জীবন থেকে কবিতায়, কবিতা থেকে জীবনে ফেরা

পর্ব 3 

আফজল আলি 


তুচ্ছ যেকোনো বিষয় কবিতা হয়ে উঠতে পারে। এই যেমন টেবিল চেয়ার ইঁট কাঠ পাথর , হাতের কাছে থাকা সামগ্রী । অন্য যে কোনো বিষয় নিয়েও কবিতা লেখা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা সহজলভ্য তা হল হাতের কাছে থাকা যেকোনো সামগ্রী। আমাদের বা সমস্ত মানুষের জীবন শুরু হয় একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জীবন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলে , তা খুব কমই এলোমেলো হতে পারে। এলোমেলো হতে চাইলেও তা হয়ে ওঠা খুব সহজ নয় । জীবনের দৈনন্দিন প্রবাহ আমাদের খুব খুব কম জনকে এলোমেলো হতে দেয় । এলোমেলো যাতে না হয় আর জন্য নানান পরিক্রমা, নানান চিন্তা চেতনা থাকে। সেই পরিক্রমা এবং চিন্তা চেতনার মধ্যে ধর্মীয় প্রভাব একটা বড়ো factor হতে পারে , আবার নাও পারে। যে যেভাবে নেবে । তবে ধর্মীয় প্রভাব একটা system এ চলে । তার নির্দিষ্ট কিছু রীতি নীতি সামাজিকতা থাকে। সেই রীতি নীতি নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে জীবনের সঞ্চার ঘোরাফেরা করে। এমনটা নয় যে এটা করা খুব কষ্টকর , আবার এমনটাও নয় এটা না করলে অথবা কঠোর অনুশাসন না মানলে সব কিছু গন্ডগোল হয়ে যাবে। জীবনের প্রবাহ itself একটা সামঞ্জস্যের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। একটা মানুষ সকাল থেকে উঠে রাত্রে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত যা যা কাজ করে তার মধ্যে ই থাকে চিন্তা , পরিকল্পনা , উদ্যোগ , বাস্তবায়ন এবং পারিপার্শিকতার সাহায্য নেওয়া। মানুষ যে কোনো সময় যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যদিও সামাজিক , ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধ এখানে কিছুটা কার্যকরী হয় । কিন্তু সেই উদ্যোগের ভিতর কখনই এলোমেলো ভাব থাকলে চলে না । তাহলে জীবনের ধারা বিঘ্নিত হতে বাধ্য। জীবনের প্রবাহ যাতে এলোমেলো না হয়ে যায় তার জন্য কি মানুষকে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করতে হয় । এমনটা নয় কিন্তু । বরং জীবনের প্রবাহ এলোমেলো হওয়াটাই বেশ কঠিন। তবে সবার ক্ষেত্রে তো সমান যায় না। কখনো কখনো কারো কারো জীবন এলোমেলো হয়েই যায় , কোনো হিসেব বা পূর্ব পরিকল্পনার মধ্যে আসে না। পূর্ব পরিকল্পনা সবার ক্ষেত্রে খাটে না। জীবন itself অনিশ্চয়তার মধ্যে কিছুটা নিশ্চয়তা। কী হবে আর কী হবে না , তা আগাম কে বলতে পারে। তবে আগাম বলা যাবে না বলে অদৃষ্টবাদে ভরসা রেখে তো চলবে না। কাজেই জীবনকে চালিত করতে হবে। চালিত করতে হবে সেই দিকে , যেদিকে লক্ষ্য স্থাপন এবং গমন । এই লক্ষ্য স্থাপন এবং গমন হল একপ্রকার জার্নি। জীবনের এই প্রবাহের সাথে কবিতার কি কোনো সম্পর্ক আছে , যে সম্পর্ক এবং টানাপোড়েন দিয়ে নিত্য তৈরি হয় কবিতা। হয়তো এমনটা হতে পারে, কবিতা লুকিয়ে থাকে এই প্রবাহের ফাঁকে , তাকে বের করে আনতে হয় । একটা মানুষ কি তাঁর বৃহত্তর জীবনে কবিতার ছায়া কেন্দ্রিক। কবিতার ছায়া কি তাঁর জীবনে পড়ে , নাকি জীবন থেকেই কেবল উৎপন্ন হয় কবিতার শরীর ও ছায়া । কবিতা তো হুবহু জীবনের প্রতিচ্ছবি হতে পারে না। কবিতায় আরো কিছু উপাদান যোগ করতে হয় , তবেই না সে হয়ে ওঠে মুগ্ধকর , জ্যোৎস্না-সুন্দরী অথবা অন্ধকার-ত্রিনয়নী। কবিতার মতো আলো অন্ধকার কি জীবনকে ঘিরে থাকে না , নাকি একটি জীবন অসংখ্য কবিতা হতে হতে বয়ে চলে । বিষয়টা বেশ জটিল মনে হলেও , তীব্র ভাবের অনুভূতিতে এগিয়ে গেলে এই রহস্যের উন্মোচন হতে পারে। 

একজন কবির দৃষ্টিতে জীবন যেভাবে ধরা পড়ে , বাস্তব জীবন ঠিক ততটা অভিমুখহীন নয় । আসলে কবিরা জীবনের নির্যাস থেকে গাছ তৈরি করে । সেই গাছের ফুল হয় , সৌন্দর্য হয় , আবার কখনও কখনও কাঁটা ও থাকে । অনুভূতির ফল ও তো থাকে , যা কবি এবং পাঠক একসঙ্গে খায় । প্রশ্নটা দীক্ষিত , অদীক্ষিত পাঠককে ঘিরে । সে বিষয়ে বিস্তারিত যাচ্ছি না । কিন্তু কবিতা গাছ হয়ে ওঠে এটা সত্যি। জীবনের ভিতর যেমন স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে , তেমনি কবিতাও থাকে। পার্থিব কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভিতর কবিতা কি বিন্যস্ত হয়ে থাকে , নাকি সেই সৌন্দর্য থেকে কবিতা লেখা হয় নানান ভাবে , অর্থাৎ একটি সৌন্দর্যের ভিতর অনেক কবিতা লুকিয়ে থাকে। যেমন ধরা যাক একটি ছোট গাছের মধ্যে মাকড়সার জাল হয়ে আছে , তার সাথে কিছু ফুল ও ফুটে আছে । তার চারপাশে আরো কিছু গাছ আছে সেখানে পাখি এসে বসে। খুব সাধারণ একটা দৃশ্য। ধরা যাক এই দৃশ্য itself একটা কবিতাকে ধারণ করে আছে । কোনো কবি সেই সৌন্দর্য দেখে তার নিজের মতো করে লিখলেন। অন্য আর এক কবি তার মতো করে লিখলেন। ফলে তৈরি হল অনেক কবিতা। হতে পারে এটি হল একটি কবিতার নানান synthesis. পার্থিব দৃশ্যের মধ্যে যে কবিতাটি লুকিয়ে আছে , সেই কবিতার প্রতিফলিত হচ্ছে আরো অনেক কবিতায়। একপ্রকার বিচ্ছুরণের মতো । জীবনের ক্ষেত্রেও মনে হয় সেরকম। একটা জীবন নানান কবিতা উৎপন্ন করতে করতে এগিয়ে যায় । একটা মানুষের থাকে নানান ভূমিকা। কখনো অভিভাবক , কখনো বন্ধু , কখনো প্রেম নিবেদনে , কখনো স্নেহপরায়ণ, কখনো শ্রমিক , কর্মচারী, কখনো শিক্ষক, এইভাবে আরো কত ভূমিকায় থাকতে হয় একজন মানুষকেই। একজন মানুষের মন বিভিন্ন ভূমিকায় বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের বাঁক এবং তার মনস্তাত্ত্বিক exchange , তাকে নিয়ে চলে নানান অভিজ্ঞতায় , উপলব্ধিতে । তাই জীবনের কাছে কবিতার নানান উপাদান এসে জড়ো হয়। শুধু চাই দৃষ্টি বা পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। যেন কবিতা জীবনের দুয়ারে এসে বসে থাকে। 

রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন 

" পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় , 

পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়।। " 

এই পথ তো জীবনের পথ । পথের প্রান্তে তো মৃত্যু , অর্থাৎ শেষ। তাই পথের প্রান্তে নয় , পথের দুধারে ই আছে দেবালয় , জীবনের নানান অভিজ্ঞতাসঞ্জাত নির্মাণ। আর সেই নির্মাণ বা দেবালয় ই তো কবিতার আধার । কীভাবে থাকবে কবি , কবিতা না লিখে ।


জীবনের দৈনন্দিন প্রবাহের মধ্যেই গড়ে ওঠে কবিতার উপাদান। এমনটা নয় যে শুধু প্রেম ভালোবাসা বিরহ দুঃখ যন্ত্রণা আনন্দ শোক , এসবের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় কবিতা লেখার রসদ । ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক , মানসিক টানাপোড়েন , ভাবের প্রকাশ , এগুলো যেমন কবিতা লেখার উপাদান , তেমনি চারপাশের বস্তুজগতও একটা বড়ো উৎস হিসেবে কাজ করে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে। আমাদের কেন্দ্র করে ছড়িয়ে থাকা বস্তুসমূহের সাথে আমাদের একটা সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক সব সময় যে আবেগ যুক্ত হয় তা কিন্তু নয়। ব্যবহৃত বা সরাসরি ব্যবহারযোগ্য যে সব বস্তু আছে , তাদের সাথে আমাদের দৈনন্দিন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই সম্পর্কের সাথে আমাদের কিছুটা হলেও আবেগ বা বন্ধন তৈরি হয় । এই বন্ধন আমাদের কবিতা লেখার অন্যতম উপাদান হয়ে উঠতে পারে। কবি প্রভাত চৌধুরী যেমন অনেক কবিতা লিখেছেন তাঁর ' নোটবুক ' কাব্যগ্রন্থে , সেখানে notes on insects, notes on mathematics , notes on birds ইত্যাদি নানান ধরনের বিষয় নিয়ে যা সাধারণত কবিতার বিষয়ের মধ্যে আসে না, বা আনতে চান না কেউ। ঠিক সেই সমস্ত বিষয় বা বস্তু যা সচরাচর কেউ ভাবনার মধ্যে আনে না । কিন্তু কবিতা তো আর রচনা লেখা নয় , কাজেই সে বিষয়ে নজর তো রাখতেই হবে। যেকোনো বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লেখা সম্ভব , এটা বলা যেমন সহজ , লেখাটা ঠিক ততটা সহজ নয় । আবার খুব যে কঠিন তা কিন্তু নয়। বস্তুধর্মের মধ্যে প্রাণ আরোপ করলে , বস্তু সচল হয়ে ওঠে । এই প্রাণ আরোপ বিদ্যা ই তো হল কবিতা। মন্ত্র পড়ে যেমন ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় , সেই মন্ত্র তো নির্বাচিত শব্দের নির্বাচিত গমক বা সজ্জা। ঠিক কবিতা যেমনটি । কাজেই বস্তুকে নিয়ে কবিতা লেখার সাথে সাথে , সেই বস্তু বা বস্তুসমূহ প্রাণ পায় , সচল হয় । এই প্রাণ বা সচল হওয়া কি সাধারণ মানুষ চোখে দেখতে পায় । পায় না। কিন্তু অনুভবে যারা বোঝার বুঝতে পারে । কবিতার মধ্যে যে শব্দের সমন্বয় থাকে, তা কি অন্য কোথাও এত প্রকট দেখা যায় । নিকট বা দূরের বস্তুর সাথে যখন কবির সম্পর্ক স্থাপন হয় ,তখন সেই বস্তু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যেন জীবনের কোনো একটি অংশ বস্তুর কাছে গিয়ে ধরা দেয়, সেই বস্তুর বা বস্তুসমূহের সাথে চলে কথোপকথন , যেন জীবন ফেলে আসা অংশের সাথে জুড়ে নেয় পুনরায় । আহা কী অনুভূতি , অর্থাৎ কবি আপন করে নিচ্ছে তার চারপাশের জগতকে , জড়িয়ে নিচ্ছে জীবনে । কবি তো একজন পর্যবক্ষেক , একজন সত্য সন্ধানী , একজন research fellow. প্রজ্ঞার সাধারণীকরণ বা বিশেষত্বকরণে যার অঙ্গীকার।

2 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সমৃদ্ধ হলাম স্যার ! খুব খুব খুব আন্তরিক,
    অনেক তথ্যবহুল উপস্থাপনা ! অনেক পরিশ্রমী কলম

    উত্তরমুছুন
  2. ভালো লাগলো আপনার লেখা,আগ্রহভরে পড়লাম।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন