শোনো কে বাজায়
রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছিলেন "জগতের প্রত্যেক অণু পরমাণু এক মহাপ্রাণের ঐক্যসূত্রে হিল্লোলিত দেখিতে পাই--এক মহাপ্রাণের অনন্তকম্পিত বীণাতন্ত্রী হইতে এই বিপুল বিশ্বসংগীত ঝংকৃত..."। ধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে আমরা প্রথমে তার উৎস নির্ধারণ করতে পারি না।মন যখন যে স্তরে অবস্থান করে তদনুযায়ী সে এই অনন্তস্পন্দিত বীণাতন্ত্রী থেকে নিঃসৃত ধ্বনি যা আদি থেকে অনাদির ব্যপ্তি নিয়ে রণিত হয়েই চলেছে তাকেই বিচ্ছিন্ন,অমার্জিতভাবে পেতে থাকে।দূরাগত সেই অব্যক্তকে প্রথমে আমরা খুঁজি বাইরে।যা বিশাল, ভূমা যা,তা যে আমারই একান্ত,চিরন্তন অনুভব তা আমরা প্রথমে ধারণা করতে পারি না।মনে হয় এই পৃথিবী, ওই আকাশই বুঝি সব অনুভব, ভাবনা, চিন্তা নিয়ে আমাদের ঘিরে রেখেছে।অতিমানসলোকের কোনো এক স্তরে তাই কখনো শোনা যায় সমুদ্রকল্লোল কখনো ঝিঁ ঝিঁ ডাক কখনো বা রিনরিন নূপুরগুঞ্জন।শব্দ যে নাদে পরিণত হয়ে জ্যোতি রূপে প্রকাশমান হতে পারে একথা ভারতীয় দর্শন স্বীকৃত হলেও আধুনিক পদার্থবিদ্যা বোধহয় তাকে অস্বীকার করতে পারে না।আর বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি বস্তু(তা সে জীব বা জড় যাই হোক না কেন)-র মধ্যে গন্ডি বা কাঠামো ভাঙার যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তা-ই তো বন্দিনী অহল্যার আত্মমুক্তির আকাঙ্খা। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের সীমাহীন ব্যাকুলতা।কবি তাই সহজেই বলতে পারেন "মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে" আর জলধিকিনারে পদাবলীকর্তাদের শ্রীমতি উন্মুখ প্রহর গোনেন "হরি গেলা মধুপুর হম কুলবালা"।
জীব আর ব্রহ্মের সম্পর্ককে যদি আমরা প্রকৃতি ও পুরুষের সম্পর্ক ধরি, বৈষ্ণবীয় কল্পনায় তাহলে দেখবো বিশ্বের রাসচক্রের কেন্দ্রে এক নিত্যমিথুনের ছবি। "একাত্মনাবপি দেহভেদং গতৌ"-- অভিন্ন আত্মা হয়েও দুটি দেহে ভিন্ন।আর চক্রের পরিধি জুড়ে সেই অনন্ত মিথুনেরই কায়ব্যুহ। এই রসের লীলা চলেছে সর্বত্রই --- জ্ঞানে,প্রেমে,কর্মে বা শক্তির উল্লাসে।রস যেন প্রেমেরই একান্ত।তা আস্বাদন ভিন্ন প্রেমের নাড়িতে রক্তধারার টান লাগে না।সব রসের ধারা সেখানে হারায়।তৈত্তিরীয় উপনিষদে বিশ্ব তাই " রসো বৈ সঃ"।অনন্ত প্রকৃতি যখন পরমা হয়ে হয়ে ফুটে উঠে পরমের সঙ্গে মিলিত হয়,অনাদিকালের তৃষ্ণা তখন এই মহামিলনে পরিতৃপ্ত হয়।যুগ যুগান্তরে অনন্ত রূপের মধ্যে দিয়ে মিলনাকাঙ্খা এই মহাসম্মিলনেই নিবৃত্ত হয়। এই অবস্থায় প্রকৃতি ক্রমশ পুরুষে ও পুরুষ ক্রমশ প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে মহা সামরস্য সংঘটিত করে।নিকুঞ্জলীলায় রসের এই মহানুষ্ঠানই রাস।
রাসের প্রসঙ্গে স্বভাবতই এসে পড়েন কৃষ্ণ,তাঁর যাবতীয় ব্যুৎপত্তি নিয়ে।সংস্কৃতে "কৃষ" ধাতুর অর্থ চর্চা করা,অনুসন্ধান করা।অনুশীলনের দ্বারা মনকে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতম পর্দায় বেঁধে যে সত্ত্বাকে অধিগত করা যায় তাই-ই কৃষ্ণ।আবার "কৃষ" ধাতুর অন্য অর্থ আকর্ষণ করা।এই সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রে থাকা সূর্য তার চারপাশে ঘূর্ণায়মান অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহকে ক্রমাগত নিজের দিকে আকর্ষণ করে চলেছে।ফলে নিজের কক্ষপথে তারা অবিরত ভ্রাম্যমাণ। ঠিক এভাবেই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিজের দিকে আকর্ষণ করে চলেছেন বলে তিনি কৃষ্ণ। অন্য দিক দিয়ে দেখলে লাল,হলুদ প্রভৃতি যতো রং তাদের মধ্যে কালো রঙের traction power সবচেয়ে বেশি। কৃষ্ণ শব্দের আর একটি অর্থ তাই বোধহয় কালো।"কৃষ"ধাতুর ভিন্নতম একটি অর্থ "অহম অস্মি" অর্থাৎ আমি আছি।আর ভূ-ধাতু -- হওয়া,থাকা।অতএব কৃষ্ণ মানে আমরা তাই সহজেই বলতে পারি : যিনি আছেন বলে আমি আছি। আমার মধ্যে তার সুমধুর প্রকাশ যখন সব ভোলানো সুরে বাঁশিগ্রস্থ করে তোলে কৃষ্ণাকর্ষণের শুরু বোধহয় তখনই।
অসীমের প্রতি,বৃহতের প্রতি এই আকর্ষণই প্রেম।ভক্তিরসে যা সংপৃক্ত।ভক্তি আর প্রেম তাই একে অন্যের পরিপূরক।দুয়ের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্য নেই।প্রেম মনের,ভাবের। আর ভাব যখন ভাষায় প্রকাশিত হয়ে মাটিতে নেমে আসে তা হয়ে দাঁড়ায় ভক্তি।শাস্ত্রকারেরা তাই বলেছেন "প্রেম ভক্তি স্বরূপিনী"।প্রেমের সংসিদ্ধিকত্ব,
উত্তরতত্ত্বই ভক্তি।আবার ভক্তি বলতে বোঝায় ভজ+ক্তিন।অর্থাৎ মনের সব বৃত্তি যখন স্থূল থেকে,জাগতিকতা থেকে প্রত্যাহত হয়ে পরমের দিকে ধাবিত হয় তাই-ই ভক্তি।বৈষ্ণবতত্ত্বে এটিই হ্লাদিনী শক্তি।পরমের প্রতি তার যে আকর্ষণ তা অন্তর্মুখীনতারই প্রতিভাস।ভয়হীনা,লজ্জাহীনা রাধা তাই প্রেমযমুনায় পাগলিনীর মতো ডুব দেন একান্তে,সহজ অনুরাগে।এ পোড়া বাঁশির জ্বালা তিনিই বোঝেন অন্যে বোঝে না দূর অধরার সুরে যিনি কখনো দংশিত হন নি --- "মুরলী শুনিয়া মোহিত হইবে সহজ কুলের বালা/দ্বিজ চন্ডীদাস কয় তখনি জানিবে পিরিতি কেমন জ্বালা"।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন