নিঃসঙ্গ ছাতিম দিনে
অবশেষে একদিন মাটির বাসরে নির্জন হল মেয়েটি । রৌদ্রঝলকিত প্রাচীর থেকে সরে গেল
ছায়ার বিলাপ ,ঘন শেফালী বনে আঁধার নামলে কবি তার বুকের পাঁজর থেকে মুঠো মুঠো ব্যথা ছড়িয়ে
নিঃস্ব হলেন । যে সব কথা এতকাল ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরব ছিল ,সেই সব ভাষার আলোকে
ধুয়ে গেল মেয়েটির মুখ । তিনপ্রহর পেরিয়ে গেলে গাছতলার দরবেশ এসে দাঁড়ালেন মহাশূন্য সমাধিস্থলে ।
একটি অলীক কাকাতুয়া ডানা ঝাপটে উড়ে গেল আস্ত এক জীবনের দিকে, বিষণ্ণতায় ভেঙে পড়ছে রাতচিত্র , দরবেশ সেই নির্জন মেয়েটির পাশে ধীর কণ্ঠে বলতে থাকেন _
কেন কাঁদিস ?
কোন প্রত্যাশায় হতে গেলি আকাঙ্ক্ষার উষ্ণ মঞ্জরী ?
খুব কী কষ্ট হচ্ছে ?
ভুল আশা , ভুল প্রেমে পুড়ে যাচ্ছে দেহ ?
হে বিস্তৃত আকাশ , প্রসন্ন হও
মেঘে মেঘে ছেয়ে দাও দূর – দূরান্ত …
এসো স্নিগ্ধতর বৃষ্টি , বৃষ্টি ,বৃষ্টি …
গভীর রাত্রির ওপারে ভাঙা সানকির মতো চাঁদ , টুপ টুপ ঝরা পাতার ঘ্রাণ।মেয়েটি স্থির, শীতল হয়ে ঘুমিয়ে,
স্বপ্নে স্বপ্নে সে আরও নিঝুম , এদিক সেদিক নির্জন সমাধি , বেদনার শাদা ফুলে ঢাকা পথ বেয়ে তার কাছে
এসেছে কে এক ছেলে ! গলায় তার মৌরিফুলের মালা, হাতে নকশাকাটা বাঁশি , বাতাসে মশলার সুবাস , ভাঙা চাঁদ আরও নিবিড় ,মেয়েটির স্বপ্নকেন্দ্র থেকে জেগে উঠছে অপার্থিব সব ধ্বনি ! তীব্র নীল আলো…
দুটি মেঠো পোকা তাদের অলৌকিক সঙ্গমরীতি ভুলে দু’জনের দিকে কী উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে ! মেয়েটি
আবেগমথিত স্বরে বলে ওঠে _ এসো , আমার কাছে এসো , স্পর্শ করো এই মধুরলগ্নের ঠোঁট , প্রতিটি
চুম্বনের শব্দে খুলে যাক নিশিকুসুমের অপরূপ যোনিজট ।এই উথালবুকের শর্বরী আজ তোমারই
অপেক্ষায় , এসো , মুছিয়ে দাও আমার মর্মবেদনার শীত…
কে শোনে কার কথা ! সুর -কাতরতায় সে ছেলে এমনি পাগল, যে বাঁশিই তার প্রেয়সী। মাটির ভিতর শুয়ে থাকা কতযুগের গুমরে ওঠা কান্না আকুল সুরের মূর্ছনা হয়ে বাঁশির শূন্যকুহরে বেজে ওঠে , সেই সুরের মায়ায়
এ মরপৃথিবী চিত্রবৎ শব্দহীন, চারিদিক মন্ত্রের মত চুপ হয়ে, এ কোন শূন্যতার সংসার! রাত্রির ঝিঁঝিঁপোকারা
গান থামিয়ে একেবারে নিস্তব্ধ … , বাঁশি বাজাতে বাজাতে বহুদূর পথে উদাস হয়েছে একাকী সেই ছেলে ।
ঘর নেই, আপনজন নেই , চাষের জমি নেই ,আছে কেবল একটি পীতবাস বাঁশি ও এমনই দু’চারটে
অশ্রুমতী রাত …
ওগো মেয়ে স্বপ্নেও তুমি ব্যর্থ ! এলোমেলো ! আরও কতকাল মাটির বাসরে থাকবে স্পর্শহীন
একা ! বাঁশির সুর বাতাসে ফিরে ফিরে ছুঁয়ে দিচ্ছে মেয়েটির দেহভাণ্ড আর মেয়েটি চিরন্তন বিষণ্ণতায় গলতে
গলতে মিশে যেতে থাকে মাটির হৃদয়ে …
কবি তার আদিঅন্তের স্বপ্ন নিয়ে পুনর্বার লিখতে বসেন । গাছতলার দরবেশ হাওয়ার দিকে মুখ করে পড়তে থাকেন কলমা ( মুসলমান ধর্মের ইষ্টমন্ত্র ) । মেয়েটি ভালবেসে এখন ধুলো ধুলো মাটি , কবি লিখে যান সেই মাটির নীরবতা , জান্নাতের অদৃশ্য সুবাস। ঘিরে ধরছে হেমন্তের কুয়াশা , কবরের শূন্যতায় পাতার মর্মরধ্বনি ,
মাটির বুক ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ এক ছাতিমফুলের গাছ, হলুদ পাতায় পাতায় যেন লেগে আছে কার
চোখের ঈষৎ অশ্রুফোঁটা ! ভিজে ছাতিম ফুলে ঝরে পড়ছে আশ্চর্য প্রণয়কথনের ঘ্রাণ …
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন