অসমিয়া থেকে বাংলায় ভাষান্তর: বাসুদেব দাস
জয়জ্যোতি গগৈ-এর কবিতা
ভাষান্তর: বাসুদেব দাস
১.
তুমি নদীর ঘাটের একটি নির্জন দুপুর বেলা
তুমি নদীর ঘাটের একটি নির্জন দুপুর বেলা
বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া প্রেমের স্বপ্ন
তুমি শিমূল ফোঁটা আবহাওয়ায়
আমার উড়ন্ত বন্ধু
কাপাস তুলোর মতো উড়ে যেখানে
যৌবনের ফাগুন
হে মাতাল সময়
কুরে কুরে খাই এসো
জীবন নদীর জল...
২.
ঈশ্বরকে
হে ঈশ্বর,
আপনার নামে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে
সম্প্রতি পলাতক আপনার সন্ধান দিতে পারা জনকে
এক মিলিয়ন ডলারের
পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে
ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিশ্বের কোণে কোণে
প্রেরণ করা হয়েছে
এই ঘোষণা
হ্যাঁ
এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
ইরাকে নিহত অবুঝ শিশু হত্যার অপরাধে…
এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
আফগানিস্তানে নিহত আবালবৃদ্ধবনিতা হত্যার অপরাধে
এই পরোয়ানা
ধেমাজিতে স্বাধীনতাকে অলংকৃত করার অপরাধে…
দিনে দিনে বৃদ্ধি পাওয়া হত্যা- অপহরণ, লুন্ঠনের অভিযোগে
আজ অভিযুক্ত তোমার হাজার হাজার প্রজা
বছর গড়িয়েছে, মামলা চলছে
পুনঃ পুনঃ সহজ হয়ে আসছে জীবন
অথচ
অপরাধীর সঙ্গে সহবাস আমার
দৈনন্দিন খবর।
হে ঈশ্বর,
আপনি জীবিত না মৃত
জাগ্রত না নিদ্রারত
হে শিশু হন্তা, মাতৃহন্তার মালিক
ঈশ্বর, আল্লা, গড আপনার নামে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে
অনুগ্রহ করে দ্রুত আত্ম সমর্পন করুন।
বিজয় রবিদাস-এর কবিতা
ভাষান্তর: বাসুদেব দাস
১.
রাত
আমাদের রাত ডাকে না
রাতের কাছে আমরা যাই
ক্লান্তি ঢেকে আমরা স্নান করি
ভিজি বলে আমাদের গায়ের গন্ধ
ছড়িয়ে পড়ে জীবনের অসীমে
রাত আমাদের আশ্রয়দায়িনী মা
যেখানে হাত পা মেলে ইচ্ছামতো আমরা শুয়ে
থাকি
রাতের কবিতা বড় মধুর
বাঁশির সুরের মতো করুণ বিহ্বগ
আমাদের দুঃখ ক্লান্তি ভুলে যাবার এই রাত
নিশ্চল নিথর এবং উত্তাল
কখন ও বীভৎস কলুষ কালিমার
দাগ ভরে থাকা রাতে ঘুমোতে পারি না
রক্তাক্ত হয়ে পড়ে জীবনের গান
একটি বীভৎস রাত আপনি কামনা করেন কি
রাত সুন্দর হোক বলে আমরা আশা নিয়ে শুয়ে থাকি
একটা স্বপ্ন দেখার আশায় তোমাকে খুঁজে বেড়াই
হে রাত , তোমার বুকে মানুষ বেঁচে থাকুক
ভালো ঘুমের জন্য আমার প্রার্থনা কাতর দুহাত
২.
এক অশান্ত প্রেমিকের মতো
তোমার হরিণী দুচোখের শিশিরে
জ্বলে উঠল কামনার দাবানল
আবেগ বিহ্বল প্রাণোচ্ছল
এক অশান্ত প্রেমিকের মতো
তোমার যৌবন দীপ্ত বুকের ঢেউয়ে
ঢেউ তুলে ভেসে যেতে থাকি
বিশাল নীলের অসীম তুমি
আমার বুকে নৌকা বেঁধে রাখ
তোমার সুন্দর আঙ্গুল দিয়ে খসে পড়ি
তোমার সুন্দর দুচোখ দিয়ে খসে পড়ি
তোমার রেশমি চুলের সমুদ্রে খসে পড়ি
এক অশান্ত প্রেমিকের মতো
আমি তোমার স্বপ্ন না দেখা হই
তোমার গানগুলি না শোনা হই
হে মোর প্রাণহরিণী প্রিয়া।।
অনুপমা বসুমতারী-র কবিতা
ভাষান্তর: বাসুদেব দাস
১.
পরীক্ষাগার
সমস্ত মায়ের মতো আমার মা আমাকে
কখন ও শোনায়নি ঘুম পাড়ানি গান
বলেনি পরীর দেশের রূপকথা
উড়ন্ত দেবদূতের কাহিনিতে করেনি
কল্পনাপ্রবণ অথবা রোমাঞ্চিত
স্বভাবের তিনি ছিলেন জেদি এবং স্বাধীনচেতা
আমি অনুশীলন করেছিলাম তাঁর চিন্তা এবং ব্যক্তিত্ব
তিনি আমার পবিত্র আত্মাকে বলেছিলেন
জাগতিক বিনিময়ে বিক্রি না করার জন্য
আর আমাকে দিয়েছিল দুর্ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি
তাঁর প্রেরণায় আমি পর্যবেক্ষণ করতে চাইলাম জীবন
দুঃখ দুর্গতির পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে চাইলাম প্রেম
আর আবিষ্কার করলাম আমার মধ্যে একটি স্বাধীনচেতা সত্তা
যা সমস্ত বিপর্যয়ের মধ্যেও ধৈর্য এবং সাহসের সঙ্গে ধরে রেখেছে আমাকে
এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা পরীক্ষাগার তৈরি করার
যে পরীক্ষাগারে জীবনের দুঃখ বেদনা, আশা নিরাশা
এবং ঘাত সংঘাতের মিশ্রণে আবিষ্কার করতে পারব
জীবনের নতুন রহস্য, তথ্য এবং সত্য।
২.
কৃষক
রোদে-বৃষ্টিতে
শীতে গ্ৰীষ্মে
তার ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ে হাসি
ঘাত সংঘাত
সুখ-দুঃখ
যাই হোক না কেন
শান্তির আভায় দীপ্ত হয়ে থাকে
তাঁর চোখ
গুণগুণাতে থাকেন তিনি
মেঠো গীতের সুর
বর্ষার মাঠে যখন হাল বায়
অগ্রহায়ণের দুপুরে যখন ধান কাটে।
কাঁধে ভার নিয়ে রুনুঝুনু শব্দে
যখন গ্রামের পথে হেঁটে চলে
তিনি জানেন না সুখের উৎস কোথায়
সুখ লেগে থাকছে তাঁর সরলতায়
সবুজ হয়ে চিরকাল।
রাজীব বরুয়া-র কবিতা
ভাষান্তর: বাসুদেব দাস
১.
নারী
আমি আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি
আসার আগে খুলে রেখে এসেছি
তোমার শরীরের পোশাক
গর্ভবতী হয়ে থাকা তোমার চারটে আলমারির
প্রতিটি পোশাকে ফেলে রেখে এসেছি
আমার জৈবিক ইচ্ছার গন্ধ
সহস্র হাত খুলছে তোমার মাংসল পোশাক
তবু তুমি নিরাভরণ হও নাই
প্রিয়তম হাতে খোলার জন্যই তুমি
পর নাকি রহস্য সাজ
পর নাকি
একবার খোলার ঠিক পরেই
অনুভব হয় চিরদিনের জন্য
খোলা হয়ে গেল তোমার আলজিভের দুয়ার
আশ্চর্য! আবার কীভাবে
পরে নাও নিত্য নতুন পোশাক
যা খোলার জন্য
আমি ভ্রমণ করি তোমার শরীর– বাগান
এখন তোমার রহস্য ভেদ করার জন্যই
মাটির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি
প্রবেশ করতে চাইছি জলের ঘরে
যেখানে আমি একটা বিন্দু হয়ে ভেসেছিলাম।
২.
বৃষ্টি ফোঁটার গন্ধ
তুমি নিঃশ্বাস নিতে শেখার পর থেকেই
নিঃসঙ্গ
তুমি নিজে তৈরি করতে পার
নিজের উত্তাপ
ধারনা করতে জান
অন্য যে কোনো একজনের ইচ্ছা
আজ যে জীবন দেখছ
তা জীবনের অনুকৃতি
যে আকাশ দেখছ
তা আকাশের স্মৃতি
হিসেব করে খরচ কর
দুর্লভ জীবন
জীবনকে ভালোবাসা ছাড়া
তোমার অন্য কোনো কামনা নেই
আকাশের মতো প্রিয় দৃশ্য নেই
আকাশ যখন বরণ করে বেদনা
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বৃষ্টি ফোঁটার গন্ধ।
জোনমণি দাস-র কবিতা
ভাষান্তর: বাসুদেব দাস
১.
মাটি
মাটির মৃত্যু নেই, মাটি অমর।
মাটির বুক ভেদ করে মাটির হৃদয়ে
শিকড় তৃষ্ণার জলের খোঁজে যায়
পেটে ক্ষুধা নিয়ে মাটির কোলেই জন্মাই আমরা
আমাদের রক্ত মাটির, হাড় মাটির
হৃদয়ও মাটির
আমাদের শরীর মাটির বলেই
মায়ের গর্ভের জলজ পথে এসে আমরা দেখতে পাই
আকাশ এবং সূর্য
মাটির কোলে মাথা রেখে আমরা ফোঁপাই, হাসি
বুকে ভর দিয়ে এগোই, লাফিয়ে চলি, দৌড়াই হাঁটি
আর বলি অস্ফুটস্বরের কবিতা
মাটির মানুষ বলেই আমরা প্রেমে পড়ি
দুঃখকে লালন করি
ক্ষুধা পেলে ভাতের খোঁজ করি, তৃষ্ণায় জল
মাটি আমাদের দেহে শস্য এবং সবুজ
শব্দ এবং গান
মাটির বুকেই আমরা আঁকি আশার দৃশ্যাবলী
মাটির মৃত্যু নেই,মাটি অমর।
মাটি হয়ে জন্মানো আমরা
একদিন মাটি হয়ে সব মিলে যাই মাটিতে,
অথচ মাটি সবসময় মাটি হয়ে থাকে
অমৃত সন্তান হয়ে অনন্ত কাল…
২.
স্বপ্ন
দুঃখের মতো নিজস্ব
আমাদের কিছু স্বপ্ন আছে,
সেই স্বপ্নের জানালা দিয়ে আমরা আকাশ দেখি…
স্বপ্ন আছে বলেই
নিশ্ছিদ্ৰ অন্ধকারেও আমরা আলোর কথা ভাবি
পাহাড়ে জঙ্গলে পথ খুঁজি
পাখির চোখে দেখি বসন্তের ফুল বাগান
স্বপ্ন আছে বলেই
আমরা কাঁদতে কাঁদতে হাসি, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে হারি
হারতে হারতে জিতি
বুকের অলিন্দে পেতে রাখি বিষাদের বিছানা
নদীরও স্বপ্ন আছে, সাগরের মতো ঢেউ তুলে গর্জন তোলার
পর্বতেরও স্বপ্ন আছে, মেঘের মতো উঁচু হয়ে আকাশ ছোঁয়ার
অন্ধেরও স্বপ্ন আছে চোখের প্রদীপে পৃথিবীর আলো দেখার
স্বপ্নই শস্যের সবুজ পথ
স্বপ্নই জীবনের বিশ্রাম ঘাট
মানুষ পৃথিবীর পুরাতন প্রেমিক।
প্রজ্ঞান জ্যোতি-র কবিতা
ভাষান্তর: বাসুদেব দাস
১.
সমুদ্র স্নান
আমি কোনোদিন সমুদ্র দেখিনি
তাই আমার চোখের মণিতে
সমুদ্র এক অপার বিস্ময়
আমি কোনোদিন অতিক্রম করিনি
হিমালয়ের সেই ধবল শৃঙ্গ
তাই আমার বুকে শৃঙ্গারোহণের
গোপন উত্তেজনা
আমি কোনোদিন চুষিনি
চেরি ফলের সেই অমৃত রস
তাই আমার ঠোঁটে
আতুরের পরম তৃষ্ণা
কাল রাতে প্রথম ঝাঁক বৃষ্টি নেমেছিল
আমি জানালাটা খুলে দিলাম
কাক ভেজা হয়ে ভেতরে ঢুকল
বৃষ্টিকন্যা
তার হাতে মায়ার আয়না
আয়নায় সেই ধবল শৃঙ্গ
চেরি ফলের অমৃত রস
আর সেই অপার বিস্ময়
সমুদ্র
সারারাত আমি যেখানে
সাঁতরে থাকলাম…
২.
পাথর ভেঙ্গে শিল্প
একটা বড় পাথর ছিল
আসা যাওয়া করা পথের পাশে
আসা যাওয়ার পথে আমরা
সব সময় দেখেছিলাম পাথরটা
কখনও বা পাথরটার আড়াল নিয়ে
আমরা প্রস্রাব করেছিলাম
কখনও বা পান খেয়ে একটু চুন
পাথরটার গায়ে মুছেছিলাম
বছর দুয়েক হল
এই পথে আসা যাওয়া করছি না
শেষবার আসার সময় একজন খনিকর
বাটালি একটা নিয়ে পাথরটার গায়ে খোদাই করতে দেখেছিলাম
আজ দেখলাম পাথরটা নেই
পথিককে স্তম্ভিত করে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অনুপম ভাস্কর্য
আমরা সাধারণ মানুষ
আমাদের জন্য পাথরগুলি ছিল কেবলই পাথর
একটা পাথরের ভেতর যে লুকিয়ে থাকে এত শিল্প
দেখিনি জানা ছিল না
একটা আঙুল হাতুড়িতে অন্য আঙুল বাটালিতে সে খনিকর
যে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন পাথর ভেঙে শিল্পের অনেক আকার
অতিরিক্তঃ
কলম দিয়ে কেটে কেটে একটা কবিতা লেখার জন্যই কালি
একজন কবি বলল কবিরা কবিতার হত্যাকারী
একটা বাটালি দিয়ে কেটে একটা মূর্তি তৈ্রি করার জন্যই যদি
হে খনিকর তোমাকেও কেউ যদি একজন হত্যাকারী বলে
কী করবে,কী করবে তুমি তখন
নির্দোষী নির্দোষী বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবে
না কি অপবাদ সইতে না পেরে জলে ঝাঁপ দেবে
আমরা বলি-হে খনিকর কান দিও না
কান দিও না এইরকম কথায়
ফেলে দিও না হাতের হাতুড়ি-বাটালি
না হলে পাথরগুলি কেবল পাথর হয়ে পড়বে
কেবল পাথর
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন