বিরহী নৈঃশব্দ্য এক

রাজা সরকার


এবারই প্রথম মনে হলো আমরা সব অমেয় অক্ষম মানুষ

আমরা কেউ আর বেঁচে নেই

জীবন থেকে খসে পড়া নষ্ট ফলের মত, কিংবা পরিচয়হীন

শবের মত শুয়ে আছি

কিংবা পথে পথে খণ্ডমাংসের মত গড়িয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই

আমাদের শীত বা গরমবোধ, বিষণ্ণ বৃক্ষের মত অন্ধকারে বিবস্ত্র হয়ে

এবারই প্রথম আমরা মরণোত্তর সব ছবি ও আলপনাগুলো খুঁটিয়ে দেখছি

আমরা কখন কে কোথায় পড়ে থাকছি, কে কোথায় কখন

কোন অদৃশ্য টানে চলে যাচ্ছি,খিন্ন লজ্জাস্থানগুলি নিয়ে বুঝি

এবার আর কোনো লজ্জা নেই আমাদের

এবারই প্রথম মনে হলো আমাদের নিজস্ব ভূগোলগুলো

স্মৃতিশূন্য মৃৎপাত্র বা জলশূন্য আধারের মত করুণ

এবারই মনে হল গণমৃত্যুর পর গণলজ্জার ভাণ্ডার উপুড় হয়ে

ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়, আমরা পোকামাকড়, কীটপতঙ্গের যোজন কলায়

মিশে মিশে গড়িয়ে চলেছি জলে জঙ্গলে মাটিতে পাথরে—


এবারই প্রথম দেখা গেল সকল প্রপঞ্চময় স্থাপত্যগুলো থেকে শাবকেরা

উড়ে গেল ঝাঁকে ঝাঁকে শেষবেলার মায়াবী নীলের দিকে

নিচে পড়ে থাকলো জাদু পুতুলের সংসার, পড়ে থাকলো

বিরহী নৈঃশব্দ্য এক, একা একা ।।



হৃদয়ভ্রূণ

রাজা সরকার

মৃত্যুর গভীরতম সত্যের এই সাগর বিষয়ে অতিকথা দিয়ে তুমি কি

কিছুই আর ঢেকে রাখতে পারো !

না, এই নিষ্করুণ সাগর তটে কতিপয় নারী পুরুষের

নির্বোধ আনন্দের এই বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢাকতে পারো শবাধার!

মহাজীবন নামের অতিরঞ্জন মাখিয়ে অসভ্য খড়গ ঘোরে মাথার উপর

আত্মগোপন ফালা ফালা করে

গর্ভমাটি খুঁড়ে তুলে নেয়া হয়েছে শিকড়শুদ্ধ হৃদয়ভ্রূণ

একটি কবিতা লেখার আয়োজন, একটি নরম আত্মার ক্ষীণ স্বর

কান পেতে শোনার জন্য আমরা ঘুমিয়ে আছি

ঘুমিয়ে আছি এক না-শরীরের শিরা উপশিরায়

ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার আগে, ভাষার কাছে সনির্বন্ধ থেকে

একটি চিঠির মুসাবিদা করে আমরা রাতটুকু কাটিয়ে দিতে

শুধু জড়িয়ে রয়েছি একে অপরের বিষন্নতায়—।।



কফিনপাখি

রাজা সরকার

স্বর্গলাভ বা পুনর্জন্মের ভাবনাগুলো কাগজে লেখা থাকলো

বিশ্বাস করো সঙ্গে কিছুই নিই নি

খণ্ড খণ্ড তো হয়েই আছি, আর কেন


মাথার উপর পাক খায় কফিনপাখির ডানা

আমায় আঁকশি দিয়ে আর টেনো না, খানিক বরফ দাও

আমায় রেলের চাকার সঙ্গে বেঁধে ঘুম পাড়াও


অন্তরজ্বালা তো থাকেই,গল্প হয়ে যাওয়া কথাগুলো রইল

বস্তাবন্দী দেহতরীও রইল, রইল না শুধু কাম ক্রোধ লজ্জা

বরফের বাক্সে এবার দমবন্ধ করে দাও , একটু পাশ ফিরি।।



তুমি কি অন্ধকার চেনো?

রাজা সরকার


তুমি কি অন্ধকার চেনো? অন্ধকারের গায়ে হাত রেখে বোঝো তার

তাপমাত্রা ? অন্ধকার হাতড়ে কি তুমি বুঝতে পারো কোনটা অশ্রু,

কোনটা রক্ত?


অন্ধকার থেকে অন্ধকারের দিকেই তো যাও দেখি, আর ভুল করে

আলো ভেবে চুম্বন করো উদ্ভাসিত করোটির কপাল—-হয়তো

এটাই তোমার সত্যার্থ, হয়তো সত্যার্থ ও ভুল এক নয় কখনো।


গভীরতা শব্দটি আসলেই একটি পরিমাপের গল্প, বিভ্রান্ত হলে

আশ্লেষের গভীরতা দিয়ে মাপতে যাও প্রেতের সংলাপ, কিংবা

নিষিদ্ধ কথার সন্ধানে যাও হাড়গোড়ের জঙ্গল পার হয়ে, যাও

অলৌকিক ঘাসের শয্যা মাড়িয়ে—


কোথায় যাও, বীজ থেকে তো সরেই গেছ তুমি , যাও নি কি—-

অব্যর্থতা ছিল কি তোমার , শিকড়ের উন্মূল বিরহে ঘুমিয়ে পড়া

কাটাদেশ কি তোমারই ছিল ? আঁচলে মুখ ঢাকা কেন তোমার—


তুমি কি কারোর অপেক্ষায় আছো পারুল?


০৬.০৩.২০


মৃত্যু-ভয় দেখিও না, মৃত্যুকে যথার্থই ভয় পাই

মৃতসঞ্জীবনীর সন্ধানে আসিনি,এসেছি চিহ্ন খুঁজতে

পায়ের ছাপ খুঁজতে, এসেছি লুকিয়ে রাখা তোমার

বিগত শতকের লেখা চিঠির বাক্স খুঁজতে ।


মৃত্যু-ভয় দেখিও না,বহ্নুউৎসবেই তো দেখেছি তাকে

দেখেছি অনেক বৃত্ত রহস্যের ছাই হয়ে যাওয়া, কিংবা

অনেক সরলরেখার ভেতর দু’একটা কৌণিক আতরদানের

মৃত্যু-ভয়ে কেমন নিঃস্ব হয়ে যাওয়া !




১টি অকথ্য ইস্তাহার।

রাজা সরকার।


লেখা যখন শেষ কথা

লেখা যখন অরূপ কথার অশেষ কথা

লেখা যখন না-বলা কথা

লেখা যখন হ্যাঁ-বলা কথা

লেখা যখন মিথ্যার আড়াল

লেখা যখন অসত্যের ফলা

লেখা যখন ম্যাজিক অথবা না-ম্যাজিক

লেখা যখন সন্দেহের চোখ—–


লেখা যখন না-লেখা

লেখা যখন না-লেখা এক বিন্দু হত্যাপ্রকল্পের বিসর্গ

লেখা যখন না-লেখা ঝরে পড়া এক বিন্দু অশিষ্ট রক্ত

লেখা যখন সতত নাড়িকাটা বিচ্ছেদ

লেখা যখন বিয়োগে বিশ্বাসী

লেখা যখন প্রতিপলে ভেঙে যাওয়া বিস্তার

লেখা যখন রহস্য বিনাশী

লেখা যখন নৈরাজ্যের সমুদ্র

লেখা যখন অবাস্তব

লেখা যখন জৈব সমুদ্রের তলদেশে বাস করা ভ্রূণ

লেখা যখন সতত জন্মমুখর জরায়ুগত অবাধ্যতা

লেখা যখন ক্ষুরের প্রেম ও অপ্রেম

লেখা যখন হারিয়ে যাওয়া নদীর সন্ধান

লেখা তখন অকথ্য অকথ্য অকথ্য অকথ্য ও অকথ্য।।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন