অবনী ধর-এর ‘ওয়ান শট’ : একটি অসাধারণ ছোটোগল্পের বই

মলয় রায়চৌধুরী

          অধিকাংশ পাঠক অবনী ধরের নাম শোনেননি, অথচ তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি অসাধারণ ছোটোগল্পের বই দিয়ে গেছেন ।

            ১৯৬৮ সালের সন্ধ্যা । হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জড়ো হয়েছেন জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য । টেবিলে উঠে পড়লেন অবনী ধর আর নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন এই গানটা, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সবাই, এমনকি হাংরি আন্দোলনের কয়েকজন ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না । যে সাংবাদিকরা খবর কভার করতে এসেছিলেন তাঁরাও গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা । পরের দিন দি স্টেটসম্যান যে সংবাদ দিয়েছিল তাতে ভাসা-ভাসা উল্লেখ ছিল । সেই সপ্তাহের ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে ।

         ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য । 

          অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন । যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান সট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ ছোটো গল্পকার ।


          গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:

জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।

জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ

শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।

উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ ।


          ১৯২০ সালে,, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের  এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা  সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই স্কাউটদের কেউ-কেউ জাহাজে চাকরি নিয়ে খালাসি এবং অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে এটাকে ছড়িয়ে দিতে সফল হন । অবনী ধর বেশ কিছুকাল জাহাজে খালাসির কাজ করেছিলেন এবং তাঁরও ভালো লেগে যায় সমবেতভাবে গাওয়া গানটি । শতভিষা, কৃত্তিবাস, কবিতা, ধ্রুপদি পত্রিকার কর্নধারদের প্রিয় সঙ্গীত-জগত  থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া এই গান সেসময়ে নিতে পারেননি সাংবাদিক আর বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, তার ওপর যেহেতু হাংরি আন্দোলনের ব্যাপার, তাই তাঁরা এটাকে অশিক্ষিত নেশাখোর-মাতালদের কারবার ভেবে হেঁ-হেঁ করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ।

          প্রথম ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ও প্রথম ছোটোগল্পকার পূর্নচন্দ্র থেকে হাল আমলের মফসসলের কথাসাহিত্যিক, প্রান্তিক ও শহুরে গল্পকার কিংবা মেট্রপলিটান ঔপন্যাসিক, তাঁদের লেখক প্রতিস্ব অবিনির্মাণ করলে প্রথম যে উপাদানটি পাওয়া যাবে, তা তাঁদের মাতৃভাষায় এবং অন্যান্য যে ভাষায় তাঁদের দখল আছে, সে ভাষায় পূর্ব প্রজন্মগুলোর সাহত্যিকদের লেখা গল্প-উপন্যাসের পঠন-পাঠনের জমা করা স্মৃতি । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণে ভাষার অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণে ভাষাসাহিত্যের জ্ঞান তথা সাহিত্যের বিশেষ ঝোঁকের প্রতি লেখকের টান, তাঁর লেখনকর্মের আদল আদরা দিশা তাৎপর্য অন্তর্নিহিত-সম্পদ দাপট চৈতন্য অস্তিত্ব আত্ম-উন্মোচন এমনকী তাঁর সাহিত্য চক্রান্তক কলমটির গঠনকারী মূল উপাদান । তাঁদের লেখন-অভিজ্ঞতার মালিকানার বখরা কিন্তু তাঁদের পড়া পূর্বসূরী গল্পকার-ঔপন্যাসিক-দার্শনিকদের প্রাপ্য। 

          আমি যে প্রতিস্ব-নির্মাণের কথা বলছি তা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ বাঁকবদলের সময়কার । উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথা, কথামঞ্জরী, দশকুমার চরিত, বাদবদত্তা ইত্যাদি গদ্যে রচিত কথাবস্তুর অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ইংরেজরা আসার পর, এবং ফলে, বাংলা গদ্যসাহিত্য ও গদ্যে নানা ধরণের সংরূপের উদ্ভব জলবিভাজকের কাজ করেছিল ; আমি সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি । এক নতুন নন্দনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল সাহিত্যের এলাকায়, যে এলাকায় লেখক নামের নির্মিত-প্রতিস্বের মানুষটির লেখনকর্মকে কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে নৈতিকতা আর বৈধতা আরোপের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল । ফলে লেখনকর্ম বা পাঠবস্তুতে সতত কেন্দ্র দখল করে থাকলেন লেখ-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিমালিকটি ।

          ইংরেজরা আসার পরই, আর বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতেই যে লেখকরা নির্মিত-প্রতিস্ব নিয়ে লেখন-পরিসরে নেমেছিলেন, তা কিন্তু নয়। লেকন পরিসরে ব্যক্তিনামের লালন, ব্যক্তি-আধিপত্যের ছাপ, ব্যক্তিপ্রসূত রচনাগত মৌলিকতা, ব্যক্তিসৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রতর্কগুলো হিন্দু বাঙালির জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছিল  সেই সময়কার কলকাতায় ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তির মননবিশ্বটি পাকাপাকি ভাবে থিতু হয়ে বসার পর । ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি, তারপর ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ওই মননবিশ্ব প্রবেশ করতে পেরেছিল। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে, লেখক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের মননবিশ্বটি ওই আদরায় নির্মিত হবার পর এবং ফলে, আর একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্র দ্বারা রচিত হলো, ১৮৭৩ সালে, প্রথম বাংলা ছোটোগল্প ‘মধুমতী’ । তার আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ আর ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পাঠবস্তুগুলোতে ওই মননবিশ্বের ছাপ ছিল না ।

          পূর্ণচন্দ্র তাঁর গল্পটিতে নামস্বাক্ষর করেননি । ‘নববাবুবিলাস’ আর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ছদ্মনামে লেখা । নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা ছোটোগল্প -- সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ বইতে জানিয়েছেন যে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সময়কালে ( ১২৮০ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একশ ছাব্বিশটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলোয় লেখকরা নামস্বাক্ষর করেননি, এমনকী ছদ্মনামও নয় । রচনার সঙ্গে লেখকের নাম দেওয়ার প্রথাটি প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবশালী প্রতিনিধি । সেসময়ে ব্রা্‌হ্মধর্ম হয়ে উঠেছিল ওই মননবিশ্বের ধারক ও বাহক । নামস্বাক্ষর না-করার প্রক্রিয়াটি থেকে স্পষ্ট যে কথাবস্তুর রচয়িতারা জানতেন না যে লেখকসত্তা বলে কোনো ব্যাপার হয়, এবং লেখকের নামটি সত্তাটিকে বহন করে । কোনও কথাবস্তু যে মেধাস্বত্ত, সে ধারণাটির প্রতিষ্ঠা হতে সময় লেগেছিল । তার কারণ অস্তিত্বের কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষকে স্হাপনের কর্মকাণ্ডটির প্রভাব, যাকে উনিশ শতকের রেনেসঁস বলা হয়, সেই চিন্তাচেতনাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য অজস্র নির্মিত-প্রতিস্বের প্রয়োজন ছিল । ইউরোপীয় চিন্তনতন্ত্রটির বাইরে যে নন্দনক্ষেত্রটি রয়ে গেল, জলবিভাজিকার অন্য দিকে, তাকে বটতলা নামে এইজন্য দোষারোপ করা হল যে সেই এলাকায় ব্যক্তিএককগুলো অনির্মিত। জেমস লঙ বললেন বটতলার বইগুলো অশ্লীল ও অশোভন, যার দরুন বাংলার সংস্কৃতি থেকে লোপাট হয়ে গেল বইগুলো ।

          ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্বায়নের মালিকানা, কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা । ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা । ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরণের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি । বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’ । অথচ লেখক হতে চান না এরকম লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন । তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন, আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন । তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না ।

          বহুকাল যাবৎ বিভিন্ন আলোচককে মন্তব্য করতে দেখা গেছে যে, উপন্যাস আর্ট ফর্মটির বঙ্গীয়করণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, ছোটোগল্প আর্টফর্মটিকে সম্পূর্ণ দেশজ করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সনেট-তের্জারিমা-ভিলানেলকে এতদ্দেশীয় করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী ইত্যাদি ।  এই যে একটি ভিন্ন ভাষসাহিত্যের সংরূপকে আরেকটি ভাষাসাহিত্যে এনে সংস্হাপন, এর জন্য দ্বিভাষী দক্ষতা এবং সংরূপটি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানই যথেষ্ট নয় । যিনি এই কাজটিতে লিপ্ত, তাঁর গ্রাহীক্ষমতা, বহনক্ষমতা ও প্রতিস্হাপন ক্ষমতা থাকা দরকার। অমন ক্ষমতা গড়ে ওঠে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে । আর এই জ্ঞান আহরণ তখনই সম্ভব যখন আ্হরণকারীর লেখক-প্রতিস্বের নির্মাণ ঘটে জ্ঞানটির পরিমণ্ডলে । 

          অনির্মিত লেখক-একককে ব্র্যাণ্ডার ম্যাথিউজ প্রণীত ছোটোগল্পের সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা যাক । ‘দি ফিলজফি অফ দি শর্ট স্টোরি’ বইতে ম্যাথিউজ বলেছেন, “যাহা কেবলমাত্র গল্প এবং পরিসরে ক্ষুদ্র, তাহাই ছোটোগল্প নহে । ভাবের ঐক্য ছোটোগল্পের পক্ষে অপরিহার্য এবং এইখানেই উপন্যাসের সহিত ইআর পপধান প্রভেদ । ছোটোগল্পে ভাবের ঐকভ আছে, উপন্যাসে নাই ।  ক্ল্যাসিকাল ফরাসি নাটকের তিনটি ঐক্যই ফরাসি নাটকে আছে ; ইহা একটি ক্ষেত্রে, একটি দিনে, বিশেষ একটি ঘটনা দেখায় । ছোটোগল্পে একটিমাত্র চরিত্র, ঘটনা বা ভাব থাকে, অথবা একটিমাত্র পরিস্হিতির পটভূমিকায় কতকগুলো ভাবের সমাবেশ ঘটে।” এখন, অনির্মিত লেখক-প্রতিস্বের কাছে ‘ভাবের ঐক্য’, ‘ভাবের সমাবেশ’ ‘ক্লসিকাল ফরাসি নাটক’ ইত্যাদি ভাবকল্পগুলো দুর্ভেদ্য থেকে যাবে, এবং ব্যাখ্যার পরও বিমূর্ততা কাটবে না ।

          ‘অ্যান ইনট্রোডাকশান টু দি স্টাডি অফ লিটারেচার’ বইতে দেয়া ডাবলু. এইচ. হাডসন-এর তৈরি অনুশাসনের প্রেক্ষিতেও ব্যাপারটা বিচার করা যেতে পারে । হাডসন বলেছেন, “ছোটোগল্পে শিল্পকলার মূল্য নির্ধারণের জন্য ‘একক উদ্দেশ্য ও ভাবের ঐক্য’ বজায় আছে কিনা তা দেখা উচিত।” এখানেও প্রশ্ন উঠবে ‘শিল্পকলা’, তার ‘মূল্য নির্ধারণ’ এবং ‘একক উদ্দেশ্য’ ভাবকল্পগুলো নিয়ে । বস্তুত যে চিন্তনতন্ত্রের কথা একটু আগে বলেছি, তার সরবরাহ করা সংজ্ঞায় খাপ খায়নি বলে পূর্ণচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের লেখা ‘মধুমতী’ রচনাটিকে সার্থক ছোটোগল্পের তকমা দেয়া হয়নি । সার্থক ছোটোগল্পের তকমা দেয়া হল ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘দেনাপাওনা’ রচনাটিকে । ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে গভীরভাবে বুঝতে না পারলে ‘সার্থক’ ছোটোগল্প লেখা সম্ভব ছিল না । সার্থকতা নামের মানদন্ডটি ওই চিন্তনতন্ত্রের ফসল । বর্তমান কালখণ্ডে ওই চিন্তনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ ।

         ওপরের কথাগুলো এইজন্য বলতে হল যে অবনী ধর, যাঁর চোদ্দটি গদ্য নিয়ে ‘ওয়ান সট’ বইটি  প্রকাশিত হয়েছিল, তিনি ছোটোগল্প-লেখক বা গল্পকার হওয়া-হওয়ি অবস্হান থেকে সেগুলো লেখেননি, এবং তাঁর লেখক-প্রতিস্বটি ছিল অনির্মিত । ১৯৬৯ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত, এই কালখণ্ডে তিনি এও চোদ্দটি গদ্যই লিখেছিলেন। ১৯৭৫ সালের পর তিনি লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনের সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল, অশোকনগরে, কিন্তু তখনও তিনি লেখালিখি আরম্ভ করেননি, যদিও তিনি নিজের জীবনের এই ঘটনাগুলো শোনাতে ভালোবাসতেন । তাঁর কথনভঙ্গিমা ও জীবননাট্যের ঘটনা থেকে স্পষ্ট ছিল যে কথাবস্তুর পরিসরটি সেই সময়ের সাহিত্যিক ডিসকোর্স এবং কাউন্টার-ডিসকোর্স থেকে একেবারে আলাদা, এমনকী হাংরি আন্দোলনের গল্পকার-ঔপন্যাসিক থেকেও আলাদা । ১৯৯৪ সালে কলকাতায় ফিরে জানতে পারি যে অবনী ধরের রচনাগুলো নিয়ে বই বের করার উৎসাহ কোনও হাংরি আন্দোলনকারী দেখাননি । আমি শর্মী পাণ্ডেকে অনুরোধ করি যে অবনী ধরের গদ্যগুলো নিয়ে একটা সংগ্রহ ওদের শিলালিপী প্রকাশনী থেকে বের করতে । শর্মী আর ওর স্বামী শুভঙ্কর দাশ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায় আর আমাকে একটা ভূমিকা লিখে দিতে বলে । এই সময়ে অবনী ধরের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ ঘটে আর ওনার জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ফেলি । অবনী ধর বইটার নাম রেখেছিলেন ‘ওয়ান শট’, কিন্তু প্রচ্ছদ আঁকার সময়ে তা ‘ওয়ান সট’ হয়ে যায় ।

          অবনী ধর জন্মেছিলেন ১৯৩৪ সালে, তখনকার পূর্ববঙ্গের মাদারিপুর জেলার কালাকিনি থানার পাঙাশিয়া গ্রামে. তাঁর মামার বাড়িতে । মারা যান ২০০৭ সালে, অশোকনগরে । তাঁর বাবা বঙ্কিমচন্দ্র ধর ( ১৯০৫ ) ওই জেলার মাইচপাড়া গ্রামের নিবাসী ছিলেন, সাত ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ; বঙ্কিমচন্দ্র ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন, কিন্তু কখনও কোনও চাকরি বা ব্যবসা করেননি ; স্বাদেশী আন্দোলনে যোগ দেবার কারণে কয়েকমাসের জেল হয়েছিল তাঁর । বঙ্কিমচন্দ্র তখনকার দিনের ম্যাট্রিক পাশ ছিলেন, অর্থাৎ যে চিন্তনতন্ত্রের কথা একটু আগে বলেছি, তার মননবিশ্বে অবনী ধরের প্রতিস্বনির্মাণের সুযোগটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, বিশেষ করে অবনী ধর যখন তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ।

          অবনী ধরের বয়স যখন এক বছর, তখন তাঁর বাবা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে, তাঁর মা লাবণ্য ধর ( ১৯১৫ - ১৯৭৭ ) , আর ঠাকুমাকে নিজেদের ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দিয়ে, অন্য এক তরুণীর সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, এবং বাকি জীবন বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গিনী বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরূপে ভিক্ষা করে চালিয়েছিলেন । যদিও বঙ্কিমচন্দ্র মারা যান ১৯৬২ সালে, তাঁর মৃত্যুর খবর অবনীরা পান ১৯৭২ সালে । ততোদিন তাঁর মা শাঁখা-সিঁদুর পরতেন । অবনী ধরের লেখক-প্রতিস্ব প্রাগুক্ত চিন্তনতন্ত্রের  পরিসরে যদি গড়ে উঠত, তাহলে তিনি এই ট্র্যাজেডির মুহূর্তটি নিয়ে  একটি কথাবস্তু তৈরি করতে পারতেন, কেননা ইউরোপীয় সাহিত্যে গ্রিসের সময় থেকে ব্যক্তি-এককের ট্র্যাজেডিটি লেখকত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপাদান ছিল, যা খ্রিস্টের নৃশংস হত্যা ও আত্মবলিদানের প্রতীকি অতিকথার প্রচার-প্রসারের কারণে সাহিত্যের নন্দনক্ষেত্রটিকে দখল করে নিতে পেরেছিল । তাছাড়া বাইবেলোক্ত “আরিজিনাল সিন” বা প্রথম পাপের পতনযন্ত্রণাকে সর্বজনীন নৈতিক-দার্শনিক বনেদে পালটে ফেলার জন্যেও জরুরি ছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের পাতায় পাতায় ব্যক্তি-ট্র্যাজেডির উপস্হিতি ।

          অবনী ধরের জীবনে বহুবার বহুরকম ট্র্যাজেডি সংঘটন দেখা গেছে, কিন্তু সেসব অভিজ্ঞতার সরাসরি মালিকানা সত্তেও তিনি সংঘটন-মুহূর্ত বা ক্লাইম্যক্স বা হুইপক্র্যাক এনডিং প্রয়োগ করে কথাবস্তুকে ঔপনিবেশিক সাহিত্য-অনুশাসন ও হেলেনিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত করেননি । প্রকৃত প্রস্তাবে কথাবস্তুগুলো গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক সাহিত্য-মূল্যবোধের আওতার বাইরে । প্রসঙ্গত, যে সময়ে অবনী ধর তাঁর প্রথম পর্বের গদ্যগুলো লিখেছিলেন, সেসময়ে মান্যতাপ্রাপ্ত বাংলা ছোটো গল্পকাররা ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুশাসন মোতাবেক, বিষণ্ণতা, পারক্য, প্রেমের বিকার, মৃত্যুপ্রবণতা, নিঃসঙ্গতার বেদনা,শহুরে যৌনতা ইত্যাদির চর্চা করছিলেন । 

          বাবা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁদের একা ফেলে নিরুদ্দেশ হবার কারণে বছর পাঁচেক অন্নকষ্টে ভোগার পর তখনকার বিহারে ( এখন ঝাড়খণ্ড ) মধুপুরনিবাসী অবনীর ‘বুড়োমা’ অর্থাৎ তাঁর ঠাকুর্দার ভাইয়ের স্ত্রী, অবনী ও তাঁর মাকে দেখাসোনার জন্য, ও নিজের বার্ধক্যে দেখভালের জন্য, সেখানে নিয়ে গেলেন । যদিও অবনীর জ্যাঠামশাবরা, প্রথম দুজন ডাক্তার, ততীয়জন উকিল, চতুর্থজন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ যথাক্রমে দেওঘর ও মধুপুরে আশ্রম বসিয়ে তার মোহন্ত ছিলেন, অবনীর পড়াশুনার এবং স্কুলে ভর্তি হবার সুরাহা হলো না । বুড়োমার আশ্রয়ে অবনী ও তাঁর মায়ের অন্ন সমস্যার সমাধান হলেও, শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগ ঘটল না । স্কুলে ভর্তির জন্য অবনীকে কলকাতার চেতলায় মামারবাড়ি যেতে হলো । প্রবাদবাক্যের মামার বাড়ির আবদারের বদলে অহরহ দুর্ব্যাবহার জোটায়, ১৯৫০ সালের পয়লা অক্টোবর, কাউকে না জানিয়ে, স্কুল থেকে পালিয়ে, অবনী চলে গেলেন মার্চেন্ট নেভিতে, খালাসির কাজ নিয়ে । তখন তাঁর ষোলো বছর বয়স ।

          এই সময়ের অভিজ্ঞতাগুলো অবনী সংগ্রহ করেন জাহাজে খালাসির কাজ করার সময়ে, বিভিন্ন দেশের বন্দর-শহরে, ইউরোপ তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাঙন কাটিয়ে উঠতে পারেনি । বস্তুত তাঁর খালাসিপর্বের কথাবস্তুগুলো, কথনভঙ্গীর অন্তর্গত আহ্লাদময়তার কারণে, সুখশ্রাব্য ও কৌতূহলোদ্দীপক ছিল, যে গল্পগুলো বাসুদেব দাশগুপ্তকে তিনি শোনাতেন । অনেকে মনে করেন বাসুদেব দাশগুপ্তের গল্পগুলোর উৎস হলো অবনী ধরের অভিজ্ঞতা । লেখালিখি না করেও অবনী ধর তাঁর জীবনযাপনের কারণে নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করতেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে খালাসিটোলায় ঢুঁ মারতেন । বাসুদেব দাশগুপ্ত ও শৈলেশ্বর ঘোষের প্ররোচনায় সোনাগাছির যৌনকর্মী বেবি, মীরা এবং দীপ্তির সঙ্গে নৈকট্য গড়ে ফেলেছিলেন । 

          হাংরি আন্দোলনের সময়ে, উৎসাহদানকারী সম্পাদক ও স্তাবকদলের অভাবে, এবং অবনী ধরের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খার অনুপস্হিতিতে, তাঁর বলা কাহিনিগুলো লিখিত পাঠবস্তুর আকার নিতে পারেনি । জরুরি অবস্হার শেষে সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ ঘটলেও, সম্পাদকরা অবনীর গদ্য সম্পর্কে আগ্রহী হননি, মূলত তাঁর কথনভঙ্গীর ও রচনাকাঠামো বিদ্যায়তনিক সংরূপ বহির্ভূত ছিল বলে । একজন খালাসির গদ্যসন্দর্ভে যে যাযাবরতার নিবাস, যার উপকরণগুলো যাত্রাপথের খুদে অনির্ণেয়তায় তাৎপর্যময়, যার বিন্যাসে ভাসমান পরিভ্রমণের অনুন্মোচিত বাচন, স্নায়ুভাষায় রচিত সেরকম স্বতঃজাত কৃৎপ্রকরণ, স্বীকৃতি পায়নি লিটল ম্যাগাজিন স্তরেও । যেহেতু অবনীর পাঠবস্তু আত্মমগ্নতাকে অতিক্রম করে যায়, এবং তাঁর বাকব্যঞ্জনা বদ্ধসমাপ্তির কাঠামোটাকেই উপহাস করে, প্রধাগত আলোচকদের দৃষ্টিও তিনি আকর্ষণ করতে পারেননি । 

          অবনীর ও তাঁর আত্মীয় পরিজনের পরিবারে নিরুদ্দিষ্ট, সাধু, সন্ন্যাসী, মোহন্ত, ভিখারি-বৈষ্ণব, বাউল ইত্যাদির পূর্বেতিহাস থাকার কারণে অবনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর মা চিন্তিত ছিলেন । বয়ঃসন্ধি অতিক্রান্ত সন্ধিক্ষণে তাঁর ছেলে হয়তো কোনও বন্দরশহর থেকে বিদেশিনী বিয়ে করে বা না-করে সঙ্গে এনে একদিন হাজির হবেন, এমন দুশ্চিন্তাও লাবণ্য ধরের ছিল । ছেলের চরিত্রে অভিজ্ঞতাজনিত পার্থক্যও তিনি লক্ষ্য করে থাকবেন । তিনি অবনীকে বললেন জাহাজের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসতে । খালাসির চাকরি ছেড়ে ১৯৫৫ সালে ফিরে এলেন অবনী ।  বুড়োমা মারা যেতে তাঁর মা মধুপুরে একা হয়ে পড়েছিলেন । অবনী দেশে ফিরে চেতলার একটা বস্তিঘরে, মামার বাড়ির কাছে, বাসা ভাড়া নিয়ে মাকে মধুপুর থেকে নিয়ে এলেন । ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩, এই আট বছর টাকা রোজগারের জন্য নানা রকম জীবিকার অভিজ্ঞতা হলো অবনীর --- ক্রেন-ড্রেজার-ডাম্পার অপারেটার, লরি-ট্যাকসি-প্রায়ভেট মোটরগাড়ি চালক, রেলওয়ে ক্যাটারিঙের বেয়ারা, কোককয়লা ফেরি, ঠোঙা ও প্যাকেট তৈরি, পোস্টার-ফেস্টুন লেখা ইত্যাদি, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য যে-ধরণের কাজ পাওয়া যায় সবই করলেন । ১৯৬২ সালে অবনীর মা পাত্রী নির্বাচন করে সাধনার সঙ্গে তাঁর বি্য়ে দেন । 

          অবনী তাঁর সংসার ইতিমধ্যে চেতলা থেকে নতুন গড়ে-ওঠা উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কলোনি অশোকনগরে তুলে নিয়ে যান । তখন সেখানে স্হানীয় স্বায়ত্বশাসনের পরিকাঠামো বিশেষ ছিল না । তিনি নবতর অভিজ্ঞতার সামনে পড়লেন অশোকনগরে । তিনি এও দেখলেন যে, যাঁদের মাঝে তিনি বসবাস করতে এলেন, তাঁরা পপতিদিনকার মূর্ত নাগরিক অসুবিধা ও জাগতিক দুঃখকষ্টে ও অভাব প্রতিকারের বদলে সোভিয়েত রাষ্ট্র, চিন, ভিয়েৎনাম, কিউবা, আমেরিকা, দিল্লী ইত্যাদি সুদূরবর্তী বিমূর্ত অদরকারি তর্কাতর্কিতে সময় ও ক্ষমতা অপচয় অপচয় করে আনন্দ পান । অর্থাৎ সুপ্রাইণ্ডিভিজুয়াল বা অধিব্যক্তিক ম্যাক্রোলেভেল ভাবুকদের পশ্চিমবাংলার মাটিপৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন তৎপরতার প্রেক্ষিতে, তাঁর মাইক্রোলেভেল খালাসিত্ব তাঁকে কল্যাণকামীতার স্বাভাবিক সনাতন মূল্যবোধে হায়ারার্কিবর্জিত করে রেখেছিল, এবং সেই ভূমিজ প্রবৃত্তিকে অবনী ধর কাজে লাগালেন ।

          তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলে, বিশেষ করে শিক্ষক সমর ঘোষ, অশোকনগরে ডাকঘর বসানো, পৌরসভা গঠন, অসামাজিক কাজকারবার বন্ধ ইত্যাদির উদ্যোগ নিলেন । উদ্যোগটিকে কন্ঠস্বর দেবার জন্য, এবং তাঁদের অভাব-অভিযোগ যাতে কর্তাব্যক্তিদের কানে পৌঁছোয়, ১৯৬৪ সালে পপকাশ করা আরম্ভ করলেন ‘অশোকনগর বার্তা’ নামে একটি পাক্ষিক সংবাদপত্র, যেটি ছিল ওই অঞ্চলের প্রথম পঞ্জিকৃত সংবাদপত্র । পত্রিকাটির আয়ু ছিল তিন বছর, সম্ভবত যথেষ্ট । পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, নিজের অভিজ্ঞতাকে কথাবস্তুতে রূপান্তরিত করে ছাপাবার কথা তাঁর মনে আসেনি কখনও ; পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত অন্যেরাও তাঁর মুখে ঘটনা শুনেও তাঁকে লিখতে বলেননি । সম্ভবত সমাজচিন্তনকে আত্মসাৎ করে ব্যক্তি-ক্রিয়াকরণের চিন্তা-পরিসর লালিত হবার মতো পৃথকত্ববোধ জাগার সুযোগ বা মনস্হিতি তাঁর হয়নি । ১৯৬৩ সাল থেকে চাকুরিহীন অবনীর কাছে আপনা থেকেই পরিত্যক্ত হয়েছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দর্শন । 

          অবনী ধরের কথাবস্তুগুলোকে দুটি পর্বে চি্‌হ্ণিত করা যায় । প্রথম পর্বটি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্বটি ২০০০ সালের পর । মাঝে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন । প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন অর্থস্রোতহীন এবং কোনও সাহিত্যিক স্বকীয়তা আনার প্রয়াস করেননি । তা আপনা থেকে হয়ে গিয়েছিল তাঁর অনির্মিত লেখক-প্রতিস্বের কারণে । অবনী ধরের ডিসকোর্স, কখনও খালাসির, কখনও বা অসংগঠিত শ্রমিক বা কর্মহীনের, ভূপ্রকৃতির উথ্থানভূমিলব্ধ, স্হানিক, অবিমিশ্র, মুক্ত, যৌগিক, বর্ণিল, অনুভূমিক, প্রতিসংস্হাপিত, কৌমনিষ্ঠ এবং অতিজ্ঞাপনমূলক । প্রথম লেখাটি, ‘আমার দুঃখী মা’ রচনার পর তিনি তা লাবণ্য ধরকেই পড়ে শুনিয়েছিলেন । স্তম্ভিত মা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর. বলেছিলেন, ‘সত্য কথাই ল্যাখছস।’

          দ্বিতীয় পর্বের শুরু ২০০০ সালে । এই পর্বে অবনীর গদ্য-কাঠামোয় কয়েকটি কারণে সাইত্যিকতা এসে গেছে । তাঁর স্ত্রী, আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে একজোট হয়ে মামলা করে ১৯৯০ সালে চাকরি পাবার পর অবনীর আর্থিক অনিশ্চয়তা কাটে । তাঁর মেয়ে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ও বি এড এবং ছেলে বি এ পাশ করেন । অর্থাৎ প্রথম পর্বের জ্ঞান পরিমণ্ডলটি, তাঁর মেয়ে ও ছেলের প্রভাবে ক্রমশ অপসারিত হয়ে বাড়ির মধ্যে একটি ভিন্ন, যা অবনীর কাছে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর ঠেকে থাকবে, জ্ঞানপরিমণ্ডলের প্রবেশ ঘটিয়েছে । তৃতীয়ত, তাঁর প্রথম পর্বের রচনাগুলো, অন্তত কিছু সাহিত্যপাঠকের, হাতে গোনা হলেও, দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে, যাঁদের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় তিনি উৎসাহিত হয়ে থাকবেন গদ্যগুলোকে একটি সাহিত্যিক আদল-আদরা দেবার । দ্বিতীয় পর্বের কথাবস্তুগুলোর গদ্যবিন্যাসে ধরা পড়ে যে প্রথাবাহিত গদ্যসাহিত্যের সঙ্গে, যেগুলো তাঁর ছেলে-মেয়ে নিজেরা পড়ার জন্য বাড়িতে এনে থাকবেন, তাঁর যোগাযোগ ঘটেছে । অবনী নিজে চেষ্টা করলেও, এই বয়সে পৌঁছে, তাঁর পক্ষে মুকুরবিম্ব গড়া সম্ভবপর হয়নি, এবং তাঁর অপরত্ববোধ ও সাহিত্যিক অপরত্ব মুছে যায়নি । প্রথম ও দ্বিতীয়, দুটি পর্বেই, তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা তাড়িত হয়েছে অপরত্ববোধের অবস্হাননজনিত  বিপর্যয় দ্বারা। আর কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের কথাবস্তুতে, অপরত্ববোধের মাত্রাগুলোকে, অবনীর মতো করে ইতোপূর্বে উপস্হাপন করতে দেখা যায়নি । তাঁর মস্তিষ্কে আতিথ্য নেয়া কথাকারটি নিজেরই স্মৃতির ঐতিহাসিক হিসেবে অবনীর সামনে উদয় হয়েছে কখনও-সখনও, যিনি অতীতকে বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করছেন না বা অতীতে বেঁচে থাকার কথা বলছেন না ; আসলে কথাকার ওই দূরবর্তী এবং নিকট অতীতের লোপাট হয়ে যাওয়া ও তাকে বাগে আনার বাচনক্রীড়ায় অংশগ্রহণকারীরূপে ‘অপর প্রতিসন্দর্ভের’ সতর্কতাগুলো জাহির করছেন । 

         অবনীর বইটি যদি আরেকবার প্রকাশ করা হয়, তাহলে গদ্যগুলোকে প্রকাশকাল অনুযায়ী সাজিয়ে নিলে ভালো হয় । সেই সঙ্গে বইয়ের নামটাও শুধরে নিতে হবে ; ওয়ান সট এর পরিবর্তে ‘ওয়ান শট’ করে দিতে হবে।

         ২০০৭ সালের ৯ অক্টোবর অবনী ধর মারা যান ।

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন