ডুলুং নদীর জলে

(ধারাবাহিক যাপনকথা)




প্রথম পর্ব


কখনও কখনও এমনি হয়। স্টেশনে ঢোকার আগে
দাঁড়িয়ে গেল ট্রেন। ব্যস্। ঘাম জমছে কানের পাশে।
এইমাত্র ফোন করছে আকাঙ্খা ব্যানার্জী। বলছি...
এই তো কারসেড পেরিয়ে গেলাম। ঘড়ির সময়টাকে
এখন দাঁড় করিয়ে রাখো খানিক। আসছি। আর
প্লাটফর্মে হাঁটছি মেজাজে। কেননা দূর থেকেই বড়
ঘড়িটায় দেখছি সকাল ন'টা দশ। মানে দশ মিনিট
লেট। ও ঠিক আছে। এখান থেকে, মানে হাওড়া
থেকে ঘাটশিলা লোকাল এক্সপ্রেসের টাইম সেই
দশটা দশে। লোকাল এক্সপ্রেস। নামটা বেশ কৌশলী,
করোনাকেন্দ্রিক লক ডাউনের পর চালু হওয়া রেল
পরিষেবার এই এক মজা। লোকাল ট্রেনের ভাড়া
কম, তাই লোকাল এক্সপ্রেস... নাম দিয়ে দ্বিগুন
ভাড়া নেয়াই চলে যাত্রীদের থেকে। দারুণ ঠগবাজী ব্যাপার। 
আমার চোখ এবং পদক্ষেপ বড় ঘড়িমুখী।
তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভীড় এবং সমবেত শব্দজঞ্জালকে
ছাপিয়ে কানে পৌঁছে গেল। বাঁ দিকে বাহির গেটের
মুখে দাঁড়িয়ে আকাঙ্খা হাত নাড়ছে। কাছে যেতেই
কন্ঠস্বর নীচু হ'য়ে গেল। বলছে... 
চলো দাদা,  টুটুন নতুন বিল্ডিং এ আছে... ফোন করেছিল এইমাত্র।
চলো মানে বাইরের পথে গনগনে রোদ্দুর। অর্থাৎ
হন্টনে ঘামের গন্ধে রুমাল ভিজবে। বেশ, তাই হোক।

চারণিক টুটুন দত্ত। কিছুদিন আগেও কথা হয়েছিল,
ও সকাল ছ'টার বাসে আগে পৌঁছে যাবে ঝাড়গ্রাম।
আমরা ট্রেনে পৌঁছবো দুপুর দেঢ়টায়। পরে ইচ্ছে
অনিচ্ছেগুলো পাল্টে গেছে। যেহেতু অত সকালে
আমাদের এই দূরত্ব পেরিয়ে বাস ধরা সম্ভব হবে না।
ব'সে আছে গেট দিয়ে ঢুকেই সামনের চেয়ারে। হাত
তুলে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিল। বসলাম চেয়ারে।
বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে প্লাটফর্ম নম্বর আঠেরো।
ছোট ন্যাপস্যাক পিঠে তুলছি... সামনের চেয়ার
থেকে উঠে এলেন এক মহিলা কন্যা সহ। আকাঙ্খার
পরিচিত জন। টুকিটাকি কথা বিনিময় সেরে চলছি
ট্রেনের উদ্দেশ্যে। অনেকটা সামনে এগিয়ে ফাঁকা
কম্পার্টমেন্ট। গুছিয়ে বসা মানেই গরম চায়ের জন্যে
খোঁজ। এই সময়টায় বড্ড আয়েশ লাগে। মনে হয়,
এই তো উদযাপন। এই তো অভিযাত্রা।

আকাঙ্খা একজন বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী।
ও লোকগান গাইছে, মাইক্রোফোনে সে সুর ছড়িয়ে
পড়ছে দূর দূর পাহাড়ী পথে। বান্দো নদীর খাত
থেকে উঠে আসছে তিনজন মহিলা, কাঁখে মাটির
কলসি... জলের তরঙ্গে ছলকে উঠছে শরীরের
কাঁপন। আর আমি হাততালি দিচ্ছি গানের ছন্দ
বজায় রেখে। এই দৃশ্যটা প্রায়ই দেখি, যখন বিমর্ষ
লাগে খুব। মনের ভিতর গুনগুনিয়ে ওঠে...
                   একটা নাচনি পোকা....
বড্ড ভালো গাও তুমি। তোমার মনে পড়ছে সেই
দিনটাকে? আমাদের আটজনের সাথে কথা বলার
জন্যে মাত্র পনের মিনিট সময় দিয়েছিলে। সবাই
তোমার সাথে ছবি তুলতেই মেতে উঠেছিল তখন।
খানিক পরেই মঞ্চে তোমার গান। আমি একটু তফাৎ 
থেকে তোমাকে বুঝে উঠতে চাইছিলাম। তুমিও
কি মনে ক'রে আমার কাছে এগিয়ে এলে। ছবি
তুললে। হাত বাড়িয়ে দিলে। সেই তো প্রথম আলাপ।
পুরুলিয়ার বইমেলা। আহা। তোমার সহজ অথচ
ব্যক্তিত্বময় সঙ্গ পেতে এবার ডাক পাঠালাম তাই।
চলো... ক'দিন সুবর্ণরেখা আর ডুলু়ং নদীর ছোঁয়া
নিয়ে আসি। তাছাড়া কবি অনিমেষ সিংহের ঐ
সুবর্ণরৈখিক মিলন মেলার আন্তরিক আহ্বান তো
আছেই। যাবে...? তুমিও রাজি হ'য়ে গেলে। টুটুন
চেয়ে আছে জানালার বাইরে। 
আর আমি শব্দহীন এক গভীর মননের ভিতর চলেছি উজান ঠেলে ঠেলে। 
যাপিত সময়ের কাছে।

                                              (ক্রমশঃ)










গোবিন্দ ব্যানার্জী

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন