আফজল আলি''র "জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট" ও জিরোবাউন্ডারি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ






জলের গভীরে

(চেতনা প্রবাহ)


 

সীমাহীনতা বা অসীম বা অনন্তের কথা কবি আফজল আলি তাঁর "জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট"-এ পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। কবিতা বিজ্ঞান এবং দর্শনের বাইরের কোন বিষয় নয়। আর মানুষ যেহেতু এই গ্রহের সেহেতু তাদের জীবন ধারাও এই বিষয়ের মধ্যেই। 
 
মূলত আমরা অর্থাৎ মানুষেরা দেশ তথা বিভিন্ন সীমায় আমাদের এই পৃথিবীকে ভেঙেছি।  পাখি-ফুল, গাছ-পালা, আলো-বাতাস, কীট-পতঙ্গ এ সবের কোনো মানচিত্র নেই।  আকাশ অবারিত অসীম।  মানুষই কেবল রাষ্ট্র রাজ্য তহসিল সমিতি পঞ্চায়েত গ্রাম তথা আরও ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র সীমায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে।  কবি আফজল আলি-  মনের এই সংকীর্ণতার প্রাচীর ভেঙে অসীম অনন্তের দিকে মানবজাতি এবং বিশ্ব ভাতৃত্বকে তথা কবিতা ও শিল্প সাহিত্যকে উত্তরণের দিশায় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলতে চেয়েছেন।  তবে কোনো আন্দোলন বা প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা বা আক্ষরিক বিপ্লব দিয়ে নয়,  মানবিক উন্মেষ, মানবিক বিপ্লব বা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজের মনে প্রোথিত চিরায়ত বিশ্বাসের দেওয়ালগুলোকে ভেঙে মুক্তির দিকে বিকশিত হওয়ার কথাই হয়তো তিনি বলতে চেয়েছেন। যদিও এই মনে হওয়া আমার নিজের, এখানে ভুল বা সঠিকের কোন মানদণ্ড নির্ণয় করার উদেশ্য বা যোগ্যতা আমার নেই।

কবি হওয়ার গুণাগুণ সব মানুষের, জীবের কিংবা আমরা যে সমস্ত বস্তুকে আপাত দৃষ্টিতে জড় বলে মনে করি সেই সব বস্তুর মধ্যেও আছে। কিন্তু সেই গুণাবলিগুলোকে জীবনের প্রতিটি স্তরে নিয়ত অভ্যাসে পরিণত করতে পারলেই একজন মানুষ সেই উজ্জ্বলতায় পৌঁছোতে পারেন। এবং নিজের উজ্জ্বলতায় জগতকে আলোকিত করে তুলতে পারেন। মানুষকে এই পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষমতা নানান অনুষঙ্গ দিয়ে অর্জন করতে হয়। আর অন্যদিকে মানুষ ছাড়া অনান্য সবকিছুর মধ্যেই এইগুণ সহজাত রূপেই স্থায়ী হয়ে আছে।  তাদের চৈতন্য-  সৃষ্টির শুরু থেকে অর্থাৎ অনাদিকাল থেকেই স্থির,  মানুষ অস্থির।  মানুষকে স্থিরবুদ্ধি হতে হলে সেটিকে অধ্যয়ন করতে বা নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারা সেই গুণাবলীকে জাগাতে হয়। বুদ্ধি কাজ করে চিন্তার মাধ্যমে, মন সক্রিয় হলে। কিন্তু ধী কাজ করে মনের শান্ত অবস্থায়। আবেগ বা emotions-কে যদি সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করা হয় তবে ধী অমূল্য হয়ে ওঠে। ধী অর্থাৎ  ফোর্থ-ডাইমেনশন।  কাজেই ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয়ের বা sixth sense ব্যবহার, প্রজ্ঞা বা wisdom, সৃজনশীলতা বা creativity, সংবেদনশীলতা বা sensitivity  ইত্যাদিতে ধী খুবই সাহায্য করে। আর একজন প্রকৃত কবির, একজন সবপ্রকৃতসত্ত্বা  নিজের ভেতর এই গুণাগুণগুলোকে সর্বদা জাগিয়ে রাখেন। এই সামান্য পার্থক্যেই পৃথিবী বদলে যেতে পারে।  এই বদলে যাবার সম্ভাবনা আছে বলেই হয়তো সূর্য চাঁদ এই পৃথিবী কিংবা এই ব্রহ্মাণ্ডের সাথে মানুষ আজও আছে।  এই হয়ে ওঠা ফুল ও ফলে সমাদৃত হবার আশা সকলের অন্তরে বাসা বাঁধুক।  

যে কোনো কবির ভাবনা ও কবির চেতনা পরিলক্ষিত হয় তাঁর জীবনশৈলীতে।  কবিতা মুক্ত পাখির ডানায় সীমাহীন তাপ-নিরুত্তাপ।  কবিতা পজিটিভ অর্থাৎ পজিটিভিটিকে আইডেন্টিফাই করে। কবি কখনোই নিরাশ নন, কবি মরতে মরতেও জিইয়ে রাখেন আশা। অন্তিম মুহূর্তেও কবি কখনো নিরাশ হন না। আমরা যে সব শব্দের উচ্চারণ দৈনন্দিন কার্যকলাপে ব্যবহার করি তার সুশৃঙ্খল বিন্যাসে পরিলক্ষিত হয় শব্দের তথা ধ্বনির অন্তর্নিহিত উচ্ছ্বাস বা নিউট্রিনোর জাগরণ।  এই জাগরণে শব্দের জাড্যতা ভেঙে প্রস্ফুটিত হয় এক জায়মান জগৎ তথা প্রাণের প্রাচুর্য।


তাছাড়া কবি এই বাউন্ডারির ভেতর কি কিছু নতুন চিহ্ন প্রকরণের কথা বলছেন যেগুলো দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে কবিতার গোত্র, নাকি কবিতাচিত্রের অন্তর্নিহিত শক্তিকে?  কিংবা এই জিরো দিয়ে কি আবার নতুন কোনো সীমানা তৈরির ঈঙ্গিত দিতে চেয়েছেন কবি?

আসলে হয়তো মানুষের মনস্তত্ত্ব একাধারে বদ্ধ আবার মুক্ত এই দুই কনট্রোভারসাল বা বিতর্কিত ভাবনার আবর্তে বিমূর্ত ক্রিস্টাল।  এই বিতর্ক মানুষ নিজের উপলব্ধির জোরেই ভেঙে ফেলতে পারে।  আর ভেঙে ফেললেই এক অসীম আনন্দের ঢেউ উথলে জীবন সুন্দর ও মনোরম হয়ে ওঠে।  এই মনোবল জোড়ালো করার লক্ষ্যেই কবির মনে হয়তো জেগে উঠেছে জিরোর ধারণা।  এটি আরোপিত নয়, প্রাচীরগুলো চোখে দেখা যায় না এগুলো মনের ভেতরের, সুতরাং নিজের মনস্তত্ত্বগত চেতনার উন্মেষে এই প্রাচীর ভেঙে ফেলা বা অপসারণ করা যায় আর এটি করতে পারেন যিনি তিনিই কবি, তিনিই শিল্পি তথা এই জগতের বা জীবনের তথা যাপনের দিক নির্দেশক। 

শব্দ বা ধ্বনির অন্তর্নিহিত চুম্বকীয় গুণাবলী যা শব্দের ভেতর সহজাত রূপেই গ্রন্থিত, গোপন বা প্রচ্ছন্ন ছিল যা শব্দ বা ধ্বনির পারস্পরিক মেলবন্ধনে প্রকট হয়ে পাঠকের মনে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নিউট্রিনোগুলোর প্রবল বিকীরণ ঘটায় এবং পাঠকের মনে অনুরণন তোলে। এই শব্দের মেলবন্ধন ঘটিয়ে মনে অনুরণন তুলতে সক্ষম কবি তথা শব্দের যাদুকর। এই হয়ে ওঠা কবিতা এই হয়ে ওঠার সাথে নিজেকে জুড়ে রাখাই কবির মনস্তত্ত্ব। 

সুতরাং কবিকে বিশ্লেষণ করবে সময়, সময়কে বিশ্লেষণ করবে অক্ষর আর অক্ষরের অন্তর্যামী হয়তো কবিই। কিংবা হয়তো তাঁকেই আমি ঈশ্বর মানি~

এই মুক্তির পথ যিনি প্রসস্ত করছেন তিনি হয়তো ভাবছেন আমি যা করছি এতে মানবজাতীর তথা পার্থিব সবকিছুর বা এই ব্রহ্মাণ্ডের উত্তরণ ঘটবে তাহলে এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, শুধু কবি বা শিল্পী বা চিত্রকরেরাই এই মহাজগতের বিনির্মানে কার্যকরী ভূমিকা রাখছেন? 
আর যারা কৃষক শ্রমিক বা অনান্য আনুষঙ্গিক কাজে নিয়জিত মানুষ, জন্তু-জানোয়ার, উদ্ভিদ, পোকামাকড়, জড় তথা সমগ্র জীবজগত কি নিছক এই ব্রহ্মাণ্ডে উপকরণ মাত্র?  নিশ্চয়ই তা নয়। 
আসলে আমরা যাঁরা চেতন তথা চৈতন্যের অধিকারী রূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বা উদ্ভাসিত করতে চাইছি তাঁরা সত্যিই কি এর সঙ্গত দাবিদার?  নাকি এগুলো শুধুই নিছক মাদকাতা? 
এ প্রশ্নগুলিরও যথার্থ মূল্যায়নের সময় হয়তো এসেছে। আবার হয়তো এই প্রশ্নগুলো যথার্থই সূত্রহীন।  আবার এমনও হতে পারে আমার বুদ্ধি ও চৈতন্য হয়তো এগুলোকে ভেঙে সামনে এগোনোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না।  

এই মহাশূন্যের আবর্তে বিচ্ছুরিত নিউট্রিনো, পজিট্রন বা মেসন কণাদের স্পিন আমার গুরুমস্তিষ্ক তার রন্ধনশালায় সুস্বাদু বা পরিপাকযোগ্য করে পাঠকের লাঞ্চ বা ডিনার টেবিলে পরিবেশন করতে সক্ষম হচ্ছে না।  আমি ব্যক্তি এটা প্রতিষ্ঠিা করতে প্রতিনিয়ত মরিয়া হচ্ছি। কেন এই প্রচেষ্টা? এই প্রচেষ্টাতে মানবজাতীর তথা ব্রহ্মাণ্ডের কতটুকু উন্নয়ণ ঘটবে তার স্যাটিস্টিক কি আমার জানা আছে? যদি জানা থাকে তাহলে সেটা সত্যিই কি অধিকাংশের মতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নাকি মুষ্টিমেয় কিছু জনসমর্থণ নিয়ে বেঁচে বর্তে কাটিয়ে যাওয়া সহজাত এক মানবিক ধৃষ্টতা।  

নাঃ এরম নয়, এতটা নিরাশাজনক নয়।  তবে শেষ করার আগে আরও কিছু শব্দের মিছিল বয়ে যাবে এই জনস্রোতে।  আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার অবসান কি শেষ হবার নয়?  মূর্ত থেকে বিমূর্ত এবং বিমূর্ত রূপ থেকে নিজেকে মূর্ততায় প্রতিষ্ঠিত করাই কি আমাদের লক্ষ্য?  

যার কোনো প্রাচীর নেই,  যে সীমানাতীত-  সেইই জিরো। তাকে কোনো বাউন্ডারির ভেতর আবদ্ধ করে ফেলার প্রবঞ্চনা আশাকরি পাঠক, শিল্পি তথা কবিকূলের নেই।  তাহলে কবিতা লিখে গল্প লিখে আমরা কী পেলাম, কেনই বা লিখছি কেন এই অযাচিত অধ্যাবসায়? এই প্রশ্নগুলি মাথা তোলে।  নিজেকে জাহির করতেই কি এই ইন্দ্রজাল? নাকি এটা মায়ায় জড়িয়ে সব দুঃখ ও সুখের উপরে নিজের আত্মোপলব্ধিকে ভাসিয়ে চলাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য?  সব প্রশ্নের সঙ্গত জবাব খুঁজে পেতে জ্ঞানের আলো তথা চেতনার এলইডি-বিচ্ছুরণে সব অন্ধকারের অবসান হয়তো একদিন আসবে~
কবি আফজল আলির জিরো'তে এলিমিনেশন নেই ইনক্লুশন আছে, সুতরাং এখানে যেমন নতুনকে গ্রহণ করার প্রবল ইচ্ছে,  ঠিক তেমনই পুরোনোকেও সঙ্গে রাখার সদিচ্ছা প্রতীয়মান। সেজন্যই কবিতার আইডেন্টিটি স্থাপনে অধুনান্তিক এবং তার পূর্ববর্তী রীতি প্রকরণ গুলোও এখানে সজীব। তবে আর যাই হোক না কেন, এই অসময়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার যে নতুন কৌশল গড়ে তুলেছেন কবি সেটির কৃতজ্ঞতা থেকে অবশ্যই তাঁকে বঞ্চিত করা যাবে না। 

কবি আফজল আলির জিরো বাউন্ডারি হয়তো গাঢ় অন্ধকারে আলোর রোশনাই।  সেই আলোয় সকলের মনের মশাল জ্বলে উঠুক।  'জিরো বাউন্ডারি কবিতা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ'- নিরলস নতুন কবিদের ভাববিনিময়, স্পর্ধার এক উন্মুক্ত আকাশ এটা বলা যেতেই পারে।  তবে সেখানে যেমন লাবণ্য আছে, অন্ধকার অবশ্যই তার সহচর। জলের কাছে উদ্ভিদ, সাদার পাশে কালো, ভালোর পাশে মন্দ যেমন। এই সহজাত সহাবস্থান থাকবেই।  

সর্বপরি আমরা আশাবাদী তাই হয়তো যথার্থই পিট সিগার এই গানটির রচনা করেছেন এবং যার বাংলায় অনুবাদ করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।  সেই গানের পংক্তি দিয়েই শেষ হোক এই মোমবাতির জীবন- "আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয় নিশ্চয়, মনে আছে যে প্রত্যয়, দৃঢ় প্রত্যয়, আমরা করবো জয় নিশ্চয়" 





আমিনুল ইসলাম 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন