ডুলুং নদীর জলে

(ধারাবাহিক যাপনকথা)




পর্ব-৩

চা পানের পরিতৃপ্তি যতটুকু সময়কে অতিক্রম
ক'রে যায়... আর সূর্যের অভিযাত্রায় দিনের এই
যে পরিক্রমণ... সেটুকু দেখতেই ছায়া স'রে যাচ্ছে।
এখন কিছুটা পথ পেরিয়ে যেতে হবে টোটো ধ'রে।
সে সব জানে টুটুন। অতএব চারণিকের মুখের
দিকে আমাদের দু'জোড়া চোখ পথের আগামীকে
দেখতে আগ্রহী হ'য়ে উঠছে। অতঃপর নির্দেশমত
টোটোয় উঠে খানিকটা আশপাশের উপর চোখ
বুলোতে বুলোতেই... শহর ঝাড়গ্রামের ভীড় পার
হ'য়ে কিছু কিছু মাটির রাস্তা, বেড়ার দোকান, কাঁচা
বাড়ির ছাউনিতে কালো হ'য়ে যাওয়া বিচালির রং,
দ্রুত হেঁটে যাওয়া খালি পা'য়ের মানুষ... নামতে
হ'ল নৃপেনপল্লীর গলির মুখে। এখানেই গ্রামের মধ্যে
কালির নতুন বাড়ি। কালিপদ সাউ। প্রাইমারীস্কুলের
প্রধান শিক্ষক। ঝাপসা একটা ছবির ভিতর থেকে
উঠে আসছে কোলকাতা বইমেলা।

ট্রেকস্ এন্ড ট্যুরস্ এর স্টলের সামনে আমি আর
কবি তাপস গুপ্ত। আরো কেউ কেউ আছে সঙ্গে।
ঝাড়গ্রাম ফেরত টুটুন ফোন ক'রে জানাচ্ছে... 
আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি বইমেলায়।
সঙ্গে ঝাড়গ্রামের কালি আছে। আর ফার্স্টকাট
মহুল খানিকটা... তোমার জন্যে। তারপর তো 
অদ্ভুত এক বিস্ময়ঘোর নেমেছিল জটিল অথচ
মৌলিক এই পৃথিবীতে। পাশেই পুলিশ ক্যাম্প। তার
পিছনে খানিক ফাঁকা জায়গা... আলো অন্ধকার
ঘেঁষা একটা ঘাসজমি। সেখানে সিগারেটপিপাসু
মানুষের আনাগোনা। কেউ কেউ ঢাউস টিফিনবক্স
খুলে ব'সেছে বিকেলোত্তীর্ণ অবসরে। আর কালি
একটা জলের বোতলে গাঢ় মহুল মিশিয়ে তৈরী
করছে পিয়াসযোগ্য তরল। টুটুন বিড়ি ধরানোর
আগে আমার হাতে গুঁজে দিচ্ছে আস্ত একটা গরম
আলুর চপ। সেটা তিন টুকরো হ'য়ে চ'লে গেল
হাতে হাতে। মহুলের বোতলে প্রথম চুমুক দিয়েই
টের পেলাম আসলি স্বাদ। দু'ই মুখ ঘুরে আবার...
ঘুরতে ফিরতেই একটা আমেজ পেয়ে বসছে।
কালি সিগারেটে আগুন ছুঁয়ে বাড়িয়ে দিল হাতে।
ভুবনভরা শান্তির উল্লাস মিশে যাচ্ছে শরীরের
গোপন প্রকোষ্ঠে... 

সামনে খানিকটা খোলা মাঠ। পেরিয়ে যেতেই
গ্রামের মাটিমাটি পথ। একটা বাঁক নিতেই একটা
দোতলা পাকা বাড়ি। টুটুন বলছে... এই হ'ল সেই
কালির রাজপ্রাসাদ। তারপর গেটে হাত দিয়েই
চীৎকার... কা লি ...   ভিতরে একটু উঠোন। আর
সবুজ গাছের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বেলি, গোলাপ
জবার মধুর আসঙ্গ সেখানে। তাদের দেখে নিয়ে
জুতো খুলে উপরে উঠছি... কালি উপরে দাঁড়িয়ে
সম্মাষণ করছে। কালি আর রত্না। আপাততঃ ওরা
দু'জনেই থাকে প্রাত্যহিক যাপনের ভিতর। এরপর
আমাদের পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্যে দ্রুত খানিকটা
অবসর। আর সেই সময়টুকুর মধ্যে কালি-রত্নার
সম্মিলিত প্রয়াসে দ্বিপ্রহরাতিক্রান্ত আহারায়োজন।

চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়... সাজিয়ে রাখা আহারপাত্র
থেকে সুমধুর আহ্বান আসছে ঘ্রাণে। আর খেতে
ব'সে কালি বলছে... ছেলে মেয়ে দু'টো পড়াশোনা
করে কোলকাতায়। ছুটিছাটায় মাঝেমাঝে আসে।
ছেলে থাকে বেলঘড়িয়ায়, মেয়ে সোনারপুরে। আর
এই হ'ল রত্না। আমার একমাত্র বউ। রত্না লজ্জা
পাচ্ছে মনে হ'ল। কিছু একটা আনার অছিলায়
দ্রুত রান্নাঘরে চ'লে যাচ্ছে। আর কালি বলছে...
আগে রত্না প্রায়ই কবিতা লিখত। নাচও শিখেছিল।
ধীরে ধীরে সংসারের কাজে এখন এমন হারিয়ে
ফেলেছে নিজেকে... কতদিন কবিতা লেখেনা...
ক ত দি ন নাচটাও আর প্র্যাকটিস করতে পারেনা।
আকাঙ্খার মুখের সবটা জুড়ে বেদনার ছায়া। সে
তখন দইয়ের বাটি থেকে চামচে তুলে নিয়েছে
খানিকটা সুস্বাদু সাদা। মাছের শেষ টুকরোটা মুখে
ফেলে টুটুন বলছে... আবার কবিতা লিখবে রত্না...
রত্না এসে পড়েছে টেবিলের সামনে। ওর চোখের
ভিতর হালকা একটু লজ্জা ছুঁয়ে আছে।
                                                     ..... ক্রমশঃ




গোবিন্দ ব্যানার্জি

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন