স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে দু- চার কথা
গৌরাঙ্গ মিত্র

স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কোনো কিছুই অপরিবর্তনীয় শালগ্রাম শিলা নয়। এই কনসেপ্টগুলি তত্ত্বের বইয়ে একরকম থাকে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তত্ত্ব অনুযায়ী সার্থক ভাবে প্রযুক্ত হলে তবেই কনসেপটগুলির মর্যাদা রক্ষিত হতে পারে। স্বাধীনতা আকাশে ভাসমান না, প্রশান্ত মহাসাগরের ট্রেঞ্চগুলিতেও স্বাধীনতা বসবাস করে না। স্বাধীনতা যথাথত রূপায়নের জন্য মানুষে গড়া একটি সমাজ ও একটি রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর প্রয়োজন। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। সমাজতন্ত্রের কথা পরে বলছি। পৃথিবীতে নানা দেশে নানা রকম রাষ্ট্রীয় কাঠামো দেখতে পাই। বেশিরভাগ দেশ বর্তমানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে চলছে। কোনো কোনো দেশ যেমন চীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে। চীনের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে, সেই ১৯১৭ সালে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কিন্তু কালের নিয়মে সোভিয়েতের সমাজতন্ত্র ঝুরঝুর করে ঝরে পড়েছে। গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকা ইত্যাদি উদারনীতি প্রবর্তন করতে গিয়ে সমাজতন্ত্রের ভীত্তিটাকে নড়িয়ে দিয়েছে।

স্বাধীনতা এই শব্দটি একটি কনসেপ্ট, যা ব্যক্তি মানুষ বা গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের বিকাশের জন্য উপস্থিত থাকা বাঞ্ছনীয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্টের আগে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ রাজের একটি কলোনি ছিল। ব্রিটিশ কলোনিতে পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিকরা যে স্বাধীনতা ভোগ করতেন স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রাপ্ত স্বাধীনতার তাৎপর্যটাই বদলে গেল। এমন নয় স্বাধীন ভারতবর্ষে পৌঁছে রাতারাতি অবস্থা বদলে গেছে। অভুক্ত, অর্ধভুক্তরা  তেলে-ঝোলে দিন কাটাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু মানুষের মর্যাদার নিরিখে- কলোনাইজড দেশ ও স্বাধীন হওয়া দেশে মানুষের স্বাধীনতার ডাইমেনশনাল পার্থক্যটা আশমান-জমিন ফারাক। 'রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হল আর গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল' - এমনটা নয়।
মনুষ্য সমাজে এক সুদীর্ঘ পথ চলার ইতিহাস রয়েছে। একসময় মানুষ প্রায় পশুজীবন যাপন করত। পরিবারে তেমন একটা সংহতি গড়ে ওঠেনি। মোটামুটি এক প্রমিস কিয়াস সেক্স লাইফ যাপন করত।  এরপরে আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠল। শিকার বা ফলমূল যা সংগ্রহ হত তা একেকটি ক্লান বা গোষ্ঠী ভাগাভাগি করে খেত। পরবর্তী ধাপে এল দাস ব্যবস্থা। 'আঙ্কেল টমস কেবিন'-এ দাস ব্যবস্থার কান্না শুনতে পাওয়া যায়। দাস ব্যবস্থার পরবর্তী পর্যায় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা। সামন্ততন্ত্রে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি জমি জায়গার মালিক, অন্যদিকে বিশাল জনগোষ্ঠী সামন্ত প্রভুদের জমিতে কৃষিকাজ করে দিন গুজরান করত। এরপরে এলো ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদ। এই পর্বে শিল্পায়ন ঘটে গেছে। শিল্প বিপ্লবের ফলে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতির ফলে কলকারখানায় নানা সামগ্রী রাশি রাশি উৎপাদন হতে শুরু করেছে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটা 'দেশ মূলত দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে' - পুঁজিপতি ও শ্রমিক সম্প্রদায়, ক্যাপিটালিস্ট ও প্রোলেটারিয়েট। হ্যাভস ও হ্যাভসনট। সমাজতন্ত্রে ধনের বৈষম্য অবলুপ্ত হয়। কলকারখানা, উৎপাদন ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বর্তমান পৃথিবীতে চীনদেশেই সবচেয়ে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশ ও পৃথিবীর অন্যান্য কিছু দেশে সমাজতন্ত্র অল্প বিস্তর প্রতিষ্ঠিত হলেও চীনের সঙ্গে তাদের তুলনা করা যায় না। রাষ্ট্র বিবর্তনের ফলে নানা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। স্বাধীনতা এই কনসেপ্টটি সবচেয়ে পুরোনো। দাস ব্যবস্থার সময়ও স্বাধীনতার ধারণাটি ছিল, তবে তার ক-জন ভোগ করতে পারত সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। দাস ব্যবস্থা - সেখানে আবার স্বাধীনতা গোরুর গাড়ীর হেডলাইট। সমাজের উপরতলে কিছু মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করত। যে স্বাধীনতা তাদের 'স্বেচ্ছাচারী হওয়ায়ও' অনুমোদন দিত। 'স্বাধীনতা' ব্যাপারটি কী? খায় না মাথায় দেয় ? ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধারণা ধার করে বলছি স্বাধীনতা হল তেমন একটি পরিবেশ - পরিস্থিতি যেখানে একজন ব্যক্তি তার ভেতরের গুণাবলীকে  উত্তমরূপে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। দরিদ্র, দরিদরতর, দরিদ্রতম, বিত্তশালী, অভিজাত সকলের কাছে স্বাধীনতার
তাৎপর্য যে এক নয় তাই নিশ্চয়ই আপনারা মেনে নেবেন।

পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে চলছে। গণতন্ত্র বোঝাবার জন্য অনেক নেতা- নেত্রী এই সংজ্ঞাটি উল্লেখ করে থাকেন।
                     The government of the people, by the people and for the people."

এই যে আমাদের দেশে ই.ভি.এম. নিয়ে এতো কথা হয়, কাগজের ব্যালট নিয়ে এতো কথা হয়, সবই তো গণতন্ত্রের জন্য। ভারতবর্ষ অন্যতম এক বৃহৎ গণতন্ত্র হলেও আপামর মানুষ গণতন্ত্রের তাৎপর্য বোঝে না। নূন্যতম যে যোগ্যতা থাকলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা সম্ভব সে যোগ্যতা অসংখ্য দেশবাসীর নেই। পাখি পড়ার মতন তাদের বোঝানো হয় যে, ভোট হল গণতন্ত্রের একটি উৎসব। সেই উৎসবে রামা-শ্যামারা যোগ দিতে  পেরে আবেগে একেবারে বেসামাল হয়ে পড়ে। মিলটন বলেছিলেন যে -  'সার্বিক ভোটাধিকার প্রদানের আগে সার্বিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।' গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনান্য রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর তুলনায় অনেক উন্নত ও প্রগতিশীল। এই ব্যবস্থায় মানুষ অনেক বেশি শিক্ষার অধিকার অর্জন করে। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জন করে। আর্থিক স্বচ্ছলতা ভোগ করে। কল্যাণকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে মানুষের শ্রীবৃদ্ধির চেষ্টা করে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তত্ত্বের বইয়ে যেমন থাকে সেগুলি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পার্থক্য চোখে পড়তেই পারে। রাষ্ট্রের পরিচালক মণ্ডলীর বিবেক ও সততার উপরে তত্ত্ব ও বাস্তবে তার  প্রয়োগের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়। ধাপ্পাবাজ পলিটিশিয়ানরা তত্ত্বগতভাবে এক সিস্টেমের কথা বলে- আর সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ফাঁক ফোকর রেখে দেয়। একজন সরলমতি নেতাও ধীরে ধীরে সাগিনা মাহাতো হয়ে ওঠে। সাগিনা মাহাতো ছবিটা দেখবেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।

হতাশ হওয়ার অনেক কিছুই রয়েছে। তবু আমরা বিশ্বাস হারাচ্ছি না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। অতএব বিশ্বাস হারালো না। আশা করব একদিন বিবেক সম্পন্ন মানুষেরা, দেশে দেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসবেন। অনেক নেতাজি সুভাষ, বিনয়-বাদল-দিনেশদের জন্ম হবে। সেই দিনই 'স্বাধীনতা', 'গণতন্ত্র' ও 'সমাজতন্ত্র' কনসেপ্টগুলি তত্ত্বগত ভাবে নয়, বাস্তবেই রূপ পরিগ্রহণ করবে। ধর্ম-কর্ম পাশে সরিয়ে রেখে নেতারা সত্যিকারের জনকল্যাণকামী হয়ে উঠুন—আপাতত এইটুকুই প্রার্থনা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন