয়ে দেন, আগামী পরশুদিন থেকে লকডাউন।
          রাতে ঘুমাতে যাওয়া অবধি রুদ্ধশ্বাস টিভি দেখা। কী হবে! কী হবে!
 
       পরদিন ভোরবেলা কাজের বউ সরলা এসে ঘোষণা করল, “মাসীমা, কাল থেকে লকডাউ না কী বলচে। সব নাকি বন্ধ কাল থেকে। ভোর থেকে রাত অবধি রাস্তায় বেরনো মানা। পুলিশ পেটাবে। আমি এখন আর আসতে পারব না। অনেকটা দূর থেকে হেঁটে আসতে হয়। আমার মাইনে যতটা হয়েছে মিটিয়ে দিও আজ।”
       শুনে মাথায় হাত সুপ্রিয়ার। “তাহলে আমার চলবে কেমন করে!” পেপারে মুখ গুঁজে বিকাশরঞ্জন জবাব দেয়, “ঠিকই তো বলছে ও। পুলিশের লাঠিপেটা খাবে নাকি তোমার জন্য! তাছাড়া ওকে এমনিতেও আসতে মানা করা ইমিডিএটলি দরকার। হাজারটা বাড়ি কাজ করে। না মুখে মাস্ক, না স্যানিটাইজার। ও তো পটেনশিয়াল করোনা ক্যারিয়ার। সরলা, কাল থেকে তোমাকে আসতে হবে না। পরিস্থিতি কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। কিছুদিন আসা বন্ধ রাখো। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”
      “সবই তো বুঝলাম মেসোমশাই। আমাদেরই হবে লল্লাট। কাজে না এলে খাব কী! আবার যা শুনছি, তাতে আসবই বা কেমন করে। তাছাড়া সবাই ছাড়িয়ে দিচ্ছে। এই আপনারা বাকি ছিলেন। সেটুকুও গেল।” চিন্তিত সরলা ঝাড়ু দিতে দিতে বলে। 

      সক্কাল সক্কাল বাজারে বেরিয়ে অমিত টের পায় এক রাতেই পৃথিবীর চেহারা আমূল বদলে গেছে। দোকানপাট এখনই খুলে গেছে। অন্যান্যদিন বেলায় খোলে। গোটা এলাকার মানুষ হামলে পড়েছে সবজির বাজারে আর মুদিখানায়। থিকথিক করছে ভিড়। সকলেই নিজের মত অঙ্ক কষে নেমে পড়েছে। কে কত বেশি মজুত করতে পারে। স্রেফ সংখ্যার খেলা। পাঁচ, দশ, পঁচিশ, পঞ্চাশ কেজি... আলু, পটল, পেঁয়াজ, আটা... দোকানিরাও অঙ্ক কষে ফেলেছে এক রাতেই। যা দাম হাঁকছে, হুমড়ি খেয়ে কিনে নিচ্ছে মানুষ। সকলেরই সবার আগে কিনে ফেলা চাই। এই বুঝি দোকানের সব রসদ শেষ হয়ে গেল! ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি... কোথায় সামাজিক দূরত্ব, কোথায় সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়! বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় অমিত। কিছু কেনে না। কাল থেকে লকডাউন হলেও গোলদারি দোকানের ওপর ছাড় আছে। নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য দোকান রোজই খুলবে। আবশ্যক পণ্যের তালিকায় পড়ে মুদিখানা। এইসব জেনেও মানুষ কেন এমন পাগলের মত আচরণ করছে বুঝে উঠতে পারে না সে।
 
বটতলার কাছে এসে দেখে ইস্তিরিওলা সুরেশ তার ইস্তিরির ঠেলা গোটাচ্ছে। এখানকার পুরনো লোক সে। 
“কী হল সুরেশ? ঠেলা গোছাচ্ছ কেন?” জিজ্ঞেস করে অমিত।
“কাল থেকে সব বন্ধ বাবু! বেওসা ঠপ হয়ে গেলো। আবার কবে চালু হবে ভগওয়ান জানে। কী করব, পরিবারকে কী খাওয়াব জানি না।” থুতনির নিচে একটা ময়লা মাস্ক লটকে চিন্তিত গলায় জবাব দিল সে। অমিত কোন উত্তর দিতে পারে না। বটতলা পেরিয়ে হাঁটতে থাকে।

পথে চোখে পড়ে এই সাতসকালেই সেলুনে লোকের ভিড়। কাল থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। নাপিতের দল প্রাণপণে মাথা মুড়িয়ে চুল কাটছে। যে কটা টাকা একদিনে কামানো যায়! পানবিড়ির গুমটির সামনে সিগারেটের প্যাকেট কেনার ভিড়। একবেলা ভাত না খেয়েও হয়ত কাটিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু নেশার বস্তুটি মজুত না থাকলে! চায়ের দোকানে দাঁড়ায় অমিত। সামাজিক দুরত্ব শিকেয় তুলে লকডাউন ঘিরে জোর জল্পনায় মেতেছে আড্ডাবাজ বাঙালি। কারও মাস্ক হাতের মুঠোয় ধরা, কারও থুতনিতে লটকে আছে, অনেকের নেই-ই। মাস্ক ভীষণভাবে চায়ের পেয়ালায় তর্কের পরিপন্থি। শম্ভু চাওলা থমথমে মুখে চা বাড়িয়ে দিচ্ছে সকলকে। সেও জানে কাল থেকে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে হবে। আমজনতার কাছে পথচলতি চায়ের দোকান অতি আবশ্যক একটি পরিষেবা হলেও, সরকারের চোখে নয়। কী করবে এইসব সাধারণ মনোরঞ্জন? কীভাবে সময় কাটাবে চায়ের দোকানের বন্ধ আড্ডা্রা? এক ভাঁড় চা খেয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসে অমিত।
সামনে রাস্তায় একদল ছেলেছোকরা। সাত-আটজন হবে। কাঁধে মাথায় ঢাউস ঢাউস ব্যাগ থলি বোঁচকা নিয়ে নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত স্বরে কাথা বলতে বলতে হন্তদন্ত হয়ে চলেছে। দৃশ্যটা কেমন অস্বাভাবিক ঠেকে অমিতের কাছে। ওদের হাবভাব দেখে বেশ বুঝতে পারে এরা সকলেই কোন নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আসছে। কৌতূহলী হয়ে ওদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে সে, “তোমরা কারা? দল বেঁধে কোথায় চলেছ?” 
“বাড়ি ফিরছি। মালিক ব্যাবসা গুটিয়ে দেবে বলেছে কাল থেকে। মাইনে দিতে পারবে না জানিয়ে দিয়েছে। তাই আমাদের রাখবে না। এখানে থাকলে খাব কী? তাই দেশের বাড়ি ফিরে যাচ্ছি আমরা। কাল থেকে লকডাউন বলছে। বাস ট্রেন সব বন্ধ হয়ে যাবে। আজ যে করেই হোক ফিরতে হবে।” একজন যুবক জানালো। 
“কোথায় কাজ করতে তোমরা?”
“বিল্ডিং কন্ট্র্যাকট্ররের আন্ডারে। রাজমিস্ত্রির কাজ।”
“তোমরা সবাই?”
“সবাই নয়। কেউ কাঠচেরাই কলে, কেউ স্যাকরার দোকানে, কেউ হোটেলে। কাল থেকে সব বন্ধ। মালিক বসে খাওয়াতে পারবে না বলে দিয়েছে। বাড়িওলা ঘর খালি করে দিতে বলেছে। এখানে তো না খেয়ে মরতে হবে। দেশেও তাই হবে। ওখানে গিয়ে মরাই ভাল। অন্তত বাড়ির লোকজন তো কাছে থাকবে দাহ করার জন্য।”
“কতদূর যাবে তোমরা?”
“মালদা, মুর্শিদাবাদ, ক্যানিং। ও যাবে কুচবিহার।” ইশারায় দলের একটি ছেলেকে দেখায় যুবকটি।
“কেমন করে যাবে? অনেক দূরের রাস্তা যে?” ওদের কথা শুনে আর উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে কষ্ট হয় অমিতের। 
“জানি না। দেখি। বাসে, ট্রাকে, পায়ে হেঁটে... যে করেই হোক ফিরতে তো হবেই।”
  নিজের বাড়ি এসে যাওয়ায় ওদের সঙ্গ ত্যাগ করতে বাধ্য হল অমিত। ভাবছিল, একটা লকডাউন কেমন সবাইকে সবার বেঁচে থাকার স্বাভাবিক অঙ্কের হিসেব পালটে দিয়ে অন্য এক কঠিন অঙ্কের সামনে এনে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে দিল। কাল থেকে সারা দেশ জুড়ে কত কোটি মানুষের জিবিকা স্তব্ধ হয়ে যাবে! কত সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এক ঝটকায় ঠেলে দিল এই মারণ ভাইরাস! এতবছর অতীতের প্লেগ, মন্বন্তর, ইত্যাদির কথা শুনে এসেছে অমিত; পড়েছে। আজ তেমনই একটা বড় করুণ আর আতঙ্কের ঐতিহাসিক সময়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে নিজেই। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে তারও চলবে না। অফিস আছে। সরকারি চাকরি। ট্রেন ধরতে হবে।  

ট্রেনেও সামাজিক দুরত্বকে বুড়ো আঙুল দেখানো নিত্যযাত্রীদের মাস্কঢাকা মুখে একই দুশ্চিন্তার কথা, গলায় অবরুদ্ধ উৎকণ্ঠা। ট্রেন বন্ধ হয়ে গেলে অফিস যাবে কেমন করে! অনির্দিষ্ট লকডাউন হলে কী হবে! কানে আসে দিকে দিকে করোনা আক্রান্ত হওয়ার কাহিনী, মৃত্যুর খবর, হাসপাতাল-নার্সিং হোমে বেড না পাওয়া, অক্সিজেনের আকাল, ওষুধের ক্রাইসিস, রাতের আঁধারে সংক্রমিত লাশ পোড়ানো বা না-পোড়ানোর হাড়হিম করা বিবরণ। সব মিলিয়ে শরীর মাথা ঝিমঝিম করে অমিতের। পলাশথুপি স্টেশনে নেমে ছুটতে ছুটতে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। সেই পাগল ছেলেটা! কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মাটিতে উবু হয়ে বসে একমনে ইটের টুকরো দিয়ে অঙ্ক কষে চলেছে। টিভি, খবরের কাগজ, জনরব, তার কানে পৌঁছোয় না। বাস আসে। কনডাক্টার জানিয়ে দেয় কাল থেকে বাস চলবে না। এমনটা যে হবে সকলে একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল। ঘোষণায় অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হল। 
 
চাকরিটা সরকারি বলে ঝক্কিটা তেমন পোহাতে হল না অমিতকে। একুশ দিনের জন্য ওদের সরকারি দপ্তর বন্ধ হয়ে গেল। অফিস যাওয়ার চিন্তা নেই। মাইনে কাটা যাওয়ার দুশ্চিন্তা নেই। বাস্তবিক সেই যে ২০২০ মার্চের শেষ থেকে অফিস বন্ধ হওয়া শুরু হল, দুর্গাপূজো অবধি বিভিন্ন সরকারি নির্দেশনামা মেনে, না-মেনে গড়িমসি করে একপ্রকার অফিস না গিয়েই কাটল অমিতের। 
  বাড়িতে বসে, টিভির পর্দায় আর স্যানিটাইজার স্প্রে করা জীবাণুমুক্ত খবরের কাগজের পাতায় চোখ রেখে অমিত হাড়ে হাড়ে টের পেল জীবনটা স্রেফ পাটিগনিতের খেলা। সংখ্যা ছাড়া জীবনে আর কিছু সত্য নয় – অতিমারিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা, অতিমারি মোকাবিলা করার মত পরিষেবা দেওয়া সাস্থ্যকেন্দ্রের আকালের সংখ্যা, হাসপাতালে না-পাওয়া বেডের সংখ্যা, অপ্রতুল ডাক্তারের সংখ্যা, অমিল ওষুধের সংখ্যা। 
  এইসব সংখ্যার সমান্তরাল চলছে আরও এক অঙ্কের খেলা। সেটা একদিকে লাভের, অন্যদিকে লোকসানের। মাস্ক নামক একটুকরো কাপড়ের দাম আকাশ ছুঁয়ে গেছে। সেই সঙ্গে স্যানিটাইজার নামক একটি তরলের। দোকান ভরে যাচ্ছে এই দ্রব্যটিতে। আবার মুহূর্তে উবেও যাচ্ছে। যে যেমন দাম হাঁকাচ্ছে, সেই দামেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। চাল, ডাল, নুন, তেলও মহার্ঘ্য দামে বিকোচ্ছে। যে দোকানদার এতদিন দরজা-জানলার রং বিক্রি করত, সেও মাস্ক স্যানিটাইজারের পসরা নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দোকান খুলছে। অক্সিজেনের কালোবাজারি হচ্ছে। ইশকুলে যে বিষয়টি বেশিরভাগ মানুষেরই আতঙ্কের ছিল, করোনা নামক অতিমারি এসে সবাইকে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সেই অঙ্ক নিয়েই মাথা ঘামাতে আবার বাধ্য করেছে। এমনকি হাসপাতালের ভর্তি বেডও মোটা অঙ্কের বিনিময়ে হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। নার্সিংহোমে চিকিৎসা নামক লাভের অঙ্কে দেউলে হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অথচ মজার বিষয় হল এই যে এ রোগের নির্দিষ্ট কোন ওষুধ নেই। সঠিক ওষুধটি যে কী তা কোন চিকিৎসক বা হাসপাতাল প্রত্যয়ের সাথে বলতে পারছে না। ক্যান্সার হলেও হয়ত এত খরচ হত না। লাভের অঙ্ক যে কতটা নির্মম হতে পারে, যত দিন যায়, অনুভব করে অমিত।
 
আর লোকসানের অঙ্ক? সে তো আরও হৃদয়বিদারক। অতিমারির প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ দুরুহ কঠিন অঙ্কের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যে অঙ্ক তারা আর মেলাতে পারবে না। উজাড় হয়ে যাওয়া জীবন, জীবিকা আর শেকড়ের সেই সরল পাটিগনিতের উত্তর সকলের জন্যই শুন্য। না কষেই সকলের এক উত্তর এসে গেছে। মাস মাইনের অঙ্কের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার স্বস্তিতে বসে সময়ের সাথে সাথে অমিত এইসব নীরবে প্রতক্ষ্য করে...
 
পাড়ার মোড়ের মাথায় লছমনের ধাবার উনুন কবেই নিভে গেছে। সেখান থেকে আর রসুন তরকার গন্ধ ভেসে আসে না, ভেসে আসে না গরম রুটি সেঁকার গন্ধ। লছমনেরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছে সপরিবারে। কোথায়, জানা নেই অমিতের। পরেশের রোল-চাউমিনের দোকানের টিনের কাঠামো শুধু দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধুলো আর সময়ের মর্চে মেখে। পরেশ এখন বাঁচার তাগিদে থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে ঠেলায় করে বাড়ি বাড়ী শাকসবজি বিক্রি করা শুরু করেছে। রিয়াজুলের মাংসের দোকান ছিল। এখন শুধু প্রকাণ্ড কাঠের গুড়িটা পড়ে আছে যার ওপর চপার দিয়ে মাংস টুকরো করত সে। তাকে আর তল্লাটে দেখা যায় না। গাড়ি বন্ধ, খাসির সাপ্লাই নেই। আরও যারা ছিল, পথের প্রান্তের প্রান্তিক মানুষেরা- কুলি, কামিন, রিকশাওয়ালা, ঠেলাওলা, মুটে, মজুর... তারা সব কোথায় গেল? দেশভাগের পরে ভারতবর্ষের বুকে ঘটে যাওয়া সবথেকে বড় পরিযায়ী শ্রমিকদের মহাপ্রস্থানে ক্ষতবিক্ষত পায়ে হেঁটে কোন অমরায় বিলীন হয়ে গেল তারা?   
  ওদিকে সব স্কুলও বন্ধ। সাধারণ আটো টোটো পুলকার চালকেরা অনেকেই দৈনিক আয় বজায় রাখতে এদিক সেদিক কাপড়ের মাস্ক বিক্রি করা শুরু করেছে পুলিশের কড়া অনুশাসনের ফাঁকেফোঁকরে। বড় রাস্তার মোড়ে ‘মডার্ন টেইলারস’-এর অনুপদর্জি দোকানের ঝাঁপ ফেলে প্যাকেটের দুধ বিক্রি করা শুরু করেছে। দুধ, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, তাই ছাড় আছে। ওর দেখাদেখি অনেকেই অঙ্ক কষে এই রাস্তা ধরেছে। এত বেশি ধরেছে যে খদ্দের নেই। তবু করছে, কটা টাকা উপার্জন হবে এই আশায়। ছুতোর, কামার, বৃদ্ধ জুতো সেলাইওয়ালা, ছাতা সারাই, ছোট ছোট জেরক্সের আর মণিহারী জিনিসের দোকান, বয়স্ক রাজমিস্ত্রি, রঙের জোয়ান মিস্ত্রি, রাস্তার পাশে মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম বিক্রি করা যুবক... সবাই কর্মহীন। কিন্তু পরিবার থাক বা না থাক বেঁচে তো থাকতে হবে। অঙ্কটা খুব সোজা। পেটে কিছু পড়লে একটা মানুষ বাঁচে। অমিত বিস্ময়ের সাথে অনুধাবন করে একটা লকডাউন এসে কেমন এতগুলো মানুষের বংশপরম্পরায় চলে আসা জীবিকা এক-দুদিনেই আমূল বদলে দিয়েছে। সকালে যে নির্দিষ্ট কয়েক ঘন্টার জন্য বাজার বসছে, দেখা গেল জীবিকা হারানো এরা সকলেই, কেউ এক-দু কেজি আলু-পেঁয়াজ, কেউ লাউ-চালকুমড়ো-বরবটি নিয়ে বাজারে ঠেসাঠেসি করে বসে পড়েছে। যোগান কম, পুঁজি কম, রসদ কম। যে লোকটা এতদিন ধরে জেরক্সের কাগজ গুনে এসেছে, সে এখন শাকের আঁটি গুনছে। রাজমিস্ত্রি বসে পড়েছে চালের একটা ছোট বস্তা নিয়ে। কেউ একফালি চটের ওপর ডালের পসরা নিয়ে চাতকের মত তাকিয়ে আছে খদ্দেরের দিকে, অন্যের পেটে কিছু দিতে পারলে তবে নিজের পেটেও কিছু জোগান দেওয়া যাবে, এই আশায়। ভিড় ওপচানো বাজারে, করোনার সংক্রমণকে বুড়ো আঙুল দেখানো উদ্ভ্রান্ত এবং কাতর মানুষের অসহায় মিছিল। বাজারে এসে প্রত্যেকে নিজের পেটের পাটিগণিত মেলাতে গিয়ে দেশব্যাপ্যি ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যু আর সংক্রমণের পরিসংখ্যান ওলটপালট করে দিচ্ছে ।
 
অফিসে না গিয়েও অমিত অবশ্য করোনার কবল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। হাসপাতাল-নার্সিং হোমের তয়াক্কা না করে চিলেকোঠার ঘরে নিজেকে দিন দশ নির্বাসনে রেখেছিল সে। এখানেও অঙ্কটা খুব সহজ। রিস্ক নেওয়ার কোন মানেই হয় না। তার থেকে কিছুদিন নিজের মত আলাদা থাকাই ভালো। পরে অবশ্য পালা করে করে বাড়ির সকলকেই এক এক করে ওই চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতে হয়েছে। অক্ষত বেরিয়েও এসেছে। কিন্তু অমিতের চেনা অনেকেই পারেনি। 



সেপ্টেম্বরে এমন একটা দিন এল যেদিন আবার অফিস গেল সে। সুপ্রিয়ার সে কী দুশ্চিন্তা! “অমু, ট্রেনে উঠে দূরে দূরে থাকবি। কারও কাছে ঘেঁষবি না।” মা-কে বোঝানোর থেকে করোনার মোকাবিলা করা সহজ। ট্রেন হাতেগোনা চালু হয়েছে। পিলপিল করছে নিত্যযাত্রী।
      বহুদিন বাদে ট্রেনে উঠে অনেক পরিচিত মুখ দেখতে পেল না সে। আর পাবেও না কোনদিন, সেটা জেনেও গেল। অতিমারির কঠিন অঙ্ক সেই মানুষগুলো কেন জানি না সমাধান করতে পারেনি। মুখগুলো মনে পড়ছিল অমিতের। প্রাণবন্ত মানুষগুলো চিরতরে হারিয়ে গেল জীবনের যাত্রাপথ থেকে! ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পলাশথুপি স্টেশনে নেমে, রেল লাইন টপকে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েই চমকে গেল অমিত। সেই পাগল ছেলেটি! মাটিতে উবু হয়ে বসে সেদিনও একমনে অঙ্ক কষে চলেছে। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে জীবিকার, যাপনের আমূল পরিবর্তন এই যুবকটির দৈনিক জীবনে যাপনে কোন পরিবর্তন আনেনি। বিস্মিত হল অমিত! অতিমারি ব্যর্থ। পৃথিবীর সব দেশের প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অঙ্ক ছারখার হয়ে গেছে, শুধু এই পাগলের হয়নি।  

  বাস অনিয়মিত চলছে, কখন আসবে ঠিক নেই। তাই অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হচ্ছিল অমিতকে। এই সুযোগে বহুদিনের চেপে রাখা কৌতূহল নিয়ে পাগলের এলোপাথাড়ি কষে যাওয়া অঙ্কগুলোর দিকে প্রথমবারের জন্য মনোযোগ দিল সে। বড় বড় গুনাত্মক অঙ্ক। দু-একটা ভাগ। আশ্চর্য! স্তম্ভিত হয়ে অমিত দেখল প্রতিটা অঙ্ক নির্ভুল মিলিয়ে দিয়েছে পাগল। তার মানে, এতদিন ধরে প্রতিদিন আপন খেয়ালে কষা নিত্যনতুন অঙ্কের খেলা অনায়াসেই মিলিয়ে গেছে মানুষটা। অবলীলায়। তার কোন হেলদোল নেই। জীবনের অঙ্ক মিলল কি মিলল না, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র অস্থির নয় এই অপ্রকিতিস্থ যুবক। কোনদিন ছিলও না, হবেও না। নাকি এভাবেই, এই অভাব-অভিযোগহীনভাবেই তার জীবনের অঙ্ক মিলিয়ে চলেছে সে! 

  বাসে উঠতে উঠতে অমিত ভাবে, তাহলে দিনের শেষে অঙ্ক মেলাতে সক্ষম হয় কারা – যারা জীবনের অঙ্ক মেলানোর জন্য পাগল হয়ে ওঠে, না একজন প্রকৃত পাগল যে কেবল কোন এক বিস্মৃত দিনের শিখে ফেলা অঙ্ক মেলানোর প্রক্রিয়া ভোলেনি?





মৌলীনাথ গোস্বামী

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন