কী সেই মুক্তি? কেমন করে পেতে হয় তাকে?
দুহাত দুপাশে ছড়িয়েও সকালের চড়ুইটার মতো কই সে-তো উড়তে পারেনা! দু-পা মুড়ে ধ্যানস্থ হওয়ার চেষ্টায় অহরহ উচ্চারণ করে
''বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি—
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি'—
কই আলোর তৈজসে উদ্ভাসিত হয় না তো আকাশ! আলোয় আলোয় ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে গাং ফড়িংটার আনন্দউদ্ভাস বারবার চোখে পড়ে তার, নিজেকে কি এভাবেও ছড়িয়ে রাখা যায় পৃথিবীর রেণুতে রেণুতে?
ভাবে অনির্বাণ— তার নির্নিমেষ চোখদুটো বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের ব্রহ্মাণ্ডের দিকে, অপার ব্রহ্মাণ্ড! অগাধ ব্রহ্মাণ্ড! তার কলতানের গভীরে ঐক্যতানের সুতোয় সুর খোঁজে অনির্বাণ!
মধ্যে মধ্যে শরতের মেঘের মতো ভেসে ওঠে দুটো লাইন—
"আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি "—
এ যেন এক আলোছায়ার নিত্য অভ্যাস বহন করছে তার জিনোম— এ হৃদয় অর্ধবিলীন হয়েও কেন সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হতে পারে না—
"সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়?"
ব্যথা? তবে কি দূরগামী কোন শাশ্বতের সবকটি লাল পাপড়ির ভ্রামরকেন্দ্রে লুকিয়ে আছে সেই নিদারুণ সত্য?
'গোরক্ষবিজয়' কাব্য ভেসে ওঠে চিত্তপটে—মীননাথ! সাধক মীননাথ! কেন সে সাধক হয়েও অবরুদ্ধ হল ষড়রিপুচক্রে— আর গোরক্ষনাথ? সে যেন এক নজিরবিহীন শিষ্য যে চূড়ান্ত মুহূর্তে গুরুকে তার পরমমন্ত্র স্মরণ করিয়ে ফিরিয়ে আনলেন সাধনচক্রে— আজও আমরা পাক-খাচ্ছি অবিরাম পাক-খাচ্ছি ওই মীননাথরূপী প্রবৃত্তিস্খলনের মাঝে— আমাদের তুলে আনবে কোন্ গোরক্ষনাথ? ব্যথার মাঝে আরও কতোকাল ঘুমিয়ে থাকব আমরা?
বন্ধুর জীবনপথে রক্ত রক্ত তামাশা—
বন্ধুর জীবনপথে ভক্তি ভক্তি বিবমিষা---
চড়কের এক সাধক বলেছিল অনির্বাণকে —নাইয়ের নাওয়ে ভেসে যা বেটা!
কী সেই নাও? কোথায় বা তার গন্তব্য? খিড়কির পুকুরে যতোবার একদৃষ্টে তাকিয়েছে সে, মনে হয়েছে এক দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার পর যেন সে ফিরে আসতে চাইছে নিজের বাসায়! অথচ কোথায় সেই বাসা? গভীর ঘুমের মাঝে একদিন সে দেখেছিল এক তন্ত্রসাধককে: ভাটার মতো একজোড়া চোখ যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অখণ্ড দরজা! হঠাৎ সে দরজা খুলে সাধক বলেছিল:
"আমার চোখের দিকে তাকাও তো খোকা!"
কী.....কী যেন দেখেছিল সে? একটা সাপ!নধরকান্তি হলদেটে রঙের সাপ হেলেদুলে হেঁটে চলেছে! আশ্চর্য হয়েছিল, চমকিত ও শিহরিত হয়েছিল, যখন সে অনুভব করে সেই সাপ তার দেহ দুলিয়ে উঠে আসছে তারই নাইকুণ্ড থেকে উপরের পথে আর সাধক তার জবাফুলের পাপড়ির মতো দুই ঠোঁট ফাঁক করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে বলছে—
'উঠে আয়— আমি দেখাব গোরক্ষনাথ!'
এইসময় ঘুমের মধ্যে হৃদস্পন্দ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘুম ভেঙে যায় তার— তখনই মাথায় চেপে বসে সেই অনিবার্য জিজ্ঞাসা: তাহলে কি মস্তিষ্কের সঙ্গমই মুক্তির পথ?
অবস্থান আর ভরবেগের দ্বৈরথের মাঝে হাইজেনবার্গ খুঁজেছিলেন, কোথায় থাকে মানব মস্তিষ্কের শক্তিকণিকা? আকাশগঙ্গার বিপুল বিস্তীর্ণ পথে তিরিশ কোটিরও বেশি স্নায়ুকোষ প্রতিনিয়ত যে শক্তির সর্বাত্বক স্ফুরণ ঘটিয়ে চলেছে তার সারবত্তায় কি মানবমস্তিষ্ক? সেখানেই কি কৈলাস? সেই সত্যই কি একম্ অদ্বিতীয়ম্?
একদিন আধো অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে ঘরের জানলা খুলে অনির্বাণ রাস্তার এককোণে দেখতে পায় ছাইয়ের গাদায় সমগ্র শরীরটাকে দলা পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা কুকুর— সেই অসহ্য শীতের রাতে তার কোলের খুব কাছে গুটিসুটি হয়ে আছে খান চারেক বাচ্চা ;তাদের কেউ খেলছে কেউবা খাচ্ছে অমৃতসুধা! সাধারণ স্নেহসঞ্চারক একটি দৃশ্য! কিন্তু দৃশ্যটি দেখতে দেখতে হঠাৎ সারা শরীরে তড়িৎ খেয়ে যায় তার— অদূরে দাঁড়িয়ে ওটা কী? অন্ধকারের মিহি প্রেক্ষাপটে মিশে আছে একটা 'ওত'! ভাম কিংবা খটাশ! একটু একটু করে এগিয়ে আসছে সে ছাইগাদার কাছে— ধীর-স্থির অনিবার্য সেই গম— কী চায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু হঠাৎই অনির্বাণের মনে পড়ল চন্দ্রধর বণিকের কথা— তার সপ্তডিঙার বিপর্যয় আর পুত্রদের ক্রমসংহারের নিদারুণ কাব্যগাথা— সেই সাপ? সে যে সদাশিবেরই আত্মজা! সেদিনের চাঁদ কি একটু একটু করে এগিয়ে যায়নি তার পরম আরাধ্যের চরণে, সেও কি বুঝেছিল সেইদিন---তার এতো প্রতিরোধ এতো অবরোধ আসলে তার পরমগুরুরই রচিত একটি মর্ত্যব্যুহ লীলা?
চোখ ছলছল করে ওঠে দৃশ্যপটে অনির্বাণের, হৃদয়ের সকল ক্রোধ যেন আর বাঁধ মানে না তার, সে শোক আজ শান্তির স্মৃতিকণারূপে ঝরতে থাকে তার চিবুক বেয়ে মাটির খুব কাছাকাছি, ছলছল নেত্রে সে আপন বুকে হাত রেখে নিজমনে বলে ওঠে তিনবার
নোঙর তোলো
নোঙর তোলো
নোঙর তোলো!
সেই আনন্দভৈরবী তার অমৃতকুঞ্জে যে আজ তুলেছে বৈখরী-জোয়ার!!!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন