শহরের চুপকথা



১.

নীল রঙ করা ইটের গাঁথনির ঘরগুলো গায়ে গা লাগিয়ে। মাঝে দুই হাত চওড়া গলি।গলি দিয়ে বাইরে এসেই বড়ো রাস্তায় জলের কল।কল বললে যদিও তার অপমান।মাথা,গলা খুইয়ে বসে আছে।ভুড়ভুড় করে জল উপচে পড়ছে।দেখলে বড়দিনের রাতে পার্কস্ট্রীটের চওড়া রাস্তায় আলো ঝলমলে উৎসবের কথা মনে পড়ে। কে খেতে পায় না? শহরে ভিখিরি আছে বুঝি!

হাঁড়ি,গামলা,বালতি,ঘটি,ডেকচি,মগ,কলসি, জ্যারিকেন সব ...সব  ঐ অন্ধকার গলি দিয়ে স্যাতস্যেতে একফালি বারান্দায় থাকবে। জলের লাইন করা সম্ভব নয়। টাকা লাগে।

জল পড়ছে...পড়ছেই।এসব সৌখিন শহুরে অপচয়।







২.

সেদিন দুপুরে শহর হাত পা ছড়িয়ে শুয়েছিল।আধা ঘুম আধা জাগরণে। পাগলিটা সারা দুপুর জেগে ময়লা পুঁটলি ঘাঁটল। মুখে বিড়বিড়– নিয়ে গেল,নিয়ে গেল। দিয়ে যা…চিৎকার করছে কখনও। 

ব্রিজের নীচে ত্রিপল টাঙানো ছাউনির সামনে মোবাইলে গেম খেলছিল জনা চারেক কিশোর। সদ্য ওঠা গোঁফের রেখা। একটু আড়াল নিয়ে প্রত্যেকেই কিছু শুঁকছে।গেল... গেল বলে ওরাও তারস্বরে চিৎকার করছে। প্রতিকী মানুষ মারার উল্লাস।


পাগলিটার কি নিয়ে গেল, কে নিল? জানা নেই।

শহরের সব কিছু নিয়ে ভাবলে চলে না। সময় কোথায়!







৩. 

নামকরা সরকারি হাসপাতালের বড়ো গেটে সর্বক্ষণের ভিড়।অ্যাম্বুল্যান্স আসছে। যাচ্ছে।

কত রকম গাড়ি,উদ্বিগ্ন মুখ, কারো মুখে হাসি কারো বা বাঁধভাঙা কান্না—দিন রাতের এ সবই চলমান জলছবি। রোগীর সুস্থ হওয়ার চাবি ডাক্তারদের কাছে জেনেও রুগীর বাড়ির আত্মীয় কয়েকজন রাস্তার পাশের বট গাছের নীচে ভিড় করেছে।

মাথায় পাগড়ি, খাটো ধুতি আর গেরুয়া পাঞ্জাবী পরা হিন্দিভাষী মানুষটির সামনে খাঁচা। ভিতরে টিয়া পাখি। খাঁচার সামনে ছোট ছোট কাগজ। কি প্রশ্নে কি কাগজ ঠোঁট দিয়ে টানছে তা ওরাই জানে।রোগীর ভাগ্য গনণার দায়িত্ব খাঁচার টিয়ার।বটগাছে সন্ধে নেমেছে।পাখিরা ফিরছে ডেকে ডেকে।খাঁচার টিয়ার ভাগ্য এমন নয় যে উড়ে উড়ে বেড়াবে।






৪.

আড়মোড়া ভেঙে বিকেল হচ্ছে তখন।দুপুরবেলা  দোকানের আধ ভেজানো দরজার পাল্লাগুলো খুলছে। টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন থেকে খানিকটা এগিয়ে চায়ের দোকান। চা পাতা জল ফুটে গেছে।দোকানির হাতে ছোট অ্যালুমিনিয়ামের মগ। গুঁড়ো দুধ দিয়ে ক্রমাগত উথলানো চলছে।তিনজন ভদ্রলোক সাথে তিনজন ভদ্রমহিলা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। সকলেই মাঝবয়সী।কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও বিয়ের পাকাকথা বলতে যাচ্ছেন।একজন ভদ্রলোক মহিলাদের দিকে তাকিয়ে বললেন , যার যার হাঁটু ব্যথা হচ্ছে বসে নাও।

চায়ের দোকানের সামনে আড়াই ফুট লম্বা সরু বেঞ্চে কষ্টে শিষ্টে তিনজনই বসলেন। পুরুষরা চায়ের খুড়ি এগিয়ে দিলেন।





৫.

যতক্ষণ শহর এই গলি রাস্তায় হাঁটাচলা করে ততক্ষণই জানলার পাশে বসে সময় কাটে।ঘিঞ্জি গলি হলে কি হবে পুরনো নোনাধরা দেওয়ালে এখনও বনেদিয়ানার সুবাস।রোয়াকে আড্ডা, ছোটোদের ক্রিকেট-ঘুড়ির সাথে ' শিল কাটাও ' হেঁকে যায়। রাত দশটায় খই দুধ খেয়ে অপেক্ষা। আমেরিকা থেকে ছেলে ফোন করবে। তারপর পাতলা চাদরটা টেনে আধবোজা ঘুম। আবার একটা দিন— জানলার ধারে বসে আশি বছরের চোখ দিয়ে শহর দেখা। পৃথিবী থমকে আছে শহরের গলিতে। 








লিপি সেনগুপ্ত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন