বাহালনগরঃ একটি গল্পকবিতা
১.
বছর পাঁচেক বয়স ফিরোজার।ছটফটে রঙিন প্রজাপতি।
সে তার ছোট্ট ভাইকে নিয়ে মাটির গন্ধ মাখে দাওয়ায়,
নিকোনো উঠোন পেরিয়ে হতে চায় ঘাসফড়িং।
বেড়াফুল আর পাথরকুচির রঙে মিশিয়ে দেয় দুপুরের রোদ।
বিকেল গড়িয়ে গেলে পুকুরঘাটে চই চই চই চই - হাঁসগুলিকে
নিয়ে ঘরে ফেরার ডাক।
২.
একটা মস্ত পাকুড়গাছ আগলে দাঁড়িয়ে কামিরুদ্দিন
শেখের বাড়ি। কাজের টানে কামিরুদ্দিন গ্রাম ছেড়ে
সুদূর কাশ্মীরে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে বাহালনগরের
মাটির গন্ধ, ফিরোজার প্রজাপতি বিকেল,দামাল ছেলে কোলে
বছর চব্বিশের টলটলে চোখ, আঁশটে গন্ধের ঝোঁক
ছাপা ব্লাউজে।
হেমন্তের ঝিলমিল রোদ যেন ছুঁয়ে আছে ফেলে আসা
বাড়িঘর। হালকা শীতের চাদর টেনে ডুবে যায় শ্রমিক
কামিরুদ্দিনের চোখ।
৩.
শীত এলে বাহালনগরের দোকানপাটের ঝাঁপবন্ধ হয়ে যায়
দিনের আলো কমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই।রাস্তার মানুষজন
টের পায় এবার শীত আসছে তার মাজা রঙের ডানা মেলে।
হাজার তিনেক কাঁচাপাকা বাড়ির মাথায় ঘুম নেমে আসবে
এবার সন্ধে রাতেই।
হঠাৎই যেন কাতর ডানায় উড়ে উড়ে আসে দুঃসংবাদ!
হেমন্তের গা ঘেঁসে ঝোড়ো বাতাস নেমে পড়ে বাহালনগরের
বুকের ওপর। ঝাপসা আলোয় বৃদ্ধ কাসেম আলির
অবাক চোখ-
'এতো রেতে গাড়ি!
কীসের লেগে এতো গাড়ির মেলা?
আগে কুখনো দেখি লাই তো?'
৪.
কাতরাসু গ্রাম।কাশ্মীরের কোল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে। আজ বাতাস
সেখানে কাতর। বইতে হবে শ্রমিক রক্তের ঘ্রাণ! হিংসার ধারালো
নখে ক্ষতবিক্ষত নিরাপরাধ পাঁচটি শরীর।
আকাশি আঁচলে ছড়িয়ে আছে পরিযায়ী রক্তের মাধুকরী।
বাহালনগরের কান্নার মেঘ উড়ে উড়ে অকাল নামিয়েছে আজ
নিরীহ কাতরাসুর চোখে।
৫.
কামিরুদ্দিনদের বুকে বুলেটের সুজনিতে ডুবে গ্যাছে গ্রাম্য
ধুলোর গন্ধ!চোখের সবুজ ধানি আলো ফিকে হয়ে ফিরে
এসেছে বাহালনগরের ঘুমন্ত দরজায়।
বৃদ্ধ কাসেম আলি অবাক চোখে দ্যাখে।
এ তো গাড়ির মেলা! কার লগে!
কেডা ঘুম ভাঙায়!
কেডা?
৬.
কোনরকম দাসখত ছাড়ায় সেদিন ছোট্ট ভাইয়ের
অভিভাবক হয়ে যায় ফিরোজা।বিষণ্ণ দাওয়ায়
দামাল ভাইকে আগলে রাখে কচি দুটি হাতে।
আজ আর ঘাসফড়িংয়ের কথা মনে আসে না...
মনে আসে না বেড়াগাছের আড়ালে ছোট্ট পাখির
বাসায় শান্ত চুপিসার।
কামিরুদ্দিনের মায়ের বুক চাপড়ানো কান্নায় রুদালি
বাহালনগরের আকাশ।মাটির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে
ক্ষতবিক্ষত শব্দের জমি-
'ওই লছিমনডা(রিকশার নাম) চালায়েই তো সংসার
টানতে পারতিস!' ভিন দ্যাশে ক্যান গেলি বাপ আমার!
দরজার ফাঁক গলে লাল নীল ছাপা শাড়ির ভাঁজ থেকে
উঠে আসে কান্নার ছোপধরা ক্লান্ত ঠোঁট-
'এমনডা কেন অইল গো!
আমাদের কী দোষ আছিল!’
৭.
প্রশ্নের পর প্রশ্ন এড়িয়ে কমান্ডোবাহিনীর আঁটোসাঁটো
ঘেরাটোপে কিছু নাছোড় সংবাদের খিদে। চেটে নেয়
বুলেট ফ্রুফ জ্যাকেটের ঘনত্ব।একে ৪৭এর ছিপছিপে
শরীরের আগুন ছুঁয়ে বুঝে নেয় দহনের তীব্রতা ।
ভুল রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। রক্তের কালভার্ট আঁকা ঠিকানায়
কিছু চিঠির দাগ লেগে এখনো। কিছু অসহায় শব্দের অস্ফুট
মাথা তুলে মেখে নিতে চায়..
বাহালনগরের মাটি
ফিরোজার বিনুনির রং
লছিমনের অভিমান
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন