মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস ও রাজনীতি

 সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

মলয় রায়চৌধুরীর তিনটি উপন্যাসের বিষয়, ভাষা ও নির্মাণকে বুঝতে চাইলে সবার আগে পাঠককে সরে আসতে হবে উপন্যাস-পাঠের প্রচলিত অভ্যাস থেকে। উপন্যাস তিনটিতেই মলয় খুব সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন আমাদের চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণের ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা উপন্যাস-ভাবনাকে। মলয়ের বয়ন-বুনন পদ্ধতি ও ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ, বাংলা ও বিহারের প্রকৃতি, সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের দ্বান্দ্বিক সমগ্রতাকে এবং তাদের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে অবিচ্ছিন্ন করে তুলতে চেয়েছে--- চারপাশের বাস্তবের সমালোচনা করতে-করতে ও তাকে অতিক্রম করে শিল্পের নিজস্ব বাস্তব নির্মাণ করতে-করতে।তার ফলে মলয়কে সবার আগে ভাঙতে হয়েছে প্রথাগত ইউরোপীয় কোড বা সংকেতগুলিকে। এমনকি, সেই সঙ্গে, তাঁকে সমালোচনা করতে হয়েছে, অতিক্রম করে যেতে হয়েছে, ইউরোপ থেকে আসা প্রধান আধুনিকোত্তরবাদী সন্দর্ভগুলির প্রশ্নহীন বশ্যতা ও উপযোগিতার মানসিকতাকেও।

অনিবার্য পরিণতি হিসাবে মলয়ের উপন্যাস তিনটিতে এমন এক নতুন, এতদিন আমাদের সামনে অনাবিষ্কৃত, ভারতীয় বাস্তবতার সন্ধান পাই, যাকে ঔপনিবেশিক চৈতন্য-কাঠামোর পরিসীমার মধ্যে ধারণ করা সম্ভব ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষিত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের কয়েক শতাব্দীর ধারাবাহিকতা আবিশ্বে যে-নিষ্ঠুরতা ও সাংস্কৃতিক আক্রমণ-অবক্ষয়ের জন্ম দিয়েছে--- তাকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন বলেই মলয়কে এই রাস্তায় হাঁটতে হয়েছে। অন্যদিকে আবার, মলয়ের বয়ন-বুনন পদ্ধতি ও ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ কিন্তু যান্ত্রিকভাবে ইউরোপকে প্রত্যাখ্যান করে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বয়ান বা টেক্সটের মধ্যে পাঠককে সীমাবদ্ধ রাখার বার্তা প্রেরণ করে না। পক্ষান্তরে তাঁর বয়ন-বুনন পদ্ধতি ও ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্ব এবং ভারতীয় স্বাধীন অভিজ্ঞান অনুসন্ধান ও সৃষ্টির আবেগ ও স্পন্দনশীলতার দ্বান্দ্বিক সংশ্লেষের পরিণতি। মলয় তাঁর নিজের মতো করে, তাঁর উপন্যাস তিনটিতে ধারাবাহিকভাবে, ঔপনিবেশিকতার দায়মোচনের প্রক্রিয়াকে বিকশিত করে তুলেছেন। তা করতে-করতে তাঁর উপন্যাসের বয়ান একই সঙ্গে ধারণ করেছে আধিপত্যকামী কেন্দ্রীয় ব্যবস্হাসমূহ ও তাদের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে-থাকা প্রান্তীয় শক্তিসমূহের দ্বান্দ্বিকতাকে এবং ওই কেন্দ্রীয় ব্যবস্হাসমূহ থেকে উৎপন্ন মহাসন্দর্ভ ও প্রান্তীয় বর্গের প্রতিদিনের যাপিত জীবনের গভীর থেকে উৎসারিত বিকল্প সন্দর্ভের দ্বান্দ্বিকতাকে।

দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে, আমাদের যে প্রত্যক্ষ ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হয়েছিল--- সেই সত্যকে আমরা বাদ দিতে পারি না। ভুলে থাকতে পারি না, পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। তার পাশাপাশি আবার প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে ফিরে যাবার চেষ্টা করেও ঔপনিবেশিকতাকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়। মলয় তাই তাঁর এই উপন্যাস তিনটিতেই ইউরোপীয় সন্দর্ভগুলিকে এবং সেই সঙ্গে ইউরোপ ও ভারতবর্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রয়ার মধ্যে অবস্হানকারী সুবিধাভোগী অংশের দ্বারা উৎপাটিত সন্দর্ভগত সক্রিয়তাকেও ইন্টারোগেট করেন। সেই সূত্রে তিনি বুঝে নিতে চান, ইউরোপ কেমনভাবে মতাদর্শগত আধিপত্য পপতিষ্ঠার সূত্রে তাদের কোড বা সংকেতগুলিকে আমাদের সামাজিক ব্যবস্হার প্রবহমানতার মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তুতে পেরেছিল, এবং এখনও কেন পারছে। এইভাবে বুঝে নিতে চাইবার পরিণতিতে, আধিপত্যকামী সন্দর্ভের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, মলয়কে নির্মাণ করে নিতে হয়েছে বিকল্প সন্দর্ভের এমন এক পরিসর যা ঔপনিবেশিকতার প্রভাবমুক্ত জাতীয় ও আঞ্চলিক উপাদানের দ্বারা সম্পৃক্ত এক সচল চিন্তাপ্রবাহের দ্বারা নির্ধারিত। এই চিন্তাপ্রবাহের সূত্রেই মলয়ের বিকল্প সন্দর্ভ প্রতিনিয়ত শুষে নিচ্ছে চারপাশের নিরুচ্চার বর্গের জীবন থেকে স্বতোৎসারিত বিভিন্ন জায়মান কোড বা সংকেতগুলিকে, এবং সেই সঙ্গে শিল্পের নিজস্ব পরম্পরা এবং শৃঙ্খলার সূত্রেই তা ক্ষয়িত করে বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত আধিপত্যকারী সন্দর্ভকে।

মলয়ের উপন্যাস তিনটির ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ ও বয়ন-বুনন পদ্ধতি উপন্যাস সম্পর্কে কোনও বিশ্বজনীন সাহিত্যিক ধারণাকে স্বীকার করে না। তাই প্রচলিত মহাসন্দর্ভের পরিসীমার বাইরে দাঁড়িয়ে মলয়কে তাঁর চারপাশের বাস্তব পরিস্হিতির সঙ্গে নতুন ধরণের নির্ধারক সম্পর্ক নির্মাণ করে নিতে হয়েছে। তা করতে গিয়ে মলয় কিন্তু খুব সচেতনভাবে এসেনশিয়ালিজমের বিপদকে এড়িয়ে গেছেন। ঔপনিবেশিকতা ও পণ্যমোহের চাপে ধ্বস্ত মধ্যবিত্তের হাহাকার ও প্রান্তীয় মানুষের আর্তনাদকে তিনি এমন নির্মমভাবে উন্মোচন করেন এবং নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ককে ও যৌন আকাঙ্খার অবদমনকে ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত করে--- এতদিন পর্যন্ত প্রতিনিধিত্বহীন এমন দৃষ্টিভঙ্গী ও ভাষায় ধারণ করেন যে, তাঁর পক্ষে এসেনশিয়ালিজমের বিপদকে অতিক্রম করে যাওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।মলয়ের ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভের নিজের ভিতরই এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যার শক্তিতে তিনি পরিপার্শ্বের সঙ্গে নতুন ধরণের নির্ধারক সম্পর্ক নির্মাণ করে নিতে পারেন। তার ফলে, মলয় একদিকে যেমন সাহিত্য-বিষয়ক বিশ্বজনীন আধিপত্যকারী ধারণাসমূহকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, আবার অন্য দিকে, অর্থ বা মিনিং উৎপাদনের ক্ষেত্রে, সংযোগের ক্ষেত্রে, আত্তীকরণের ক্ষেত্রে, উপন্যাস পাঠের প্রচলিত-সজ্ঞায়িত সীমাকে ভেঙে ফেলে নতুন দেশজ রাজনৈতিক বাস্তবতা ও তজ্জনিত নবোথ্থিত অভিঘাতকে ধারণ করতে পারেন --- উপন্যাসের সন্দর্ভে তাকে সঞ্চালিত করতে পারেন।

মলয় রায়চৌধুরী অর্থ-উৎপাদন, সংযোগ ও আত্তীকরণের ক্ষেত্রে বিকল্প সন্দর্ভের ওপর নির্ভর করেন বলেই তাঁর উপন্যাস তিনটির সঙ্গে কোনো সুপরিচিত বাণিজ্যসফল পত্রিকা বা প্রকাশনার নাম জড়িয়ে থাকে না।'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' ছাপা হয়েছিল 'হাওয়া৪৯' পত্রিকায়, 'জলাঞ্জলি' ছাপা হয়েছিল 'রক্তকরবী' পত্রিকায়, ও 'নামগন্ধ' প্রকাশ করেন ঢাকার 'সাহানা' প্রকাশন সংস্হা। সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানার দ্বারা উৎপাদিত পণ্যগুলির উৎপাদন পদ্ধতির প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হল: প্রমিতকরণ ও নকল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। মলয় রায়চৌধুরী এই দুই বৈশিষ্ট্যকে প্রত্যাখ্যানের সূত্রে, আসলে প্রত্যাখ্যান করেন সেই সন্দর্ভে স্বচ্ছন্দ বোধ-করা আশুতোষ পাঠক-কুলকেও। মলয়ের সন্দর্ভে প্রবেশ করতে চাইলে মেরুদণ্ডকে ঋজু রেখেই প্রবেশ করতে হবে। দেশ-কাল সম্পর্কে মলয় তাঁর গভীর জিজ্ঞাসাকে হাজির করতে চান বলেই --- তাঁর উপন্যাসের পাঠককেও কোনও-না-কোনও ভাবে এক ধরনের জিজ্ঞাসার দ্বারা আলোড়িত হবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। নতুন রুচির সঙ্গে দ্বিরালাপে অনীহ পাঠকের জন্য মলয়ের সন্দর্ভ নয়।

'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এ পাটনার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সূত্রে মলয় আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন গোটা বিহারের জাতি, বর্ণ ও শ্রেণীসম্পর্কের আবহমান জটিল নেটওয়র্কের সামনে। মলয় বিহারের সামাজিক কাঙামোর বিভিন্ন স্তরে অবস্হানকারী জাতি ও বর্ণের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের দ্বান্দ্বিক সমগ্রতার সূত্রে গড়ে-ওঠা সামাজিক গতিশীলতাকে বুঝে নিতে চেয়েছেন। বিহারের এই সামাজিক গতিশীলতার সঙ্গে আঞ্চলিক উৎপাদন-ব্যবস্হা ও বৃহৎ পুঁজির সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। এই সামাজিক গতিশীলতা একান্তভাবেই ভারতীয় সমাজের ও ইতিহাসের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। বিহারের ধর্ম ও বর্ণের লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে বাঙালিদের অবস্হা খুবই করুণ। হয় তাদের বিহার থেকে চলে আসতে হচ্ছে, অথবা নিজস্ব সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের বিষয়ে সচেতনতাকে বর্জন করতে হচ্ছে। 'সাংস্কৃতিক চাপ থেকে চাগিয়ে-ওঠা অসহ্য দুঃখের খতিয়ান রাখে না কোনও ভূভাগের ইতিহাস। মিলিয়ে যায় হরপ্পাবাসী বা মিশরীয়র মতন।' শিলচরের বাঙালিদের এক ধরনের সংগঠিত প্রতিবাদ আছে। বিহারে কিন্তু এখন বাঙালি পরিবারের ছেলে-মেয়েদের হিন্দি বা ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া অন্য মাধ্যমে লেখাপড়ার সুযোগ প্রায় নেই।

রিজার্ভ ব্যঙ্কের নোটগুনিয়েদের সূত্রে ক্ষমতা-কাঠামোর অভ্যন্তরীন চরিত্র ও নানা ধরনের দুর্নীতির সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির বিবরণের মধ্যে মলয় আমাদের সচেতন করেন মানুষের শ্রমশক্তি ও কাগজের নোটের মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে। 'অতনুকে ছাড়ে না পচা নোটের জীর্ণ গন্ধ, যে-গন্ধে ওর চারিদিকে ঘনিয়ে চলেছে দুর্বহ স্বচ্ছ অন্ধকার। পোড়াবার সময়, চুল্লি থেকে ভেসে আসে মড়া পোড়াবার হুবহু গন্ধ, অথচ ছাইয়ের রং সোনালি। চুল্লিতে নোট ফেলার সময়ে ননীদা হরিবোল দেন, রাণা রামদেও সিং আওয়াজ দিয়ে ওঠে রাম নাম সৎ হ্যায়'। হরিবোল আর রামনামের সূত্রে নোটের দহন--- মানুষের দহনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠে। কারণ অর্থ হল বিনিময়ের গতিপথে আবশ্যিক প্রয়োজন থেকে গঠিত স্ফটিকস্বরূপ, তার দ্বারাই শ্রমোৎপন্ন বিভিন্ন দ্রব্য কার্যত পরস্পরের সঙ্গে সমীকৃত হয়, এবং এই ভাবে কার্যক্ষেত্রে পণ্যে পরিবর্তিত হয়।যে-হারে মানুষের শ্রমশক্তি দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে পরিণত হয়, ঠিক সেই হারেই একটি বিশেষ পণ্য পরিণত হয় অর্থে। অর্থও যে একটা পণ্য এটা বোঝা তেমন মুশকিল নয়। কিন্তু পণ্য কেন ও কী ভাবে অর্থে পরিণত হয় তা জানা গেলেই বোঝা যায়--- নোট পোড়াবার সময়ে মানুষ পোড়ানোর গন্ধ পাওয়া যায় কেন। অর্থ পণ্যকে প্রমেয় করে না। ব্যাপারটা তার উল্টো। মূল্য হিসেবে সমস্ত পণ্যই মনুষ্য-শ্রমের বাস্তব রূপ, সুতরাং প্রমেয়, সেই কারণেই একটিমাত্র বিশিষ্ট পণ্যের সাহায্যে সেই মূল্যের পরিমাপ করা চলে, এবং উক্ত বিশিষ্ট পণ্যটিকে পরিণত করা যেতে পারে সেগুলির মূল্যের সাধারণ পরিমাপে, বা অর্থে। পণ্যের মধ্যে যে মূল্যের পরিমাপ, শ্রমসময় অন্তর্নিহিত থাকে তাকে অবশ্যই যে বাহ্যিক রূপ ধারণ করতে হবে, মূল্যের পরিমাপ হিসেবে অর্থ সেই বাহ্যিক রূপ।অর্থের ভিতর পণ্যের মূল্য স্বতন্ত্র সত্তা লাভ করে বলেই তো অর্থ সঞ্চালনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।কাজেই, সঞ্চালনের মাধ্যম হিসেবে অর্থের গতি আসলে মানুষের শ্রমশক্তি দ্বারা উৎপন্ন পণ্যের নিজ রূপেরই গতি। সেই কারণেই একই মুদ্রা, বিক্রেতার হাতে আসে পণ্যের হস্তান্তরিত রূপ হিসাবে, এবং আবার তার হাত ছেড়ে চলে যায় পণ্যের পরম হস্তান্তযোগ্য রূপ হিসেবে। অর্থ যে মুদ্রার আকার ধারন করে সেটা হয় সঞ্চালনের মাধ্যম হিসেবে তার কাজের দরুন।পণ্যের দাম বা অর্থ-নাম দিয়ে কল্পনায় সোনার যে-ওজনের পরিচয় দেওয়া হয়, তাকে সঞ্চালনের ভেতরে, মুদ্রার আকারে অথবা এক নির্দিষ্ট মূল্যের সোনার টুকরোর আকারে অবশ্যই সেই সমস্ত পণ্যের সম্মুখীন হতে হয়। দামের মান নির্ধারণের মতো মুদ্রা নির্মাণও রাষ্ট্রের কাজ। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাই প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণেই থাকে। রাষ্ট্র কতগুলি কাগজ সঞ্চালন-ক্ষেত্রে ছাড়ে, তার ওপর এক টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন অর্থ-নাম ছাপা থাকে। কাগজি অর্থ--- সোনা কিংবা অর্থের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি প্রতীক। তার সঙ্গে পণ্যের মূল্যের সম্পর্ক এই যে, মানুষের শ্রমশক্তি দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য ভাবগতভাবে যে-পরিমাণ সোনায় প্রকাশিত হয়, কাগজ তারই প্রতীকী পরিচয় বাহী। এভাবেই কাগজের নোট মানুষের শ্রমশক্তি দ্বারা সৃষ্ট মূল্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। তাই নোট পোড়ানোর সময়ে মড়া পোড়ানোর গন্ধ, হরিবোল আর রামনাম গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আমাদের ঔপনিবেশিক অস্তিত্ব আর চৈতন্যের ঔপনিবেশিকীকরণকে প্রবলভাবে সমালোচনা করেন মলয়, রাজগিরের একটি বাড়িতে 'ল্যাংটো পাথরের এলিয়ে পড়া' নারীমূর্তির একই সঙ্গে বর্ণনা ও সমালোচনার সূত্রে।'আম্রপালীর উরু আর নিতম্বে গড়া ভেনাস। উর্বশীর খোলা স্তন মেলে হেলে রয়েছে হেলেন অব ট্রয়। শকুন্তলার কটাক্ষ বিলোচ্ছেন মার্বেল-পাথরের শীতল ক্লিওপেট্রা। দেশ ছেড়ে যেতে পারেনি এসব জারজ মেমের দল'। (ডুবজলে পৃ ৭৫) আবার সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের আমেরিকা যাত্রা ও রজনীশের আশ্রমে আমেরিকান নারীদের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করাকে যুক্তি সম্মত করে তোলা হয় তৃতীয় দুনিয়ার বহু ব্যবহৃত সাম্রাজ্যবাদ 'বিরোধী' কিছু শব্দকে ব্যবহারের মাধ্যমে। 'চন্দ্রকেতু সিং দশ হাজার টাকা খরচ করে আমেরিকান মাগিদের ঠুকে আসছে রজনীশ আশ্রমে ফি-বছর একবার। বলছিল যে পেন্টাগন, সি আই এ, এম এন সিদের ঠুকছে মনে করে চাপে মাগিগুলোর ওপর।' (ডুবজলে পৃ ৮১)। আবার সরকারি পয়সায়, রেমিটান্স নিয়ে যাবার সূত্রে, আশ্রয় পাওয়া যায় 'ভূতল দেহগ্রাহকের পান্হশালা'-য়। খাদ্য, পানীয় ও নারীদেহ জোগানোর একটি অঘোষিত সরকারি ব্যবস্হা আছে--- সরকারি পয়সায়। আবার পাঁচদিন বা পনেরোদিন বা একবছরের জন্যে বদলি হয়ে বা ট্রেনিং-এর জন্য ইংল্যান্ড, আমেরিকা, মিশর, ফিলিপিন্স বা থাইল্যান্ড যাবার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আধিকারিকদের ভিতরে যে ল্যাং মারামারি চলে তার বর্ণনা প্রসঙ্গে মলয় চমৎকার মন্তব্য করেন: 'কতো রকমের যে বিদেশি ভিক্কে পাওয়া যায় তৃতীয় বিশ্বে।' ( জলাঞ্জলি ৯৭)। অভিন্ন ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে ঊর্ধতন ও অধস্তন পদাধিকারীর মধ্যে আলোচনার সূত্রে গোটা উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন শহরের পতিতালয়গুলির গলিঘুঁজির খবর ও যৌন অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান অবাধে চলতে থাকে। মলয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মীদের জ্ঞান ও ক্ষমতার সঙ্গে তাদের যৌন জীবনকেও অন্বিত করে দেন। যার পরিণতিতে বহিরঙ্গে এক আপাত-বোহেমিয়ান আচার-আচরণের মধ্যেও অন্তরঙ্গ স্তরে নিঃশব্দে প্রবাহিত হতে থাকে ঔপনিবেশিকতার ধারাবাহিকতার সত্য ও তার মলয়কৃত সমালোচনা।

মলয়ের এই সমালোচনার সূত্রে স্পষ্ট হয় ক্ষমতা মদমত্ত ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্হা যৌনজীবনের ওপর বিভিন্ন কৃৎকৌশল চাপিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণকে কেমনভাবে সর্বব্যপ্ত করে তুলতে চায়। মলয় দেখিয়ে দেন যৌন-নৈতিকতাও কেমনভাবে ক্ষমতার নির্মিতি হয়ে ওঠে। ক্ষমতার সূত্রে, মতাদর্শগত আধিপত্যের সূত্রে, মানুষের আত্মপ্রশিক্ষণের সূত্রে, শৃঙ্খলা আরোপিত হয় শুধু বহিবৃত স্তরে নয়, সেই সঙ্গে অন্তর্বৃত স্তরেও। যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণের কৃৎকৌশল আসলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্হার অস্তিত্বরক্ষার প্রাকরণিকতার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন। মলয় তাঁর তিনটি উপন্যাসেই বারবার দেখান--- যৌন আবেগের তীব্রতাকে নিয়ন্ত্রণ করে কেমনভাবে প্রচলিত সামাজিক স্হিতাবস্হাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, প্রান্ত ও কেন্দ্রকে মিলতে দেওয়া হয় না। যখনই এই নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে চাওয়া হয় বা প্রান্ত ও পরিধি মিলতে চায়--- তখনই ভেঙে পড়ে সামাজিক ও মনস্তাত্বিক জগতের আপাতগ্রাহ্য শৃঙ্খলাগুলি, এসে যায় উন্মাদনা আর দুর্ঘটনা। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্হার বিভিন্ন কৃৎকৌশলের সূত্রে যৌনসম্পর্কের ওপর দাম্পত্যের একচ্ছত্র অধিকার সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়।তার ফলে দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনও সম্পর্কের সূত্রে উৎপাদিত সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতির সমস্যা এই ইনটারনেটের যুগেও বিদ্যমান।তার ফলে আমাদের যৌন-নৈতিকতার ধরনা যৌনতা ও দাম্পত্যে অনোন্যসম্পৃক্ত হয়ে আবর্তিত হচ্ছে। মলয়ের তনটি উপন্যাসের অনেক চরিত্রই এই আবর্তনের শৃঙ্খলার বাইরে চলে যেতে চায়। অথচ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্হা যৌন-প্রক্রিয়াকে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তাকে করে তুলতে চাইছে একবাচনিক। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই মলয়ের উপন্যাসগুলি যে-নির্মম সত্যকে উন্মোচন করে তা হল--- আমাদের যৌন জীবনের পরিসর হচ্ছে মানবিক গতি ও স্হবিরতার দ্বিবাচনিক সম্পর্কের পরিসর, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিসর। ব্যক্তিসত্তা প্রচলিত ব্যবস্হার সামনে আত্মসমর্পণ করে 'সামাজিক' ও 'নেতিক' হয়ে উঠেছে--- আবার কখনও প্রচলিত ব্যবস্হাকে ভেঙে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার বহুস্বরিক দ্বিবাচনিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে।

ননীগোপালের বিয়ের রাত্রে সব কথার উত্তরে অরিন্দম বলেছিল 'না'। শিমুলতলা থেকে ফিরবার পরে পুরো উন্মাদ হয়ে গেল। তার দু-বছর আগে থেকে পাশের ফ্ল্যাটের সাত বছরের বড় এক পীনোন্নত মহিলার সঙ্গে দুমদাম অফিস পালিয়ে দুপুর কাটাচ্ছিল অরিন্দম। 'মহিলা আসল কাজটা করতে দিচ্ছেন না অথচ চলছে দু-বছর'। অরিন্দমের স্বীকারোক্তি এই রকম: 'মিধ্যে নিয়েই কী গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, অসহ্য।...অথচ জীবনের বিরুদ্ধে আমি কিছুই করিনি। পালাতে হবে। দুঃখের নিজস্ব আনন্দ থেকে পালাবো।...জানাজানি হয়ে গেলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই।...কলকাতায় বদলির দরখাস্তটা মঞ্জুর হয়ে গেলে বেঁচে যেতুম।' আবার মানসিকভাবে, প্রথাগত অর্থে, 'সুস্হ' হয়ে কাজে যোগ দেবার পর সে আবার স্বীকার করে: 'ছাড়াতেই পারছিলুম না নিজেকে। ভালো লাগাটাই খারাপ লাগতে আরম্ভ করেছিল।' তারই পাশাপাশি সহকর্মীদের বলে: 'যখন পাগল ছিলুম তখন দশ টাকার রুপোর কয়েন বেরিয়েছিল। আমার জন্য রেখেছে কি না ।' ( ডুবজলে পৃ ৩৭ )। অরিন্দমের আখ্যান এভাবেই ধারণ করে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার দ্বিবাচনিকতাকে; প্রচলিত যৌন সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে আসার আকাঙ্খা, আবার তার পরেই, প্রচলিত ব্যবস্হার সামনে নতজানু হবার মধ্যবিত্ত অনিবার্যতাকে। আবার এই নতজানুত্বই মানুষকে মানসিকভাবে 'সুস্হ' বলে প্রমাণ করে।

মলয়ের এই উপন্যাস তিনটিতে আকাঙ্খার রাজনীতির দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিসর দৃশ্যমান হয়--- চরিত্রগুলি বিপরীতধর্মী দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। এক দিকে মানসী বর্মণ চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার ডাক্তার স্বামীর কাছে চল;এ যায় নওয়াদায় ওয়ারিশ আলি গঞ্জে। এলাকাটা 'বিনোদ মিশ্র-র নকশালদের গড়'। মানসীর স্বামী সেখানে ডাক্তারির সঙ্গে সঙ্গে নিচু জাতের লোকের মধ্যে বিপ্লবের প্রচার করেন। তার ডাক্তারখানাই মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টারের ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতির অফিস। ননীগোপালও চলে গেছে ওদের কাছে। মুসহরদের সন্তানদের অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করতে থাকে মানসী। গয়া, জাহানাবাদ, অওরঙ্গাবাদ, নওয়াদার গ্রামে বন্দুকধারী যুবকরা থাকে তার পাহারায়। ননীগোপাল সাইকেলে এ-গ্রাম সে-গ্রাম করে মাথায় গামছা বেঁধে। রসিক পাসওয়ানের সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে পাটনা থেকে কলকাতা আসবার সময়ে অরিন্দম আবিষ্কার করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে তার প্রাক্তন সহকর্মী নিরুদ্দেশ হয়ে-যাওয়া অতনুকে--- নকশাল অধ্যুষিত অঞ্চলে নিম্নরর্ণের মানুষদের এক ঘণবিবাহের অনুষ্ঠানের পুরোহিত হিসেবে। 'ইংরেজিতে মন্তর পড়ছে, পরিষ্কার ভালো ইংরেজিতে আর আবোল-তাবোল উচ্চারণে সেগুলো তারস্বরে ওগরাচ্ছে হবু স্বামী-স্ত্রী।...ইংরেজিতে কী পাঠ করছে কান পেতে শোনে অরিন্দম আর স্তম্ভিত হয়ে যায়। চিনে ছাপানো 'রেড বুক' থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করছে...।' ( জলাঞ্জলি পৃ ৪২ )।

আবার অন্যদিকে আকাঙ্খার রাজনীতির ভিন্ন পরিসর দৃশ্যমান হয় ইন্দ্রাণী সাধুখাঁ'র কেরিয়ার সচেতনতা এবং অভিজিৎ-সুজাতার সম্পর্কের সূত্রে।চাকরির সূত্রে ইন্দ্রাণী সাধুখাঁ ও অভিজিৎ লশকর ইন্সপেকশানে এসে যে-বাড়িতে আশ্রয় পায়, সে-বাড়ির মালিক ও তার ছেলে কাঠমান্ডুতে থাকে ও সেখানে ক্যাসিনো চালায়। ইন্দ্রাণী ও অভিজিৎ-এর দেখাশোনা করে কেয়ারটেকার অমরুতমল লোঢ়া। করয়ারটেকার রোজ তাদের বিহারের ওই অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস শোনায় মৌখিক ইতিহাসের আকরণে। তারই মধ্যে আশ্রয়দাতার নিঃসন্তান পুত্রবধু সুজাতার সঙ্গে অভিজিৎ-এর মানসিক ও দৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সুজাতা গর্ভিণী হয়। পরে অভিজিৎ জানতে পারে সুজাতার শ্বশুরের সন্তান-উৎপাদন ক্ষমতা না থাকার ফলে অমরুতমলই সুজাতার স্বামীর জন্মদাতা। আবার সুজাতার স্বামীরও একই সমস্যা থাকার ফলে সুজাতার গর্ভে অভিজিৎ-এর সন্তান এল, অমরুতমল ও সুজাতার শ্বাশুড়ির পরিকল্পনার সঙ্গে সুজাতার অভিনয়ের পরিণতিতে। প্রতারিত অভিজিৎ বলে, 'অমরুতমল জানতো, শাশুড়ির সমর্থন ছিল, পুরো নাটকটা উদ্দেশ্যপূর্ণ, শুধু ব্যবহৃত হলুম আমি আর বেচারা অনাবাসী স্বামী।' ( জলাঞ্জলি পৃ ৯০ )।

ম্যানিলা যেতে উচ্চাকাঙ্খী ইন্দ্রাণী, অভিজিৎ-এর এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলে, 'তুমি এভাবে নিজেকে জড়াচ্ছ কেন ঘটনাটার সঙ্গে, বলো তো ? ওদের একটা লেজিটিমেট বাচ্চা চাই। নল-খোকা, ল্যাবরেটারি-খুকু না করে এই উপায়ে হলে ক্ষতি কি ? কেলেঙ্কারি হল না কোনও।' ( জলাঞ্জলি পৃ ৯০)। ফিরবার পথে, ট্রেনে ওঠার আগে, রেলস্টেশনে, সুজাতার শাশুড়ি অভিজিৎ-এর হাতে লক্ষাধিক টাকা দামের একটি হিরের আঙটি পরিয়ে দেন। ট্রেনে উঠে ইন্দ্রাণী ওপরের বার্থে রহস্য উপন্যাসের ডুবে থাকতে-থাকে দেখে ট্রেন বারাউনি থেকে হাতিদহের দিকে যাবার সময় ট্রেনের জানলা তুলে অভিজিৎ আঙটিটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কেরিয়ার সচেতন ইন্দ্রাণী 'বললে না কিচ্ছু। লাঘব করা যাবে না। অন্যের ছোঁয়াচে কষ্টের মুখোমুখি পড়ে গেলে, নিজের যাতনা বেড়ে যেতে পারে। মোহমুক্তো ওভাবে হয় না। শীতকে জাঁকিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে, গলা ওব্দি কম্বল টেনে, অভিজিৎ-এর অসুখ যাতে না ওর নিজেরই উপসর্গ হয়ে ওঠে, রহস্যোপন্যাসে ফিরে যায় ইনি ( ইন্দ্রাণী)।' (জলাঞ্জলি পৃ ৯১)।

পরবর্তী অন্য একটি ইন্সপেকশনের সময়ে, ধানবাদে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হোটেলের বাইরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অনুর্ধ পঁচিশ এক উন্মাদিনীকে দেখে অভিজিৎ ইন্দ্রাণীকে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ডেকে তোলে উন্মাদিনীকে জামাকাপড় পরাবার প্রস্তাব নিয়ে। 'ইনি ভেবেছিল স্বাভাবিক হয়ে এসেছে অভিজিৎ। দেখা যাচ্ছে ওর তো রাত্তিরে ঘুম আসে না। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে মাঝরাতে।...কিসের যে তাগিদ অনুভব করছে ও ।' (জলাঞ্জলি পৃ ১০৯)। ধানবাদ থেকে ফিরে ইন্দ্রাণী জানতে পারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাকে ম্যানিলা পাঠাচ্ছে। আর অভিজিৎ চলে যায় উন্মাদ আশ্রমে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্হায় এই দুটি পরিণতিই যেন অনিবার্য ছিল।যে যত বেশি সুশৃঙ্খল হবে তার তত উথ্থান আর যে যত আবেগতাড়িত প্রবৃত্তিচালিত সে তত বেশি-বেশি করে চলে যাবে কেন্দ্র থেকে দূরে, মার্জিনে। প্রচলিত মহাসন্দর্ভের সামনে যাঁরা নতজানু হন না, কোনও না কোনও ভাবে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্হা তাদের উন্মাদ হিসেবে চিহ্ণিত করবেই।'পাগলা-পাগলিদের লোকে বাড়ি থেকে তাড়ায়। শহরের ভিতর থেকে হ্যাট-হ্যাট হাঁকিয়ে, শহরের বাইরে পাঠিয়ে নিশ্চিত হতে চায় সবাই। ল্যাংটো হলে বেড়ে যায় হ্যাট-হ্যাটের মাত্রা। ব্যবসাকেন্দ্র থেকে ভাগিয়ে ঠেলে দেয়া হয় আড়ালে-আবডালে। বড়লোক পাড়ায় ঢুকে গেলে, সেখান থেকে তাড়িয়ে গরিব পাড়ার দিকে। তারপর আর দেখা যায় না।কোথায় যে ওরা উবে যায়!'(জলাঞ্জলি পৃ ১১০)।

মলয়ের উপন্যাসে একদিকে অতনু-মানসীদের জগৎ, অন্যদিকে অভিজিৎ-অরিন্দমের জগৎ। আকাঙ্খাকে যথাপ্রাপ্ত কাঠামোর স্তরে নামিয়ে আনতে চায়নি।আকাঙ্খা নিজেই নিজের মধ্যে এক নতুন বাস্তব বানিয়ে তুলেছে। আর সেই সূত্রেই উক্ত দুই জগতের বাসিন্দারাই একই সঙ্গে অতিক্রম করে যায় যথাপ্রাপ্ত প্রতিমা ও কল্পনার সীমাকে। একইভাবে আকাঙ্খা একটি শাস্ত্রীয় নির্দেশ লঙ্ঘনকারী শক্তিতে পরিণত হয়। তার ফলে বোঝা যায়--- আকাঙ্খা বিধিনিষেধের জন্ম দেয় না, পক্ষান্তরে বিধিনিষেধই আকাঙ্খার জন্ম দেয়। অতনু-মানসীরা আকাঙ্খার রাজনীতির মোকাবিলা করতে চায় শ্রেণীগত অবস্হান থেকে। আর অন্যদিকে অরিন্দম-অভিজিৎরা তা করতে চায় বিষয়ীনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বিষয়ীনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি আকাঙ্খার অযৌক্তিক পরিমন্ডলকে গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক উৎপাদনের যুক্তিবাদী বিশ্বকে অস্বীকার করতে চায়। অন্যদিকে শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি--- সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক, দুই ধরনের দমনকেই একটি অভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে অবিচ্ছিন্নভাবে বুঝতে চায়।শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি আকাঙ্খা উৎপাদনের সূত্র ধরে যে সমগ্রতার ধারনা গড়ে তুলতে চায় তা সবসময়েই এক ধরনের পরিবর্তন-প্রবাহের মধ্যে সচল থাকে।অভিজিৎ-অরিন্দমের ধনতান্ত্রিক শৃঙ্খলাকে অতিক্রমের আকাঙ্খা কোনও বিকল্প সমগ্রতার ধারণা ও সচলতার সঙ্গে সংলগ্ন হয় না বলেই--- তাদের বিষয়ীনির্ভর আকাঙ্খার রাজনীতি ধনতান্ত্রিক সমগ্রতাধর্মী চিন্তা এবং আমাদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর অনমনীয়তার বিরুদ্ধে যত তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবেই গ্রাহ্য হোক না কেন --- তা কিন্তু ওই প্রতিক্রিয়ার সূত্রেই ওই সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোগুলির যাথার্থ্যকেই প্রমাণ করে।দ্বান্দ্বিক অবস্হান থেকে দেখলে বোঝা যায়--- চরম ভিন্নতা, বৈচিত্র ও অনন্যতা তার বিপরীতধর্মিতার দিকে চলে যায়, এবং সমগ্রতাধর্মী অনুরূপত্ব ও অশেষ পুনরাবৃত্তির ফলে যথার্থ পার্থক্যগুলি মুছে যেতে থাকে।

ইন্দ্রাণীর শৃঙ্খলা ও সাফল্যের কাঠামো ও সমগ্রতার ভিন্ন প্রেকআপটে স্হাপন করেই যেমন অভিজিৎ-অরিন্দমের আকাঙ্খা-উৎপাদনের সিজোফ্রেনিক প্রবাহকে সজ্ঞায়িত করা সম্ভব--- অন্যদিকে তেমনি তাদের এই আকাঙ্খার রাজনীতি ইন্দ্রাণীর উক্ত শৃঙ্খলা ও সাফল্যকেই যথার্থ ও অনিবার্য বলে প্রমাণ করে ফেলে। তার ফলে তাদের আকাঙ্খার রাজনীতি যথাপ্রাপ্ত পরিসরের সিনক্রোনিক বা সমকালীন ব্যাখ্যা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ কালগত বিখাশের ডায়াক্রোনিক বা ঐতিহাসিক ধারণার কাঠামো নির্মাণ করতে পারে না।তার পাশাপাশি অতনু-মানসীরা তাদের কর্মকান্ডের সূত্রে অনেক বিশৃঙ্খলা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও--- একদিকে যেমন বিষয়ীর এক ধরনের সুস্হিতির কথা বলে, অন্যদিকে তেমনি তা বিষয়ীর নিজেকে পুনর্নিমাণের ঐতিহাসিক ক্ষমতার প্রতিও গুরুত্ব দেয়। অন্যভাবে বলা যায়, অতনু-মানসীদের আকাঙ্খার রাজনীতি বাইরের শক্তির নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতার অধীন থাকা বিষয়ীকে বিচ্ছিন্ন ও খন্ডায়িত সত্তা হিসেবে দেখার কথা না-বলে--- সামাজিক ও ঐতিহাসিক দ্বারা নির্ধারিত বিষয়ীর কথাও বলে। যে-বিষয়ী আবার অন্য বিষয়ীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে ওই সব বস্তুগত, সামাজিক ও ঐতিহাসিক শক্তিসমূহকে পরিবর্তিত করতে পারে।

মলয়ের উপন্যাসে বিহারের বিভিন্ন জাতের লড়াইতে বাঙালিদের অবস্হা যে কতটা করুণ তা আমরা স্পষ্ট বুঝে নিতে পারি। হয় তাদের বিহারি সংস্কৃতির আধিপত্য মেনে নিতে হবে, নয় তো কলকাতায় চলে আসতে হবে, অথবা ক্রান্তিকারীদের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। ১৯৯৫-এর একটি হিসেব থেকে জানা যায়, বিহারের মোট জনসংখ্যার ১১.২ শতাংশ উচ্চবর্ণের, ২১.২ শাতাংশ পিছড়ে বর্গ, ১৮.৫ শতাংশ তপশিলী জাতি, ৭.৭ শতাংশ তপশিলী উপজাতি, ১৪.১ শতাংশ মুসলমান, সব থেকে পিছিয়ে-পড়া জাতি ২৯.৫ শতাংশ ও অন্যান্যরা ১.৮ শতাংশ। হিন্দিভাষী ৮০ শতাংশ, উর্দুভাষী ৯.৯ শতাংশ, বাংলাভাষী ৩.৫ শতাংশ। ভারতবর্ষে দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন ৪০ শতাংশ মানুষ, বিহারে সেখানে ৫৯ শতাংশ। উচ্চবর্ণের মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণ, ভুমিহার, রাজপুত ও কায়স্হরা। মধ্যবর্ণের মধ্যে যাদব, কৈরি ও কুর্মিদের সংখ্যা সব থেকে বেশি।বর্তমানে ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারাতে যাদবরাই এখন সবথেকে এগিয়ে। ১৯৯০-এর মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট সামনে আসার পর থেকে সত্তা পরিবর্তনের যে-প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল তাতে কুর্মি গোষ্ঠীও শামিল ছিল। কিন্তু ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারাতে অসন্তুষ্ট হয়ে তারা বিরোধী অবস্হানে চলে যায়, যাদের প্রতিনিধি নিতীশ কুমারের সমতা পার্টি। বিহারে জনতা দল সমাজের মধ্যস্তরের সমর্থনেই ক্ষমতায় আসীন।যাদব উথ্থানে কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব কৃষক, ভূমিহীন কৃষক, সাধারণ মধ্যবিত্ত, মেহনতি জনতাসহ আর্থিক দিক দিয়ে সার্বিকভাবে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণীভুক্ত মানুষদের সামনে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছোনোর কোনও সিঁড়িই উন্মোচিত হয়নি। বিহারে যে-কোনও জাতের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণীতে অবস্হান করলেই শোষণ, সামাজিক অন্যায় ও অত্যাচারের শিকার হন। উচ্চবর্ণের স্বার্থ অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থে ধাক্কা লাগলেই জাতপাতের দ্বন্দ্ব হিংস্র দাঁত-নখ প্রকাশ করে ফ্যালে প্রকাশ্যে। শ্রেণীস্বার্থ বিঘ্নিত হলে উচ্চবর্ণের মানুষেরা রাষ্ট্র-অর্থ-পেশি ক্ষমতাকে নির্বিচারে প্রয়োগ করে নিম্নবর্ণের মানুষদের হত্যা করে, সমস্ত ধরনের মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে।

পশ্চিমবঙ্গের পরিস্হিতি সেরকম নয় অবশ্যই। রাজনৈতিক  সমাজ ও জনসমাজের ভিতরকার কার্যকারণ -সম্পর্ক বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় বিপরীতধর্মী।বিহারে আজও জাতিদ্বন্দ্বের ভাষা কর্কশ, প্রাক-আধুনিক এবং রাষ্ট্রকে সে-ভাষা আগে নিজের ভাষায় অনুবাদ করে নিয়ে তবে কাজ করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে সুশৃঙ্খল-আধুনিক রাষ্ট্র এটাকে বদলে দিয়ে সমাজ ও গোষ্ঠীর স্বাধীনতার এক্তিয়ারকে খর্ব করে দিয়েছে। এখানে উচ্চবর্ণ, মধ্যবর্ণ ও তপশিলীরা সবাই রাষ্ট্রের ভাষাতেই কথা বলে। আধুনিক কথোপকথনের ক্ষেত্রে প্রধান সোপান হল আধুনিক শিক্ষা। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা একসঙ্গে তিনটি উদ্দেশ্য সাধন করছে:  ১) জীবিকাগত সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে; ২)আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্হার মুখোমুখি হয়ে প্রতিষ্ঠা বা সুবিধাজনক অবস্হান তৈরিতে; ৩) গ্রামসমাজে ক্ষমতালাভ করতে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার সাহায্যে সমাজে কর্তৃত্বের ভূমিকা অর্জন করার গুরুত্ব অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। সেটা বোঝা যায় এটা দেখে যে, অন্যান্য রাজ্যে অব্রাহ্মণ বা 'পশ্চাদপদ'-রা কর্তৃত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকার জন্য ব্রাহ্মণদের রীতি ও আচারকে অনুকরণ করতে চায়। এই প্রবণতা আর.এস.এস. ও বিজেপির মধ্য ও নিম্ন বর্গের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে প্রবলভাবে দৃশ্যমান।পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের সংস্কৃতায়নের প্রভাব প্রায় নেই , এবং তার পাশাপাশি আবার উগ্র পাশ্চাত্য জীবনযাপনের মানসিকতাও বাঙালি সমাজে নিন্দনীয়। তাই সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা এখানে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষার সূত্র ধরেই পশ্চিমবঙ্গের নতুন পঞ্চায়ের ব্যবস্হা ও রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রের অসংখ্য আঙুলের মতো ছড়িয়ে থেকে জনসমাজের ওপর রাজনৈতিক সমাজের মতাদর্শগত আধিপত্যকে নিশ্চিত করেছে। তার ফলেই উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ ও মধ্যবর্ণ--- সবাই অতি সহজেই রাষ্ট্রকে গ্রহণ করে। সব বর্ণের সব প্রতিবাদ-পদ্ধতি ও জাত-বিদ্বেষ রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সীমার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। শিক্ষা ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ-তাঁবেদারির সূত্র ধরে ক্ষমতাবৃদ্ধির বিষয়ে বিভিন্ন জাতির মানুষ মনোযোগী হয়ে উঠেছে। তার ফলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ক্রমশ ভোটব্যাংক হিসেবে নিজেদের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে। তাই তাদের রাজণেতিক সক্রিয়তার সঙ্গে তাদের জাতিসত্ত্বার সম্পর্ক ক্রমাগত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ১৯৭৭-এর পর, পশ্চিমবঙ্গে ভূমিসংস্কার ও চাষের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তিকে সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগের পরিণতিতে অনেক স্বয়ম্ভর মাঝারি চাষিই অবস্হাপন্ন জোতদারে পরিণত হয়ে গ্রামীণ রাজনীতির কেন্দ্রস্হলে এসে দাঁড়িয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত আইন মেনেই একজন মানুষ যে পরিমাণ জমি নিজের হাতে রাখতে পারেন, তার ভিত্তিতে তাঁকে জোতদার বলা যায়। লক্ষ করবার বিষয়--- বিত্তশালী, প্রভাবশালী মাঝাতি চাষিদের এই নতুন শ্রেণিটির অধিকাংশই মধ্যশ্রেণি বা জাতির সদস্য। তার পাশাপাশি এটাও লক্ষ করবার বিষয় যে এরা যেসব মজুর ভাড়া করেন তাদের মধ্যে উচ্চ বা মধ্যবর্ণের কাউকে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। নতুন ক্ষমতাবান এই মধ্যবর্ণের মানুষদের আয়ের প্রধান উৎস অবশ্যই কৃষি, ব্যবসা ও শিল্প উদ্যোগ।তাঁদের একটি অংশ আবার শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাদের প্রকাশক্ষমতা উচ্চ মানের।পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রতিনিধি আছে। মনে রাখার কথা, ১৯৭৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বিভিন্ন স্তরে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ও নির্বাচনের পরে কর্মমর্তা নির্বাচনের সময়ে নিম্নবর্ণের মানুষদের মর্যাদাপূর্ণ অনুপ্রবেশ ও প্রতিনিধিত্ব যে-আলোড়ন তুলেছিল তা এখন স্তিমিত। পঞ্চায়েতের সূত্রে রাজনৈতিক সমাজ যতই জনসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে, 'জ্ঞান' ততই 'ক্ষমতা'র উৎস হিসেবে আরও বেশি-বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জ্ঞানের অভাবেই নিম্নবর্ণকে ১৯৭৮-এর পর আবার ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।অন্যদিকে জ্ঞানের সূত্রেই মধ্যবর্ণ ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এসেছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিকাল কলেজ, গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, উচ্চবর্ণের তুলনায় মধ্যবর্ণের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এখন অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই, ১৯৯০তে মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যে-ব্যাপক জাতি-ভিত্তিক আন্দোলন দেখা গিয়েছিল, তার কোনো প্রভাবই পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। মধ্যবর্ণের উথ্থান আগেই ঘটে গেছে। তবে সবটাই ঘটেছে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিয়ে, রাষ্ট্রের ভাষাকে স্বীকার করে নিয়ে, জনসমাজের ওপর রাজনৈতিক সমাজের নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার করে নিয়ে।

বদলি হয়ে কলকাতায় চলে আসার পর অরিন্দমের সঙ্গে যোগাযোগ হব তার প্রাক্তন সহকর্মী কয়েন এগজামিনার ও বর্তমান কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টার আদিত্যর সঙ্গে। আদিত্যের সূত্রে মলয়ের মন্তব্য: 'চাকরির এই ক'বছরেই সরকারি অভিজ্ঞতা ওকে মনুষ্যজনোচিত যুক্তিবাদীতে পালটে ফেলেছে।এরকম হলেই বোধ হয় একজন লোক মানুষ থেকে মানব হয়ে যায়। মানবসন্তান। কলকাতা শহরটা দেশভাগের পর মানব উৎপাদনের কারখানা হয়ে গেছে।' ( জলাঞ্জলি পৃ ৫ )।'মনুষ্যজনোচিত যুক্তিবাদী' হয়ে ওঠার সূত্রে 'মানুষ' 'মানব' হয়ে যায় --- এই রূপকের মাধ্যমে মলয় স্বাধীনতার পরে কলকাতা ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে 'আধুনিকতা'র বিস্তারের দিকে ও তার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতে চেয়েছেন। এই অঞ্চলে মানুষের চৈতন্যে শাসকশ্রেণির মতাদর্শগত আধিপত্য ্তটাই প্রবল যে, আদিত্যর 'আদর্শ রুণু গুহনিয়োগী নামে আক প্রাক্তন অফিসার' 'জ্যোতি বসুর মতন কর্মজীবী মুখ্যমন্ত্রী ওব্দি রুণু স্যারের কদর করে পদোন্নতির ধাপ একের পর এক এগিয়ে দিয়েছিলেন ওনার দিকে।'  (নামগন্ধ ৫ )। 'এ এস আই-এর চাকরিটা ধর্মঠাকুরের পাঠানো। টাকাও আপনা থেকে আসা শুরু করেছে। ধর্মরাজের কৃপায় একদিন না একদিন রুণু গুহনিয়োগীর মতন প্রভাব প্রতিপত্তি লোকবল ঐশ্বর্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর গণমাধ্যমের আদরযত্ন পাবে। বাসের সিটে বসে হাতজোড় করে আদিত্য। কপালে ঠেকায়।' (নামগন্ধ ৮-৯)।

কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যবিত্ত চৈতন্যের সামগ্রিক পণ্যায়নের প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে আদিত্যর ভাবনাকে বোঝা যাবে না। আদিত্যর ভাবনা শুধু একজন পুলিশ কর্মীর ভাবনা নয়। অর্থ ও ক্ষমতার প্রতি এই আকাঙ্খা প্রায় সব পেশার মানুষদের মধ্যেই সংক্রামিত হয়েছে। নৈতিকতার মানও সেই স্তরেই এসে ঠেকেছে। কলকাতা সত্যই মানব উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে-দিতে অরিন্দম, আদিত্য আর যিশু বিশ্বাসে আলোচনায় দেশভাগ, উদ্বাস্তু আন্দোলন, ট্রাম আন্দোলন, আর এই দুই আন্দোলনের নেতা ভবেশ মন্ডলের কথার মধ্যেই স্বচ্ছন্দে রাইটার্স বিল্ডিংএর সুশ্রী কিশোরী চা-উলির সঙ্গে যিশুর যৌন সম্পর্কের প্রশ্ন এসে যায়। 'হত্যা আর মৃত্যু থেকে যৌনতার এলাকায় খেলাচ্ছলে পৌঁছে উপশম হল অরিন্দমের।' আধুনিকতা মানুষকে প্রকৃতি থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে সংস্কৃতিবান বানিয়ে ফেলবার পর তাকে নির্মমতার ওপারে অন্য কোনও মমতাহীনতায় পৌঁছে দিয়েছে। স্পষ্টই টের পাওয়া যাচ্ছে যে আদিত্য পোঁছে গেছে সে জায়গায়। কত সহজে খুনের আতঙ্ক থেকে নিজেকে যৌনতার আমোদে নিয়ে এল।' মিডিয়ার মেসেজও এভাবেই মানুষকে হিংস্রতায় দোলাতে-দোলাতে বিনোদনের জগতে ডুবিয়ে দেয়। ধনতন্ত্র যতই মানুষকে সাম্প্রতিকতম তথ্য-প্রযুক্তির স্রোতে ভাসিয়ে দেয়, বিনোদনের আমোদে ডুবিয়ে দেয়--- সে ততই সমসাময়িকে বাঁচতে শুরু করে, ইতিহাসবোধ হারাতে শুরু করে। এলিয়নেশন ও রিইফিকেশনের বোধ সামাজিক উৎপাদনের ভাবনা থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যায়।পণ্যমোহের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণির রূপান্তর এইসব দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবনাকে সত্য বলে প্রমাণ করেছে। প্র্যাগমাটিজমই এখন গৃহীত মতাদর্শ। সততার মুখোশকে বাঁচিয়ে রাখার সফল কৌশলেরই অন্য নাম সংস্কৃতি। সংস্কৃতিবান প্র্যাগমাটিকরাই এখন কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের মানব।

অরিন্দম যখন কেটলিউলিকে বলে, 'তোমায় আমি বিয়ে করতে চাই', তখন তার জবাবে কেটলিউলি বলে, 'কুটো দিনের জন্য ?' অরিন্দম বোঝে: 'কেটলিউলির মেরুতে বার্তা পৌঁছাবার ভাষা ওর কাছে নেই। হিন্দি আর বাংলা সিনেমা কেটলিউলির কাছে প্রেম-ভালোবাসাকে হাস্যকর আর ফালতু করে দিয়ে থাকবে। প্রেমের সমস্ত অভিব্যক্তিকে ফোঁপরা করে দিয়েছে আধুনিকতা।' (নামগন্ধ ৭১)।পাটনায় পাশের ফ্ল্যাটের সাত বছরের বড় পীনোন্নত মহিলার সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ হওয়া ও তারপরে পাগল হয়ে যাওয়া অরিন্দমের কেটলিউলি সম্পর্কে মনে হয়েছিল, 'মেয়েটির শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন, মনে হচ্ছিল অরিন্দমের। চিরপ্রদোষ মাখা শ্যামাঙ্গিনী।...এর প্রাণশক্তির জোরের বখরাটুকু আজীবন চায়, আজীবন চায় অরিন্দম।' (নামগন্ধ ৮১)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবেও কেন্দ্র আর প্রান্ত মিলতে পারে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মীর সঙ্গে কেটলিউলির মিলনের আগেই মারোয়াড়ি হলদিরামের গাড়ির সঙ্গে অরিন্দমের গাড়ির সংঘর্ষে তাদের মৃত্যু হয়। তখন যিশু বিশ্বাসের প্রশ্ন গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠৈ: 'যৌনসম্পর্কের শ্রেণীবিভাজন কি সত্যিই মেটানো যায় ?'

যিশু বিশ্বাসের এই প্রশ্ন তার নিজের জীবনেই আবার ফিরে আসে 'নামগন্ধ'-র শেষে। দেশভাগের পরিণতিতে ভবেশ মন্ডল তার ছোট বোন খুশিরানী মন্ডলকে নিয়ে চলে এসেছিল পূর্ববঙ্গ থেকে নাকতলায় যিশু বিশ্বাসের পাড়ায়। তারপরে ইউ সি আর সি, ট্রাম আন্দোলন, উদ্বাস্তু আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মী ভবেশ হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায় তার বোনকে নিয়ে। খ্রিস্টান যিশু এম বি এ ডিগ্রি নিয়ে, ব্রিফকেসে ল্যাপটপ নিয়ে, পার্ক স্ট্রিটে কনসালটেনসি ফার্ম খুলে, পেশাগত কারণে হুগলির গ্রামে ঘুরতে-ঘুরতে তিরিশ বছর পরে ভবেশ ও খুশিকে আবিষ্কার করে। 'মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর এক লাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন হিমঘরের অংশিদার পঁয়ষট্টি বছরের গেরুয়া পোশাক, বাঁহাতের সরু-সরি আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে থাকে ধবধবে দাড়ি, কালো ফ্রেম গ্রাম্য বাইফোকাল, বাবরিচুল ভবেশ মন্ডলকে হুগলি জেলার এই প্রত্যন্ত গ্রামে দেখে যতটা স্তম্ভিত হয়েছিল, তার চেয়ে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছিল যিশুর ভবেশকার বোন খুশিদিকে দেখে।' (নামগন্ধ ১৩ )। 'তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাঁচে কংরেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলোনের দিনগুলোয় তুলকালাম করেছিল ভবেশকা।...আর আজ হিমঘরের অংশিদার ভবেশকা, সংরক্ষণের ক্ষমতার দ্বিগুণ আলু ঢুকিয়ে, দু'লাখ কুইন্টাল পচিয়ে, সেই একই হুগলি জেলার চাষিদের ভয়ংকর বিপদে ফেলেও নির্বিকার।' (নামগন্ধ ১৩)। পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে খুশিরানীর। এখন পর্যন্ত যত জন তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, তাদের কেউ খুন হয়েছে, কেউ জ্যান্ত পুড়ে মারা গেছে। 'আমি খুব অপয়া'। খুশি আসলে পূর্ববঙ্গের মিনহাজুদ্দীন খানের নাতনি খুশবু। ভবেশ দেশ ছাড়ার আগে তাকে শৈশবে তুলে নিয়ে আসে। এদেশে এসে পরিচয় দেয় সৎবোন বলে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পুরোনো খবরের কাগজে খুশির দাদুর দেয়া বিজ্ঞাপনের সূত্রে যিশু একথা জানলেও খুশি জানে না। তাই তার সঙ্গে যারই বিয়ে ঠিক হয়--- তার কেন অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, তা বোঝে না। খুশির বন্দিত্ব, অসহায়তা, সরলতা ও নারীত্বের যন্ত্রণাকে বাঁচিয়ে রেখে ভবেশ মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর তার আক্রোশ মেটায় কি ?

গ্রামের ক্ষমতার নতুন অধিকারী মধ্যবর্ণের সঙ্গে ১৯৬০-এর দশক থেকে বাম রাজনীতির সম্পর্ক ঘনিষ্ট। কিন্তু তিরিশ বছর পরে ভবেশের সিন্দুক থেকে যিশু আবিষ্কার করে: 'আলুর বন্ডের বই, পাকিস্তানের পুরোনি একশো টাকরা একটা বান্ডিল, পঞ্চাশ সনের হলদে খড়খড়ে পাকিস্তান অবজার্ভার আর দৈনিক আজাদ, দুটো একই মাসের। একটায় ছবিসুদ্ধ বিজ্ঞাপন, লাল কালিতে ঘেরা। লাল শালুর পাক খুলে শতচ্ছিন্ন বইটা, গীতা নয়, লুপ্ত সোভিয়েত দেশে ছাপানো দাস ক্যাপিটাল...।' (নামগন্ধ ১৭)। এই আবিষ্কারের সূত্রে খুশি ও ভবেশের অতীত ও বর্তমান উন্মোচিত হয়।মার্কসের ক্যাপিটাল লাল শালুতে আবৃত হয়ে সিন্দুকে চলে যায়, ও তুলে-আনা মুসলিম নারীকে বন্দি রাখার সূত্রে মুসলিম সমাজের প্রতি পুষে-রাখা ক্রোধের নিবৃত্তি ঘটানো হয়। এই মজতাদর্শগত ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১৯৯৯-তে প্রকাশিত এই উপন্যাসের ভবেশ মন্ডল যদি কোনও সামান্যতম ক্ষতির আশঙ্কাতেই ২০০০-এ বামপন্থী শিবির থেকে দক্ষিণপন্থী শিবিরে চলে যায়--- তাহলে তো অবাক হবার কিছু থাকে না। ১৯৭৭-এর পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে-আসা গ্রামের মধ্যবর্ণের মানুষদের মতাদর্শগত অবস্হান কেমন ? তপশীলী জাতি ও উপজাতির মানুষদের সামনে এমন কোনও চওড়া সিঁড়ি এখনও নির্মিত হয়েছে কি--- যার মধ্যে দিয়ে তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছতে পারে ? এই প্রশ্ন দুটির সঙ্গেই সম্পর্কিত থাকে খুশির এই আকাঙ্খা: 'খুশিদি ফিরে যেতে থাকে তিরিশ বছর অতীতের প্রতিবেশী তরুণের শ্রেণি-নিষিদ্ধ সম্পর্কে, অপ্রত্যাবর্তনীয় সময়ে।' খুশো ও যিশু দুজনাই তো এখন প্রৌঢ়। তবুও তারা মিলতে পারে না--- কেন্দ্র ও প্রান্ত মিলতে পারে না বলেই। খুশিকে নিয়ে পালাবার মুহূর্তে যিশু ডাকাত সনগদেহে গণধোলাইতে খুন হয়।

মলয় রায়চৌধুরী তাঁর উপন্যাস তিনটিতে ইউরোপীয় কোডগুলোকে ভাঙতে-ভাঙতে যে আখ্যান নির্মাণ করেছেন--- তাতে তিনি গভীর ভাবে বুঝতে চেয়েছেন তাঁর স্বদেশ ও স্বকালে মানুষের অভিজ্ঞানকে।তাঁর স্বদেশের মানুষেরা নির্মিত হয়ে উঠেছে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার পরিণতি হিসেবে। প্রতিটি মানুষের চৈতন্যে ধৃত রয়েছে অসংখ্য উপাদান। এই সব উপাদানের কিছি প্রাকঔপনিবেশিক, কিছু ঔপনিবেশিক আবার কিছু উপনিবেশিকোত্তর চরিত্রের। মলয়ের সমালোচনার লক্ষ্য চৈতন্যের ঔপনিবেশিকিকরণের প্রক্রিয়াকে চিহ্ণিত করা, ঔপনিবেশিক বীক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করা। উপন্যাস তিনটিতে একই চরিত্রেরা অনেক সময়েই ফিরে আসে, আবার অনেক চরিত্র একবার দেখা দিয়েই হারিয়ে যায়। উপন্যাস তিনটিতে ঔপনিবেশিক সংস্কারকে মেনে নিয়ে একটি চরিত্রকে নায়ক বানিয়ে, একক কন্ঠস্বরের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করে, প্রথাগত ট্রিলজি লিখবার প্রয়াস নেই। যদিও তা করবার সুযোগ অবশ্যই ছিল।অরিন্দমকে মাঝখানে রেখে তা করাই যেত। কিন্তু মলয় সচেতনভাবে এই ঔপনিবেশিক আদরাকে ভেঙে কন্ঠস্বরের প্রাচুর্যের সূত্রে নতুন ধরনের দ্বিবাচনিকতার জন্ম দিয়েছেন। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সমাজ ও জনসমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিন্নতাকে মলয় যেভাবে উন্মোচন করেছেন তা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে ইতিহাসের একরৈখিকতাকে অপ্রমাণ করেছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসই যদি একরৈখিক না হয়, তাহলে বিশ্ব ইতিহাসের একরৈখিকতাকেও প্রমাণ করা যায় না। তাহলে ঔপনিবেশিক শাসনের যথার্থতাকেও প্রমাণ করা যায় না। আর তা যদি করা না যায়, তাহলে তৃতীয় বিশ্বের নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব ও নন্দনতত্ত্বের প্রয়োজনও অস্বীকার করা যায় না।

যাঁরা মনে করেন ইউরোপ ইতিহাস নির্মাণ করে ও তৃতীয় বিশ্ব হচ্ছে ইতিহাসের কাঁচামাল, মলয়ের উপন্যাস তিনটি তাঁদের ধারনার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। মলয় দেখান ভারতবর্ষ মানেই উচ্ছিষ্ট-উপনিবেশ নয়, বিশৃঙ্খল-গরিব-হাঘরে-অলস-ট্রাইবাল নয়। তা দেখাতে গিয়ে মলয়কে নির্মাণ করে নিতে হয়েছে এক নিজস্ব ভাষাকাঠামো যা তিনটি উপন্যাসে একইরকম নয়। ভারতীয় বাস্তবে বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্নতা এই ভাষাকাঠামোর ভিন্নতাকে অনিবার্য করে তোলে না কী ? শাসকশ্রেণি তার মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেই তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনিবার্য হয়ে উঠে আসে প্রতিরোধের ভাষা--- বিকল্প সন্দর্ভ। মলয়ের তিনটি উপন্যাস জুড়ে এই সন্দর্ভের পার্ধক্য সম্পর্কে বারবার সচেতন করা হয়েছে পাঠককে। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবে, ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভ নির্মাণে, তার জন্য ভিন্ন-ভিন্ন আখ্যান কৌশল অবলম্বন করেছেন মলয়। আবৃত্তিকার, সংবাদ পাঠক-পাঠিকা, এফ এম তরঙ্গের অনুষ্ঠানে সঞ্চালকদের কৃত্রিম উচ্চারণ বাংলা ভাষায়, বিভিন্ন অঞ্চলের, উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য, সূক্ষ্মতা, সৌকর্যকে যেভাবে বিনষ্ট করেছে, তার বিরুদ্ধে মলয়ের উপন্যাস তিনটিতে সচেতনভাবে প্রতিরোধ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়--- সচেতন ভাষাগত নির্মাণের সূত্রে। আর এই নির্মাণের সূত্রেই মলয় পাশ্চাত্য মানদন্ডের বাইরে চলে আসার প্রয়াস পান। আমাদের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠানগুলো ধারাবাহিকভাবে পাশ্চাত্য মানদন্ডগুলোকেই

একমাত্র মানদন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছে মহাসন্দর্ভের সাহায্যে। মলয়ের উপন্যাস তিনটিতে তাই বারবার প্রান্তে দাঁড়িয়ে জনসমাজের গভীরে প্রবেশের চেষ্টা চালাতে-চালাতে, প্রতিষ্ঠান-স্বীকৃত মানদন্ডগুলোকে প্রত্যাখ্যানের প্রয়াস খুঁজে পাওয়া কষ্টকর নয়। আর এই প্রয়াসকে বাদ দেওয়া মলয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যে কোনও সৎ শিল্পীর মতো মলয়ও তাঁর বাস্তবের স্বদেশে সংখ্যালঘু, বিপর্যস্ত। তাই তাঁর কল্পিত স্বদেশে তিনি বার বার অতিক্রম করে যেতে চান কেন্দ্র ও প্রান্তের অলঙ্ঘনীয় দূরত্বকে।ঔপনিবেশিকতা-মুক্ত জনসমাজই মলয়ের শেষ আশ্রয় বলেই 'নামগন্ধ' উপন্যাসের শেষে খুশিরানী মন্ডলের শেষ গন্তব্যের হদিশ তিনি দেন না। তিনি জানেন খুশিরানীকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় অনুসন্ধান করতে হবে, নির্মাণ করতে হবে তার স্বদেশের ইতিহাসকে, তার আত্মপরিচয়কে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন