কাব্য গ্রন্থঃ গণতান্ত্রিক আলো / আমিনুল ইসলাম
প্রকাশনা: কবিতা পাক্ষিক (কলকাতা বইমেলা ২০২০)
প্রচ্ছদ: ডঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য
মূল্য : ৫০ টাকা
পাঠ প্রতিক্রিয়া: প্রকাশ ঘোষাল
কবিতা পড়তে পড়তে আমার ভীষণ ভীষণ হাঁটতে ইচ্ছে করে। দীর্ঘ জীবন ধরে আমি শুধু হেঁটে চলেছি। আমার চারপাশে গাছ, তার শূন্যে বাড়ানো হাত, হাতের মুদ্রায় অসংখ্য চরিত্র লিপি, শিকড়, তারও শরীরে বদলে ফেলা রঙের বাহার, পাথরের স্তব্ধতা, স্তন্ধতার ভেতর একবুক নিশ্বাসের হারমনি সবকিছু আমার দায়বদ্ধতার ঘরে এসে জড়ো হয়। আমি এড়াতে পারি না। কি করেই বা এড়িয়ে যাব? ভারত বর্ষের মতো দেশে যখন দেখি ভুল স্টেশনে নেমে ভুল দৌড়ে মানুষ কচুরিপানায় ঝাঁপ দিচ্ছে, সমস্ত রেল ক্রসিং গুলো স্থির, আত্মনির্মিত দর্শন ছিটকে পড়ছে রাস্তায় তখন কবি ছাড়া এই স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার থেকে কে মুক্তি দেবে ভাবতে থাকি। চৈতন্যের (ফোটন কণা) ক্ষতস্থানে জীবনের স্বর কি কোন মহিমা খুঁজে পায়। আসলে শুধু আমার নয়, আমাদের পৃথিবীর সব প্রাণীজগতের একটু বেঁচে থাকার জন্য আলোর প্রয়োজন। তখনি প্রশ্ন ওঠে কী রকম আলো? ঐ আলোর প্রকৃতিই বা কী। এর উত্তর সরাসরি পেয়ে যাই কবি আমিনুল ইসলামের কাছ থেকে। 'গণতান্ত্রিক আলো'। ঝলমলে বিশেষণ। আমার পাঠজীবনে এরকম শব্দ ব্যবহার কোনদিন দেখিনি। কবি স্পেসিফিক হয়ে যান সমাজ জীবনের প্রতি। একেই বলে দায়বদ্ধতা। আসলে আমাদের ভাবনা অন্তঃশীলা। কবির প্রকৃতিও তাই। ফলত বিভিন্ন কবির প্রকাশভঙ্গি তার শিল্পের দুয়োরে এসে দাঁড়ায়। আমিনুলের লেখার মধ্যে যা অস্ত্র পাই তা সমাজের হৃৎপিণ্ড এফোঁড়ওফোঁড় করে দেবার পক্ষে বেশ জুতসই।
আমিনুলের শব্দ প্রয়োগ এবং তার পারস্পরিক রূপান্তর ক্রিয়ায় দেখি দ্বিতীয় মাত্রা ছাড়িয়ে তৃতীয় মাত্রায় পৌঁছে যায়। একজন কবির পক্ষে প্রতিটি লাইনে শব্দের ভারসাম্য রাখাও খুব জরুরি। বলতে দ্বিধা নেই, বাঁশ ও বাঁশির এই দুটি সিগনিফিক্যান্ট শব্দ দুটো ডায়ালেক্ট তৈরি করে। একই স্পিসিস থেকে জন্ম হয়েও শুধু তার অ্যালোট্রপিক ফর্মের ফলে তার সমস্ত মেকানিজম বদলে যায়। এখানেই কবি আমূল সার্থক। খাল কেটে কুমির ডাকার গল্পে একটু লবন বেশি হলে দাঁত হাসে। প্রবাদ বাক্যকে এইভাবে বলার একটা শব্দময়তা থাকে। ঝাড়ের বাঁশ ঝাড়ে না রেখে ঘরে আনলে যে কি হয় তা পাঠক মাত্রই বিলক্ষণ জানেন। এই চূড়ান্ত অস্বস্তিকর অবস্থায় আমাদের প্রত্যেকেরই যাপনচিত্র আঁকা হয়। 'ঘুমের পিল গিলে ফেলছি,।এটাই কি আমাদের পরিণতি? না। কেননা কবি যেহেতু সামাজিক সেহেতু বাঁচার পথ ভাবতেই হবে তাকে। লিখতে বাধ্য হন 'বিনিদ্র রাতের সহবাসে মৃত্যুঞ্জয় বাঁশির খোরাক'। শুধু আকার-এর পরিবর্তে ই-কার বসিয়ে কবিতার অর্থময়তার অভিমুখ কিভাবে যে বদলে যায় ভেবে আশ্চর্য হই। বলাবাহুল্য যে দিতে পারে, তা একমাত্র বোধহয় কবিরাই পারেন। হয়তো বা অনেকেই পারেন। কে জানে!
কবির কয়েকটি লাইন যেমন না বললেই নয়। যা অতন্ত্য প্রাসঙ্গিক। স্লো-মোশনে একবার ভাবলেই বোঝা যাবে কবিতার ধমনিতে মননের প্রবাহমাত্রা।
১. শুধু কালি ও কাগজের সহমরণে জাগিয়ে রাখি দৈনন্দিন খননকাজ – এছাড়া কবির কোন বিকল্প নেই। ছিল না। কেননা ঐ জীবন খুঁড়ে-খুঁড়ে কবির যাবতীয় প্রাপ্তি। সবই কি সহমরণে যায়? পাঠকের ওপর প্রশ্ন রইল আমার।
২..সব সবুজ মেখে নিতে প্রস্তুত ধানগাছ (ডেভেলপমেন্ট অফ অ্যাগ্রো সিভিলাইজেশ্যন)
৩. প্রতিটি গোলাপকুঁড়ির বাজারদর মাত্র পাঁচ আর মালতীর খোঁপায় সাজলে সে অমূল্য হয়ে ওঠে। পজিশনাল আইসোমেরিজম এর চূড়ান্ত উদাহরণ। পাঠক লক্ষ্য করুন গোলাপের শুধু অবস্থান বদলে দিয়ে রোমান্টিকতা এবং তার সাথে সাথে বাজার অর্থনীতি ছাপিয়ে মননের হার্ট কোরে স্থাপন করে দিয়েছেন সৌন্দর্যের আদিকোষ। আমরা আসলে ভুলে যাই বাজার দুনিয়ার পরেও আর এক দুনিয়া আছে। জীবিকা আর জীবন দুটোর সত্ত্বাধিকারী এক হলেও তাদের বিন্যাস এক নয়।
৪. অনেকটাই ডিসট্যান্স পেরিয়েছি টিফিনবক্সটি থেকে – শৈশবের গন্ধ এখনো লেগে আছে বুঝি। নিখাদ সত্যি। এখানে টিফিনবক্সের কালই তো পরবর্তী সময়কে চিহ্নিতকরণের জন্য ঝুঁকে পড়েছে। ঐ গন্ধ এখন তারই প্রজন্মের কাছে ট্রান্সফার হয়েছে। টিফিন–পিরিয়ড়ে দুষ্টুমিরা পেয়েছে মেয়ের শৈশব'। আহা। স্মৃতিচারনকেও কি সুন্দর ভাবে বলা যায় ।
৫. কবিতার জীবনবৃত্তান্তে ক্রাইসিস শব্দ যোগ হলে দুটি শীর্ণ হাত বেরিয়ে আসে ছায়ার পাঁজরে।
ছায়ার পাঁজর। দৃশ্যমান জগৎ কে বহুমাত্রিক ভাবনায় পৌঁছে দেওয়ার কি অসাধারণ মুন্সিয়ানা কবির। বাস্তবিক ছায়ার কোন পাঁজর হয় না। এবং লাইট ছাড়া ছায়াও হয় না। পাঠক একবার ভাবুন ছায়ার মাইক্রোস্কোপিক ধর্মের কাছে কবির ভাবনা কোন স্তরে যেতে পারে। পাঁজরের ছায়া নয়, ছায়ার পাঁজরে। ধ্বনিগত সাম্যের প্রতিচ্ছবি।
কবিতা আমার কাছে ইন্টারনাল অ্যান্ড এক্সটারনাল মিরর ইমেজেস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। সেখানে ক্রাইসিস হলে প্রতিমুহূর্তে নিজের ছায়ার কাছেই মানুষ পরাজিত হয়। এ এক ভয়ংকর যন্ত্রণা। আমার বিশ্বাস কবির 'গণতান্ত্রিক আলো'র বিনিময়ে এ-যাপন পৃথিবীর কখনোই কাম্য নয়।
আমার মনে হয় শব্দের অবস্থানগত ভারসাম্য এবং চিন্তায় বৈজ্ঞানিক চলাফেরা না থাকলে কবিতা কখনোই পূর্ণতা পায় না। কোন শব্দ ব্যাখ্যার অতীত কিংবা অনুভবের ধারক ও বাহক বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কেননা শব্দ বিজ্ঞান বহির্ভূত নয়। কবির এবং পাঠকের চিন্তনের তরঙ্গ সুপার ইমপোজ করলেই পাঠক রিয়ালিটির মুখোমুখি হয়।
প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক কবিতার একটা ম্যাট্রিক্স থাকে। আর ম্যাট্রিক্স মানেই সেখানে চিহ্ন সংকেত, অর্থ, স্থান, কাল তদুপরি মননশীলতার সামাজিক বিকিরণ থাকতে বাধ্য। আজকাল অধিকাংশ কবিতাই তো মেধাভিত্তিক। ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড ট্রান্সলেশন অফ ওয়ার্ড ইদানীং কবিতায় খুব বেশি নজরে আসে। আমিনুলের কবিতায় দেখুন – সামনের ব্যানারটির পিছনদিকে ঠিক কী রং আছে সেটা হয়তো জানার প্রয়োজন নেই / আসলে সমস্তটা না জানাই ভালো /। কবিতার নামকরণেই সতর্কবার্তা কেননা কবিতার নাম 'চোরাবালি'। 'চোরাবালি'র চরিত্র জানলেই কবিতার ওয়েভলেন্থ মেজার করা যায়। কিন্তু কবি সমগ্র ছবিটাকে রিয়ালিটির অ্যাসপেক্টএ ব্যবহার করেছেন। এবং এর পরেই নিজের পৃথিবীতে ঢুকে পড়ে দেখেছেন কিছু আতর আর পানপাতার খয়েরী স্বপ্ন/ তোমার সংলাপে লেখা হয় প্রত্ন জলস্রোত আর একটি অন্তঃসলিলা চোরাবালি।
আমি দেখি ইদানিং বাংলা কবিতায় অসংখ্য গতিপ্রকৃতি। একই কবিতায় হাজার অভিমুখ তাদের চলন বলন যেন দিনরাত পরিশ্রমের ফসল। বিশেষণকে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করার টেকনিক রপ্ত করা হচ্ছে। এতে নাকি মায়া মুগ্ধজাল তৈরি হয়। শব্দবিন্যাসের যাদুবিদ্যা আমিনুলও ভালোই জানেন।কিন্তু তার কলমের তির এই সমাজের নারকীয় নির্লজ্জতার বুকে বিঁধে যায়। রাস্তায় নামলে লাগাম হাতে চাবুক শুশ্রূষা চলে অবিরাম বাক্যটি যে কোন মানুষের শরীরের উষ্ণতা বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট। হয় ভয় কিংবা প্রতিবাদ এই দুটোর মধ্যে আমাদের যে কোন একটিকে বেছে নিতেই হয়।
আমিনুল বহু কবিতায় অদ্ভুত ফোটোগ্রাফিক্স করেছেন। জানলার ফাঁক গলে নিভে যাবে মোম কিংবা পুতুল নাচের পুতুলগুলো শ্মশানঘাটে ঝগড়া করে। এইসব দৃশ্যগুলো কবি তার শরীরে মোমের মতো জ্বালিয়ে আত্মবীক্ষণের পরিসীমায় কবিতার জন্ম দেয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন