মলয় রায়চৌধুরী ও পশ্চিমবাংলার পচনরত কালখণ্ড
নয়নিমা বসু
পশ্চিমবাংলার দেশভাগোত্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন কালখণ্ড এক নতুন প্রতিবাদী সাহিত্যের জন্ম দিয়েছিল । মলয় রায়চৌধুরী যিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টাদের অন্যতম তিনি পঞ্চাশ বছর পর আমার সঙ্গে এই আন্দোলনের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করলেন ।
“একটি সংস্কৃতির অবসানের সময়ে সেই সমাজের মানুষ যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে”, মুম্বাইয়ের কাণ্ডিভালির একঘরের ফ্ল্যাটে বসে চিন্তারত মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “আজকে যখন পশ্চিমবাংলার দিকে পেছন ফিরে তাকাই তখন হাংরি আন্দোলনের পূর্বাশঙ্কাকে ভবিষ্যবাণীর মতন মনে হয়।”
মলয় রায়চৌধুরী, এখন ৭২ বছর বয়স, যিনি প্রথম থেকেই ছিলেন প্রতিবাদী সাহিত্যিক, নভেম্বর ১৯৬১ সালে আভাঁগার্দ সাহিত্য আন্দোলন হাংরি জেনারেশন আরম্ভ করেছিলেন । সেই আন্দোলন সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং ভদ্রলোক বঙ্গ সমাজের কটু সমালোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল । হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের প্রথাবাহিত মৌল তর্কবিন্দুগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল ।
সেই সময়ে কলকাতা, যাকে তখন বলা হতো ক্যালকাটা, অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। দেশভাগের সর্বনাশা কারণে উৎখাত মানুষদের ভয়াবহ স্রোত বদলে দিচ্ছিল কলকাতা শহর ও তার আশেপাশের শহরতলি অঞ্চলকে । দেশভাগের আগে থেকেই আতঙ্কিত মানুষেরা পশ্চিমবাংলায় আসা আরম্ভ করেছিল এবং তা ষাটের দশকে এবং তার পরেও বহুকাল বজায় ছিল । ১৯৫৯ পর্যন্ত বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে গিয়েছিল, এমনকি ভিটে ছাড়ার সময়ে খুন হয়েছিল । যুবসমাজের একটা অংশ এই সর্বনাশকে সহ্য করতে অপারগ ছিল । তাদের মনে হয়েছিল যে ভারতের কংগ্রেস পার্টির নেতারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা পরিণত হয়েছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে । নিজেদের ক্রোধকে প্রকাশ করার জন্য কয়েকজন তরুণ আরম্ভ করলেন হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলন, যা হাংরি জেনারেশন নামে খ্যাত ।
সাক্ষাৎকারে মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “১৯৫৯-৬০ সালের পশ্চিমবঙ্গ পৌঁছে গিয়েছিল পচনের টকে যাওয়া কালখণ্ডে ; আমার বয়সী যুবকেরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এই সময়ে সমাজের প্রভাবশালী ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছিল বুদ্ধিজীবীদের, যে ক্ষমতাবিন্যাস ততদিনে দখল করে নিয়েছিল রাজনীতিকদের দল, যারা বেশির ভাগই ছিল কানা গলির ব্যক্তিএকক । পশ্চিমবাংলাকে ছেয়ে ফেলেছিল পার্টিশানের ঝোড়ো তরঙ্গ । আমার মানসিক অবস্হা কবিতা লেখার পরিবর্তে এই পচনের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল । ফলে আমরা পরামর্শ করে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করতে বাধ্য হলুম ।”
মলয় রায়চৌধুরী এই আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী এবং আরও দু’জন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়ের সঙ্গে । তিনি ‘হাংরি’ ধারনা পেয়েছিলেন মধ্যযুগের ইংরাজ কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ পঙক্তি থেকে । এই চারজন বাঙালি কবি মিলে হাংরি বুলেটিন ও ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করতে লাগলেন আর তা বিলি করা আরম্ভ করলেন কলকাতার বিখ্যাত কফিহাউসে, সরকারি অফিসে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদপত্র দপতরে ।
রায়চৌধুরী ভাতৃদ্বয় দ্বারা আরম্ভ-করা এই আন্দোলনের কোনো দপতর, হাইকমাণ্ড বা পলিটব্যুরো ধরণের কেন্দ্র ছিল না এবং এর সদস্যরা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে কোনো রচনা লিখে নিজেরা প্রকাশ করতে পারতেন । মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “হাংরি আন্দোলনের আগে আর কোনো এরকম সামাজিক-রাজনৈতিক সাহিত্য আন্দোলন হয়নি। তাছাড়া আমরা আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলুম। বহু যুবক লেখক ও চিত্রশিল্পী আন্দোলনে যোগ দেয়া আরম্ভ করলেন । সরকার যখন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ আরম্ভ করল, ততদিনে তিরিশ জনের বেশি সদস্য হয়ে গিয়েছিল।”
মলয় রায়চৌধুরী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছিলেন । বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীর কারণে, যিনি কলেজে পড়ার জন্য পাটনা থেকে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন এবং আদি নিবাস উত্তরপাড়ায় সেসময়ে থাকতেন ।
প্রশাসনের দৃষ্টি হাংরি আন্দোলনকারীরা সেই সময়ে আকর্ষণ করলেন যখন তাঁরা ক্ষমতাধিকারীদের, বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের, আমলাদের এবং সংবাদপত্রের মালিকদের জোকার, দানব, দেবী-দেবতা, রাক্ষস, কার্টুন ইত্যাদির কাগজের মুখোশ পাঠিয়ে জানালেন “দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন।”
২রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ এগারোজন হাংরি কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো । তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সাহিত্যে অশ্লীলতা । মূল অভিযোগ ছিল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় অশ্লীলতার জন্য, ইংরেজিতে ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ নামে অনুদিত ।
আদালতে মামলা বেশ কয়েক বছর যাবত চলল । তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার সংবাদ ৪ নভেম্বর ১৯৬৪ টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল এবং তার ফলে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল । ওক্তাভিও পাজ, আর্নেস্টো কার্ডেনাল প্রমুখের মতন কবি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করলেন । বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গও মলয় রায়চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছিলেন । এর ফলে ভুল ধারনা প্রচারিত হয়েছিল যে হাংরি আন্দোলনকারীরা বিট আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ।
মলয় রায়চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারে জানালেন, “প্রচারের দরুন আমার কবিতা ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে সেখানকার লিটল ম্যাগাজিনগুলোয় প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হলো । নিউ ইয়র্কের সেইন্ট মার্কস চার্চে আমার কবিতার পাঠ-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হয়েছিল মামলার খরচ তোলার জন্য । এই সাহায্যগুলো ছাড়া হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা লড়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না । আমার আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না । বেশিরভাগ হাংরি বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন । আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হলুম, আমার জেলহাজতের সংবাদে আমার ঠাকুমা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন । আমি সাময়িকভাবে লেখালিখি ছেড়ে দিলুম।”
মলয় রায়চৌধুরী আরও বললেন যে, পরবর্তী নকশাল আন্দোলনের কারণে হাংরি আন্দোলন এক প্রকার আড়ালে চলে গিয়েছিল, যদিও নকশালরা সেরকমভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখালিখি করেননি ।
শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিকদের সহযোগীতায় এবং পরিবারের সমর্থনে মলয় রায়চৌধুরী মামলায় জিতে যান। কিন্তু ততদিনে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল । বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হিন্দি ভাষায় ( ভুখি পীঢ়ী এবং হাংরি জেনারেশন হিসাবে খ্যাত ) এই আন্দোলন সম্পর্কে বৃহত্তর জনগণ বিশেষ জানেন না এবং বিষয়টি বুঝতে পারেন না ।
মলয় রায়চৌধুরী বললেন যে, “আমি মনে করিনা হাংরি আন্দোলন বিফল হয়েছিল ; সরকার এই আন্দোলনকে দাবিয়ে দিয়েছিল । এই আন্দোলন আরও বহু ভারতীয় ভাষায় ছড়িয়ে পড়ছিল এবং সেই সময়ে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে বাধার সৃষ্টি করেছিল । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে নেতার পদ দেয়া হয়েছিল, তিনি ১৯৬৩ সালে আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন আর আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন । কয়েকজন, যাঁরা উদবাস্তু পরিবার থেকে এসেছিলেন, ভয়ে আন্দোলন ছেড়ে চলে গেলেন, কেনা তাঁরা জানতে পেরে গিয়েছিলেন যে সরকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে চলেছে । কয়েকজনকে সিপিএম এবং অন্যান্য বামপন্হী দল লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল ( যেমন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ প্রমুখ )।”
১৯৬৮ সালে মলয় রায়চৌধুরী সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন, যিনি রাজ্য স্তরের ফিল্ড হকি খেলোয়াড় ছিলেন । আদালতে মামলা জিতে যাবার পর মলয় লখনউতে এআরডিসিতে যোগ দেন । মলয় এ-পর্যন্ত সত্তরটির বেশি বই লিখেছেন, সবই ছোটো প্রকাশকদের দ্বারা প্রকাশিত - প্রচুর পাঠক থাকা সত্ত্বেও বড়ো প্রকাশকরা আগ্রহ দেখান না । দুই বার হার্ট অ্যাটাকের পর এবং অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি ও আরথ্রাইটিসের কারণে মলয় কলম ধরে লিখতে পারেন না, কমপিউটারে টাইপ করে লেখেন ।
মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “তরুণরা প্রায়ই আমাকে অনুরোধ করেন আবার হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করার জন্য । আমি তাঁদের বলি নিজেদের সময় ও পরিসরকে নিজেরা বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে এবং নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম গড়ে নিতে ।”
ঋণস্বীকার : বিজনেস স্ট্যাণ্ডার্ড
২১ জানুয়ারি, ২০১৩
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন