সোজা কলমে, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর

ইউসুফ মোল্লা


     "মাথা আছে ঝুঁকে

তুমি কি এখনও তাকে ভাবো? 

সে চলেছে ওই, আর

প্রতিটি গলির মোড়ে লালাভরা ছুরি হাতে

দাঁড়িয়ে রয়েছে অপমান।" 

               (ছুরি/গোটাদেশজোড়া জউঘর) 

হ্যাঁ, কবি শঙ্খ ঘোষ সমাজের এই অবমানন, অপমান সহ্য করতে পারতেন না। তাই যখনি সমাজের পচা-গলা সিস্টেম দেখেছেন, তখনই প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন বারেবারে। আর সে গর্জে ওঠা কখনও সরাসরি রাজপথে নেমে, কখনও কবিতার মাধ্যমে অল্প শব্দ প্রয়োগ করে। তাইতো কবি বলেন,—

"একথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে/ সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।" কবির এই কবিতা পড়ে মনে হয়, সহজ করে সবাই লিখতে বা বলতে পারেন না। যা তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। তিনি সমাজের যে মেকি রূপ ছিল, তা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। তাইতো তাঁর প্রায় কবিতায় 'শূন্য' শব্দের প্রয়োগ দেখতে পাই। যদিও তিনি এই শূন্যতার মধ্যে ঢেউ তুলেছিলেন। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, 'বার্গম্যান'-এর সেই বিখ্যাত উক্তি—"জনতা বসে বসে নান্দনিকভাবে লেহন করতে পারে এমন শিল্পকর্ম আমি তৈরি করতে চাই না, আমি তাদের পিঠের তলদেশে একটি ধাক্কা মারতে চাই, যাতে তাদের ঔদাসীন্য পুড়ে খাক হয়ে যায়, তাদের আত্মতুষ্টি ভেঙে গিয়ে তারা চমকে ওঠে।" আর বার্গম্যানের প্রতিধ্বনি দেখতে পাই শঙ্খ ঘোষের কবিতাতেও—"তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে/ এত বজ্জাত হয়েছে।" আজকাল সময় যখন নেতারা বলেন, জনতা জনার্দন, হাতজোড় করে ভোট ভিক্ষা চায় জনতার কাছে। কিন্তু ভোটে জেতার পর সেই নেতা হয়ে যান নারায়ণ। আর তার সাগরেদরা হয়ে যান নারায়ণী সেনা। তাইতো কবি গুজরাটের বীভৎস দাঙ্গার সময় লেখেন—"নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।/ যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসে না কোন/ কূটতর্ক নিয়ে,... যদি বলি দিন বলে দেয় দিন/যদি বলি রাত, বলে রাত।" এইভাবে তাঁর কবিতায় আমরা বর্তমান সময়কে খুঁজে পাই। এই গুজরাট দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে তিনি একটি অসাধারণ নিবন্ধ লিখেছিলেন, 'ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা'। শুধু গুজরাটবাসী নয়; প্রত্যেক ভারতবাসী যে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তা দৃপ্ত ভাষায় অকুতোভয়ে লিখেছিলেন, 'গুজরাট জ্বলছে। আমরা জানি, গুজরাটের মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে সে-আগুন নেভাবার দায়িত্ব আমাদেরও, এই রাজ্যের মানুষদেরও।' একইসাথে এই রাজ্যের নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর প্রতিবাদে তিনি সান্মানিক সরকারি পদ থেকে সরে আসতে দ্বিধা করেননি। কোথাও আবার দেখা যায় নকশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে যাদবপুরের প্রিয় ছাত্র তিমির বরণ সিংহ পুলিশের হাতে মার খেয়ে মারা গেলে কবির প্রতিবাদী কলম লেখেন— 'ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়/ দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ/ তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?/ নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই/ তোমার ছিন্ন শির, তিমির।' ১৯৫১ সালে খাদ্যের দাবিতে কোচবিহারে এক ষোল বছরের কিশোরীর পুলিশের হাতে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কবি লেখেন— 'নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে/ আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে!'


    উৎপলকুমার বসু তাঁকে সার্থক অভিধায় বিশেষিত করেছিলেন: পঞ্চাশ দশকের 'প্রথম ভোরের পাখি'। আর এই অভিধা তিনি দিয়েছিলেন বোধহয় এই কারণে—'সত্যি বলা ছাড়া আর কোন কাজ নেই কবিতার' এই সত্য তুলে ধরার জন্য। সে-সময় খ্যাতিমান কবিগণ রচনা করেছিলেন কেবল ব্যক্তিজীবনের দিনলিপি। 'রাজনৈতিক সমাজনৈতিক সমস্ত দিকেই আমাদের জীবন যাপনের যে অসত্য প্রকৃতি, তার সমস্যাকে এড়িয়ে থাকা মানেই সত্যের পাশ কাটিয়ে যাওয়া, ঐতিহাসিক পটের মধ্যে দাঁড়িয়ে গোটা জীবনের অ্যাম্বুগুইটিকে অস্বীকার করাও তেমনি এক পাশ কাটানোর কারণ।' জ্ঞানপীঠ গ্রহণের সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন, সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে যে অসাধু অসহিষ্ণুতা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে লেখক-কবিদের সজাগ ও প্রতিবাদী হওয়া দরকার। তাইতো তাঁর 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' কবিতায় আমরা এমন ধ্বনি পাই— 

  আমাদের ডানপাশে ধস্

  আমাদের বাঁয়ে গিরিখাত

  আমাদের মাথায় বোমারু

  পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ

  আমাদের পথ নেই কোনো

  আমাদের ঘর গেছে উড়ে

  আমাদের শিশুদের শব

  ছড়ানো রয়েছে দূরে দূরে

  আমরাও তবে এইভাবে

  এ-মুহুর্তে মরে যাব না কি? 

  আমাদের পথ নেই আর

  আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।


     বাংলা কবিতায় কঠিন শব্দ, তৎসম শব্দ, বিদেশি শব্দের প্রয়োগ অনেকদিনের। ইদানীং দেখা যাচ্ছে এই ঝোঁক আরো বাড়ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা যেন মরুদ্যান। কী সুন্দর সহজবোধ্য শব্দের ব্যবহার, মুখে মুখে বলা কিছু শব্দ নিয়ে অনায়াসে তৈরি করতেন অপার রহস্যময়তা। আর সেই সৃষ্টি অসাধারণ বুনট পাঠকদের হৃদয় স্পর্শ করে যেতো। তাইতো কোনো কঠিন শব্দের প্রয়োগ না করে 'পাগল' কবিতাটিকে বুঝিয়ে দিলেন—

   "আরো একটু মাতাল করে দাও। 

   নইলে এ বিশ্বসংসার

   সহজে ও যে সইতে পারবে না! "

কবি জানেন, সুস্থ মস্তিষ্কে সবকিছু সহ্য করে চলা দুর্বিসহ; তাই মাতাল হওয়াই হয়তো শ্রেয়। 

"ঈষৎ মাত্র গিলে নিলে

 যা সওয়াবেন তাহাই সয়।"—আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক অনেক বেশি অবিচার সহ্য করতে পারে। অত্যাচারিত তারাই, যারা নির্বোধ, বুদ্ধিমানেরা স্বভাবতই ঊর্ধ্বে থাকেন এসবের। তাইতো কবি হাওড়ার ব্রিজের চুড়োয় তুলে দেখিয়েছেন নির্বোধের স্থান সর্বদা বুদ্ধিমানের পদতলে। " আজকাল বনে কোনো মানুষ থাকে না, কলকাতায় থাকে।"— ব্যঙ্গাত্মক'বাস্তু' কবিতায় মানুষের মধ্যেকার অমানুষটিকে তুলে ধরেছেন। এইরকম সহজ ভাষার প্রয়োগে কবি সমাজের সকল স্তরের মানুষের সমস্যা, চাহিদা, অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। কবি শঙ্খ ঘোষ আমৃত্যু কখনো কোনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করে চলেননি। কারণ তিনি জানেন আপোষ করলে প্রতি পদে নিজেকে ছোট করে চলা হবে, নিজের কাছেই নিজের আত্মসম্মানটুকুও কিছু ক্ষেত্রে বিকিয়ে যায়। 

"আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!"

 কবি 'ভিড়' কবিতায় এমন সহজকথা সহজভাবে বলেছেন। কোনো কঠিন আভিধানিক শব্দ ব্যবহার ছাড়াই যে কীভাবে আধুনিক আত্মোপলব্ধির কথা কবিতায় লিখে ফেলা যায়, তার নির্দশন হলো তাঁর কবিতাগুলো। নারী ও তার অপ্রাপ্তিজনিত অপূর্ণতা নিয়েও কবি সরল ভাষায় লিখেছেন 'রাঙামামিমার গৃহত্যাগ' কবিতাটি। এক গৃহবধূ বাইরের মুক্তির হাতছানির ডাকে সাড়া দিয়ে যখন তার সাধের তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসার পেছনে ফেলে বেরিয়ে পড়েন সেই অনাস্বাদিতের কাছে ধরা দিতে, প্রতি পদক্ষেপে গৃহবধূ তার ছাপ ফেলে রেখে এগিয়ে যান—

  "ঘর, বাড়ি, আঙিনা

  সমস্ত সন্তর্পণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা

  ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে.. "

অথচ, তার অন্তরাত্মা পড়ে থাকে এই সংসারের ভেতর—"ছড়ানো পালক, কেউ জানে না!"


   এইভাবে কবি শঙ্খ ঘোষ সহজসরল ভাষার প্রয়োগে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কথা তুলে ধরেছিলেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। বিশেষ করে তাঁর চোখের সামনে যখনই কোনো অন্যায় হতে দেখেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সিংহের মতো গর্জে উঠেছে তাঁর শানিত কলম। তাঁর অবর্তমানে অন্যান্য সাহিত্যিকদের প্রতিবাদী কলম কতখানি এই অভাব পূরণ করতে পারবে, তার অপেক্ষায় রইলাম।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন