জীবন থেকে কবিতায় , কবিতা থেকে জীবনে ফেরা

পর্ব 2 

আফজল আলি 

জীবনের প্রজ্ঞা হল কবিতা লেখার বড়ো রসদ। এই প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য খুব বেশি পড়াশোনা করতে হবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। ইন্দ্রিয়জাত, ভাবজাত, অভিজ্ঞতাজাত অবস্থান থেকেই প্রজ্ঞার উপাদান সংগ্রহ করা যায়। একটা মানুষের জীবন বড়ো বিচিত্র । নানান অভিজ্ঞতা তাঁকে ঘিরে থাকে জীবনের পথচলায় । এই নানান অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর ভিতরে তৈরি হয় অনুভূতির তরঙ্গ , ভাবের প্রবাহ । এক অভিজ্ঞতা থেকে অন্য অভিজ্ঞতায় যখন প্রবেশ করি তখন তো আমাদের ভিতরে চলতে থাকা process আমাদের অনুভবকে আরো গভীর করে তোলে , একটা মানুষ ই ভিতরে ভিতরে কেমন পরিবর্তিত হতে থাকে। বয়স বৃদ্ধি আসলে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং শারীরিক অবস্থানের , গঠন কাঠামোর কিছু পরিবর্তন। এর বাইরে বয়সের অস্তিত্ব কোথায় আর আছে । এটা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এই অমোঘ পরিণতি আমরা না পারি অতিক্রম করতে , না পারি জয় করতে । আমরা স্বীকার হই। তবে মনে রাখতে হবে মৃত্যু সবারই পরিণতি। কাজেই এই পরিণতিকে ভুলে থাকাই শ্রেয় । ধর্ম কর্মে মৃত্যুকে স্মরণ করার কথা বলা আছে কারণ মানুষ যেন অসৎগামী, অত্যাচারী না হয়ে ওঠে । সংযমের পাঠ নেওয়ার জন্য মৃত্যুকে স্মরণ করতে বলা । এর বাইরে গিয়ে মৃত্যু চিন্তাকে আমরা উপেক্ষা করতেই পারি । আসলে পঞ্চাশের আগে এই সব চিন্তা সাধারণত আসে না। তারুণ্য মৃত্যু চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রাখে। কারণ তারুণ্যের জোশ হল কিছু করার মধ্য। এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে। এই তারুণ্য নির্ভরতায় একজন কবি বেঁচে থাকেন । তাই কবিকে সাধারণত মৃত্যু ছুঁতে পারে না। কবিতা হল তারুণ্যের প্রতীক। কবিতার মধ্যে জীবন ভরা থাকে , এবং আরো অনেক কিছু ই থাকে । তাই যদি সত্তর বছর বয়সেও কবি যদি প্রেমের কবিতা, প্রবাহের কবিতা লিখতে পারেন অথবা জীবনের সেই দিক নির্দেশ যা থেকে উত্তাপ পাওয়া যায় , তাহলে সেই কবিকে কীভাবে বৃদ্ধ বলা যাবে। তিনি তো যুবক ই । বেশির ভাগ কবিই তাই যুবক থাকেন । শরীর কিছুটা ক্ষয় হলেও , অন্তরে সে চির তরুণ। আর এই চির তরুণ হয়েই একজন কবি পৃথিবী ত্যাগ করেন। ভাবের এই তারুণ্যের মধ্যে ই লুকিয়ে থাকে উত্তম কবিতা লেখার উপাদান। যে কবির মধ্যে যত বেশি প্রাণ আছে , সেই কবি তত লিখতে পারেন। একজন কবিকে যে দীর্ঘ জীবন পেতেই হবে এমন দিব্যি কে দিয়েছে। তাঁর লেখাই হল তাঁর জীবন। কবিরা আর দশজন মানুষের মতোই সাংসারিক, দৈনন্দিন জীবনে। কিন্তু আলাদা শুধু তাঁদের সৃষ্টিশীলতায়। আর একজন সৃষ্টিশীল মানুষের চিন্তা চেতনা আর পাঁচ জনের মতো হবে না , হতে পারে না। তাই কবিরা আলাদা , কবিরা রহস্যময়। এই রহস্যময়তা অর্জন গল্পকার পারেন না। কবিরা যেভাবে শব্দের ঐন্দ্রজালিক, আলো আঁধারি সৃষ্টি করেন , ভাবের আবিষ্টতা দ্বারা এটা অন্য কেউ পারেন না। এটাই স্বাভাবিক। কাজেই সেই রহস্যময়তা সৃষ্টির মানুষটি ও যে অন্য রকম হবে , এ বিষয়ে দ্বিমত হতে পারে কি । 

যেটা বলছিলাম তা হল কবিতা লেখার উপাদান। আমাদের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কবিতা লেখার উপাদান। এই কবিতা লেখার উপাদানের সাথে যখন প্রজ্ঞা যোগ হয় , তখন কবিতা হয়ে ওঠে অন্য মাত্রার। আর এটিই অর্জন করতে হয় । কবিতা মনের শান্তি এনে দেয়। কিন্তু কবিতা মনের শান্তি আনে কীভাবে , কীভাবেই বা দুঃখের অবসান ঘটায় । মানুষের জীবনে মৃত্যু যখন আছে , দুঃখ ও তখন অবধারিত। আমরা কেউ ই এর বাইরে যেতে পারি না। সুখ এবং আনন্দ এত দ্রুত সরে যায় যে আমরা ফিরে দেখতে গিয়ে দেখি দুঃখ এসে দরজা খটখট করছে । একজন দার্শনিক ঠিক এই জায়গাতেই ব্যক্ত করেন তাঁর চিন্তাশীলতা। কীভাবে দুঃখ ভোলা যাবে। দুঃখ প্রতিরোধ করা কঠিন , কিন্তু দুঃখ ভুলে থাকা যায়। কবিতা লিখলে দুঃখ ভুলে থাকা যায়। কষ্ট কিছুটা লাঘব হতে পারে। কারণ দুঃখের সাথে জড়িয়ে থাকে মস্তিষ্ক , ভাব , অনুভব , চেতনা , ঘটনার বিস্তার , ইত্যাদি আরো কিছু যা আমাদের শরীরে অভিঘাত তৈরি করে । খুব সুক্ষভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে দুঃখজনিত এই অভিঘাতের মধ্যে থাকে শব্দের ঘোরা ফেরা । নানান শব্দ যেন এইসব অভিঘাতকে ঘিরে থাকে। কেটলিতে যখন জল গরম করা হয় , তখন তৈরি হয় বাষ্পের ঘনঘোর। গরম যত বাড়তে থাকে , বাষ্পের উদ্গীরণ বা চাপ তত বেশি হতে থাকে। এটা খুব সাধারণ একটা উদাহরণ। সেই বাষ্প যদি বার করে দেওয়া হয় তাহলে জল আস্তে আস্তে আবার শান্ত হয়ে যায়। আমাদের দুঃখের অভিঘাতের মধ্যে ও তেমনি ভাবের শব্দ ঘোরাফেরা করতে থাকে। একজন কবি বা সৃষ্টিশীল মানুষ যদি শব্দের মাধ্যমে সেই অভিঘাতের উদ্গীরণ প্রকাশ করতে পারেন তাহলে ভিতরের দুঃখ যন্ত্রণা অনেকটা কমতে পারে। আর এই প্রকাশ হল কবিতা। কবিতার সাথে , কবিতার শব্দের সাথে কবির ভিতরের কষ্ট যন্ত্রণা প্রকাশ হতে হতে হালকা রূপ ধারণ করে , ফলত কবি কিছুটা relief পান । কবির ফুসফুস হৃৎপিন্ড এবং মগজ একপ্রকার রসায়ন ক্রিয়ার আবেশে আগের থেকে সতেজ হয়ে ওঠে । ব্যথা মুক্তির আনন্দে কবি আবার চনমনে হয়ে ওঠে । আর এই process এর ফলে সে ধরে রাখতে পারে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। যদিও বিষয়টি ঠিক অতটা সহজ নয় , আবার কঠিন ও নয় । তাই মনের শান্তির জন্য কবিতা লিখুন । আত্মার বিকাশের জন্য কবিতা। শক্তি অর্জনের জন্য কবিতা। এটা প্রমাণিত যে কবিতা লিখলে হার্ট ভালো থাকে। অর্থাৎ বিষয়টা হচ্ছে , কবিতার মধ্যে একপ্রকার energy থাকে যা উভয়ের ক্ষেত্রেই ক্রিয়াশীল। কবি এবং পাঠকের মধ্যে। 

ভালোবাসার ভাবনা দিয়ে যেমন কবিতা লেখা শুরু হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে , সেই ভালোবাসা ভাবনা ধীরে ধীরে যখন বিরহ বা অভিসারে প্রবেশ করে , যেখান থেকে আবার যখন সাংসারিক পর্বে প্রবেশ করে , তখন যেমন অনুভূতির পর্যায় পরিবর্তিত হয়, তেমনি কবিতাও প্রাথমিকভাবে প্রেম বা ভালোবাসার পর্ব থেকে শুরু হলেও পরবর্তীতে তা আরো প্রগাঢ় রূপে নানান দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রোমান্টিকতার বাঁধনে থাকতে থাকতে কবিও হয়ে ওঠেন সৌন্দর্যচেতনার অন্তর্মুখ । ফলে কবি এবং রোমান্টিকতা যেন জড়িয়ে জড়িয়ে থাকে । তাই কবিরা হলেন চির রহস্যময় , স্বপ্নঘেরা চোখের সমন্বয়। কবিরাই তো পারেন স্বপ্ন দেখতে , স্বপ্ন দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিতে। তাদের জগত হয় পরাবাস্তবতার , জাদুবাস্তবতার , অথবা বাস্তব জীবনে প্রতিবাদী। সত্যকে দেখিয়ে দেওয়া যে কবিদের কাজ । কতজন বুঝতে পারে কবিদের। 

ঠিক যেমন জীবন হল একটা স্রোত । এখানে স্বপ্ন নিয়েই কেটে যায় প্রতিটা আগামীকাল। প্রতিদিন আমরা স্বপ্ন দেখি , চিন্তা সাজাই আর কঠিন বাস্তবে নিজেদের ঝলসে চলি । দুঃখ ভুলতে চাই , ভোলার চেষ্টা করি । কতটা পারি বা না পারি সেটা ভিন্ন বিষয় , কিন্তু সব কষ্ট যন্ত্রণার পরেও একটা স্বপ্ন থাকে। কবিতার মধ্যে ও তাই । প্রতিটি কবিতার মধ্যে স্বপ্ন থাকে , একজন কবির ব্যথা নিংড়ানো শান্ত কলরব থাকে। জীবন যন্ত্রণার বাষ্প বেরিয়ে যায় কবিতার আকারে , আবার ভালোবাসা আনন্দ উচ্ছ্বাসের অবগাহন ধরা থাকে কবিতায়। কবিতা লেখা জীবন আর কবিতা না-লেখা জীবনের মধ্যে পার্থক্য তো থাকেই । যারা জানে তারা বুঝতে পারে। 

এই কবিতাটা কি পড়া যাবে । একটু মিলিয়ে নেওয়া যাক। 

চিত্রকল্পে দেশলাই জ্বেলে 

" জীবন আসলে নষ্ট বৈশাখ । কবিতাগুলো দেখি ।
পুনরায় বাতিল করতে থাকি 
এত এত ভালোবাসার কবিতা আসলে নিছকই এক ঘড়ির কাঁটা 
শীত ঢুকে পড়েছে, এখন যেতে হবে কয়েকটা পুরনো স্মৃতির কাছে
অনেক স্বপ্ন এখনও দেখা বাকি আছে 
সেই মোমবাতিটি জ্বালিয়ে আবার পুড়িয়ে দেব কষ্টগুলো 
অতিক্রান্ত রাতের ধূপ গন্ধ ছড়ায় গভীরে 
একটা সমাধান পরবর্তী চায়ের সন্ধান করে
আরো একটা তছনছ ছিল 
শিকড় উপড়ে দেখি অনেক গভীরে চলে গেছে জট
তাই দ্বিতীয় আর একটি রাতের তল্লাশি করতে হবে 
চিত্রকল্পে দেশলাই জ্বেলে রাত পোহাব আগুনে "

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন