অনিরুদ্ধ আলম-এর কবিতা 





খোঁজ 


নিরালা একা অনেক দূরে সমুদ্দুরে পাহাড়পুরে ঘুরি 

তবুও এক-উষ্ণ উঁকি কীভাবে পায় আমার খোঁজ? মনে 

সারাবেলা তা ছলকে পড়ে। তুমি যে খুব তুমুল তুমি! উড়ি 

প্রাচীন পুবে। আমি কি কোনো সওদাগর? কোথায় ছুটি? ক্ষণে


আবারো কেন চোখের চাওয়া ঝলসে ওঠে আকাঙ্ক্ষাতে। কিছু 

কথার কায়া ছড়িয়ে ছায়া প্রাসাদ গড়ে অন্তরালে। নদী 

তেমন করে নারীকে জেনে হয়েছে আরো অধিক নদী। পিছু 

ডাকুক যত শ্মশানবাড়ি, তোমাকে ছুঁই ঘাসের ঘ্রাণে। যদি 


বৃষ্টি নামে, জানালা খুলে রাখিও নীল হাওয়ার দিকে। হাতে  

কখনো হাত হবে না রাখা? জোয়ারে কত ফেলেছি ছিপ! মাছ

মেরুন যেই তুলব নায়ে, উজির এসে নেবে তো কেড়ে। রাতে 

জলপরিও তোমার নানা গল্প বলে অল্প কোরে। গাছ


রোদের ঢঙে সাজিয়েছিল শূন্যতার রঙিন দোর। রোজ 

একটা কোনো ঘণ্টাধ্বনি কোথাও বাজে। তোমার করে খোঁজ? 






হীরের কৌটো  


নীলের শূন্যতা, শূন্যতার নীল, বাতিল আধুলিতে

রোদের লীন-ছোঁয়া বাতাসে বাঁধে বাসা। ইলশেগুঁড়ি জমা 

হল কি অনেকটা বোধের কৌশলে জলের আরশিতে? 

যে-নদী আঁজলাতে আগলে রাখো, তার কী নাম, প্রিয়তমায়


সুশীল পাথরের মতন জেদি চিল কুতুব মিনারের 

মগ্নতাকে মেনে দিয়েছে মুছে কত কুয়াশাঘন-প্রেত! 

হীরের কৌটো কি নেয় না বেশভূষা সান্ধ্যভ্রমণের?

তোমার ও আমার মধ্যে কে ওড়ায় অশনি-সঙ্কেত?


কাঁটালতার লাজলজ্জাগুলো যেন বল্লমের ফলা 

গীতল বৃষ্টির জরায়ু চুয়ে নামে শতায়ু ভালোলাগা

কে আসে রাঙা পায়ে? এ-মন অবিরল নিতল কুয়োতলা

মায়াবী কারো আঁখি আমাকে দিল শুধু অধীর রাত-জাগা।


দাও না ঠিকানাটা! ট্রেনের এক-বগি ভর্তি বেলিফুল 

পাবেই উপহার। কোকিল-কুহু-ডাকে লগ্ন মশগুল!






কেউ কি পিছু ডাকে


বাতাসও বকলম। তেমন নীল-নীল আরক পান করে 

দ্বীপান্তরে-থাকা উষ্ণ শূন্যতা। বকের ডানা থেকে 

ঝরেছে যে-শিশির, মেরুন মোরগের পৌরাণিক স্বরে 

সে বুঝি অপরের মোহন মায়াজাল হৃদয়ে নেয় মেখে? 


অলস সময়ের বয়স কত হল? প্রাচীন গুহামুখে 

এসেই মরজিনা ছড়িয়ে দেয় মেকী ‘চিচিংফাক’ ধ্বনি 

আমি কি স্বর্গের চাবিটা ভুল কোরে মোহের টুকটুকে

গলিতে রেখে আসি? দরবেশের মতো চোখের গূঢ় মণি 


মেধাবী ধানফুল পেতেছে অবিরত। অন্ধ দেহভার 

দ্বন্দ্ব বেদ্রূপে শুদ্ধ উনুনের ক্রুদ্ধ উম আঁকে 

হিরন্ময় কোনো মায়াবী শুকতারা কেন যে বারেবার 

ডহর ডাকঘর গড়েছে এই মনে? কেউ কি পিছু ডাকে?


ক্ষমতাহীন ক্ষণে জলের রাজটীকা কুড়াল রাজহাঁস 

তোমার লাবণ্য নিয়েছে নদী ঋণে নিমেষে একরাশ! 


    




আরশি নগর 


বৃষ্টি কি নামছে? নিশিথ সূর্যের কয়েকখানা নাও 

চোখের মতো নদী দখলে রেখে দেয়। স্নিগ্ধ চঞ্চল

রেখার ভালোলাগা আমাকে তলোয়ারে বিদ্ধ করে। তাও 

হৃদয়ে কিছু কাঠ-চেরাই বেজে যাক সঘন অবিরল। 


ভিজছি বৃষ্টিতে। পাথুরে মাছিদের দেশে কি আনমনে

দেয়ালও পাতে কান? আছি তো সুরম্য ভদ্রাসনে খুব

জাদুর জালিয়াতি জলেরা কম জানে। লুপ্তপ্রায় ক্ষণে 

আরশি নগরের মায়াবী প্রতিবেশী এ-মনে দিল ডুব। 


বৃষ্টি ঝরছেই। অলৌকিক কোনো ত্রিভুজ আনচান 

ফুর্তিবাজ হতে কখনো শেখায় নি। বর্ষপূর্তিতে 

নগরশীর্ষের মেঘেরা এসেছিল। সকল সাম্পান 

কোন সে-অপ্সরী নিমেষে কিনে নয়? সুরেলা সঙ্গীতে 


গাইল সারাবেলা, ‘তোমার শুভ হোক!’ জাফরি-কাটা কালো 

দুলছে বৃষ্টিতে। কারো কি মুখ ওতে লাবণ্য ছড়াল?  





মহুয়ার বোতল 


প্রতিটি ঘ্রাণ তার আন্তরিক রঙ লুকিয়ে রাখে কই? 

হাওয়ার সিন্দুকে? সমুদ্দুরে? দূরে? লতার অরণ্যে?

সঙ্গোপনে সাধু শূন্যতাও এক-অশ্ব থইথই

সবুজ কাঁকড়ার ঝাঁকড়া মৌসুম বাঁচে তো লাবণ্যে।


প্রতিটি রঙ কেন পিনোন্নীত তার আড়ালে রাখে ঘ্রাণ?

মদির মহুয়ার বোতলে সঞ্চিত অধীর ভালোলাগা

পাহাড়ি মেয়ে তা কি বিকিয়ে কিনে নেয় অচেনা আনচান?

বৃষ্টি জেনেছিল নিরাভরণ সেই নদীর রাত-জাগা।


শীতল লুকোচুরি নিতল ঘ্রাণে পোড়ে। গীতল রঙে জটা 

ছড়াতে কি পারে নি? বিষণ্ণতা ক্ষণে তীক্ষ্ণ নখ মেলে

ত্রিশূল চক্ষুর দত্যি সেজেছিল। চড়ুই পাখি ন’টা

খেলুক দেহলীতে। দুখজ প্রদীপের সুখজ আলো জ্বেলে


রঙিন ঘ্রাণ কে এ মননে করে দান? কেবলি হয় ঢেউ!

সাঁতারু ভেবে ভুল বুঝেছে আমাকেই হৃদয়হীনা কেউ।  


  



বরফ-গলা নদী


সবুজ কাগজের পৃষ্ঠাজুড়ে ওই কে আঁকে কাঁটাতার?

নষ্ট বীজ থেকে ভ্রষ্ট উচ্ছ্বাস না-পাক খুঁজে ডানা!

প্রেম কি একফোঁটা ময়ূরপঙ্খিতে মত্ত সংসার?

স্বপ্ন দেখাতে যে শেখাল অবিরল, তার তো টানাটানা 


দু’ চোখে নিরবধি বিছানো চোরাটান। শানিত প্রতিবেশী 

তুষারঝড়ে উড়ি। বরফ-গলা নদী নিক-না তবে পিছু!

তোমার গুলশানে ঝরছে চেরিফুল। কণ্ঠে স্বর-পেশী

ফুলিয়ে অকাতর রবিন মাতে গানে। স্বপ্ন দেখি কিছু - 


আমার শীতঋতু ফুরাবে একদিন। নিদাঘ টিউলিপ

হাওয়ার মজ্জাতে সাজাবে কি শয্যা? আসবে তুমি সেই  

সিগাল পাখিদের বিলাসী মৌসুমে। দৃষ্টি ছেয়ে ছিপ 

পাতবে বৃষ্টিরা। স্বপ্ন বিউগল বাজিয়ে চলছেই 


মনন-মন্থনে। আমার উঠোনটা হরিণী-অভ্যাসে 

ঝলসে উঠুক-না কুয়াশা চিরে ক্ষণে স্বপ্নাবেশী ঘাসে!  




কাচ-কাটা হীরে 

মাখি না কতদিন বিজয় দিবসের রঙিন উচ্ছ্বাস

বাতাসে বর্ণিল আলোর চুম্বন দেখি না কতকাল

অগ্নিগিরি-বেশে আজো কি গাঁয়ে ফোটে পলাশ একরাশ?

শানানো ছুরি হয়ে প্রাচীন বৃষ্টিরা উজায় ঝাঁপতাল। 


স্মৃতি কি কালিজিরা শস্যকণাদের দস্যুমতো ঘ্রাণ

কিংবা কাচ-কাটা হীরের আশ্লেষ? সোনালি অক্ষরে 

কঙ্কাবতী লিখি। বলেছ এই বুকে ছড়িয়ে আনচান - 

‘একাকী হলে পাখি লগ্নহীন হয় দৃশ্যহীন ঝড়ে।’


বিষণ্ণতা কোনো গুপ্তচর বুঝি? নিয়ত নেয় পিছু!

প্রবাস-প্রান্তরে অরুন্ধতী কারো চুলের বন্যাতে 

দেখি না বেলিফুল উতালা অবিরল। বর্ণচোরা কিছু 

মুখোশধারী মোহ স্বদেশ হতে চায়? জোছনা-মহড়াতে 


গাধার টুপি প’রে কে ডাকে রাতভর? লাল ও সবুজের 

ডহর তোপধ্বনি প্রাকৃত আমাকেই ফিরিয়ে দিক ফের

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন