মানুষবাজার

 সমীর রায়চৌধুরী

রিক্সা করে পাটনা সচিবালয়ে যাচ্ছি–। স্টেট ব্যাঙ্কের সচিবালয় শাখা থেকে পেনশন তুলি। যখন যেখানে থাকি এটিএম কার্ড সঙ্গে থাকে, তবে প্রত্যেক বছর নভেম্বর মাসে বেঁচে থাকার ‘এই তো আছি’ জানাতে আসি। কিন্তু আসার আসল উদ্দেশ্য ছেলে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে যাওয়া আর পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। তবে মাঝে-মাঝে বহুকালের ভুলে-যাওয়া সম্পর্কের হঠাৎ রিনিউয়াল ঘটে।রিক্সা চলেছে, কাজকর্ম মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছি, যাতে মিস না করি। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে আসা নীল ইন্ডিকা গাড়ি পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়েছে, জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে, হ্যাঁ, আমাকেই—

…এই…এই…সুকুমার…আবে…আবে…

ইদানিং হয়তো বয়সের জন্য আমার ভাবা-মন ইচ্ছে মতো বা রিফ্লেক্সে সাড়া দেয় না, একটু সময় লাগে। এখন প্রথম অভ্যাস না চেনা, না-করনের ডাঠা আর বসত। পেছোতে পেছোতে স্কুলজীবনে।

আরে শ্রীবাস্তব !

রিক্সার ভাড়া দিয়ে খুচরো ফেরত নিতে ভুলে যাই। নেমে পড়ি। স্কুল জীবনের বন্ধু। পড়াশোনায় ভালো ছিল। সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখত নতুন কিছু করবে। শ্রীবাস্তব আমারই বয়সী, অথচ এখনও স্বপ্নময় মুখ, বেশ হাট্টাকাট্টা। স্কুলের শেষ ক্লাস পেরিয়ে হঠাৎ একদিন রওনা দিল বম্বেতে। তখনও মুম্বাই হয়নি। ওর এক দূর সম্পর্কের কাকা থাকেন ভেরসোভায়। তখনও সমুদ্রের ধারে মেছোদের গ্রাম, একটু একটু শহরের অংশ হয়ে উঠছে। আজকের ভেরসোভার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। শ্রীবাস্তব হাফপ্যান্ট পরেই পাটনা থেকে ভেরসোভা। কী যে করছে ,বন্ধুবান্ধবরা কেউ জানতে পারিনি বহুকাল। কেউ কেউ বলত চলতা-পুরজা। শ্রীবাস্তবকে এভাবেই বারবার দেখতে পেয়েছি। দেখেছি, বন্ধুবান্ধবের কথা ঠিক নয়। তার ভাবনা-চিন্তার ফসল বেশ ঈর্ষাজনক, অভিনবত্ব তার সহজ দখলে।

কবে পাটনা এসেছিস ?

—আরে স্থায়ীভাবে মুম্বাই ছেড়ে বেশ কয়েক বছর আগে পাটনা চলে এসেছি। মুম্বাইতে ফিল্মে এক্সট্রা মানুষজন সাপ্লাইয়ের কাজ করছি। তবে অন্য এলাকায়। ইদানিং মানুষ সাপ্লাই করি মিছিলের জন্য… আনুষঙ্গিক জিনিস, পতাকা…ফেসটুন…এসব রাখি...

কোন রাজনৈতিক দলের মিছিল?

—প্রায় সব দলকেই জোগান দিই…যার যত লাগে…হঠাৎ প্রতিবাদে এদের মানুষ জোটাতে বেশ অসুবিধে হয়…

একই লোক সবার মিছিলে দিস, নাকি আলাদা ব্যবস্থা আছে?

…একই লোক বলতে পারিস…বেকার মানুষের তো অভাব নেই…আর কিছু লিঙ্কম্যান আছে…তাদের মাধ্যমেও মানুষ জোটাই…

মতাদর্শের কী হয়?

–সে আবার কি জিনিস

জেডিইউ…বিজেপি…আরজেডি…কংগ্রেস…কত সব দল আছে…

—মতাদর্শ নেতাদের ঝক্কি…দ্যাখ সব হিন্দু যেমন হিন্দুত্ববাদী নয়…সব বামপন্থী যেমন একরকম নয়…সব কংগ্রেসি একরকম নয়…সাধারণ মানুষের কী যায় আসে…তার সমস্যা বেঁচে থাকা…

আর নেতাদের সমস্যা ক্ষমতাদখল…তাই কী…

—চল অফিস এসে গেছে

শ্রীবাস্তবের গ্রাউন্ডফ্লোরে অফিস…মাটির তলায়…মালপত্তর রাখতে গোডাউন…বেশ সাজানো গোছানো…বেশ কয়েকজন কর্মচারী…আলমারি, সাজানো ফাইল…রেজিস্টার

—এই যে লিংকম্যানদের রেজিস্টার…সকলের ঠিকানা…ফোন নাম্বার

সব দল সব সময়েই কী মানুষ জোটানোর জন্য তোর কাছে আসে?

—কেউ কেউ জিনিসপত্তরের জন্য আসে…আবার যে ক্ষমতায় থাকে তাদের সবসময় মানুষ সাপ্লাই করতে হয় না। ক্ষমতার আসেপাশে মানুষ ঘুরঘুর করে…

কলকাতায় আছি…পাড়ায় অবশ্য দেখছি…এক ভাই তৃণমূলে আর এক ভাই সিপিএমে– আবার পাশের পাড়ায় দেখছি কিছু মানুষ একদল থেকে আরেক দলে ঢলে গেল…ক্ষমতায় যে দল, সবাই সেদিকে ভিড়ে যাচ্ছে…কাগজেও পড়ি…টিভি নিউজেও দেখছি…তবে রাজনীতি বা রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই

—নেতাদের মধ্যে কিন্তু এখনও কিছু-কিছু সৎ, আদর্শবান মানুষ আছে…তবে সংখ্যায় কম…যাকগে নিজের কথা বল…মুম্বাইতে তুই যখন চার্চগেটের কাছে পিজি হস্টেলে ছিলিস…সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে…

অত কাছ থেকে সেই প্রথম শুটিং দেখি…বোধহয় মালা সিনহার একটা ফিল্ম…টুকিটাকি ভিড়ভাড়…নাচাগানা…ডবলবডি…ডামি…এসব লোকজন তুই দিতিস

—ফিল্ম লাইনের কমোডিটি বলতে পারিস

তোর কাজ-কারবার নিরালি…তুলনা হয় না…তবে পাড়ায় দেখেছি কিছু-কিছু মিস্ত্রি বাড়ি তৈরির লাইনে…শহরে কাজকর্মে লোকের জোগান দেয়…আয়া সেন্টার…গাড়িচালকের সেন্টার…বাঁশদ্রৌণীতে আছে…ফোন করলেই আয়া বা গাড়িচালক পাওয়া যায়…আজকাল অনেকের গাড়ি আছে তবে মাস মাইনের লোক রাখে না…প্রয়োজনমতো সেন্টার থেকে লোক নেয়

—সে তো মানুষবাজারের অনেক লাইন…তুই অত-শত জানিস না

তবে তোর লাইন দুটোতেই একটা এলিমেন্ট কমন…

—হ্যাঁ, অভিনয়

ব্যাপারটা আরো মডার্ন

—তোদের লাইনে যেমন একজন লেখক আর টেক্সটের বক্তব্য এক নাও হতে পারে

আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেকেই দেখেছি যে, লোকটা ব্যক্তিজীবনে যা আর তার লেখায় যা, তা এক নয়

—তোদের ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’ তো সোস্যালিস্ট ছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করার সময়ে বলেননি যে গ্রামে তাঁর আরেক পরিবার আছে…সত্য গোপন করেছিলেন…

সে তো ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার রেণু সংখ্যায় লতিকাদির লেখায় আছে…তিনি নিজেই সেসব কথা লিখেছিলেন…তাঁর কেনা পাটনার বাড়িতে তো এখন প্রথম স্ত্রীর ছেলে থাকেন…যিনি বিজেপির এমএলএ…এগুলো মডার্নিটির ব্যাধি বলতে পারিস…তা না, প্রায়ই তো দেখি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলবদল

—আজকাল অবশ্য আইন বদলেছে…তাই কম ঘটছে…তবে মানুষবাজারের ব্যাপার, ঐ যে বললি মডার্নিটির জন্যে মানুষের মধ্যে অভিনয়ের এলিমেন্ট…

শুধু ঐ কথায় সবটা বলা হয় না রে…দ্যাখ জন্মসূত্রে আর বহুকালের বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ জেনেছে যে ভাষার আড়ালে লুকোনো যায় নিজেকে…

—হ্যাঁ, জীবজন্তু তো যে যার মতো লুকোয়…নানা…গর্তে…ছদ্মবেশে…প্রকৃতির নানা ধরনের আড়ালে

সে আড়াল বাহ্যিক হতে পারে বা স্বভাবজ ভেতরের ব্যাপার…মানি স্বজ্ঞাত হতে পারে তবে মানুষের মেইন আড়াল তার ভাষা, তার নিজস্ব যুক্তিপদ্ধতি

—সে তো ভালোভাবেই জানি…সে দিক থেকে ফিল্মের বা প্রকৃত অভিনেতারা সন্মানীয়…তাই নয় কি?

হ্যাঁ, তার অবস্থান স্বচ্ছ..আর এতে তোর চলে যায়? মুম্বাই থেকে চলে এলি কেন?

—মুম্বাইতে আমার একটা ফ্ল্যাট আছে…ছেলে ওখানে চাকরি করে….মেয়ের বিয়ে বিহারেই দিয়েছি।

এখানে রাজনীতিতে জাতপাত তো একটা ফ্যাক্টার…

—তা তুইও তো জানিস…তবে কোলকাতিয়া দলগুলোর মতো শাসকদল এখানে কথায় কথায় প্রতিবাদ মিছিল বের করে না…নীতিশকুমার কাজ করছে…লোকে মানছে…

ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের তুই বিশ্বাস করিস?

—ক্ষমতা দূর্নীতির মূল…তবে কমবেশির তফাত আছে…নীতিশ সাফসুতরা…তা তার বিরোধীরাও মানে…

মানুষবাজারে মানুষকে তোর কমোডিটি মনে হয়…বাজারে আর সব প্রডাক্টের মতো…?

—হ্যাঁ…কাঁচের জিনিসের বাজারের মতো।

শ্রীবাস্তবের অফিসে তার বসার চেয়ারের পেছনের দেওয়ালে ওমকারের ছবি…ওম থেকে উঠে আসছে আগুনের শিখা….বিহারে বেশ কমন…ভ্রামরী আসন বহুকাল আগেই বিহারের মানুষ জানে…দ্বারভাঙ্গাতে থাকার সময়েও দেখেছি…ধ্বনি আর আগুনের সম্পর্ক…মানুষের ভেতরে তাপ সঞ্চার করে…উম দেয়…

তুই কি নিয়মিত যোগব্যায়াম করিস …? ওটা আমাদের পরিবারে বহুকাল থেকে চলে আসছে…তুই করিস কি…?

—হ্যাঁ, একটা আত্মবিশ্বাস দেয়।

মেয়েমানুষ আর নাবালক পাচারকারীরাও মানুষবাজারের অবৈধ কমোডিটি, তবে তোর মানুষজনকে বৈধ কমোডিটি বলা যায়…

—মানুষবাজারের এলাকা আর সব বাজারের থেকে আলাদা নয়…

সেখানে কি বাজারদরের ওঠানামার নিয়ম কাজ করে…?

—ফিল্মলাইনে সে চান্স পাওয়া যেত, তবে মিছিল ক্ষমতাবাজ তুখোড়দের ব্যাপার, বেশি ঘাঁটানো বিপজ্জনক…এখন আমার আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই…আমি এবং আমার স্ত্রী, আর মা কখনও আমার কাছে কখনও ছোটোভাইয়ের কাছে গিয়ে থাকেন…

যোগব্যায়ামের ক্যাম্প করেও আজকাল মানুষবাজার থেকে টাকা তোলা হচ্ছে…

—তবে কারো মানুষবাজার বাড়তে থাকলে ক্ষমতার লোভ বাড়তে পারে…সাবধানে না ব্যবহার করলে হাত পুড়তে পারে…

আমার ইচ্ছে করছে প্রত্যেক দলের মিছিলে যোগ দিই…ব্যাপারটা নিজে ফিল করি…

—তা করতেই পারিস…তবে তোকে নিয়ে মুশকিল…তোর মুখ ভিড়ের মুখের মতো নয়…শিল্পীদের এই একটা মুশকিল…তার মুখ…দৃষ্টি…ক্রমশ ভিড় থেকে আলাদা হয়ে যায়…সিনেমায় অভিনয়ের জন্য দরকার পড়ে মেকআপ ম্যানের…যে তার ছিরিছাঁদ বদলে দেয়, আর সে নিজে চলনে-বলনে পার্ধক্য আনে পরিচালকের সাজেশান জেনে নিয়ে…লুকোনোর জায়গা এগুলো।

তাহলে যত বহুত্ব নিয়ে সে খেলে তত তার একক পরিচিতির বাড়বাড়ন্ত হয়…

—অতশত বুঝি না, মানুষবাজারের চেয়ে আর ভালো বাজার নেই, সব চেয়ে কম লগ্নীর ব্যবসা।

আর দ্যাখ, বাজার কাউকে ছাড়ে না ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন