তাপস গুপ্ত-এর ধারাবাহিক গদ্য



পোস্টমডার্ন কবিতা: কিছু কথা

পর্ব:৩

আধুনিকতার জমাটি স্বপ্ন বেঁধে প্যারিসে খুব কম জমি ব্যবহারে মডার্ন স্থাপত্যের আদলে এক বিশাল বাড়ি তৈরি করা হল। উদ্দেশ্য নিম্নবিত্ত বস্তিবাসীদের একটি সুস্থ বাসস্থান এবং পরিবেশে ঠাঁই দেওয়া। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ওই বাড়িটি অপরাধ জগতের বিভীষিকাময় মূল ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল; ড্রাগস, চুরি, ছিনতাই এর স্বর্গ রাজ্য হয়ে ওঠা আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন এই বিশাল বাড়িটিকে ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই বিকেল ৩ টে ৩ মিনিটে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে  দেওয়া হতেই  প্রখ্যাত আর্কিটেক্ট জেংক্স বলেছিলেন, এই পোস্ট মডার্নিজম শুরু হল। ওদিকে আমেরিকায় কবি সমালোচক চার্লস ওলসন(১৯১০-- ১৯৭০) কবি রবার্ট ক্রিলির সঙ্গে এক আলোচনায় ১৯৫১ তেই বললেন,"...post modern world that lay beyond the imperial age of the discoveries and the industrial revolution." এখানেই পরে ওলসন বলেছেন, হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওই আণবিক বিস্ফোরণের দিনই আধুনিক ধারণা বা দর্শন তার মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলেছে। ওলসন এর কবিতা  এবং তাঁর ভাবনারাশিকে ছুঁয়ে না  গেলে আমেরিকার পোস্টমডার্ন আন্দোলনের বিবর্তনের ধারা অধরা থেকে যাবে। ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে আমরা  বিষয়ের  সেই অভিমুখে এগোতে থাকলেও কিছু প্রাসঙ্গিক  আলোচনা আমাদের সেরে নেওয়া প্রয়োজন।

আমাদের আলোচনার বিষয়ীভুত অঙ্গ হল পোস্টমডার্ন চিন্তা,তার দর্শন এবং সেই প্রেক্ষিতে জড়িত কিছু কবিতা এবং তার নির্মাণ শৈলী। একথা অনস্বীকার্য নয় যে, পোস্ট মডার্ন একটি 'ইজম' বা তত্ব। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ঐতিহ্যময়  'আধুনিক' ও তার অপূর্ণতা কে সমালোচনায় বিদ্ধ বিক্ষত করা এবং তাকে সঙ্গে নিয়েই এই উত্তর আধুনিকের স্বপ্নময় অভিযাত্রা (পর্ব ২)। অর্থাৎ অন্যান্য ইজম বা তত্বের মতই এটিও একটি তত্ত্ব। আমাদের পরবর্তী আলোচনা সংশয় হীন মসৃণতা প্রাপ্ত হয়ে উঠতে পারে, এরকম এক নিটোল আগামী প্রাপ্তির আকাঙ্খায় একথা দ্বিধাহীন স্বীকার্যে নিয়ে বলি, কোনো কবি তত্ব বা ইজম কে মাথায় রেখে অথবা এই ইজম কে প্রি-ইনস্টলড করে কবিতা সৃষ্টি করেন না। শব্দ এবং সাজানো শব্দের গতিশীল অলিন্দ প্রকোষ্ঠে 'ইজম' এর দর্শন হীরক দ্যুতি সম ছড়িয়ে কবিতার ভাব সৌন্দর্য আলোকিত করে দিতে পারে মাত্র। বললাম বটে 'মাত্র', কিন্তু সৃষ্টি বা নির্মাণে এই ফিউশন বোধ এবং শিল্পের মাত্রা চেতনার ভারসাম্যর সাযুজ্য রক্ষা না করলে সৃষ্টির মহত্ব লাভ অথবা তার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব নয়।
আরও সহজে বললে, কবিতা বা সজ্জিত শব্দ ভাব অথবা ভাবশব্দ প্রাণ পেতে চায় পাঠক হৃদয়ে। কবির অভিজ্ঞতালব্ধ লৌকিক ভাব সহৃদয় হৃদয়-সংবেদী হয়ে ওঠে পাঠক মনের স্পর্শে অলৌকিক কবিতার জগৎ, রসের জগৎ। সংবেদী, লৌকিক ইত্যাদি প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা আলোচনা করে আমরা আবার বিষয়ে ফিরব।সাহিত্য দর্পণে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:

       পরস্য ন পরস্যেতি
                মমেতি ন মমেতি চ।
        তদাস্বাদে বিভাবাদে
        পরিচ্ছেদো ন বিদ্যতে।

রসিক পাঠকের মনে হয় কাব্যের ভাব বা চরিত্র পরের অথচ পরের নয়, তেমনি তার নিজের বা নিজেরও নয়।  মনে হতে পারে তাহলে বিষয়টি বিজ্ঞান বা দর্শনের কোনো দুরূহতম abstract বিষয়। কিন্তু আমরা জানি কবি যা রচনা করেন তা কোনো আউটলাইন নয়, সম্পূর্ন কংক্রিট বিষয়। ভাব ও রসের এই জগৎ কে ভারতীয় আলংকারিকেরা বলেন অলৌকিক মায়ার জগৎ। লৌকিক ভাব ই কবির রচনায় তার পরিমিতি কে ছাড়িয়ে অলৌকিক রূপ প্রাপ্ত হয়ে "রস" লাভ করে। সুতরাং কাব্যের সৃষ্টি "কংক্রিট ইউনিভার্সাল " এর সৃষ্টি।
এই নির্মাণ মুহূর্ত ক্ষণে কবি কোনো নিয়মে আবদ্ধ থাকেন না, তাই মায়াকোভস্কি বলেন, কবিই তৈরি করে নেবেন কবিতার নিয়ম।

নিয়মভাঙা এই সৃষ্টির রূপ ভাস্কর্য রসজ্ঞ-পাঠক অথবা প্রাজ্ঞ-সমালোচক কবিতার অন্তর্নিহিত পরতটিকে রঙে রঙে আমাদের চিনিয়ে দিতে থাকেন। যেমন নিকোলাস গ্যিয়েন এর কবিতা সম্পর্কে এক আর্জেন্টিনীয় রসিক সমালোচক মার্টিনেড এস্ট্রাডা লিখেছিলেন, " All his work is a battle against oppression, against the privileges and the rivalries that separate human beings of whatever condition." এখানে বলার কথা এই যে, কবিতাটির মধ্যে বিদ্রোহী ভাব থাকলেও তা কবিতার ভাব বিস্তারে বৃহদাংশ জুড়ে নেই। তেমনি  আমাদের আলোচ্য বা অনুবাদিত কোনো কবিতায় পোস্ট-মডার্ন বস্তু ধর্মটি এই ভাবেই কম বেশি মাত্রায় যোজিত হয়ে থাকবে।

চার্লস ওলসন এর পরে পরেই পোস্ট-মডার্ন কবি হিসেবে যাঁর নাম চলে আসে তিনি হলেন জন অ্যাসবেরি। সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন,"...poets suffer from an anxiety influence".. ডেভিড রেমনিক এক সাক্ষাৎকারে ব্লুমের এই মন্তব্য টি তুলে অ্যাসবেরিকে মজার খোঁচা দিলে উত্তরে অ্যাস বেরি বললেন- "I think his theory of the  anxiety of influence has a poetic truth,as I've said. I, myself, am not conscious of feeling it while I am writing but I am anxious about so many things that this may well be one of them. But it goes by too quickly for me to be cognizant of it."  শ্রদ্ধেয় পাঠক পুরো মন্তব্য টির সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনের বক্তব্যে খেয়াল করলে দেখবেন (অবশ্যই বুঝবেন) কবি তাঁর সৃষ্টি মুহূর্তে তত্ত্ব চেতনের বন্ধন মুক্ত দশায় থাকেন (চেতন, মুক্ত, দশা ইত্যাদি শব্দ আধ্যাত্মিক অর্থে ব্যবহৃত নয়)। এবার জন অ্যাসবেরির একটি অনুবাদিত কবিতা দিলাম। কবিতার নাম -
Alms For the Beekeeper 
যার তর্জমা করেছি ...
"মৌমাছি পালনকারীর জন্য খয়রাতি" 
এখানে এবার মূল কবিতাটিও রেখে দিচ্ছি এই উদ্দেশ্যে যে মূল কবিতাটিতে শ্রদ্ধেয় পাঠক চোখ বুলিয়ে নিলে তাঁর কৌতূহল এবং তুলনাপ্রিয় মন ভাবনার ভারসাম্য জুড়ে নিতে পারবেন সহজেই আর এই রচনার উদ্দেশ্য কিয়দংশে হলেও তুষ্টি লাভ করবে।

Alms for the Beekeeper

He makes better errors that way.
Pass it around at breakfast:
the family and all ,down there with a
Proximate sense of power,
Lawyering up.
Less log heavy,your text strategy
beat out other options,is languid.
Duets in the dust start up,
begin, again.

He entered the firm at night.
The 26th is a Monday.


মৌমাছি পালনকারীর জন্য খয়রাতি

তার সেই বাছাই করা ভুল গুলোর সংকট কাঁটা
সহনে সহ্যে নেয় প্রাতরাশ সময়:
অদূরবর্তী পরিবার জনেরা চেতনা শক্তি রহিত,
সাজানো যুক্তির সাজানো কৌশল
শুধু ভারি কাগুজে পুঁথি টেক্সট সম বহমান
পরাজিত নির্জীব বিকল্প নির্মাণ।
ধুলোর মধ্যে শুরু হয় মল্ল যুদ্ধ
পুনরায় পুনর্জীবিত দ্বৈত রণ।

ঢুকেছিল সে রাতে
কারবারী সংস্থায়

কোনো এক সোমবারে, তারিখ ছাব্বিশে।


(ক্রমশ)

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন