রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়


সংযুক্তা পাল

পর্ব- ৩

রবীন্দ্রত্তোর বাংলা কবিতায় বিরাট অভিঘাত এল ; একদিকে কল্লোল গোষ্ঠীর রবীন্দ্র-আদর্শের বিরোধিতা অন্যদিকে পাশ্চাত্য সাহিত্য তত্ত্ব ও কবিদের প্রভাব।ফ্রয়েড এবং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজ ও মানুষের বীক্ষণ।যৌনচেতনা, মনোবিকলন, শ্রেণিতত্ত্ব, জৈবিকতা, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিতরে ছদ্মবেশ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এ সবই পাল্টে ফেলল বাংলা কবিতার ভাব ও ভাষা। বোদলেয়ার, এলিয়ট, ইয়েটস, হুইটম্যান এঁদের চিন্তনকে আত্তীকরণে বাংলা কবিতার ভিন্ন রূপরেখা তৈরি হলো। বোদলেয়ারের প্রভাব যাঁর মধ্যে কার্যত অনেকটাই পাওয়া গেল তিনি বুদ্ধদেব বসু।

'বন্দীর বন্দনা' কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় প্রবৃত্তি বা লিবিডোকে প্রেমের নিগড়ে রূপ দিচ্ছেন কবি; জৈবিক প্রবৃত্তির কারাগারে বন্দী ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে এই সত্যই জানাচ্ছেন যে মানুষ ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করতে সর্বদাই ব্যর্থ, তবু প্রচেষ্টা নিরন্তর। বহু সমালোচকই আলোচ্য পর্বে কবির কবিতায় 'কাম-গন্ধ'এর দাপাদাপি দেখেছেন কিন্তু এও সত্য যৌবনের এই অপরিমিত আস্ফালনকেও আমরা জীবন থেকে বাদের খাতায় সরিয়ে দিতে পারিনা, কখনো কখনো এ উন্মাদনা, প্রশ্ন, বিদ্রোহ সবই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় প্রেম এক দেহবাদী চৈতন্যে গড়া,এক দীর্ঘ স্তবক এ প্রসঙ্গে ব্যবহার করছি—


'বাসনার বক্ষো মাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,/দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।/রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গার-/রমনী-রমণ-রণে পরাজয়– ভিক্ষা মাগে নিতি;/তাদের মেটাতে হয় বঞ্চনার দুর্দম বিক্ষোভ।/আছে ক্রূর স্বার্থদৃষ্টি , আছে মূঢ় ক্লেদলিপ্ত লোভ,/হিরন্ময় প্রেমপাত্রে হীন-হিংসা-সর্প গুপ্ত আছে।/আনন্দনন্দিত দেহে কামনার কুৎসিত দংশন,/জিঘাংসার কুটিল কুশ্রীতা।/সুন্দরের ধ্যান মোর এরা সব ক্ষণে-ক্ষণে ভেঙে দিয়ে যায়,/কাঁদায় আমারে সদা অপমানে, ব্যথায়, লজ্জায়।/ভুলিয়া থাকিতে চাই;-ক্ষণ-তরে ভুলে যাই ডুবে গিয়ে লাবণ্য উচ্ছ্বাসে—/তবু ,হায়, পারিনা ভুলিতে।/নিমেষে-নিমেষে ত্রুটি,পদে-পদে স্খলন-পতন,/আপনারে ভুলে যাওয়া–সুন্দরের নিত্য অসম্মান।/বিশ্বস্রষ্টা, তুমি মোরে গড়েছো অক্ষম করি' যদি,/মোরে ক্ষমা করি' তব অপরাধ করিয়ো ক্ষালন।'

একজন কবির সার্থকতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভাবনার বিবর্তনে গড়ে ওঠা দর্শনের পরিনমনে।যে দেহবাদকে আশ্রয় করে তিনি প্রেম তথা নারীর দিকে চোখ রাখছেন সেই দেহের ভেতর সূঁচ ফুটিয়ে যেন দেহাতীতের বিশ্বরূপ দর্শন করাচ্ছেন পাঠককে অথচ এই দেহাতীত ভাবনা ইন্দ্রিয়াতীত নয় বরং তা বাস্তব সত্যের আকারেই প্রকাশিত।


'নতুন ননীর মতো তনু তব?জানি তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কঙ্কাল—/(ওগো কঙ্কাবতী)/মৃত-পীত বর্ণ তার:খড়ির মতন শাদা শুষ্ক অস্থিশ্রেণী–/জানি,সে কিসের মূর্তি। নিঃশব্দ, বীভৎস এক রুক্ষ অট্টহাসি–/নিদারুণ দন্তহীন বিভীষিকা।'


কঙ্কালের বীভৎসতা সম্পর্কে সচেতন কবিসত্তা তবুও নারীর প্রতি তাঁর কামনাকে জয় করতে পারেননি—

'নতুন ননীর মতো তব তনুখানি/ স্পর্শিতে অগাধ সাধ,সাহস না পাই।'

আধুনিক বাংলা কবিতায় নারী যেন সরাসরি রক্ত-মাংসের প্রতীক হয়ে 'কঙ্কাবতী' তে দেখা দিল। প্রবন্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় কবি সুভাষের নারী ভাবনার সঙ্গে বুদ্ধদেব এর নারীর স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি এখানে কিঞ্চিৎ উল্লেখের প্রয়োজন এ কারণেই বাস্তব জীবনে ছুঁয়ে থাকা নারী বুদ্ধদেব বসু র কবিতায় যেন ভীষণ ভাবেই রক্ত-মাংসের কথা বলে এবং ওই দেহবাদকে কেন্দ্র করেই নারীত্বের ধারণাকে প্রকাশ করেছেন তিনি। আসক্তির আসঙ্গ উপাদান ব্যতিরেকে নারীর অন্য ভূমিকা খুব একটা চোখে পড়ার মত নয়।


'মোরে প্রেম দিতে চাও?প্রেমে মোর ভুলাইবে মন?/তুমি নারী, কঙ্কাবতী,প্রেম কোথা পাবে?/আমারে কোরো না দান, তোমার নিজের যাহা নয়।/ধার করা বিত্তে মোর লোভ নাই ;সে ঋণের বোঝা/বাড়িয়া চলিবে প্রতিদিন–/যতক্ষণ সেই ভার সর্বনাশ না করে তোমার।/সে-ঋণ করিতে শোধ দ্রৌপদীর সবগুলি শাড়ি/খুলিয়া ফেলিতে হবে।/সভামধ্যে, মোর দৃষ্টি 'পরে/নিতান্ত নিরাবরণা , দরিদ্র,সহজ /তোমাকে দাঁড়াতে হবে;রহিবেনা আর/রহস্যের অতীন্দ্রিয় ইন্দ্রজাল।'

বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় নারী ও প্রেম সমান্তরাল। সচেতন দিনের কর্মসক্রিয়তা,অচেতন মনের গূঢ় আর্তি ও তাড়নায় জীবনের যে সম্বন্ধ রচিত হয় সেখানে শরীরী আবেদন কোথাও তুচ্ছ হয়ে যায়;মনের গভীরে থেকে যায় একান্ত বৈদেহী ভালোবাসা।শরীর যে নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম একথা সর্বৈব সত্য তাই 'গভীর গুহার গহ্বর থেকে গাঢ় কন্ঠ প্রতিধ্বনি/আমার মনের অপার আকাশে হাজার হাজার প্রতিধ্বনি:/ডাহিনে ও বামে, উপরে ও নিচে, এখানে-ওখানে প্রতিধ্বনি:/প্রতিধ্বনি!/'কঙ্কা-কঙ্কা-

কঙ্কাবতী গো-কঙ্কা,কঙ্কা, কঙ্কাবতী-'/এখানে-ওখানে প্রতিধ্বনি।' ('কঙ্কাবতী')


দেহ থেকে মনে প্রেমের এই বিবর্তিত রূপ বা উত্তরণ বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার মধ্যে পাই। বুদ্ধদেব যত এগিয়েছেন তত দেহকে অতিক্রম করে নারীকে মননে গ্রহণ করেছেন।

'কাজের জোয়ারে, ঘুমের সময়ে তোমার নামের শব্দ রটে–/কঙ্কা-কঙ্কা-কঙ্কাবতী!/কঙ্কাবতী গো!'


কবি তাঁর কবিতায় প্রৌঢ়তার দিকে যত এগিয়েছেন মৃত্যু, জড়তা সব কিছুকে অতিক্রম করে শুধুমাত্র যৌনতা বা শরীরী গন্ধে নয়, ভালোবাসাকে ভালোবাসা দিয়েই যেন গ্রহণ করেছেন।প্রেম ও নারী এক নবলব্ধ সৌন্দর্যবোধে উত্তীর্ণ। নাগরিক জীবনের কোলাহল,ইট,কাঠ-কংক্রিটের জঙ্গলে যে উপলব্ধি সম্ভব হয়ে ওঠেনি 'চিল্কায় সকাল' এ প্রকৃতি নারীকে অনুভব করবার সে সুযোগ করে দিয়েছে। বাস্তবিক এ নারী কিন্তু পূর্বতন পর্বের সম্ভোগেচ্ছার আধার মাত্র নয়–

'কেমন নীল এই আকাশ।–আর তোমার চোখে/কাঁপছে কত আকাশ,কত মৃত্যু,কত নতুন জন্ম/কেমন ক'রে বলি।'('চিল্কায় সকাল')


দীর্ঘ কবিতা যাপনে নারীই কখন শব্দ প্রতিমা রূপে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে তা স্বয়ং কবির কাছেই এক জিজ্ঞাসা-


'কিন্তু কারে? কারে ভালোবাসি?/সে কি নারী?সে কি কোনো নারী?সে কি কোনো/চিরন্তনী-রঙ্গিনী নারীর মুখশ্রীর অসীম অমিয়,/অনির্বচনীয়, অবিস্মরণীয়?/না কি সে কবিতা? কবিতার জ্বলন্ত কল্পনা, ছন্দের দারুণ/ উন্মাদনা? বানীর আগুন ('মৃত্যুর পরে: জন্মের আগে')


জীবনের পরিনত পর্বে পৌঁছে সৃষ্টির সৌন্দর্য যেন প্রেম এবং নারীতেই সংহত হয়ে আছে, তাই শব্দ ও নারী এ দুয়ের প্রতি কবির সৎ ও মহৎ উচ্চারণ—

'কবিতারে আরো বেশি ভালোবেসে আরো ভালোবেসেছি নারীরে '

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন