আফজল আলি
ভুবনডাঙা একটা মাঠের নাম হতে পারে , একটা গ্রামের নাম , আবার গ্রাম প্রান্তর নগর বন্দর ছাড়িয়ে পৌছে যেতে পারে বিশ্ব-গ্রামে মানে global village. হ্যাঁ অসম্ভব তো নয় । ভুবনডাঙা একটা সাহিত্য পত্রিকা যার প্রকাশ অন্তর্জাল পত্রিকা রূপে যাকে বলি web magazine. একটা web magazine তার সাম্প্রতিকতা নিয়ে পৌছে যেতে পারে পৃথিবীর আঙিনায় । তাই ভুবনডাঙা হল বিশ্ব-গ্রাম । বিশ্ব-গ্রামের ধারণা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছিলেন ওনার ভাবনায় এবং লেখনীতে। বিশ্ব ভাতৃত্ব বোধ। Universal brotherhood. যা আমাদের মনকে গড়ে তুলবে অনেক অনেক বড়ো , দরদী একজন মানুষ । বিশ্ব-গ্রামের ধারণা নিয়ে আর একটি দর্শন তৈরি হয়েছে যার নাম জিরো বাউন্ডারির কনসেপ্ট । বর্তমানে রাজনৈতিক যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে , মানুষে মানুষে বিভেদ যেভাবে বাড়ছে সেই পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে জিরো বাউন্ডারি মানসিকতা একমাত্র পারে এই সমস্যার নিরসন করতে । জিরো বাউন্ডারি মানসিকতা হলে নিজের গ্রাম শহর এবং দেশকে ভালোবেসেও সমগ্র পৃথিবীকেও ভাবা যেতে পারে নিজস্ব পরিসর। তাহলে কী ঘটতে পারত।
প্রতিটা মানুষের মধ্যে থাকে ক্ষমতা ভোগ এবং বিস্তারের ঝোঁক । সেই ঝোঁক থাকে অবদমিত । সিগমুন্ড ফ্রয়েড যেমন অবদমিত যৌনতার কথা বলেছিলেন , ঠিক তেমনি অবদমিত ক্ষমতায়ন । কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা পারে না প্রকাশ করতে । তার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতি । আবার এই অবদমিত ক্ষমতায়নের নেশাকে চাপা দেওয়া যেতে পারে বা suppressed বা kill করা যেতে পারে মানুষের আবেগ ভালোবাসা অনুভব জ্ঞান এসবের মাধ্যমে । পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে তা ওই ক্ষমতায়নের নেশা। অর্থাৎ নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদারের জায়গায় রাখা। একদল চায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন বা জাহির করতে আর একদল চায় তা রুখে দিতে। জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট ঠিক এই জায়গাটাতে ধরেছে। শ্রেষ্ঠত্ব হল একটি আধুনিক ভাবনা । বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই ভাবনা আর কাজে আসে না । প্রতিটা মানুষ যদি তার ভাবনা বৃহত্তম দিকে নিয়ে যায় তাহলে তার মধ্যে ক্ষুদ্রতা কমতে আরম্ভ করে । এই ভাবে ক্রমশ সে হয়ে উঠবে বিশ্ব নাগরিক । শুধু ভাবনার অভিমুখ প্রসারিত করা দরকার, যদিও বিষয়টি বেশ কঠিন । মানুষের মধ্যে যদি অপরের প্রতি ভালোবাসা সহানুভূতি মর্মবোধ বিলোপ হয়ে ঘৃণার আবেশ প্রবেশ করে তাহলে কী হবে মনুষ্য জন্ম। শ্রেষ্ঠ বলে কিছু হয় না এটা স্বীকার করলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে । জিরো বাউন্ডারির কনসেপ্টে গাঁথা আছে তেমন কিছু নতুন ভাবনা । এই কথাগুলো বলতাম না যদি বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে না induced করত।

এবার সাহিত্যের মধ্যে আসি । ভুবনডাঙা web magazine এর মালিক হল আমিনুল ইসলাম । ইতিমধ্যেই ম্যাগাজিনটা বেশ পরিসর তৈরি করেছে । সেই পরিসর হল কবিতা তথা সাহিত্যের নতুন অনুভব নতুন সৃষ্টি । তরুণ প্রজন্ম কবিতা নিয়ে ভাবছে এটা কম নয় । এক সময় print magazine এর বাইরে অন্য কিছু ভাবা যেত না । কিন্তু সময় বদলে গেছে । এখন web magazine ক্রমশ শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক মানুষ তথা পাঠকের কাছে চলে চলে যাচ্ছে মুহুর্তে এবং তা দেশ স্থান ছাড়িয়ে । এটা বেশ উৎসাহব্যঞ্জক । বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো হচ্ছে ।

কবিতার ক্ষেত্রে আমি যেটা বলি কবিতার গুণমান । গতানুগতিক বা আবহমান কবিতা লিখে মোবাইল বন্দি করে কী হবে । এর চেয়ে নতুন ভাবে নতুন চিন্তনে সৃষ্টি গতিশীল হোক। কবিতার ক্ষেত্রে , কী বক্তব্যর উপর লিখছি এটার থেকে কেমনভাবে লিখছি এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ । এই কেমনভাবে লিখছির মধ্যেই থাকে নতুনত্ব স্বাদ বা ছোঁয়া । নতুন লেখা এবং ভাবনার জন্য মেধা লাগে , ঝুঁকি থাকে । কিন্তু নতুন না এগিয়ে এলে কবিতা গতি পাবে কী করে । ভুবনডাঙা নতুনেত্বর ছোঁয়া নিয়ে নতুন মুখ তুলে আনার যৌক্তিকতা জারি রাখবে এবং পাঠকদের করবে সমৃদ্ধ এটা আশা করা যায় । Web magazine গুলো সার্বিক ভাবে আগের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এটা আনন্দের । এই ম্যাগাজিনের মাধ্যমে উঠে এসেছে অনেক নতুন নতুন মুখ । একটা ম্যাগাজিনের মাধ্যমে অনেকেই উৎসাহিত হয় , লিখতে অনুকূল গতি পায় এটা কম কীসে । ভুবনডাঙা সেই চেষ্টা ই চালিয়ে যাবে। আপনারা সঙ্গে থাকুন , তৈরি হোক সাহিত্য-জোট , সহিতের জোট , ভালোবাসার জোট। মানুষের এখন দরকার ভালোবাসা আবেগ । তবেই হঠে যাবে ঘৃণা বিদ্বেষ । মানুষ তো একটাই জাতি আর সাহিত্য মানুষের জন্য তৈরি করে মনোরম পরিবেশ, সামাজিক অভিপ্রায় এবং অভিমুখের দিক নির্ণায়ক তো কবিরা ই । তাঁদের চিন্তাধারা সমাজকে কলুষ মুক্ত করে । তাই কবিতা জিন্দাবাদ , হিংসা মুর্দাবাদ ।

একটা কবিতা যখন লেখা হতে থাকে তখন এলোমেলো অনেক ভাবনা কবির মাথায় চলে আসতে পারে অথবা একটা ভাবনাকে নিয়েই কবি এগিয়ে যান ছড়িয়ে পড়েন । কবিতার লেখনী ভঙ্গি ও তার বহিঃপ্রকাশ নিয়ে নানান পথ ও মত তথা মতবাদ তৈরি হয়েছে। আধুনিক , উত্তর আধুনিক , জিরো বাউন্ডারি । অনেকেই আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। উত্তর আধুনিকতার পরে যে নতুন কিছু হতে পারে তা মানতে সংকোচ বা মর্যাদাহানীকর ভাবেন। কিন্তু চিন্তা থেকে থাকে না । তা প্রসারিত হবেই কারো না কারো দ্বারা । সেই চিন্তার প্রসারণ যদি ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স বা জার্মান বা আমেরিকাতে হয় তাহলে আমাদের সরকারবাবুরা দু হাত তুলে লাফাতে লাফাতে গ্রহণ করে , করতে অভ্যস্ত । আর ভিন্ন হলে ঘ্যাচ। কবিতার ইতিহাস যদি দেখি তাহলে দেখতে পাবো , সাহিত্য সৃষ্টি ধাপে ধাপে মুক্ত হতে চেয়েছে। এই চাওয়ার মধ্যে বিবর্তন লুকিয়ে আছে । এই মুক্ত হওয়ার ঝোঁক তৈরি করেছে মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুক । আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক । এবং উত্তর আধুনিকের পরে পুরোপুরি মুক্ত অবস্থান জিরো বাউন্ডারি । এটাই হল পরিণতি । এখন তরুণ কবিরা নানান ভাবে নানান ডাইমেনশন এ লিখছেন। বা চেষ্টা করছেন। কিছু খামতি থাকতে পারে , তবে সার্বিকভাবে নতুন এক উদ্দীপনা এসেছে । এই উদ্দীপনা থেকে উঠে আসবে নতুন কাব্য ভাষা । তবে আমরা সাধারণত যশ সম্মানের দিকে ছুটে চলি । এটা করতে গিয়ে আমরা নকল বা প্রভাবিত হতে আরম্ভ করি কারো বা কারো দ্বারা বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ কবিদের দ্বারা । এটা একজন তরুণ কবিকে সঠিক দিশা দেখাতে পারে না । তৈরি করতে হবে নিজস্ব ভাষা এবং নতুন শৈলীর বিকাশ । ভুবনডাঙা সেই বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে ।
এবারের ভুবনডাঙা সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে পেরে এবং লেখার আমন্ত্রণ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি । সকলে ভালো থাকুন । সকলের মঙ্গল হোক ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন