রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

পর্ব- ৫

সংযুক্তা পাল

'—সাতটি দিন ও রাত্রি একটি কবিতা আমার,/প্রেমের কবিতা করেছ আমাকে।'(পলায়ন)

কবি স্বয়ং কবিতা তাও আবার প্রেমের!এই নিরুদ্বিগ্ন প্রেমের উচ্চারণ সম্ভব করেছে বলা বাহুল্য নারীর প্রতি অনুভব। তবে বিষ্ণু দে -র ভাবনায় 'নারী'কে গতানুগতিক প্রেরণাতত্ত্বে ভিড়িয়ে দেওয়া যায় না। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে প্রেমিকের মানসলোকে নারীও তার অবস্থা ও অবস্থানের যে ভিন্নতা কামনা করে এসেছে বিষ্ণু দে-র সৃষ্টিতে তার সর্বাঙ্গীন অভিপ্রায় লক্ষ করা যায়, যেখানে পণ্যজীবি, ধনতান্ত্রিক সভ্যতা, পুঁজিবাদী আগ্রাসন,মানবমন ও চরিত্রের অবক্ষয়, অবদমিত চেতনা বা লিবিডোর তাড়নায় কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় নেওয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে নারীর প্রতি প্রেম কিংবা অনুভব একাত্ম হয়ে উঠেছে বারবার, এ এক স্বতন্ত্র বীক্ষণ—

'তোমার দৃষ্টির ওই আহ্বান/জাগায় যে জোয়ারের গান।/তোমার নেব্যুলা চোখ নক্ষত্রের  জীবনে আমার/বিপ্লবের নৃত্য জাগায়'


কবি যেন তাঁর প্রেমিকার দৃষ্টির আহ্বান থেকে দূরে চলে যেতে চান।রাতের আকাশে অস্পষ্ট রশ্মিপুঞ্জের মত নেব্যুলা।এই নেব্যুলা হল কবি প্রিয় দূরস্থিত দৃষ্টির তাৎপর্য।সেই দৃষ্টির কারণেই বোধহয় কবি সম্যক পৃথিবীতে দুর্জ্ঞেয় এক বোধের মতই নারীকেও এভাবে আবিস্কার করতে সমর্থ হন।

'সেইদিন দেখেছি তোমাকে,/কোলাহল–কুৎসিত এ–নগরের ভিড়ে/দুষ্টশ্বাস জনতা –আঁধারে/বার হ'য়ে এলে/সবাইকে পিছে রেখে,/সবাইকে রেখে এলে নিচে/–সেইদিন দেখেছি তোমাকে।('প্রত্যক্ষ')


পরবর্তী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর অঙ্কিত নারী জনগনের মধ্যবর্তিনী এক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে বিক্ষুব্ধ চেতনায় কিন্তু বিষ্ণু দে 'দুষ্টশ্বাস জনতা আঁধারে' নারীকে 'শ্রেয়স' রূপেই এনেছেন। সর্বসাধারণের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে এই নারী দাঁড়ায়না যদিও সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসে স্বতন্ত্র মহিমায়। স্রষ্টার এ হেন সৃষ্টির তারতম্যের পর্যালোচনায় প্রসঙ্গের অভিমুখ ঘুরে যেতে পারে, অতএব ফিরে আসি—


বিষ্ণু দে -র প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'উর্বশী ও আর্টেমিস'–রাবীন্দ্রিক উর্বশীর মিথকে ভেঙে ফেলা হয়েছে।ইন্দ্রিয়ের ঘর্ষণ ও রোমান্টিক চেতনা পারস্পরিক আদান-প্রদান ঘটিয়েছে নিজেদের মধ্যে।


'স্বল্পপরিধি রক্তসূত্র সরস অধর/মুখে রেখেছি ও শুনেছি বক্ষে গ্রহদের বেগ।/দেখি মুহূর্তবিম্বে চিরন্তনেরই ছবি/উর্বশী আর উমাকে পেয়েছি এ-প্রেমপুটে।'('পলায়ন')


লাস্যময়ী উর্বশী আর উমার স্থৈর্য। রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে রাবীন্দ্রিক বৃত্ত থেকে স্বতন্ত্রতা। রবীন্দ্রনাথ নারীর দুই রূপ লক্ষী ও উর্বশীর কথা বলেছেন; একজন গৃহলক্ষী অন্যজন কামনা রাজ্যের রানী। বিষ্ণু দে এই দুই রূপের সহাবস্থানে নারীর সামগ্রিক সত্তাকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন হৃদয়ে।এই দুই ভাবের সংহতিতেই তাঁর নারী যেন প্রকাশিত।

আধুনিক পুরুরবা তাই জন্ম জন্মান্তর ধরে উর্বশীর জন্য অপেক্ষার ধারণাকে খন্ডন করে। যান্ত্রিক সভ্যতায় মিথ এর পুনর্বয়নে নারীর ভাবকল্পও অন্য আদর্শে নির্মিত।


'আমি নহি পুরূরবা।হে উর্বশী,/ক্ষনিকের মর অলকায়/ইন্দ্রিয়ের হর্ষে,জানো ,গ'ড়ে তুলি আমার ভুবন?/এসো তুমি সে-ভুবনে ,কদম্বের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে।/ক্ষনিক সেখানে থাকো,/তোমার দেহের হায় অন্তহীন আমন্ত্রণবীথি/ঘুরি যে সময় নেই–শুধু তুমি থাকো ক্ষনকাল,/ক্ষনিকের আনন্দ-আলোয়।'(উর্বশী)

সমালোচকের মতে 'তাই উর্বশীর (বন্ধ্যা)মোহে কবি তৃপ্ত না হয়ে বিপরীতে আনলেন কৌমার্যের বলদৃপ্ত শুদ্ধ সৌন্দর্য,গ্রীসীয় পুরাণে বর্ণিত চন্দ্র ও শিকারের দেবী আর্টেমিসকে। উর্বশীর প্রেমে আসঙ্গলিপ্সার অনন্ততা,আর আর্টেমিস শুচিশুভ্র চরিত্র্যে–নৈতিকতা ও কৌমার্যের রক্ষয়িত্রী,প্রেমের প্রতিনিধি। এখানেই রবীন্দ্রনাথ থেকে বিষ্ণু দে বিচ্ছিন্ন হলেন এবং উর্বশীর সঙ্গে তুলনাসূত্রে আর্টেমিসের প্রতি তাঁর আসক্তিকে দ্বন্দ্বসঙ্কুল আধুনিক মনের প্রেম স্বরূপ সম্পর্কে অসহায়তার অপূর্ব প্রকাশ ঘটালেন। এখানেই তিনি আধুনিক।'

দুঃস্থসময়-এ 'কাশের নিমন্ত্রণ' তা যেন প্রকৃতির নির্বোধ খামখেয়ালিপনা,'নীল রহস্যের মাঝে ফেনায়িত রাত্রির বুকে ছড়ানো মাকড়সার জালের মত 'কৃষ্ণ যবনিকা' কবির নিভৃত অন্তর তবুও দুঃসাহস রাখে–

'রন্ধ্রহীন আর্তনাদে' 'আঁধার হেডিসের মতো' সেখানে ভালোবাসার পথ দেখায় ওফেলিয়া।কবির বর্তমান সত্তা , অতীতের স্মৃতি দুয়ের বিমূর্ত সংযোগ সেতু ওফেলিয়া–


'আমি যে তোমায় ভালোবাসি সে কি তাই শুধু ওফেলিয়া?'এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিচ্ছেন–

'ধূমকেতু এই বিরাট দাহন বিশ্ব আমার তোমার চোখেই পেয়েছিল তার পরমাগতি।।'(ওফেলিয়া)

ভ্রম থেকে বিচ্যুতি- বিচ্যুতি থেকে স্বর্গ তথা লক্ষ্যভ্রষ্ট সেখান থেকে আত্মবীক্ষণ ও দর্শনবোধে উপনীত কবিসত্তা।


বিষ্ণু দে-র নারী কখনো রোমান্টিক স্বপ্ন বিলাস–আবার কখনো রক্ত-মাংসের অবিকল্প আদিমতা , প্রবৃত্তি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেখানে তার মায়াজাল বিস্তার করে।

'আজ কি আমাকে ভুলেছ মহাশ্বেতা?/অমৃতের বারি মদির ওষ্ঠাধরে/স্মৃতি-বিস্মৃতি শরতের ধারা ঝরে।/আজ কি আমাকে ভুলেছ মহাশ্বেতা? শরীরে তোমার অলকানন্দা গান।/আচ্ছোদনীরে করো তুমি যেই স্নান,/স্বপ্নবাণীতে শিহরায় ক্রন্দসী।'('মহাশ্বেতা')


এক ঐতিহাসিক আবহমানতায় ,এলিয়টীয় ঐতিহ্যের নিমগ্ন সাধক রূপে সৌন্দর্যের অবিনির্মাণ ঘটিয়েছেন বারবার । যুদ্ধবিধ্বস্ত মানবীয় ধ্বংসস্তুপের আবর্জনায় , বর্তমান অন্ধকারের নির্নিমেষ দুর্ভেদ্যতা ভেদ করতে চেয়েছেন স্মৃতির মধ্যে দিয়ে , নারী সেখানে আলোর প্রতীক, নাগরিক বুর্জোয়া সমাজের অসহিষ্ণুতাকে অবলোকন করে তার পুনর্নির্মাণ করেছেন ইতিহাসের আলোকে।


'তারপরে এল রণমন্থনে দূর বিদেশের নারী/কালো সন্ধ্যায় দিলে শ্বেতবাহু দুটি–/স্মরণ তোমার হানে আজো তরবারি!'('ক্রেসিডা')

পূর্বতন সমাজ ভাবনাকে অনেকটাই অতিক্রম করে গেছেন বিষ্ণু দে তাঁর নারী চিন্তায়।যুগের বিবর্তন নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের ক্রমান্বিত অগ্রগতি ও পরিবর্তন তাঁর চোখে আধো-স্বপ্নের নায়িকাকে আধো-বাস্তবের নারীতে পরিনত করেছে অবশেষে। তিনি প্রেক্ষাপটকে আত্মস্থ করতে পারেন, ভাবনার গভীরে তাকে প্রোথিত করে দেন এ তাঁর অনন্য বিশেষত্ব;তাই 'আমাদের মেয়েরা' কবিতা শুরু করছেন মেয়েদের যে প্রথাগত ইমেজ ব্যবহার করে–


'ছোটোখাটো বীরত্বের প্রাত্যহিক নিষ্ঠার জীবন:/সূর্যের জাগার সঙ্গে ভোরে ওঠা , দিনরাত্রি/নিয়মিত নম্র সুরে বাঁধা'


দৈনন্দিন কাজকর্ম, সংসার তথা সন্তান প্রতিপালন,ব্রত-পূজা পাঠ, বারান্দায় কিংবা ছাদে কলরোল তুলে গল্প,চুল বাঁধা এই ছবি দ্বিতীয় স্তবকে বদলে যাচ্ছে; আসলে বদলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত জীবন, নারীও বদলাচ্ছে হয়তো বা বদলের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিচ্ছেন মনে মনে।

'জীবনের দাবিদাওয়া তাই তীব্রতর অন্তর্যামী হয়ে ওঠে,/তোমরা ভ্রূকুটি হানো ,তাই আজকে আওয়াজে/অবশ্যম্ভাবিতার বিদ্যুৎ ঘনায়।সুখও অনেক/মাধুর্যের অন্য সুরে অন্তরঙ্গ আপিসের ভিড়ে কিংবা/এমন কি মেয়েলি মিছিলে , শাড়ির বিন্যাসে,ক্লান্ত রাত্রে/তোমরা এনেছ আজ অমিত্রাক্ষরের /বিপদসঙ্কুল সমৃদ্ধির জের পয়ারের মিলে।'('আমাদের মেয়েরা')


প্রাকৃতিক ভালোবাসা আবার মিলিত নারীও সেখানে যেন ভীষণ স্বাভাবিক—শারীরিক; সচেতন মনন অপেক্ষা অচেতন অধি-বাস্তবতায় যা কিছু প্রবৃত্তিগত, জৈবিকতা,বৈকল্য,বাসনা অধীত বিদ্যা-বুদ্ধির বাইরে এর সবটাই সক্রিয়।ইন্দ্রিয় থেকে অতীন্দ্রিয়তার দিকে নয়, অতীন্দ্রিয়তার অলীক চেতনার ভিতর দিয়ে ইন্দ্রিয়ের ভূগোলের এ যেন স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতঃসিদ্ধ আবিস্কার।

'আমার জীবনে তুমি প্রায় বুঝি প্রত্যহই ঝুলন–পূর্ণিমা,/মাঘী বা ফাল্গুনী কিংবা বৈশাখী,রাস বা কোজাগরী;/এমন কি অমাবস্যা নিরাকার তোমারই প্রতিমা।/আমারও মেটে না সাধ , তোমার সমুদ্রে যেন মরি'


তাই কবির অন্বিষ্ট যে নারী তাঁকে সঙ্গিনী করেই তিনি জনসমুদ্রের জোয়ারে মিশেছেন। নিঃসঙ্গতার উত্তরণ ঘটেছে।

'তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া/

তোমারই ঘাটের কাছে/ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে ঘাটে বাগানে বাগানে।/জল দাও আমার শিকড়ে।।'


কবির এই অন্বিষ্ট প্রিয়াই তাঁর বোধির সমূলে , চেতনার শিকড়ে জল সিঞ্চন করে তাঁকে জীবনের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন,যে যাপিত জীবন ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশের এক অখন্ড সংহতি ও

সম্পূর্ণতার প্রশস্ত পথে অগ্রসর হতে প্রেরণা জোগাবে। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন