ট্রাউজার-পরা মেঘ    : ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি 
মলয় রায়চৌধুরী    
               
প্রস্তাবনা
তুমি ভাবলে,
স্যাঁতসেতে এক মগজের কল্পনায়,
এক তেলচিটে খাটে হাত-পা-ছড়ানো পেট-মোটা চাকরের মতন,--
আমার হৃদয়ের রক্তাক্ত ছেঁড়া টুকরো নিয়ে, আমি আবার  ঠাট্টা করব ।           
যতক্ষণ না আমি উপেক্ষিত নই, আমি হবো নিষ্ঠুর আর পীড়াদায়ক ।
আমার চিত্তে আর দাদুসুলভ স্নেহশীলতা নেই,
আমার আত্মায় আর ধূসর চুল নেই !
আমার কন্ঠস্বর দিয়ে জগতকে ঝাঁকিয়ে আর কাষ্ঠহাসি হেসে,
আমি তোমাদের পাশ দিয়ে চলে যাই, -- সৌম্যকান্তি,
বাইশ বছর বয়সী ।
সুশীল ভদ্রমহোদয়গণ !
তোমরা বেহালায় তোমাদের ভালোবাসা বাজাও ।
অমার্জিতরা তা ঢোলোকে তারস্বরে বাজায় ।
কিন্তু তোমরা কি নিজেদের অন্তরজগতকে বাইরে আনতে পারো, আমার মতন
আর কেবল দুটো ঠোঁট হয়ে যেতে পারো পুরোপুরি ?
এসো আর শেখো--
তোমরা, দেবদূত-বাহিনীর ফুলবাবু আমলার দল !
মিহি কাপড়ের বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসো
আর তোমরা, যারা তোমাদের ঠোঁট পেতে দিতে পারো
সেই রাঁধুনীর মতন যে নিজের রান্নার বইয়ের পাতা ওলটায় ।
যদি তোমরা চাও--                                   
আমি কাঁচা মাংসের ওপরে চারুশিল্পের শত্রুর মতন লালসিত হবো
কিংবা সূর্যোদয় যে উদ্রেক ঘটায় তার রঙে পালটে দেবো,
যদি তোমরা চাও---
আমি হতে পারি অনিন্দনীয় সুশীল,
মানুষ নয় -- কিন্তু ট্রাউজার-পরা এক মেঘ। 
আমি সুন্দর অঙ্কুরোদ্গমে বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করি !       
তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের প্রশংসা করব, ---
পুরুষের দল, হাসপাতালের বিছানার চাদরের মতন কোঁচকানো,
আর নারীরা, অতিব্যবহৃত প্রবাদের মতন নির্যাতিত ।
   

প্রথম পর্ব
তোমরা কি ভাবছ আমি ম্যালেরিয়ায় ভুল বকছি ?
তা ঘটেছিল ।
ওডেসায়, তা ঘটেছিল ।
“আমি চারটের সময় আসব,” কথা দিয়েছিল মারিয়া ।
আটটা…
নয়টা…
দশটা…
তারপর তাড়াতাড়ি,
সন্ধ্যা,
বিরাগ দেখানো,
আর ডিসেম্বরসুলভ,
জানালাগুলো ছেড়ে
আর ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
আমার পেছন থেকে, আমি শুনতে পাই হ্রেষা আর হাসি
ঝাড়বাতিগুলোর ।
তোমরা আমায় চিনতে পারতে না যদি আগে থেকে পরিচিত হতে :
পেশীতন্তুর স্তুপ
গোঙানি,
স্নায়বিক অস্হিরতা ।
এরকম একজন বোকাটে কি চাইতে পারে ?
কিন্তু একজন বোকাটে অনেক কিছু চায় ।
কেননা নিজের জন্য তা অর্থহীন
তা তোমরা তামায় গড়া হও
কিংবা হৃদয় হোক শীতল ধাতুর ।
রাতের বেলায়, তোমাদের দাবিকে জড়িয়ে নিতে চাইবে
মেয়েলি কোনোকিছু দিয়ে,
কোমল ।
আর এইভাবে,
বিশাল,
আমি কাঠামোর ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হই.
আর আমার কপাল দিয়ে, গলিয়ে ফেলি জানালার কাচ ।
এই ভালোবাসা কি অসাধারণ হবে নাকি গতানুগতিক ?
তা কি বজায় থাকবে নাকি উপেক্ষিত হবে ?
বিরাট কেউ এরকম দেহে আঁটবে না :
একটু ভালোবাসা জরুরি, -- একটা শিশু, হয়তো,
যখন মোটরগাড়ি হর্ন বাজায় আর আওয়াজ করে তখন এ ভয় পায়,
কিন্তু ঘোড়ায়-টানা ট্র্যামের ঘণ্টি পছন্দ করে ।
আমি মুখোমুখি হলুম
তরঙ্গায়িত বৃষ্টির সঙ্গে,
তবু আরেকবার,
আচ্ছা অপেক্ষা করো
শহুরে ফেনার বজ্রপাতের গর্জনে ভিজে গেলুম ।
ছুরি নিয়ে পাগলের মতন বাইরে বেরিয়ে,
রাত ওকে ধরে ফেললো
আর ছুরি মেরে দিলো,
কেউ দেখেনি ।
ঠিক মধ্যরাতে
গিলোটিন থেকে খসা মুণ্ডুর মতন পড়ে গেলো।
জানালার কাচে রুপোর বৃষ্টিফোঁটা
জমিয়ে তুলছিল মুখবিকৃতি
আর চেঁচাচ্ছিল ।
যেন নত্রে দামের পশুমুখো নর্দমাগুলো
চেল্লানো আরম্ভ করে দিলো ।
ধিক্কার তোমাদের !
যা ঘটেছে তাতে কি তোমরা এখনও সন্তুষ্ট নও ?
কান্না এবার চারিধার থেকে আমার গলা কাটবে।
আমি শুনতে পেলুম:
আস্তে,
বিছানার বাইরে রোগীর মতন,
একটা স্নায়ু লাফালো
নীচে ।
প্রথমে,
পুরুষটা সরে যায়নি, প্রায় ।
তারপর, সন্দিগ্ধ
আর সুস্পষ্ট,
ও লাফাতে আরম্ভ করলো।
আর এখন, ও আর আরও দুই জন,
এদিক-ওদিক লাফাতে লাগলো, তিড়িঙ নাচ ।
একতলায়, পলেস্তারা তাড়াতাড়ি খসে পড়ছিল ।
স্নায়ুরা,
বড়োগুলো
ছোটোগুলো,--
নানান ! --
পাগলের মতন টগবগাতে আরম্ভ করলো
যতক্ষণ না, শেষে,
ওদের পা ওদের টানতে অক্ষম হলো ।
ঘর থেকে রাত টপটপ করে বেরিয়ে এলো আর ডুবে গেলো।
চটচটে মাটিতে আটকে গিয়ে, চোখ তা থেকে পিছলে বের করতে পারলো না।
হঠাৎ দরোজাগুলো দুমদাম করতে লাগলো
যেন হোটেলের দাঁতগুলো কিড়মিড় করতে শুরু করেছে ।
তুমি প্রবেশ করলে,
আচমকা যেন “এই নাও !”
সোয়েড চামড়ার মোচড়ানো দস্তানা পরে, তুমি অপেক্ষা করলে,
আর বললে,
“তুমি জানো,--
আমার শিগগির বিয়ে হবে।”
তাহলে যাও বিয়ে করো ।
ঠিকই আছে,
আমি সামলে নিতে পারবো ।
দেখতেই পাচ্ছো -- আমি শান্ত, নিঃসন্দেহে !
কোনো শবের
নাড়ির স্পন্দনের মতন ।
মনে আছে ?
তুমি বলতে :
“জ্যাক লণ্ডন,
টাকাকড়ি, 
ভালোবাসা আর আকুলতা,”--
আমি কেবল একটা ব্যাপারই দেখেছি : 
তুমি ছিলে মোনালিসা,
যাকে চুরি করা জরুরি ছিল !
আর কেউ তোমায় চুরি করে নিলো ।
ভালোবাসায় আবার, আমি জুয়া খেলা আরম্ভ করব,
আমার ভ্রুর তোরণ আগুনে উদ্ভাসিত ।
আর কেনই বা নয় ?
অনেক সময়ে গৃহহীন ভবঘুরেরা
পোড়া বাড়িতেও আশ্রয় খোঁজে !
তুমি আমাকে ঠাট্টা করছো ?
“উন্মাদনার কেবল গুটিকয় চুনী আছে তোমার
ভিখারির কয়েক পয়সার তুলনায়, একে ভুল প্রমাণ করা যাবে না !”
কিন্তু মনে রেখো
এইভাবেই পম্পেইয়ের শেষ হয়েছিল
যখন কেউ ভিসুভিয়াসের সঙ্গে ইয়ার্কি করেছিল !
ওহে !
ভদ্রমহোদয়গণ !
তোমরা অশুচি 
নিয়ে চিন্তা করো,
অপরাধ
আর যুদ্ধ ।
কিন্তু তোমরা কি দেখেছো
ভয়ঙ্কর সন্ত্রস্ত
আমার মুখ
যখন
তা
নিখুঁত শান্তিময়তায় থাকে ?
আর আমি অনুভব করি
“আমি”
আমাকে ধরে রাখার জন্য খুবই ক্ষুদ্র ।
আমার অন্তরে কেউ কন্ঠরুদ্ধ হচ্ছে ।
হ্যালো !
কে কথা বলছে ?
মা ?
মা !
তোমার ছেলের হয়েছে এক অত্যাশ্চর্য অসুখ !
মা !
ওর হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে !
তার বোন, লিডিয়া আর ওলগাকে বোলো
যে আর কোথাও কোনো লুকোবার জায়গা নেই ।
প্রতিটি শব্দ,
মজার হোক বা অভদ্র,
যা ও নিজের জ্বলন্ত মুখ থেকে ওগরায়,
উলঙ্গ বেশ্যার মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে
জ্বলন্ত বেশ্যালয় থেকে ।
লোকেরা গন্ধ শোঁকে--
কোনো কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।
ওরা দমকলকে ডাকে ।
ঝলমলে হেলমেট পরে 
তারা অবহেলাভরে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে ।
ওহে, দমকলের লোকদের বলো :
বুটজুতো পরে ঢোকার অনুমতি নেই !
গনগনে হৃদয় নিয়ে একজনকে বিচক্ষণ হতে হবে ।
আমিই তা করব !
আমি আমার জলভরা চোখ ঢেলে দেবো চৌবাচ্চায় ।
আমাকে কেবল আমার পাঁজরকে ঠেলতে দাও আর আমি আরম্ভ করে দেবো।
আমি লাফিয়ে পড়বো ! তোমরা আমাকে বাধা দিতে পারবে না !
তারা বিদ্ধস্ত ।
তোমরা হৃদয় থেকে লাফিয়ে পড়তে পারবে না !
ঠোঁটের ফাটল থেকে,
এক অঙ্গার-আস্তৃত চুমু উৎসারিত হয়,
জ্বলন্ত মুখাবয়ব থেকে পালিয়ে যায় ।
মা !
আমি গান গাইতে পারি না ।
হৃদয়ের প্রার্থনাঘরে, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল গায়কদের গায়ে !
শব্দাবলী আর সংখ্যাসমূহের প্রতিমাদের
খুলির ভেতর থেকে,
জ্বলন্ত বাড়ি থেকে শিশুদের মতন, পালাতে থাকে ।
এইভাবে ভয়,
আকাশে পৌঁছে, ডাক দেয়
আর তুলে ধরে
লুসিতানিয়ার আগুনে-বাহু আর উদ্বেগ ।
শত-চোখ আগুন শান্তির দিকে তাকালো
ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে, যেখানে লোকেরা ঘামছিল ।
এক শেষতম চিৎকারে,
তুমি কি গোঙাবে, অন্তত,
শতাব্দীগুলোকে প্রতিবেদন দেবার জন্য যে আমি অগ্নিদগ্ধ ?


দ্বিতীয় পর্ব
আমার মহিমাকীর্তন করো !
প্রসিদ্ধরা কেউ আমার সমকক্ষ নয় !
যাকিছু এপর্যন্ত করা হয়েছে তার ওপরে 
আমি ছাপ মেরে দিই “নস্যাৎ।”
আপাতত, আমার পড়ার ইচ্ছে নেই।
উপন্যাস ?
তাতে কি !
বইপত্র এইভাবে তৈরি হয়,
আমি ভাবতুম :--
একজন কবির আগমন হয়,
আর নিজের ঠোঁট অনায়াসে খোলে।
অনুপ্রাণিত, মূর্খটা বেমালুম গাইতে আরম্ভ করে--
ওহ ক্ষান্তি দাও !
দেখা গেলো :
উৎসাহে গাইবার আগে,
নিজেদের কড়া-পড়া পায়ে ওরা কিছুক্ষণ তাল ঠোকে,
যখন কিনা কল্পনার ঘিলুহীন মাছেরা
হৃদয়ের পাঁকে কাদা ছেটায় আর মাখামাখি করে ।
আর যখন, ছন্দে হিসহিসোচ্ছে, ওরা গরম জলে সেদ্ধ করে
যাবতীয় ভালোবাসা আর পাপিয়া-পাখিদের ক্বাথের মতন ঝোলে,
জিভহীন পথ কেবল কিলবিল করে আর কুণ্ডলী পাকায়---
তাতে আর্তনাদ করার বা এমনকি বলার মতো কিছুই থাকে না ।
আমরা নিজের গর্ববশে, সারাদিন সৎমেজাজে কাজ করি
আর ব্যাবেলের শহর-মিনারগুলোর আবার পুনরানয়ন হয় ।
কিন্তু ঈশ্বর
গুঁড়িয়ে 
এই শহরগুলোকে ফাঁকা মাঠে পালটে ফ্যালেন,
শব্দকে মন্হন করে ।
নৈঃশব্দে, রাস্তাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দুর্দশায়।
গ্রাসনলিকার পথে এক চিৎকার ঋজু দাঁড়িয়ে পড়ে।
যখন মোটাসোটা ট্যাক্সি আর মোটরগাড়ি অন্তরায়ে স্হির,
গলার ভেতরে আটকে থাকে ।
যেন ক্ষয়রোগের কারণে,
নিষ্পিষ্ট বুক শ্বাস নেবার জন্য খাবি খাচ্ছিল ।
শহর, বিষাদে আক্রান্ত, তাড়াতাড়ি রাস্তা বন্ধ করে দিলো ।
আর তখন--
তা সত্ত্বেও !--
রাস্তাটা চৌমাথার মোড়ে নিজের ধকল উগরে দিলো কেশে
আর গলা থেকে বারান্দাকে ঠেলে বের করে দিলো, শেষ পর্যন্ত,
মনে হলো যেন,
শ্রেষ্ঠশ্রেনির দেবদূতের গায়কদলের ধুয়ায় যোগ দিয়ে,
সাম্প্রতিককালে লুন্ঠিত, ঈশ্বর তার তাপ আমাদের দেখাবে !
কিন্তু রাস্তাটা উবু হয়ে বসে কর্কশকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো :
“খেতে যেতে দাও !”
শিল্পপতি ক্রুপ আর তার আণ্ডাবাচ্চারা ঘিরে ধরে
শহরে চোখরাঙানো ভ্রু আঁকার জন্য,
যখন কিনা সঙ্কীর্ণ প্রবেশপথে
শব্দাবলীর লাশ এদিক-ওদিক ছড়ানো পড়ে থাকে,--
দুটো বেঁচে থাকে আর মাথাচাড়া দ্যায়,--
“শুয়োর”
আর অন্যটা,--
আমার মনে হয় “খাবার সুপ” ।
আর কবির দল, ফোঁপানি আর নালিশে ভিজে সপসপে,
রাস্তা থেকে দৌড় লাগায়, বিরক্ত আর খিটখিটে :
“ওই দুটো শব্দ দিয়ে এখন আর ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়
এক সুন্দরী রমণী
কিংবা ভালোবাসা
কিংবা শিশির-ঢাকা ফুল।”
আর কবিদের পর,

অন্যান্য হাজার লোকের হুড়োহুড়ি আরম্ভ হলো

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন