জীবন থেকে কবিতায় , কবিতা থেকে জীবনে

আফজল আলি 
পর্ব-১

জীবন থেকেই কবিতা উঠে আসে কিংবা কবিতা থেকেও জীবনে ফিরে আসা যায়। প্রথমটা না হয় বোঝা গেল , কিন্তু দ্বিতীয়টা ঠিক ধোঁয়াশা লাগছে। কবিতা থেকে কীভাবে জীবনে ফেরা যাবে। একটু অন্য ভাবে চিন্তা করা যাক ব্যাপারটা। মনে করেন আপনার মন খুব খারাপ , ভালো লাগছে না কিছু , জীবনের ক্লান্তি হতাশা ক্রমশ গ্রাস করছে আপনাকে , আপনি ভাবছেন সামনে অনেকটা অন্ধকার, ঠিক তখন আপনি একটা কবিতার বই তুলে নিন । পড়তে থাকুন । অক্ষরগুলো ধরে ধরে পড়তে থাকুন , তারপর বাক্যগুলো । না , বাক্যের গঠনের ভিতরে যাওয়ার দরকার নেই , শুধু ভাব এবং ভাবনাগুলো নিয়ে মেতে উঠুন , দেখবেন অনেক কিছু আছে একটা কবিতার ভিতরে , শব্দগুলো আপনাকে দৃষ্টি দিয়ে দেখবে , আপনার কষ্টগুলো শেয়ার করবে , আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে , আর কবিতার মধ্যবর্তী ভাব বৈভব , চেতনার জাগৃতি আপনাকে করে তুলতে পারে চিন্তার জন্য নির্দিষ্ট উপঢৌকন , রসদ । একটা কবিতার মধ্যে কী কী থাকতে পারে। চেতনার বিকাশ , স্বপ্নের উপসর্গ, আনন্দের ভ্রম , বিস্ময়ের ঘোর , শব্দের দ্যুতি , অনুভবের উদযাপন , নিমিত্তের পর্যবক্ষেণ , এবং জীবন ঘনীভবনের প্রতীয়মান ছাপ । এর বাইরেও আরো কিছু থাকে যেমন সুন্দরের নৈঃশব্দ্য , মাতালের গুপ্তধন , ছায়া শিকারীর সমর্পণ। কবিতায় উদ্বেগ থাকে না , রক্তক্ষয় থাকে না , অহংকারের ঘনঘোর কি থাকে , থাকে না মনে হয় , তবে বিদ্রোহ থাকে। তাই একটা কবিতা থেকে জীবনে ফেরা বেশ রোমাঞ্চকর। কবিতার ঘ্রাণ নিয়ে জীবনের অঘ্রাণ মাসে প্রবেশ তো করা যেতেই পারে , হয়তো পাল্টে যেতে পারে জীবনটাই। 
এখন কথা হল কী পড়বেন , কার কবিতা পড়বেন। উত্তরে প্রবল হাওয়া দিলে দক্ষিণের বায়ু আটকে যায়, আবার দক্ষিণ এলে বসন্ত বায় । রবীন্দ্রনাথ পড়া তো যাবেই , নজরুল ও কিংবা সুকান্ত, জীবনানন্দ , বুদ্ধদেব বসু , সুনীল , শক্তি , শঙ্খ, কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায় , বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , শামসুর রহমান , নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পড়া যেতে পারে জয় গোস্বামী, কিংবা প্রভাত চৌধুরী , নাসের হোসেন বা আফজল আলি। অথবা যেকোনো , হাতের কাছে যা পাওয়া যায়। একটা কবিতার অভ্যন্তরীণ বিষয় ভাবনা এবং দর্শন আপনাকে জীবনের stepping গুলো সম্পর্কে সচেতন করতে পারে। যাঁরা লেখেন , তাঁরা তো পড়েন ই , আমি লেখার বাইরে মানুষের কথা বলছি । একটা কবিতা তাঁদের কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ধরুন রবীন্দ্রনাথের ' সোনার তরী ' পড়ছেন । দেখবেন জীবন থেকে মৃত্যুর দিকে চলে যাওয়ার কী অদ্ভুত বিবরণ। তখন তো মনে হতেই পারে শূন্যের উপার্জনে আমরা কীভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারি । তবে বেশির ভাগ কবিতার মধ্যেই আপনি কিছু না কিছু রসদ পেয়ে যাবেন। শক্তি চট্যোপাধ্যায়ের লিরিকস, শঙ্খ ঘোষের প্রজ্ঞা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহজতার অনুভব ইত্যাদি ইত্যাদি। নতুন পুরনো মিলিয়ে পাঁচটা পাঁচ রকম স্বাদ বদল থেকে স্বাদে বদল । পাঠকেরও আবার ভাগ আছে । কবি নিজে হলেন সবচেয়ে উৎকৃষ্ঠ পাঠক তাঁর নিজের কবিতার , তারপর হল দীক্ষিত পাঠক , এবং রইল অপর পাঠক। এই অপর পাঠক নিয়েই আমার যাবতীয় বক্তব্য। অপর পাঠকের মধ্যেও এমনও আছেন যাঁরা সুচারু বিশ্লেষণ করতে জানে , বোঝে । বহু ভঙ্গিমার একত্র সমাবেশ আমাদের সামর্থ করে তুলবেই। অর্থাৎ ব্যাপারটা কিছুটা বোঝানো গেল , কবিতা থেকে জীবনে ফেরা যায় । অর্থাৎ কবিতা শুধু যে কবির জন্য নয় , তা জীবনের জন্য ও । 

যাঁরা কবিতা লিখতে আসেন প্রথম প্রথম তাঁদের আবার নানা রকমের অভিজ্ঞতা হয় । প্রথমেই আঘাতটা আসে ঘরের লোকের থেকে। তাঁদের কাছে কবিতা মানে বখাটে এবং নষ্ট ও উচ্ছন্নে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। তাই regist করতে থাকে যাতে না লেখায় জড়িয়ে পড়ে নিজের মানুষটি। এই regist সংসারের যেকোনো সদস্যর থেকেই আসতে পারে। তখন নতুন লিখতে আসা মানুষটি হতাশ হয়ে পড়ে , প্রেরণা হারিয়ে ফেলে । নিজের স্ত্রী যদি কবিতাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নেয় বা " ও সব করে কিচ্ছু হবে না " - এই বন্ধনের স্বীকার হয়ে পড়েন , তখন সমস্যাটা বেশ গভীরে অসহায় হয়ে পড়ে । এই অবস্থা থেকে কেউ কেউ উত্তীর্ণ হতে পারে, কেউ পারে না। এই তো সেদিন আমার এক অফিস কলিগ তার এই সমস্যার জন্য নাকি গাড়িতে বসেই কবিতা লেখে , যদিও গাড়িটি তার ব্যক্তিগত বহনের জন্য। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে কবিতার প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ ঘরে না লিখে বাইরে লিখতে থাকে। কবিতা হল একপ্রকার অসুখ , আবার বিত্ত। এই অসুখের দাওয়াই হল কবিতাই , না লিখে থাকা যায় না। আবার কবিতা কেন বিত্ত , সেটা বলতে গেলে তো বলতে হয় , কবিতা লিখলে রাজার মতো মন পাওয়া যায় , ঈশ্বরের অতুল ঐশ্বর্যের ঠিকানা পাওয়া যায় , পাওয়া যায় তার স্বাদ অনুভূতি ঘ্রাণ । এই তো বিত্ত। কবিরা অসম্ভবকে সম্ভব করে দিতে পারে । তাদের কলমে থাকে এমন এক তরবারি যা রক্ত ঝরায় না , কিন্তু টলিয়ে দিতে পারে । 
তাই জীবনের অনুভব নিয়ে যেমন কবিতা হয় , তেমনি কবিতা থেকে জীবনেও ফেরা যায় বিত্তবান হয়ে । পড়েই দেখুন না একটা কবিতা যেভাবে বললাম।

3 মন্তব্যসমূহ

  1. ঋদ্ধ করলেন আপনি । এমন সুন্দর বিশ্লেষন ও পরিবেশনা মনোরম ও ইতিবাচক । ভালো লাগলো ।

    উত্তরমুছুন
  2. পড়লাম দাদা... এভাবেই তো জীবনে ফিরতে চাই আমরা যারা কবিতাকে ভালোবাসি...সুন্দর!

    উত্তরমুছুন
  3. আমার কাছে কবিতা লিখতে যাওয়া কোরআন পাঠের মতো মনে হয়।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন