হত্যাকাণ্ড

ত্রিদিব মিত্র

আমাকে বারবার জীবন থেকে হড়কে জীবনের ফঁদাই পড়তে হচ্ছে

মৃত্যু কেবলই কেবলই প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে

চারটে বাঘ আর তিনটে বুনো শুয়োরের

ধ্বস্তাধস্তি চলছে আবছা জ্যোৎস্নায়

আমার মিথ্যে জিভ থেকেই সত্যের চ্যালেঞ্জ ফঁড়ে

ঝলসা দিচ্ছে মানু-বাচ্চাদের

তাদের কান্না শুনে বধির হয়ে যাচ্ছে আমার কান

আনন্দে সাততলা অব্দি লাফিয়ে উঠছে আমার জিভ

প্রেমিকার কষ্ট দেখে আনন্দে কঁদে উঠেছিলাম আমি

চুমু খেতে গিয়ে আলজিভ শুকিয়ে আসছে আমার

চারিদিকের ভিজে স্যাঁতসেতে অন্ধকার থেকে

আমি দানব না যিশুকৃষ্ট বুঝতে না পেরে

রেস্তঁরায় ভিড় করছে মেয়েমানুষেরা

আজ আর কোনো রাস্তা খঁজে পাচ্ছে না কেউ সরলভাবে হাঁটবার

সব রাস্তাই লুটিয়ে থাকে

সব পাপোষের তলায় গড়িয়ে যায় ধুলোর ঝড়

সব জীবনের মথ্যেই ভয়ংকর কাঁপানো অর্থহীনতা শূন্যতা

আঃ মৃত্যু বাঞ্চোৎ মৃত্যু

অপমৃত্যুও ফেরার হয়ে পালাচ্ছে আমার ভয়া

কেননা আমি বুঝে গেছি মৃত্যুর দমবন্ধ ভান

কেননা আমি মৃত্যুর কাছে গিয়েছিলাম সরল চোখে

ভয়ে কঁচকে গিয়েছিল তার চোখ

অন্ধ চোখে কঁদে উঠেছিল মাথা নিচূ করে

এবং খালি হাতে নির্জন রোদে ফিরতে হল আমাকে জটিল চোখে

নিজেকে নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে পারছি না আর

আমার নপুংসকতা দেখে তুমি হেসে উঠেছিলে-আমার ভালবাসা

ভয় আর ভালবাসার মধ্যে শুয়ে তুমি ফিরে গেলে ভয়ের কাছে

বঁচার তাগিদে তুমি ফিরে এলে মগজের কাছ-বরাবর

ফালতু মগজের জ্যামিতিক অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি বিশৃঙ্খলায়

সভ্যকে ঘৃণা করেও লুকিয়ে রইলে সভ্যতার কলকব্জায়

বদহজম থেকে তৈরি হল আমার বদরাগ

সমাজের ভুল চেতনা থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলাম শূন্যের বেতারে

টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে রোজ তিন কোটি চুমু

এপার-ওপার করছে পৃথিবীময়

রেলের মোটা তার বেয়ে উড়ে যাচ্ছে ৭৪ কোটি মাছি

আমার শরীরের চারিদিকে অসংখ্য 'টোপ'

নিজেকে ঝাঁঝরা করে জীবনের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে

খেলতে চাইলাম চাতুরী

তোমার প্রতারণা থেকে ভালবাসা আলাদা করতে পারছি না একদম

আমি ভাবছি আমাদের প্রথম অভিসম্পাতের কথা

আমি ভাবছি আমাদের শেষ চুম্বনের কথা

আমার দিব্যজ্যোতি আমার আম্ধকার

আমার চারধারে বেইজ্জতি আর বেলেল্লাপনা বারবার

চলছে মানুষের

আমি বুঝতে পারছি মানুষ মানুষকে ভালবাসতে পারছে না

....মানুষ মানুষকে কোনোদিনই ভালবাসেনি

উঁচু বাড়ির মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ছে হৃদয়সুদ্ধ লাশ

আমি দেখতে পাচ্ছি প্রয়োজন কিরকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আকাশের দিকে

আমার ধর্ম কি মনে করতে পারছি না কোনোদিন বুঝিনি বলে

আমার শিরা থেকে রক্ত ছিনিয়ে নেবে বলে

স্হায়ী-অস্হায়ী যুদ্ধ চলছে মানুষের আগুপিছু

পাঁজর গুঁড়ো করে বেরিয়ে আসছে রজনীগন্ধার ডানা

অ্যালকহলিক রক্তের ফেনা থেকে তৈরি হচ্ছে আঁশটৈ ক্ষুরধার ভালবাসা

আমি ক্রমশ প্রেম থেকে শরীরহীনতায় ভাসছি

প্রেমিকার বেগুনি মুখ জ্বলে উঠছে ফঁসে যাচ্ছে প্রয়োজনমত

অদরকারি কাগজপত্রে ঢেলে দিচ্ছি আমার বর্তমান

কবিতা আমার বুক থেকে শুষে নিচ্ছে আমার আয়ু

আমার ভালবাসা রক্তমাংস থেকে মানুষ তৈরি করছে তাদের ফিচলেমি

অসুস্হ ভালবাসা ফিরিয়ে আনবার জন্য

মনুষ্যযন্ত্রের সঙ্গে হায় তুমিও

আমার সকল উত্তাপ জযো করে তৈরি করলাম লালগোলাপের পালক

ব্যবসায়িক উৎপাদন থেকে কুড়িয়ে নিলে তুমি একমুঠো প্রতারণা

আগুনের হল্কা চুঁড়ে দিলে আমার গায়ে

শিশুর মত হেসে উঠলাম আমি

পুড়ে গেল আমার সমস্ত শরীর

আকাশ ঘঁষে ছুটে গেল আমার ক্রোধ

স্বাধীনতার হাতে হাত রাখতে পারছে না কেউ ভয়ে

ওঃ

আমার আর সবার মাঝখানে গজিয়ে উঠছে একটা সুদীর্ঘ গভীর ফাটল

আমি বুঝতে পারছি আমার দ্বারা কিছুই হবে না

নিজেকেও তেমন করে ভালবাসা হল না আমার

এই এক জন্মেই হাঁপিয়ে উঠছি আমি

এক সঙ্গেই হাসছি আর হাসছি না

ওঃ ক্লান্তি ক্লান্তি - অক্লান্ত আওয়াজ - আঁকাবাঁকা টানেল -

লুপ - পরিসংখ্যান - ক্ষুধা - মহব্বৎ - ঘৃণা -

কেবল বোঝা বয়েই জীবন চলে যায় ১০১% লোকের

আত্মাকে খঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সমস্ত শরীর ছেঁকেও

বিপ্লবউত্তেজনানারীসংঘর্ষহিংস্রতাবন্যনীরবতা নাচছে

আমি একবারও নিজের দিকে তাকাতে পারছি না ফিরে

মানুষের কোনো কাজই করে উঠতে পারলাম না আজ ওব্দি

ফালতু অব্যবহার্য হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছি বমিওঠা চোখে

মগজে চোলাই কারবার চলছে গুপ্ত ক্ষমতার

কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ওরফে আমার ভালবাসা আমার অসহায়তা

মানুষের রক্তাক্ত পেঁজা শরীরের পাহাড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে

অক্ষম আর আঊর্ব স্বাধীনতা

মানুষের ক্ষীণ শরীর বেয়ে শরীর ঘিরে শরীর ধরে চলেছে

অসংখ্য বিশৃঙ্খল শৃঙ্খলা

ওঃ আমি কোনো দিনই ভালবাসতে চাইনি

আঃ..................................আঃ

কলজে গঁড়িয়ে যায় চাপা হিংস্রতায়

বুকের ভেতর ইনজিনের চাপা ক্রোধ

রক্তের উত্তেজনে থেকে তৈরি হচ্ছে বন্যতা

অস্তিত্বহীন আত্মার পায়ে স্বেচ্ছায় প্রণাম রেখেছিল সুবো

তিন মাস জঘন্য নীরবতার পর আঁৎকে উঠে কুঁকড়ে গিয়েছিল প্রদীপ

মানুষের সাহসিকতাকে ভুল করে সন্দেহ করতে শিখেছি

ভুল জেনে ভুল মানুষের সঙ্গে মিশে

আমি চালাক হতে ভুলে যাচ্ছি স্বেচ্ছায়

ভাঁটার সঙ্গে সঙ্গে চতুরতা মূর্খতাও গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে

ত্রিদিবের মুখ ত্রিদিব নিজেই কতদিন চিনতে পারেনি

আদপে সত্য কোনো স্পষ্ট মুখ খঁজে পাচ্ছি না নিজের

"মানুষের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই" বলতে ককিয়ে উঠেছিল

৩৫২ কোটি মানুষ তায় ঐতিহ্য আর পোষা চরিত্রহীনতা

ওঃ অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এখন

কে বা কারা গলা টিপে ধরছে ভুল করে

আমার ।

তাদের অজান্তেই...

(১৯৬৩ সালে শিবপুরের পুরানো বাড়িতে থাকাকালীন রচিত, এবং মলয় রাচৌধুরী সম্পাদিত 'জেব্রা' পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত । )

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন