কবিতা নির্জন অনুভূতি
সমরেন্দ্র রায়

যখন একটা মােটর গাড়ী ছুটতে থাকে, তখন বাইরে থেকে যে গতি আমরা দেখি তা ওই বস্তুর সামগ্রিক গতি, কিন্তু ওই গতি সম্ভব হয় তার জ্বালানী পেট্রল বা ডিজেলের
জন্য; অর্থাৎ উহাদের অণুগুলির মধ্যে সংঘাতের বা গতির সৃষ্টি হয় বলে। এই গতি হল আণবিক গতি। এখন যদি গাড়িটির গতিকে ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে চালক ওটাকে যে লক্ষ্যের পথে নিয়ে যাচ্ছে সেই লক্ষ্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ওই গতিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অর্থাৎ পেট্রল বা ডিজেলরূপ জ্বালানি কার্য করার ফলে গাড়ির আভ্যন্তরিন যন্ত্রের কিরূপ পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, কেবল তা বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সেরূপ একজন কবির
কাব্য বা সাহিত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তার আভ্যন্তরিন উত্থিত কার্য সামাজিক উদ্দেশ্যে আলােকিত হচ্ছে কিনা তা ভাবনার অবকাশ থেকেই যায়। আবার মানুষ মাত্রই দ্বৈত সত্ত্বার দাস - সেক্ষেত্রে যে কবি বা যাঁরা সাহিত্য রচনা করেন তাঁরা কিন্তু মানুষ থেকে আলাদা নন, সত্তাতে
আলাদা – আসলে এটা আপাত অহংকারিক
স্বনিযুক্তিকরণ। তাই কে কিভাবে একটা বিষয় গ্রহণ করবে এটা সকলেরই অজানা থাকে — তবুও বাস্তবকে অস্বীকার করে চলার কোন উপায় নেই। যেমন প্রভাত সূর্যের রঙিন আলােকে স্বর্ণরেণু বলে কেউ কেউ ভুল করেন, আমিও করি। যেমন সীতা স্বর্ণমৃগকে মৃগ ভেবে ভুল করেছিলেন। কিন্তু ওই স্বর্ণমৃগ অচেতন ছিল না।
আমি কিন্তু দুটোকেই বড় মনে করে থাকি। নারীত্ব শিখাইয়াছে ভালােবাসাকে আর মনুষ্যত্ব শিখাইয়াছে ভালােবাসাকে আবিষ্কার করতে। আমি বলি, কোন কিছুই অনড় সত্তাযুক্ত নয় আবার একেবারে অস্তিত্বহীনও নয়। আসলে এক থেকে দ্বিধাবিভক্ত এবং মূল কে রেখে
পরিবর্তনের ধারা চিরায়ত—তাই পার্থক্যটাকে চিনে নেওয়া যায় যা গুণগতরূপকে পরিশীলিত করছে কিনা।

একজন কবি যখন একটি কবিতা রচনা করেন, তখন তাঁর অন্তর্নিহিত শক্তির দ্বারা অন্যের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করার চেষ্টা অবশ্যই করেন, তা হাসূচক বা নাসূচকও হতে
পারে। হা এবং না দুটোরই অস্তিত্ব ভয়ঙ্কর একে অপরের উপর নির্ভরশীল। বাস্তব জগতে যখন আমরা বলি একটি বস্তু আরেকটি বস্তুকে উৎপন্ন করে, তখন বুঝতে হবে প্রথম বস্তুটির অন্তর্নিহিত শক্তি অন্য বস্তুটির অন্তর্নিহিত শক্তির রূপ গ্রহণ করেছে। এর বাইরে কাব্য বা
সাহিত্যকে রাখা যায় কি? গােটা ব্যাপারটাই নির্জনতার ভ্রুণ থেকে উন্নীত এক সামগ্রিক প্রকাশ। কবি বা কবিতা আপাতদৃষ্টিতে পরিপূরক মনে হলেও এক নয়। এক হচ্ছে,
ব্যক্তিজীবনের আবরণ তা না পসন্দও হতে পারে, আর দুই হচ্ছে, তার নির্জনতার অবচৈতনিক ফসল
আন্তঅভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ যা ব্যক্তিকে আবরণ মুক্ত করে ফেলতে পারে। কবিদের ছলনার জায়গাটাও স্বার্থপরতার পরকাষ্ঠায় বাঁধা। তাই মাঝে মাঝে বহিঃপ্রকাশ নির্জনতার। ফসল হলেও জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কাজটাও ইনারা করে থাকেন এবং তা যুগ থেকে
যুগান্তরের গতি নিয়ে নেয়। এতদসত্ত্বেও যেকোন সৎ লেখার স্ফুরণ Message হয়ে মানুষের
মণিকোঠায় অন্তঃস্থ হতে পারে।

আসলে অনুভূতি কোন পথে হাঁটবে, একজন কবির অন্তঃচেতনার বহিঃপ্রকাশ কিভাবে প্রকাশিত হবে, তা চিন্তার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের সংমিশ্রণে গঠিত বলেই প্রথম চিন্তার সঠিক স্ফুরণ ঘটে না। কেননা বহিরঙ্গে অনেককিছুই ভাবার অবকাশ থাকে, অথচ সেই ভাবনার
প্রকাশ করতে গিয়ে সেই প্রথম চিন্তার ফসল না ফলতেও পারে - আবার তার স্ফুরণ ঘটলেও কবিতার প্রতি কবির কোন দখলদারী থাকে না। কেননা ব্যক্তিগত চিন্তা এখানে গৌণ। আবার সেই প্রকাশ তখনই কবিসত্তাকে অতিক্রম করবে যখন কবির অনুভূতি অন্যের অনুভূতির
অংশীদার হয়ে উঠবে। আমরা যাকে যেভাবে চিনেছি তার আকৃতি, প্রকৃতি, আচরণ বিভিন্ন হলেও সদৃশ চিনে নিতে কষ্ট হয়না এবং সেই চেনা পথ ধরেই সমাজের অসংখ্য ভৌতিক এবং আদিভৌতিক রূপকে মিলিয়ে নিই —তা ব্যক্তিগত বিচারে চেতনিক, অচেতনিক, আধুনিক বা উত্তরাধুনিক অথবা চিন্তার অসংখ্য নামগােত্রেই ধরা যাক না কেন। কবি যে বাস্তবের জীব তাই তার চিন্তার
অতিকল্পনার বিচরণ অবশ্যই জগৎ পরিমণ্ডলের বাইরে নয় – কেননা চিন্তাও অচিন্তারই নৈসর্গিক ফসল।।
মনে রাখতে হবে প্রত্যক্ষকারী মন সােজাসুজিভাবে আন্তরসত্তাকে জানে এবং আন্তরসত্তার মাধ্যমে আমরা বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব কল্পনা করি, যদিও এই ভাবের সতন্ত্র ও
স্বাধীনসত্তা নেই – অথচ মনই হল চরম তত্ত্ব, এই চরম তত্ত্বই অনুভূতির জাগরণ ঘটিয়ে দিতে পারে। একজন স্রষ্টার ক্ষেত্রে এটিকেই ওতপ্রোত করে নিতে হয়।
কবিতা কালগর্ভ। জালবদ্ধ জানালায় যে সৌররশ্মি আসে, সুদীর্ঘকাল পরে তার প্রলয় হয়। আঙিনায় এখন আলাপন সেরে নিতে হবে। নিরসন করতে হবে ফকিরি চাদর।
তাহলেই গাছেরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন