“আমিই ক্ষুধা - তোমাদের জিভের  মতান্তর” -- হাংরি আন্দোলনকারীদের কাব্যবিপ্লব

মধুবন্তী চন্দ

          গত শতকের অবক্ষয় এবং অধঃপতনকে আর. কে. লক্ষণ-এর মারাত্মক কলমে সৃষ্ট ‘কমন ম্যান’-এর মতন আর কোনো কিছুই ভালো ভাবে তুলে ধরতে পারেনি ।  নোংরামিতে ভুগতে থাকা একটি প্রজন্মের অন্তরজগতের সত্তাকে তাঁর ক্যারিকেচারগুলো, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষয়ে পচে যাওয়া অবস্হাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে স্পষ্ট করে তুলেছিল । সামাজিক অস্হিরতায় তা পাওয়া গেছে, বলিউড ফিল্মে তা দেখা গেছে । সত্যিই, যদি ভেবে দেখা যায়, ষাটের, সত্তরের আর আশির দশকের, মুখ বন্ধ করে দেয়া স্মৃতির তলদেশ থেকে উঁকি দিতে দেখা যায় দাঁতে দাঁত চেপা উথালপাথাল, ভুল পথে চলে যাওয়া রাজনৈতিক ধারণা, ভেঙে-পড়া অর্থব্যবস্হা এবং ক্ষুধার্ত জোয়ারের  উত্তাল।

          এই বিধ্বস্ত সময়েই জন্মেছিলেন হাংরি আন্দোলনের আভাঁগার্দ কবির দল, পশ্চিমবাংলাকে কেন্দ্র করে, তারপর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে, এমনকি ইটালি, ফ্রান্স এবং জার্মানি ইত্যাদি দেশে । যদিও তাদের আভাঁগার্দ তকমা দেয়া হয়েছে, তাঁদের রচনাবলী পড়ে আমার মনে হয়েছে তাঁরা নিরীক্ষারত বিতর্কিত কবিদের চেয়েও অনেক বেশি কিছু । তাঁরা ছিলেন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ, ভূমি থেকে উৎপাটিত, জখমে আঘাতপ্রাপ্ত, শহরের পথে ছোটানো রাগি টাঙাওয়ালার মতন, কম পয়সায় কাজ করিয়ে নেয়া শ্রমিকের মতন, যারা শহরের ঘিঞ্জি বস্তিতে গালমন্দ করে জীবন কাটায়, উদ্বাস্তু শিবিরে কোনঠাশা শ্বাসরুদ্ধ দেশত্যাগী মানুষেরা, বঞ্চিত মানুষের যে ছবি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, সবই । হিন্দিতে নামকরণ করা হয়েছিল ‘ভুখি পিঢ়ি, বাংলায় ‘ক্ষুধিত প্রজন্ম’, যে নামে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ।

          তাঁর বিখ্যাত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায়, যে কবিতার জন্য তাঁকে জেলে পোরা হয়েছিল, হাংরি আন্দোলনের কবি মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন :


“সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাবো

শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দেবো

কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই”


          হাংরি আন্দোলনকারীদের কার্যসূচি ছিল সুস্পষ্ট : তাঁরা ছিলেন ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ । যা কিছুই আইন, রাজ্য, রাষ্ট্র, সমঝোতা, সীমাবদ্ধতার শৃঙ্খলায় বেঁধে-ফেলা, আনুগত্যের দাবিদার, মধ্যবিত্ত, মূল্যবোধকাঠামো, বুর্জোয়াপনার সামান্যতম রেশ যাতে ছিল, তাকে উল্টে দিয়েছিলেন তাঁরা । কিন্তু তাঁরা মার্কসবাদের আইডিওলগ হবার ভান করেননি, বরং ছিলেন  মার্কসবাদবিরোধী । মজার ব্যাপার হল, সেই সময়েই মার্কসবাদীরা ছিলেন শাসন-ক্ষমতার অধিকারী আর রাজ্যের প্রশাসক, যাকে তাঁরা বিধ্বস্ত করতে চাইছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের ইশতাহারগুলোয় ছিল ঝোড়ো লক্ষ্য, যা থেকে বুঝতে পারা যায় যে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে প্রতিবাদী  এবং আটপৌরে মানুষের সংস্কৃতির বাইরে যার দরুন তাঁদের কবিতাগুলো সরাসরি অশ্লীলতার পর্যায়ে গিয়ে পড়েছে, কলার-তোলা এলিট সম্প্রদায়কে আক্রমণ করেছে যে এলিটরা তখনও পর্যন্ত উনিশ শতকের মাইকেল মধুসূদনের আলোয় নিজেদের আলোকিত করছেন, এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যোতিতে।

          তাঁরা ঢাকার কুট্টি-টাঙাওয়ালার বুলিতে লিখেছেন ( সুবিমল বসাক-এর ছাতামাথা উপন্যাস ) এবং মৃত ভ্রুণ ও সঙ্গমের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়েছেন ( শৈলেশ্বর ঘোষের জন্মনিয়ন্ত্রণ ) । মধ্যবিত্ত বাবু সমাজের কাছে তাঁদের লেখাকে ভাষা বলে মনে করা হয়নি, বরং মনে করা হয়েছে বাড়ির-চাকর-বাকররা যে বুলিতে কথা বলে সেই বুলিতে হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের কবিতাকে নিমজ্জিত করতেন । কোনো কোনো আলোচকের দৃষ্টিতে তা ছিল বন্য-মতবিরোধিতা, আবার কারোর কাছে সাঙ্ঘাতিকভাবে আপত্তিকর, কিন্তু ক্ষমতার শোষণ ও শাসনে ক্রুদ্ধ জনগণের কাছে হাংরিদের কবিতা ছিল তাঁদের কন্ঠস্বর । ত্রিদিব মিত্র হত্যাকাণ্ড কবিতায় লিখেছিলেন :


“ফালতু মগজের জ্যামিতিক অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি বিশৃঙ্খলায়

সভ্যকে ঘৃণা করেও লুকিয়ে রইলে সভ্যতার কলকব্জায়”


তাঁর কন্ঠস্বর, সামাজিক পেষণের তলায় চাপা দেয়া হয়েছে, শহরের ট্রাম আর ট্র্যাফিকের গর্জনের আড়ালে, তা ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের অস্ত্র, যার ফলে বহু নিম্নবর্গের কবি-লেখক, যাঁদের কখনও সাহিত্যের মঞ্চে জায়গা দেয়া হতো না, তাঁরা নিজের স্হান গড়ে নিতে পারলেন । তাঁরা পেলেন লেখকের সন্মান, তা সে বিশৃঙ্খলা ও মৃত্যুর চাকরি হলেও পরোয়া করা হয়নি । পথচারীদের মতো ঝড় তোলার মহা-আয়োজন ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের । সাহিত্য জগতে উথালপাথাল ঘটাবার পর তাঁরা জোকার, ভাঁড়, পুরাণের চরিত্রদের ক্যারিকেচারের মুখোশ পাঠিয়েছিলেন রাজনীতিকদের, বিদ্যায়তনিক কর্মকর্তাদের, আমলাদের এবং সেই সমস্ত লোকেদের যাঁরা শোষণকারী ক্ষমতাবিন্যাসের খেলুড়ে ছিলেন । সেই উপহারগুলোর ওপরে লেখা থাকতো ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’।

           তাঁদের দুঃসাহস বুর্জোয়া সংবেদনকে আঘাত হানলো, বেশ তছনছ করে, অতিশয় ক্রুদ্ধ করে । বিট জেনারেশনের কবিরা হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সহযোগীতা করলেন । ‘এল কর্নো এমপ্লুমাদো’ পত্রিকার সম্পাদিকা মার্গারেট র‌্যাণ্ডালকে মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, “তোমাদের লেখাপত্র যদি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠাও তাহলে আমরা সেগুলো আমাদের ভাষায় অনুবাদ করে এখানকার পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে পারব ।”

         ইয়েটস লিখেছিলেন….

“থিংস ফল অ্যাপার্ট ; দি সেন্টার ক্যাননট হোল্ড ;

মেয়ার অ্যানার্কি ইজ লুজড আপঅন দিস ওয়র্লড”


          ষাটের দশকের কথা ভাবলেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অস্হিরতা এবং আরও অস্হিরতার ছবি। এই সময়ের পরেই নকশাল আন্দোলন  তাত্বিক আদর্শ নিয়ে ভীষণভাবে দেখা দিলো । অস্হিরতার তরঙ্গ বইতে লাগলো সারাটা দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত, যা বাস্তবায়িত হতে দেখা গেল নানা ধরনের দাঙ্গা আর রাষ্ট্র-আয়োজিত হত্যাকাণ্ডে । সেগুলো ছিল স্বাধীনতার সময়ে দেয়া কথার খেলাপি । কিন্তু অশান্তি ছিল সর্বত্র। সমীর রায়চৌধুরী হাংরি পত্রিকার একটি নেপালি সংস্করণও এই সময়ে প্রকাশ করেছিলেন ( প্রচ্ছদ হাংরি শিল্পী অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা ) ।

         ষাটের দশক ছিল সমাজ বিপ্লবের মহাকাল । ব্রিটিশদের চাপানো রক্ষণশীলতা পালটি খেয়ে গেল যৌনবিপ্লবের হাতে, যে বিপ্লবে ফাটল ধরে গেল পুরোনো পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রাচীরে । শহুরে পথপার্শ্বে গজিয়ে উঠতে লাগল হিপিদের কমিউনিটি এবং লাইসারজিক অ্যাসিডে নিমজ্জিত একটি প্রজন্ম । এ-কথা সত্য যে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি বহু দেশের এবং আইডেনটিটির মানুষদের তার সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছিল, যার দরুন কবিতাটি স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, ফরাসি এবং আরও বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছিল । ক্ষুধা ছিল একটি বুনিয়াদি সমস্যা । যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল তা হলো শ্বাসবদ্ধকর সামাজিক অবস্হা । অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তার সমুদ্রের আছাড় খেয়ে ভেঙে পড়ছিল তাবৎ কাঠামো । 

          হিপি কমিউনগুলো স্বপ্ন দেখছিল ধ্বংসাবশেষ থেকে নতুন করে গড়ে তোলার, যখন কিনা অসহায়তায় আক্রান্ত হাংরি আন্দোলনকারীরা হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের জন্য দায়ি ক্ষমতাচক্রের ওপর নিজেদের যৌথ শোক থেকে সংগ্রহ করা বিষ ঝরাচ্ছিল ।

          মলয় রায়চৌধুরী এখনও শব্দের যুদ্ধাস্ত্র সংবরণ করেননি । কবিতা লেখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল । তা সত্বেও হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের শান দেওয়া কবিতার পত্র-পত্রিকা বিলি করে গেছেন কলেজের করিডরে এবং রাজপথে । যেমন-যেমন তাঁদের প্রভাবের প্রসার পশ্চিমবাংলা ছাড়িয়ে অন্যত্র ঘটতে লাগল, রাজ্য সরকার, তখন মার্কসবাদীরা সরকারে এসেছে, হাংরিদের কন্ঠরুদ্ধ করার প্রয়াস করল । বেশ কিছু লেখককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । কেউ কেউ আন্দোলন ছেড়ে পালিয়ে গেল এবং নিজেদের হাংরি সহলেখকদের বিরুদ্ধে কথা বলা আরম্ভ করল । যাঁরা এই আন্দোলন আবেগের সঙ্গে আরম্ভ করেছিলেন তাঁদের বেশ ক্ষতি হয়ে গেল । শেষ পর্যন্ত স্তিমিত হয়ে গেল আন্দোলন । তবু অনেকের কলম এখনও লিখে চলেছে, সাহিত্যজগত মলয় রায়চৌধুরী এবং তাঁর মতো বিপ্লবীদের সম্পর্কে গর্বান্বিত, যাঁরা তাঁদের কলম এখনও থামাননি এবং ঈথারে উথালপাথাল ঘটিয়ে চলেছেন ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন