আমি একজন দলহীন বামপন্থী

(আমার ডাইরি থেকে)

পিনাকীরঞ্জন সামন্ত 


বামপন্থী মানসিকতা কোনো থিয়োরি-বেসড রাজনীতির কুক্ষিগত সম্পদ নয় । বামপন্থী মানসিকতা অর্জন করতে একটি সুন্দর শোভিত মনন বাগানের প্রয়োজন হয় ।  শিক্ষা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের শিকড় থেকে তৈরি হওয়া এক মনন শিল্প যা মানুষকে এক নতুন পথ দেখায় । বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নবকুমার ও কপালকুণ্ডলার ট্রাজেডির মূল কারণ দুজনের চিন্তা চেতনার গুরুতর পার্থক্য - নবকুমার সমাজের মানুষ তার চিন্তাধারা সামাজিক ধর্ম, নীতিবোধ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত, আর কপালকুণ্ডলা জনসমাজ বর্জিত এক প্রাকৃতিক স্বাধীনতা, মানব সমাজের নিয়ম বহির্ভূত পরিবেশের মানুষ সুতরাং এটাই সত্য - মানুষের ধ্যান ধারণা তার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত সামাজিক পরিবেশের উপরেই নির্ভরশীল । মার্ক্স তার '  কমিউনিস্ট ইশতাহারে তাই বলেছেন - মানুষের বৈষয়িক অস্তিত্বের অবস্থা, সামাজিক সম্পর্ক ও সমাজ জীবনের প্রতিটি বদলের সঙ্গে তার ধারণা, মতামত, বিশ্বাস এককথায় মানুষের চেতনা যে বদলে যায় - একথা বুঝতে কি গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাগে ? 

আবার দর্শন, শিল্প-সাহিত্য প্রভৃতি ভাবাদর্শ গত বিষয় সবই মানুষের চিন্তা ভাবনা তার সমাজব্যবস্থারই প্রতিফলন, সেইহেতু দর্শন, শিল্প সাহিত্য প্রভৃতি ও প্রকৃতপক্ষে ঐ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন । এককথা সংস্কৃতি গোটাটাই সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন । মধ্যযুগীয় সংস্কৃতি আর আধুনিক যুগের

সংস্কৃতি বা ইদানীং ইলেকট্রনিক্স কম্পিউটার যুগের সংস্কৃতি কখনও এক হতে পারে না ।


মার্কসবাদ অনুসারে - সংস্কৃতির লড়াইটা অর্থহীন হয়ে যায় কারণ সংস্কৃতি যখন structure এর প্রতিফলন হয় তখন structure এর লড়াইটাই আসলে সংস্কৃতির লড়াই । যেমন একজন ডি এস পি কর্মী বা একজন ইঞ্জিনিয়ার বা একজন ডাক্তার কখনো একজন কামার কুমোর চাষীর বা খুব সাধারণ লেবারের কর্ম, চিন্তা, চেতনা বা সংস্কৃতির দায় নেয়না বা কখনো এক হতে পারে না । কারণ - সংস্কৃতি এখানে একটি (passive) বা নিষ্কৃয় বিষয় মাত্র ।


মানব চেতনার একটি রূপ হিসাবে সংস্কৃতির পরিবর্তন সঙগঠনকারী শক্তি সবসময় খেলা করে এবং সেইহেতু সমাজ পরিবর্তন কারী বৈপ্লবিক কাজের অনুপূরক শক্তি হচ্ছে সংস্কৃতি ।


মার্কসের কথা অনুযায়ী - মনে রাখতে হবে যে কোনো তত্ত্ব বা জ্ঞান যে মুহূর্তে জনগণকে আকৃষ্ট করে সেই মুহূর্তেই ঐ তত্ত্বটি একটি বস্তুগত বা বাস্তব শক্তিতে পরিণত হয় এবং ঐ structure এর কর্ম পদ্ধতি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে সে এগিয়ে যায় বা যেতে বাধ্য ।


পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিকাশের পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে - বর্তমান তৃণমূলে বহু বামপন্থী মানসিকতার মানুষ আছে । যে মানুষগুলি একদিন বামপন্থার জোয়ার এনেছিল সত্তরের দশকে - এখন প্রশ্ন হলো -  সেই মানুষগুলো হঠাৎ সরে গেল কেন ? একটাই উত্তর - কর্ম সংস্কৃতির ফেলিওর -  (failure ) মার্কসবাদের মূল গাঁথুনি থেকে সরে যাওয়া - স্ট্রাকচারাল সংস্কৃতির সঠিক গতি নির্ধারণ করতে না পারা ।


হ্যাঁ জানি -  বহু দক্ষিণপন্থী চোর জোচ্চোর ও আছে এই তৃণমূলের ছত্র ছায়ায় এবং সেটাই তো স্বাভাবিক এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় - যেখানে ফ্রি মার্কেট - ফেয়ার কম্পিটিশন ও প্রাইভেট প্রপার্টি বুর্জোয়া বা পাতি বুর্জোয়া এই মানুষের দল এক সমাজ বিচ্ছিন্ন একক, নগ্ন, আত্মপর সত্তায় পরিণত - যেখানে - a man who is concerned only with himself and doesn't care a rat for anybody else (Lenin) - যেখানে মূলত এই বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপরতাই হলো বুর্জোয়া বা পাতি বুর্জোয়ার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সারবস্তু । যারা কোনো মানবিকতার ধার ধারে না  ।।


তাই কমরেডস - দোহায় - সকলকে না জেনে বামপন্থার দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা কোনো বৈপ্লবিক মতবাদ নয় । মানুষকে কাছে টানতে হবে not for self but for others এই আলোক

বর্তিকায় । ইহার নাম - বাম সংস্কৃতি ।


বর্তমান শতাব্দী মানবজাতির জীবনের দ্রুত ও গভীর পরিবর্তনের যুগ । এই যুগ বিভিন্ন ভাবে বিচিত্র নামে আখ্যায়িত হয় । যেমন কেউ বলেন - বিদ্যুতের যুগ, কেউ বলেন যন্ত্রযুগ - অধুনা পদার্থবিদেরা তার নাম দিলেন - পারমাণবিক শক্তির যুগ, গণিতবিদদের ভাষায় ইলেকট্রনিক কম্পিউটার যুগ,রাসায়নবিদরা বললেন - কৃত্রিম উপাদানের যুগ আর শেষমেশ জ্যোতিরবিদরা বললেন - মহাকাশ যাত্রার যুগ আর আমরা - মানে এই সাধারণ জনগণ, যারা নিত্যদিন স্বপ্ন দেখি বা দেখতে অভ্যস্ত, যারা ক্রমাগত ইঁদুর দৌড়ে ব্যাস্ত সারাদিন - যারা ভালো চাকরি করি, কেউ ইন্জিনিয়ার, ডাক্তার, কেউ বড় আমলা সচীব যাদের নিত্য নতুন ভাবনা আমার আরো একটি ভালো চাকরি চাই, আরো একটি ভালো গাড়ি চাই , আরো একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং আমরা যারা কবিতা গল্প উপন্যাস লিখে সময় কাটাতে চাই । নিত্যদিন মঞ্চে মঞ্চে বিভিন্ন রকম বিনোদন মূলক কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে আপন আপন সেলিব্রেটি হতে চাই । কবিতার আসরে বসে চুক চুক মদ্য পান করি । (সকলেই নয় ) এরা একদল । 

এরা ভারতের মোট জনসংখ্যার ( ৩৫ - ৪০ %)  


এবং 

আমরা যারা একেবারেই নিম্নবিত্ত থেকে গরীব শ্রেণির ঠ্যালাওয়ালা থেকে রিক্সা ওয়ালা, অটো টটো, বা কোনরকমে কন্ট্রাক্ট প্রথায় চাকরি করে দিনাতিপাত বা রাস্তায় রাস্তায় ফেরি , মাঠে ঘাটে কাজ করি, ফুটপাতে চা পান সব্জি বিক্রি করি বা দিন আনি দিন খাই । আমরা যারা রক্ত ঘাম ঝরিয়ে চাষাবাদ করি - মাটি থেকে কয়লা তুলি - দিনরাত অভাবের তাড়নায় মা বাবা বউ-এর সঙ্গে ঝগড়া করি - তারপর দিনান্তের শেষে কেউ কেউ ( সকলে নয়) আকণ্ঠ মদ্য পান করে নিজের আমি কে ভোলার চেষ্টা করি - দ্বিতীয় দল । এরা ভারতের মোট জনসংখ্যার ( ৬০ - ৮০ % )


এবং আরো একটি দল আছে যাদেরকে আমরা প্রধানত বড় পুঁজিপতি বা মালিক বা জমিদার শ্রেণি

(এখন কর্পোরেট বা অন্যকিছু ) বলেই জানি - এরা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ কোটি ( অর্থাৎ ৮ - ১০ % ) আপাতত তাদের বাদ দিয়ে 


বাকি আমারা এই হেরিফিরি জনগণ মানে


 ১২০ কোটি মানুষ যারা একটি দেশের নাগরিক - একটি দেশের গণতন্ত্র কে বিশ্বাস করি, এবং এই প্রচলিত গণতান্ত্রিক সিস্টেমকে প্রাধান্য দিই আর নিয়মিত ভোট দিই, নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত করি - তাঁরা - তাঁরা কী বলেন ?


হ্যাঁ - এটাই স্বাভাবিক প্রশ্ন । এবং এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের যেতে হবে সেখানে - যেখানে ঐ উপরের দুটি দল থেকে উঠে আসা নেতা এবং নেত্রীদের নিজ নিজ দর্শনের কথা এবং আপামর জনসাধারণের মান শিক্ষা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থানের কথা । এখন যেহেতু আমি বলেছি আমি একজন দলহীন বামপন্থী তাই আমার পাখির চোখ হবে সেইভাবে অনুসন্ধান বা দৃষ্টিপাত, তা হয়তো অন্যের সঙ্গে নাও মিলতে পারে সেক্ষেত্রে আমার কিছু যায় আসে না । কারণ আমি একজন খুব সাধারণ আরো পাঁচজনের মতো । 


এখন কেন আমি বামপন্থী বা বাম মনস্ক । তা হলে আমাকে ফিরে যেতে হবে আমার যৌবনের প্রারম্ভে ঐ সেই কবির কাছে - যিনি আমার বন্ধু ছিলেন - হ্যাঁ ঐ রবীন্দ্রনাথ এবং আমি ছিলাম তাঁর বন্ধু উপেন ।। 


"শুধু বিঘে দুই জমি ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে । বাবু বলিলেন - বুঝছো উপেন ? এ জমি লইব কিনে" 

তখন বয়স কতো হবে - পনেরো কি ষোলো । পরিচয় হলো সি পি আই নেতা কমরেড নীতিশ শেঠের সঙ্গে । সেই থেকেই শুরু হলো আমার এক অন্যরকম পড়াশোনা - না মার্কসবাদ নয় । রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ । নীতিশ শেঠ সেদিন বলেছিলেন - আগে ভারতবর্ষ কে চেনো - ভারতীয় দর্শন পড় তারপর মার্কস ফিলোজফি । শুরু হলো আমার নতুন জীবন নতুন উদ্দীপনা - আমি যে তখন আঠারো। 



আমি একজন বামপন্থী এটা সগৌরবে ঘোষণা করতে হয় নাকি। নাকি বামপন্থী বললে একটা অন্যরকম রোমান্স খেলা করে। একটা অভিনব রঙিন রুমালের উন্মাদনা। যারা বামপন্থী ঘোষণা করে না তারা কি বামপন্থী নয়। তারা কি কেউ ভালো মানুষ নয়। এসব ভাবতেই - বন্ধুবর চন্দন ভট্টাচার্য্যর কথা মনে পড়লো - তিনি বলছেন - বাম ডান বলে কিছু হয় না। নিম্নবিত্ত বা গরীব মানুষ সকলেই বামপন্থী এবং এরা যেখানে পায় সেখানেই ছোটে এবং আরো অনেক কিছু। না তাঁর কথা সব ফেলে দিতে পারি না। ভারতবর্ষে এখন ১৪০ কোটি মানুষ, তার বেশিরভাগটাই দারিদ্র্য সীমার নীচে - কতো শ্রমজীবী, কতো গরীব চাষী থেকে কতো নিম্ন আয়ের মজুরি প্রাপ্ত মানুষ  সারাদিন কীভাবে দিন যাপন করে তার হিসেব আমরা ক'জন রাখি ? তা হলে প্রশ্ন আসে আমি কীসের বামপন্থী। কেন বা ডানপন্থী ( দক্ষিণপন্থী ) নই। তফাৎ কী। ভালো খারাপের প্রশ্ন আছে নাকি ! সকলেই তো মানুষ। আমি মনে করি আমরা যতই বলি না কেন - আমার মনে হয় মানুষের কর্ম ও সংস্কৃতির আসল পরিচয় হলো সে মানুষ তা তিনি যে পন্থীই হোক না কেন। 


আরো একজন বন্ধুসম প্রিয় মানুষ শ্রী কল্লোল মজুমদার আমাকে জানালেন -  "সংস্কৃতির দিক থেকে বামপন্থাকে দেখার একটা ঝোঁক হলো পাখির চোখে দেখা - super structure থেকে structure কে দেখা এবং ওই structureকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা এবং সেই অনুযায়ী তাকে পাল্টে ফেলার প্রয়াসটাই বামপন্থী মানুষজন করে থাকেন।" এটাও খুব সুন্দর মন্তব্য। তবু বলবো ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা বিলোপ, বা বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষার লড়াই কে আমি কোনোমতে উপেক্ষা করতে পারি না - যদিও তাঁরা কখনো নিজেদের কে বামপন্থী মানুষ হিসেবে প্রচার করতে যায়নি - অথচ তাঁরাই ছিলেন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।


যাই হোক - আমি যখন নিজেকে বামপন্থী বলে ঘোষণা করতে চাইছি তখন আমার প্রাথমিক কাজ হবে - সংস্কৃতি আসলে কী - কী তার রূপ - এবং কেনই বা সে শুধু বামপন্থীদের কাছে ঘোরাফেরা করে ? কেন - ডানপন্থীরা কী দোষ করলো যে সংস্কৃতি তাদের শরীর থেকে তার সরূপ প্রকাশ করবে না বা সেই structure কে ভেঙে পাল্টাতে পারবে না। আমাদের কাছে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র থেকে আরো বহু মানুষ উদাহরণ হয়ে আমাদের বুকে বসে আছেন যারা আমাদের দেশের অন্ধকারকে আলোকিত করার নানাভাবে নিজেদের যুক্ত করেছেন - তা সে স্বাধীনতা সংগ্রাম হোক বা otherwise অন্যকিছু।


তাই এসব আলোচনার ফাঁকে - আসুন আমরা বরং একটু জানার চেষ্টা করি - structure বা সংস্কৃতি আসলে কী - এবং তার স্বরূপ উদঘাটন করার চেষ্টা করি।


আমার বাবা বলেছিলেন সংস্কৃতি বা কালচার প্রথম জীবনেই শেখা উচিত বা এই নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করা উচিত যা পরবর্তী জীবনে কাজে লাগে । ঐ যে বলে না পরিবেশ। এক এক পরিবেশের এক এক রকম গুণ। বলতে কি স্বাধীনতার শুভ লগ্নে আমার জন্ম - ১৯৪৭। আর ১৯৬০ সাল থেকেই দেখা শুরু হয় আমার অন্ধকার । সে আলাদা বিষয়। এখন যা বলছিলাম - structure বা সংস্কৃতি ( culture )


বর্তমান সময় যে সভ্যতার সঙ্কটের মুখোমুখি এটা আমরা প্রায় সকলেই জানি। একদিকে পুজিবাদ আর অন্যদিকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার যে লড়াই তারই ছায়াকল্পে সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্তন এবং মার্কসীয় দর্শনের বীজ নির্মাণ করেছিলেন ভি আই লেনিন। সেসব অন্য কথা।


কালচার মাত্রই কোনো না কোনো বৈষয়িক কাঠামোর প্রতিফলন, অর্থাৎ কোনো একটা আর্থ- রাজনৈতিক কাঠামোকে ঘিরেই তার অনুকূল কালচার সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'শেশের কবিতায়' বলেছেন, "কমল হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার।" এই সংজ্ঞার বহুজন একমত হলেও, তথাকথিত কমিউনিস্ট সম্প্রদায়ের বক্তব্য একটু আলাদা। তাঁরা বলছেন - বিদ্যের বদলে  - এখানেই তাঁরা আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক কাঠামো বসাতে চান। অর্থাৎ কমল হীরে পাথরটাই হলো - আর্থ রাজনৈতিক সিস্টেম আর তার থেকে যে দ্যুতি ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। একথা সাধারণ সত্য। এ কথা সমাজতন্ত্রের বেলায় যেমন সত্য, ক্যাপিটালিজমের বেলাতেও তেমন সত্য। প্রত্যেক আর্থ রাজনৈতিক সিস্টেমের অনুগ একটা কালচার থাকে। স্তালিন বলেছেন - সিস্টেমের পক্ষে প্রয়োজনীয় বলেই এই কালচার সৃষ্ট হয়।

আজকের বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদী ভোগবাদ, এবং জাত পাত ধর্মের গোঁড়ামি - একটি সিস্টেম, একটি structure এবং এখান থেকে বা একে ভেঙে ফেলার বা পাল্টে ফেলার যে আয়োজন চলছে সেখানেই মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। যাকে আমরা যাই বলি না কেন - আমাদের মনে রাখতে হবে - Best utilisation of education is Culture.  


এই পর্ব শুরু করার আগে বলি আমার আগের তিনটি পর্বের বাজার কাটতির কথা। খুব একটা আশানুরূপ নয় তবু কয়েকজনের মন্তব্য আমাকে অনেক ভাবিয়েছে এবং আমাকে রীতিমত ঋদ্ধ করেছে। প্রথমেই বলি এই যে আমি নিজেকে দলহীন বলছি বা কেন - এর কোনো উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করিনা। কিন্তু আমি যদি ঘটা করে বলি - আমি বামপন্থী এবং কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন - কেন ? তা হলে আমাকে উত্তর দিতেই হবে - কেন আমি নিজেকে বামপন্থী ভাবি আর কেনই বা এই ঘটা করে নিজেকে জাহির করার প্রয়োজন হলো। 


সম্প্রতি এই যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন পর্ব অনুষ্ঠিত হলো সেখানে দেখলাম - কিছু কিছু মানুষ যখন প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর সাপেক্ষে অথবা দুই সরকারের পক্ষে কিছু কথা বলেছেন, তখন কিছু কিছু মানুষ তাঁদেরকে হয় বিজেপি বা বিজেমূল বা তৃণমূল বা দক্ষিণপন্থী বা ফ্যাসিসট রূপে চিহ্নিত করেছেন। এবং আমাকেও - ফলে দু একজনকে আমি ইতিমধ্যেই আমার ফেসবুক থেকে ইতি টেনেছি। যদিও আমার মনে হয় তারা সকলেই বামপন্থী এবং একটি বিশেষ দলের উগ্র সমর্থক। 


যাই হোক - এখন আসি আমার বামপন্থী স্বরূপ উদঘাটনে। প্রত্যেক মানুষের একটা নিজস্ব দর্শন থাকে। একটা জাতির দর্শন থাকে। একটা ভৌগলিক সীমায় বসবাসকারী মানুষের দর্শন থাকে। আসলে সেই দর্শন কী। যেমন আমাদের ভারতীয় দর্শন। আমাদের ভারতীয় দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো - আধ্যাত্মিকতাবাদের দর্শন যেখানে দর্শন শব্দের অর্থ হলো সত্যদর্শন বা তত্ত্বদর্শন। যে সত্য বা তত্ত্ব সমগ্র বিশ্বে নিহিত, যার থেকে এই বিশ্বের চেতন-অচেতন সকল কিছুই উদ্ভুত, ভারতীয় দার্শনিকরা সেই পরম সত্যকে দেখতে চান, উপলব্ধি করতে চান, সত্যকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এই সম্পর্কে আরো বিশদ ব্যাখ্যা আছে। তা থাক।


অপরদিকে - বিশ্বের একদল সমাজবিজ্ঞানী (জার্মান দার্শনিক হেগেল, ফয়েরবাখ, ইংরেজ অর্থনীতিবিদ আ্যডাম স্মিথ বা ডেভিড রিকার্ডো) এবং পরিশেষে কার্ল মার্কস। এই মনীষীরা পৃথিবীকে বা পৃথিবীর মানবজাতির আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া কর্মকে বিশ্লেষণ করে বা বলা যেতে পারে কোনোরকম আধ্যাতিক ও বিজ্ঞান বিরোধী ধারণার আশ্রয় না নিয়ে প্রকৃতি কে তার অভ্যন্তরস্থল থেখেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এই অনুভবে যেখানে ধর্মীয় মতবাদের তীব্র সমালোচনা করে এক নতুন রপের সঙযোজন ঘটালেন - যা বিশ্বব্যাপী এক আলোড়ন সৃষ্টি করলো - যেখানে বলা হলো - মানবজাতি তার শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে সমাজের ইতিহাসকে পাল্টে দিতে পারে। আর তা থেকেই সৃষ্ট হয়েছে নানা দার্শনিক মতবাদ, অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহ, আঁকা হয়েছে আদর্শ সমাজব্যবস্থার চিত্র - যেখানে ন্যায়বিচারের প্রতি জনসাধারণের অটুট প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সমাজের অপরিণত মস্তিষ্কের কাছে এই বিজ্ঞান চেতনা কতোটা গ্রহণযোগ্য - এটাও ভাববার বিষয়। 


মহাশয় - আমি এই দ্বিতীয় দর্শনে ক্রমশ আসক্ত হয়ে পড়েছি। না কোনো দল নয়। তবু আমি ভারতীয় তাবৎ মানুষের পাশে যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের মত পরিবর্তন করে ভোট প্রদান করে এবং আমিও তাদের মধ্যে একজন এবং অবশ্যই বামপন্থী। 


আমি ভারতীয় নাগরিক এবং ভোট দিই তাদের - যারা ভারতবর্ষের এই ধর্ম ও কুসংস্কার আবৃত জীর্ণ এই structure কে ভেঙে ফেলতে চায় তাদের নিজস্ব ধারায়।

1 মন্তব্যসমূহ

  1. পড়লাম
    আপনার আদর্শ জীবন-দর্শন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
    ঋদ্ধ হলাম
    কে কী এবং কেন এই তিনটি বিষয় ভীষণ জরুরি নিজেকে ভাঙাচোরা কিংবা আত্মখননের জন্য
    শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন