তিমিরগন্ধী রাইমোহিনী
সংযুক্তা পাল

রাত্রির গায়ে আরো একবার সোঁদা গন্ধটা পায় নীলিমা।গরম দুর্বিষহ কিন্তু বৃষ্টি তো হয়নি, মাটির ঐ ভ্যাপসা গন্ধটা আসছে কোথা থেকে! প্রশ্নের একটা নিজস্ব দায় থাকে উত্তর খুঁজে নেবার। নীলিমা দরজা জানালাগুলো খুলে দিল।গন্ধটা কমে আসার পরিবর্তে আরো খানিকটা তীব্র হল।বাইরে বেরিয়ে বাগানের দিকে কিছু দূর যেতেই পুকুরের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছ থেকেই গন্ধটা আসছে বলে মনে হল নীলিমার।যত এগোয় ভ্যাপসা গন্ধটা ক্রমে আঁশটে হয়ে উঠতে থাকলো। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো ও। একটা কৃষ্ণকায় মূর্তি হাঁটু গেড়ে বসে আছে; দেখে মনে হলো অপেক্ষারত। নীলিমাকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠলো
      "গন্ধের উৎস খুঁজতে এসেছ?"
অবাক হয় নীলিমা; ওর মনের মধ্যে কি চলছে সেটা এই লোকটা জানলো কি করে, তাছাড়া লোকটার পরিচয়ই বা কি আর এখানেই বা কেমন করে ঢুকলো! যদিও পাঁচিল টপকে আসাটা এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়।
           ওর হতভম্ব অবস্থা বুঝতে পেরেই লোকটা নিজেই বলে চললো—
         "এই পুকুরে একটা মাছ আছে।"
নীলিমা সাহসে ভর করে কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বললো "সে একটা কেন! অনেক মাছই আছে।"
"এ মাছ যে সে মাছ নয়, মৎস্যকন্যা" জ্বলজ্বল করে ওঠা চোখ দুটোর ভেতরের ঘোলাটে সাদা অংশটা মুহূর্তে লাল হয়ে উঠলো ও ছায়ামূর্তির মত মানুষটার।
"সারাদিন দানবের মুঠোয় বন্দী থাকে ঐ মৎস্যকন্যা, রাত্রিবেলা দানব ঘুমিয়ে পড়লে মুঠো আলগা হয়ে আসে, তখনই সে মুঠো থেকে বেরিয়ে জলের মধ্যে খেলে বেড়ায়,তারই গন্ধ রাত্রির গায়ে লেগে থাকে।"
নীলিমা মনে মনে ভাবতে থাকে লোকটা নির্ঘাত পাগল আর নইলে অতিরিক্ত গরম আবহাওয়ায় মাথা-পেট দুইই গরম হয়েছে,নইলে এত রাতে একজন অচেনা মানুষকে কেউ রূপকথার গল্প শোনাতে বসে!
"কি মনে হচ্ছে, আমি রূপকথার গল্প শোনাচ্ছি তাই তো? ভেবে দেখো, দানবের ভয় আর তার কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা কিংবা আনন্দ... রূপকথার এই মূল থিমটা তোমার-আমার সবার জীবনেই একেবারে গেড়ে বসে আছে।"
নীলিমা বুঝে পায়না একথার কি উত্তর দেবে, অবশেষে সেখান থেকে চলে আসাই শ্রেয় মনে করে। তাছাড়া রাতও বেড়ে চলেছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাঢ় হচ্ছে গন্ধটা।
টর্চ নিয়েই বেরিয়েছিল।টর্চের আলোয় অন্ধকার সামান্য আলোকিত হলো কিন্তু ছেয়ে ফেলা শূন্যতা কিছুমাত্র দূর হলো না।নিজের ঘরে ঢুকে আবার দরজা জানালাগুলো বন্ধ করে দেয় নীলিমা। প্রায় রোজ রাতেই গন্ধটা নাকে নিতে নিতে একরকম অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। উপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।

বিছানার ওপর ছড়ানো ছিটোনো বইপত্রগুলো আবার গুছিয়ে এনে লিখতে বসে ও। আর্টিকেলটা কালকেই জমা দিতে হবে।বিষয় সমসাময়িক দেশীয় তথা রাজ্য-রাজনীতির বিশ্লেষণ।দু-দুবার আর্টিকেলটা রিজেক্ট হয়েছে; এডিটরের অভিপ্রায়ের সঙ্গে মেলেনি বিষয়বস্তুর অভিমুখ। তিনি বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে যে দিকগুলোর ওপর স্পটলাইট ফেলেছে নীলিমা তা তাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে,তাই ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে ওকে সবদিক বাঁচিয়ে এবং সাহায্যকারী উপরতলার মানুষগুলোর মন জুগিয়ে লিখতে হবে। ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ বলে চেঁচাবে নিশ্চই তবে মূল ফ্যাসিজমের ক্ষেত্রটিকে আড়ালে রেখে,যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে।
        অগত্যা চাকরি বাঁচাতে লাস্ট চান্সটাতো ওকে নিতেই হবে। সত্যের নয়, স্বার্থের তাগিদে লিখতে বসে নীলিমা। আশ্চর্য! এবার পেনের কালিটা থেকেও ক্রমশ ঐ আঁশটে গন্ধটা বেরিয়ে পড়তে শুরু করে ; অসহায় নীলিমা ভেতরের অস্বস্তিকে মানিয়ে নিতে নিতে ভাবতে থাকে—
কালকের সকালটা ঠিক কিরকম হবে...

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন